ঢাকা: ৩৬টি কমিউনিটি সেন্টার এখন গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের(ডিএসসিসি)। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চরম অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার কারণেই কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এসব সেন্টারগুলোর অবস্থা খুবই করুণ।রাজধানীতে ব্যক্তিখাতের উদ্যোগে গড়ে ওঠা কমিউনিটি সেন্টারগুলো জমজমাট ব্যবসা করলেও সিটি করপোরেশন নির্মিত সেন্টারগুলো দিনের পর দিন খালি পড়ে থাকছে।ভাড়া হলেও তার কোনো সঠিক হিসাব নেই নথিপত্রে।করপোরেশন বড় অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হলেও এদিকে করো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ভাবখানা এমন যে “সরকার কা মাল দড়িয়া মে ঢাল”।
জানা গেছে, বিয়ে-বৌভাতসহ নানা উৎসবে নাগরিকদের সেবা দেয়ার জন্য ডিএসসিসি এলাকায় বিভিন্ন সময়ে ৩৬টি কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ করা হয়।
জনগণের ট্যাক্সে বিশাল অংকের টাকায় এগুলো নির্মাণ করা হলেও নির্মিত হওয়ার ছয় মাস যেতে না যেতেই এগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
এর মধ্যে আবার কয়েকটি পুলিশ ও র্যায়ব তাদের কার্যালয় হিসাবে ব্যবহার করছে।বেশ কয়েকটি সেন্টার ঘুরে দেখা গেছে সেন্টারগুলো চরমভাবে অবহেলিত।অনেক সেন্টারের ভেতরে আয়েশ করে ছাগল-গরু শুয়ে থাকতে দেখা গেছে।
ব্যক্তিমালিকানাধীন সেন্টারগুলো ঝকঝকে তকতকে অবস্থায় থাকলেও সিটি করপোরেশনের সেন্টারগুলোর অবস্থা ঠিক বিপরীত।
করপোরেশনের সেন্টারে লিফট থাকলেও তা অকেজো হয়ে আছে, ফ্যান থাকলে বেশিরভাগই অচল, বিদ্যুৎ চলে গেলে নেই বিকল্প ব্যবস্থা, এসিগুলোও সেভাবে কাজ করে না, লাইটিং ব্যবস্থাও দুর্বল, গ্যাস সংযোগ থাকলেও সাপ্লাই ভালো না, এছাড়া আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সেন্টারগুলোতে অনুপস্থিত।
কম টাকায় এসব সেন্টার ভাড়া পাওয়া গেলেও সেন্টারগুলো ভিজিট করার পর প্রায় সবাই মুখ ফিরিয়ে নেন।অনেকের মন্তব্য ফ্রি দিলেও এগুলো নিবো না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ব্যবস্থাপনা ত্রুটির কারনেই সেন্টারগুলোর এই করুণ অবস্থা।
যেখানে ব্যক্তি মালিকানাধীন কমিউনিটি সেন্টারগুলো বছরে কোটি টাকা আয় করছে।একটি কমিউনিটি সেন্টারের সিডিউল পেতে যেখানে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয় সেখানে সিটি করপোরেশনের সেন্টারগুলো খালি পড়ে থাকেছ।এসব কী ভাবা যায়!
সিটি করপোরেশনের এই কর্মকর্তা বলেন, স্রেফ দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার কারণে বছরে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সিটি করপোরেশন।
সবচেয়ে মজার ব্যপার হচ্ছে-কমিউনিটি সেন্টারগুলো থেকেও আয়-ব্যয়ের কোনো হিসাবই নেই করপোরেশনে।নথিপত্রও পাওয়া যাচ্ছে না। করপোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, কেবল চলতি বছর নয়, এই খাতে বিগত বছরের আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাবই নেই কোথাও।
কমিউনিটি সেন্টারগুলোর দুরাবস্থা খতিয়ে দেখা এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও ব্যবস্থাপনা কীভাবে উন্নত করা যায় সে লক্ষ্যে সংস্থার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (টিইডি) আশিকুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত চার সদস্যের তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও এই দুরবাস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে।
কমিটি তদন্ত করতে গিয়ে আয়-ব্যয়ে ব্যাপক গড়মিল খুঁজে পেয়েছে। সেন্টারগুলো থেকে গত পাঁচ বছরের হিসাবে বের করতে গিয়েও তাদের গলদঘর্ম অবস্থা হয়েছে।
কমিটি গত পাঁচ বছরের হিসাব বের করতে গিয়ে বহু কসরত করে তিন বছরের আংশিক হিসাবে বের করতে পেরেছে। সেখানে এটা থাকলেও সেটা নেই-এমন অবস্থা।
নথিপত্র ঘেটে আবার কমিউনিটি সেন্টারগুলোর নির্মাণ ব্যয়, পানি ও জ্বালানি ব্যয় রক্ষণাবেক্ষণসহ অন্যান্য রেকর্ডপত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। এ ব্যাপারে কারো কোনো জবাবদিহীতাও যেন নেই।
তদন্ত কমিটি তাদের অনুসন্ধানে দেখতে পেয়েছে যে, ডিএসসিসির ৩৬ কমিউনিটি সেন্টারগুলোর মধ্যে ২টি এখনো নির্মাণাধীন, ৩টি ব্যবহার অনুপোযোগী, ২টি পূণার্ঙ্গ ও ৩টি আংশিক থানা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে, ২টি র্যা ব কার্যালয় ও ২ করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাকি সেন্টারগুলোর মধ্যে ২২টি পূর্ণাঙ্গ ও ৩টি আংশিক কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে চালু রয়েছে। এরই মধ্যে আবার বেশ কয়েকটির নাম যুক্ত হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায়।
এসব সেন্টারে ব্যায়ামাগার, স্বাস্থ্য সেবা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, লাইব্রেরি, কমিশনার কার্যালয়, ইপিআই কেন্দ্র, দুর্যোগকালে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
অন্যদিকে গত ১জুন রাজধানীর মৌলভীবাজারে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে মেয়র সাঈদ খোকনের উপস্থিতিতে ৩১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রফিকুল ইসলাম রাসেলের বক্তব্যেও কমিউনিটি সেন্টারগুলোর দুর্দশতার চিত্র ফুটে উঠে। বক্তৃতায় তিনি বলেন, মৌলভীবাজারে কমিউনিটি সেন্টারটি খুবই ঝুঁকিতে। ভূমিকম্প হলেই ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে’।
পরে মেয়র সাঈদ খোকন তাঁর বক্তব্যে বলেন, দ্রুতই এসব ঝুঁকিপূর্ণ কমিউনিটি সেন্টারগুলো মেরামতের উদ্যোগ নেয়া হবে।
অভিযোগ রয়েছে, কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যালয় হিসাবে ব্যবহার করলেও অফিসের বিদ্যুত, পানি ও গ্যাস বিল পরিশোধ করার তাগিদ অনুভব করছেন না। ফলে এ নিয়ে ভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। আর এর দায় গিয়ে পড়ছে সিটি করপোরেশনের ওপর। ইউটিলিটি সার্ভিস চালু রাখার স্বার্থে বাধ্য হয়েই এসব বিল সিটি করপোরেশনকে পরিশোধ করতে হয়েছে অনেক সময় এবং এখনো হচ্ছে।
জানা গেছে, আগে বছরে এ খাত থেকে শত কোটি টাকা রাজস্ব আসলেও সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চরম অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে এখন আশানুরূপ আয় হচ্ছে না। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তদন্ত কমিটিসহ সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
তদন্তে এই অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তকর্তাদের চিহিৃত করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে সেভাবে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।সেন্টারগুলোর ভাড়া বাবদ মোটা অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছে এর আগে বহুবার। পরে এগিয়ে আসে দুর্নীতি দমন কমিশন। কমিশন সিটি করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তাকে চিহিৃত করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগও এনেছে। তবে কমিশন যাতে কোনো কাগজপত্র খুঁজে না পায় সে কারণের সব নথি গায়েব করে দেয়া হয়েছে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। এ নিয়েও অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ রয়েছে।
তদন্ত কমিটি কমিউনিটি সেন্টারগুলোকে সচল করার জন্য অবস্থা প্রথামিক পদক্ষেপ হিসাবে সাদেক হোসেন খোকা কমিউনিটি সেন্টার, ইসলামবাগ কমিউনিটি সেন্টার ও শরাফতগঞ্জ কমিউনিটি সেন্টারটিকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
একই সঙ্গে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মেরামত ও ক্রয়ের জন্য পরিচালনাকারী কর্মকর্তাকে ক্ষমতা দেয়ার সুপারিশও করা হয়েছে।
এর আগে ২০১৩ সালে ১ সেপ্টেম্বর এক বৈঠকে ডিএসসিসির কমিউনিটি সেন্টারগুলো নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সে সময় কমিটি সিটি করপোরেশনের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে কমিউনিটি সেন্টারগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার সুপারিশ করে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের(সুজন) সভাপতি বদিউল আলম মজুমদার ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জনগণের সেবার জন্য তাদের টাকায় এসব কমিউনিটি সেন্টার তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু জনগণ সে সেবা পাচ্ছে না এটা খুবই দুঃখজনক। তবে আমরা আশা করি বর্তমান মেয়র এবিষয়ে দৃষ্টি দেবেনে এবং সেন্টারগুলো সংস্কার করে ব্যবহারে উপযুক্ত করার জন্য উদ্যোগী হবেন। একই সঙ্গে এগুলোকে লাভজনক খাত হিসাবে পরিণত করার ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন।জনগণের ট্যাক্সে টাকার যাতে আর অপচয় না হয় সেদিকে লক্ষ রাখবেন নতুন মেয়র।
ডিএসসিসির সমাজকল্যাণ ও সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সিটি করপোরেশনের অধীনে থাকা কমি্উনিটি সেন্টার ভাড়া হয় না বিষয়টি সঠিক নয়। কয়েকটি পুলিশ-র্যা ব ব্যবহার করছে। আবার কয়েকটি আঞ্চলিক কার্যালয় হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, রাজধানীর মেয়র হানিফ কমিউনিটি সেন্টার, ধূপখোলা কমিউনিটি সেন্টার এবং কামরাঙ্গিরচর কমিউনিটি সেন্টারের পুনঃসস্কার চলছে। এসব কমিউনিটি সেন্টারে আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা থাকছে।
জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশানে মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, যেসকল কমিউনিটি সেন্টার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহার করছে সেগুলোকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। তবে হুট করেই এসকল থানা সরিয়ে দেওয়া যাবে না। এর সঙ্গে জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত আছে। তাই সংশ্লিষ্ট এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য স্থান পাওয়া গেলেই এগুলো সরিয়ে দেয়া হবে।
তিনি বলেন, যেসকল ওয়ার্ডে সিটি করপোরেশানের কমিউনিটি সেন্টার নেই সেগুলোর জন্য জায়গা খোঁজা হচ্ছে। জায়গা পেলেই এসমস্ত এলাকায় কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ করা হবে।
ঢাকা দক্ষিণের নতুন এই মেয়র আরো বলেন, যেসকল কমিউনিটি সেন্টারগুলো ব্যবহারে অনুপযোগী হয়ে গেছে। সেগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
(ঢাকাটাইমস/৫জুন/টিএ/এআর/ ঘ.)