logo ২৫ এপ্রিল ২০২৫
এই বিএসটিআইয়ের ওপর আস্থা রাখব কীভাবে?
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
০৫ জুন, ২০১৫ ১৫:৫৪:১৪
image


ঢাকা: সুইস প্রতিষ্ঠান নেসলের ম্যাগি নুডলস নিয়ে ভারতজুড়েই তুলকালাম। একের পর এক রাজ্যে নিষিদ্ধ হচ্ছে ম্যাগি বিক্রি। উপায় না পেয়ে নেসলেও বাধ্য হয়েছে বাজার থেকে চটজলদি ম্যাগি নুডলস তুলে নিতে। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের বাজারেও কম জনপ্রিয় নয় খাবারটি। চটজলদি বানিয়ে পরিবেশন করা যায় বলে এর চাহিদাও বেশি। সুস্বাদু হওয়ায় বাচ্চাদের কাছেও বেশ জনপ্রিয় ম্যাগি। ভারতে ম্যাগি নুডলসে অতিরিক্ত সিসার অস্তিত্ব পাওয়ার পর বাংলাদেশের বাজারেও প্রভাব পড়েছে। কমে গেছে ম্যাগির বিক্রি।

ভারতের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি অব ইন্ডিয়া (এফএসএসএআই) একাধিকবার পরীক্ষায় ম্যাগিতে সিসা ও ক্ষতিকারক রাসায়নিকে অস্তিত্ব পেয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) বলছে ম্যাগিতে ক্ষতিকারক কিছুর প্রমাণ পাচ্ছে না! যে কারণে একই প্রতিষ্ঠানের পণ্য ভারতে নিষিদ্ধ হলেও বাংলাদেশে এখনও কোনো নিষেধাজ্ঞা আসেনি। বরং অতিরিক্ত ছাড়ের প্রলোভন দেখিয়ে ঠিকই ম্যাগি নুডলস বাজারজাত করছে নেসলে।

পুষ্টি ও খাবারের মান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে এখনও ভোগ্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে খামখেয়ালিপনা রয়েই গেছে। এখনও শত শত ভোগ্যপণ্য আছে যেগুলো বিএসটিআইয়ের মান নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে এখনও দেদারে চলছে এ ধরনের ব্যবসা। অন্যদিকে বিএসটিআইয়ের মান নিয়ন্ত্রণ হলেই যে পণ্যের গুণগত সব মান ঠিক আছে, এমন নিশ্চিত হওয়ার সুযোগও নেই। কারণ, বিএসটিআইয়ের মান নিয়ন্ত্রণ নিয়েও আছে অনেক প্রশ্ন। তাছাড়া আধুনিক প্রযুক্তির যুগে পণ্যের মান নিরূপণে বিএসটিআইয়ে ব্যবহৃত প্রযুক্তি ততটা লাগসই কি না তা নিয়েও সন্দেহ আছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, খাদ্যে ও ফলমূলে ফরমালিন শনাক্ত করতে অত্যাধুনিক মেশিন খোঁজা হচ্ছে। এজন্য ন্যাশনাল ফুড সেইফটি ল্যাবরেটরির প্রধান এ কে এম জাফরউল্ল্যাহকে সভাপতি করে পাঁচ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটিও করা হয়েছে। এই কমিটিতে বিএসটিআইয়ের প্রতিনিধিরাও আছেন। এই কমিটি থেকে এ বার্তা সহজেই পাওয়া যায় যে, ১৬ কোটির বেশি জনসংখ্যার এই দেশের মানুষকে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহের জন্যও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। এটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক বটে। যেখানে প্রতিবেশী দেশ ভারত এসব বিষয়ে অনেক এগিয়ে গেছে সেখানে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকাটা মেনে নেওয়ার মতো নয়। বেঁচে থাকার জন্য মানুষের সবচেয়ে বেশি যেটার দরকার সেই খাবারের মান নিয়ে যদি আমরা উদাসীন থাকি তাহলে মধ্যম আয় ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ কতটা কাজে আসবে? আগে তো নাগরিকের বেঁচে থাকা, তার পর না উন্নয়ন। খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞদের মত এটি।

সুইস প্রতিষ্ঠান নেসলের বড় শাখা ভারতে। নেসলে যে শুধু ম্যাগি নুডলস তৈরি করে তা নয়। মসলা, চকলেট, শিশুদের খাবারসহ নানা ধরনের খাদ্য তৈরি করে। সে হিসেবে দেশটির বিপুল নাগরিক নেসলে পরিবারের সঙ্গে যুক্ত চাকরি বা ভোক্তা হিসেবে, যা দেশটির অর্থনীতির জন্যও একটা বড় নিয়ামকও। ভারত যদি নিজেদের নাগরিকদের সুস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে ম্যাগির ব্যাপারে কঠোর হতে পারে, সেখানে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাধা কোথায়? বিএসটিআই যদি গুণগত মান নির্ণয়ে ব্যর্থ হয় তাহলে আন্তর্জাতিক সহায়তা নিতে পারে। প্রয়োজনে নেসলের যেসব পণ্য বাজারে রয়েছে সেগুলোর নমুনা বিদেশে পাঠিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। মনে রাখা দরকার, ম্যাগি নুডলসের ভোক্তাদের বড় একটি অংশ শিশুরা। কম সময়ে তৈরি করা যায় বলে, বাচ্চাদের স্কুলের টিফিন থেকে শুরু করে হালকা নাস্তা হিসেবে ম্যাগি চালিয়ে দেওয়া যায়। এখনও বাংলাদেশের মানুষ এ ব্যাপারে অন্ধকারে রয়েছে। তাদেরকে আলোতে নিয়ে আসার দায়িত্ব দেশের খাদ্য ও স্বাস্থ্য বিভাগ এড়াতে পারে না।

ভারতে যখন সিসাকাণ্ড ম্যাগি কোণঠাসা হয়ে পড়ল ঠিক সেই মুহূর্তেই নেসলে বাংলাদেশ ম্যাগিতে বড় ধরনের ছাড় দিল। ১০ টাকা থেকে তিন বছরের ব্যবধানে ১৭ টাকায় পৌঁছা ম্যাগির প্রতি প্যাকেট নুডলসের দাম ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা হয়েছে। মানুষকে আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও টেলিভিশনেও নিয়মিত চমকপদ বিজ্ঞাপনও প্রচার করা হচ্ছে। তবে নেসলে কর্তৃপক্ষের দাবি, বিক্রি কমে যাওয়ায় তারা দাম কমিয়ে দেয়নি এটা তাদের ‘প্রমোশনাল ক্যাম্পেইন’। ম্যাগির এই ‘ক্যাম্পেইন’ এখনও চলছে। অথচ সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থা এগুলো গায়েই মাখছে না! এ কথাও নিশ্চিত করে বলতে পারছে না যে, ম্যাগিতে ক্ষতিকারক কিছু নেই।

শুধু নুডলসই নয়, নেসলের অন্য পণ্যগুলোও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা দরকার। পাশাপাশি আরও যেসব নুডলস বাজারে রয়েছে সেগুলোও পরীক্ষা করে দেখার সময় এসেছে। এমনিতেই খাদ্যে ভেজাল দেশের গুরুতর একটি সমস্যায় পরিণত হয়েছে। তার ওপর যেসব খাবারকে মানুষ নিরাপদ মনে করে খাচ্ছে সেগুলোতেও জীবন ধ্বংসকারী পদার্থের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, এটা কোনোভাবেই ভালো কোনো নমুনা নয়। ব্যবসা করতে গিয়ে মানুষের জীবন বিপন্ন করে দেওয়ার চেষ্টা কখনও সমর্থনযোগ্য নয়, বরং যে বা যারা এসবের সঙ্গে জড়িত তাদের কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। দেশে খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে আইন আছে, প্রয়োগ নেই। আর প্রয়োগ থাকলেও কিছু অসাধু লোকের জন্য এগুলো কাজে আসছে না।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, টাকার বিনিময়ে মানহীন পণ্যেও বিএসটিআইয়ের অনুমোদন পাওয়া যায়। এ কথা পুরোপুরি মিথ্যা নয়। এ দেশে টাকা হলে সব হয়, সেখানে বিএসটিআই এসব থেকে মুক্ত প্রতিষ্ঠানটির প্রতি এ বিশ্বাস আনার মতো কোনো নজির কি আছে? বরং বিভিন্ন সময় মানহীন পণ্যে অনুমোদন দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটিকে। নাগরিকের জন্য নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এই দায়িত্ব পালনে যা করা প্রয়োজন সরকারকে তাই করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আমাদের পিছিয়ে থাকা মোটেও কাম্য নয়।



(ঢাকাটাইমস/ ০৫ জুন /এইচএফ/ঘ.)