logo ১৪ মে ২০২৫
অভিযোগকারীর কাছে তথ্য চাওয়া দোষের নয়: কামাল লোহানী
২৭ আগস্ট, ২০১৫ ১৩:০৩:১৯
image

সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী। এই নামে পরিচিত হলেও তাঁর পারিবারিক নাম  ‍আবু নাঈম মো. মোস্তফা কামাল খান লোহানী। সম্প্রতি দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম ও সাপ্তাহিক এই সময়ের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। দীর্ঘসময়ের আলাপে উঠে আসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রসঙ্গও।


ধানমন্ডির বাসায় কামাল লোহানীর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক বোরহান উদ্দিন ও তানিম আহমেদ।


ঢাকাটাইমস: মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এই স্বাধীনতার সীমাইবা আসলে কতটুকু।স্বাধীনতার নামে আজকাল ব্যক্তিগত আক্রমণও করা হচ্ছে। এধরনের আক্রমণ করা যাবে কিনা?


কামাল লোহানী: মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে। তবে কাউকে আক্রমণ করে কথা বলতে হলে আপনাকে সশস্ত্র হতে হবে। তথ্য প্রমাণের পাশাপাশি আপনার কাছে যুক্তি থাকতে হবে। কাউকে আক্রমণ করতে চাইলে আপনাকে ভাষা প্রয়োগে দক্ষ হতে হবে, কৌশলী হতে হবে। একইসঙ্গে দায়িত্বশীল হতে হবে। বিশেষ করে সাংবাদিকদের তো আরো বেশি সজাগ থাকতে হবে। আপনি যা দেখলেন তাই লিখে দিবেন তেমনটা না। কারণ রাষ্ট্রের নীতির বাইরে গিয়ে আপনি লিখতে পারেন না। সেক্ষেত্রে যিনি মত প্রকাশ করছেন বা করলেন তাকে মনে রাখতে হবে যে রাষ্ট্রকে বা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির প্রতি কোনো অন্যায় আচরণ করা হয়েছে কিনা।


ঢাকাটাইমস: কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলে তার প্রমাণ চেয়ে আইনী নোটিশ দেয়া হয়রানিমূলক হবে কিনা?


কামাল লোহানী: কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করার পর অভিযোগকারীর কাছে তথ্য চাওয়ায় দোষের কিছু নেই। এটা হয়রানিমূলক হবে না। কিন্তু আনীত অভিযোগের তদন্ত করার জন্য যাকে দায়িত্ব দিতে হবে তাকে অবশ্যই অভিযোগকারীর চেয়েও উচ্চ পদমর্যাদার কিংবা সমপর্যায়ের হতে হবে।


ঢাকাটাইমস: কেমন চেয়েছিলেন আর কেমন বাংলাদেশ দেখছেন?


কামাল লোহানী: পাকিস্তানের কাছ থেকে লড়াই সংগ্রাম করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। কারণ সেখাকে আমাদের সমস্যার অন্ত ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৩বছর পরও সমস্যা কাটেনি। বরং দিনদিন বাড়ছে। বিশেষ করে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তো আরো সমস্যা। আমরা যেজন্য স্বাধীনতা অর্জন করেছি তা আসলে হয়নি। সেক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর বাকশালের কথা বলা হোক আর চারটি পত্রিকা রেখে বাকিগুলো বন্ধ করে দেয়ার কথা বলা হোক-তবুও আমরা যে কোনো ধরণের সমস্যা নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে পারতাম। আমাদের কয়েকজনের জন্য তার সাক্ষাৎ পেতে আগে  থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হতো না সরাসরি যেতে পারতাম। কিন্তু এখন তো তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আমি কি তার সঙ্গে দেখা করা বা কথা বলার কথা ভাবতে পারি? আর সমালোচনা করলে তো ৫৭ ধারা আছে। এই আইনটা আসলে একটা ভীতিকর বিষয়। পাকিস্তান আমলেও এমনটা হয়নি। এগুলো আসলে স্বৈরশাসনের একটা উপাদান। এটা দুঃখজনক। এসব করে আসলে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি।


আর দেশে গুম, খুন, অপহরণ যেভাবে হচ্ছে এটা কোনো স্বাধীন দেশে ভাবা যায়? প্রতিনিয়ত সরকারি দলের লোক নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে মরছে। এখন সরকারও কঠোর হচ্ছে। কি করবে টিকে থাকতে হলে তাদের অবশ্যই কঠোর হতে হবে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে এসব খুনোখুনির কারণে বিরোধী রাজনৈতিক দল বগল বাজানোর সুযোগ পাচ্ছে।


ঢাকাটাইমস: দেশের এমন পরিস্থিতি কেন?


কামাল লোহানী: স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিচার না করার কারণে দেশে যে বিচারহীনতা শুরু হয়েছিল সেটা হলো অন্যতম কারণ। যে কোনো দেশে যু্দ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করার পর স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার করা হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ২২ হাজার যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু করেন। পরে যদিও বঙ্গবন্ধু এদের মধ্যে নিরপরাধ যারা ছিল তাদের ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরকে হত্যা করেন এবং বাকি যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দেন। পরবর্তিতে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার যাতে না হয় সেজন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন। এর মাধ্যমে দেশে বিচারহীনতার রীতি চালু হয়। পরবর্তিতে যে জামায়াত স্বাধীনতা যু্দ্ধে পাকিস্তানীদের সঙ্গে জল্লাদ- কসাইয়ের ভুমিকায় ছিল তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দিলেন।


এর কারণেই কিছুদিন পরপর হুজি, আনসারুল্লাহ, জমিয়াতুল মুজাহিদীন নামে তালিকা করে হুমকি দেয়া হয়। সঠিক সময়ে এদের বিচার করলে হুমকি আসতো না।


এরপর এরশাদের স্বৈরশাসন চললো নয়বছর। এখন তিনি গণতন্ত্রের ছবক দিচ্ছেন। কিন্তু এরশাদের ওই আমলের সঙ্গে এই আমলের বক্তব্য মিলিয়ে দেখলে তাকেই তো দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া উচিত। সে তো প্রতিনিয়ত মিথ্যা কথা বলছে। এই এরশাদকে রাজপথে আসার সুযোগ দিয়েছে ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক দলগুলো। এরশাদ একদিকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। অন্যদিকে সরকারের সব কাজের যে সমালোচনা করছে কি দারুন!


ঢাকাটাইমস: মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার দেখে কি মনে হচ্ছে?


কামাল লোহানী: আমার কোনোভাবে বুঝে আসছে না কি কারণে বিচারটি ঢিলেতালে চলছে। এটা কি উদারতা না দুর্বলতা। আমার মনে হয় এটা রাজনৈতিক দুর্বলতা।


আমার প্রশ্ন কেন মানবতাবিরোধী অপরাধীদের রায়ের পর আবার আপিল করার সুযোগ থাকবে? এর আবার নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই। শুধু তাই নয়, আপিল বিপক্ষে গেলে আসামিপক্ষ রিভিউ করার সুযোগ পাবে। এইসব সুযোগে জামায়াতের অন্যতম আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক দেশের বাইরে চলে গেছেন এখন আর আসেননি।


দেখুন প্রথমে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের শীর্ষ পদে একজন জামায়াতের লোককে বসানো হয়েছিল। আমরা দাবি করায় পরে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।এখনো ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন পদে জামায়াতের লোকজন বসে আছে। রাজনৈতিক দুর্বলতা ও স্বার্থপরতার কারণে এমন অবস্থা।


আমার প্রশ্ন জামায়াতকে কেন এখনো নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না। তবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার পর আমার একটি শর্ত হলো তাদের কোনো দলে ভেড়ানো যাবে না। কিছুদিন আগে দেখলাম সরকারি দলের নেতাদের হাতে ফুল দিয়ে জামায়াতের লোকেরা আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছে। প্রায়ই এমন খবর পাচ্ছি। খুবই খারাপ লাগে এমনটা দেখলে।


অথচ হেফাজতকে রাতের মধ্যে সরিয়ে দেয়া হলো গণজাগরণ মঞ্চকে তুলে দেয়ার বিনিময়ে। এটা কোনো কথা? কারণ ওটা তো ছিল একটা স্বতঃস্ফূ্র্ত কর্মসূচি।


ঢাকাটাইমস: সাংবাদিক সংগঠনগুলোর ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি?


কামাল লোহানী: আইয়ুব খান অনেক চেষ্টা করেও সাংবাদিকদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে পারেননি। পাকিস্তান আমলে আমরা যারা সাংবাদিক নেতা ছিলাম আইয়ুব খান নিজে তাদের অনেকটা সমীহ করে কথা বলতেন। কিন্তু আজ ওমুক সাংবাদিক আটক হচ্ছে, মার খাচ্ছে। কিন্তু কোনো প্রতিবাদ নেই। সাংবাদিকদের এই বিভাজের জন্য পেশার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু এটা শুরু করেন বেগম খালেদা জিয়া। যা এখন দুটো আলাদা গ্রুপে পরিণত হয়েছে। সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের চেষ্টার থেকে নেতারা কিভাবে সম্পত্তি বানাবে সেই চিন্তায় থাকেন।এটা দুঃখজনক। আমরা কয়েকজন মিলে সাংবাদিক ইউনিয়নকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা শুরু করেছিলাম কিন্তু জামায়াতপন্থিদের অসহযোগিতার কারণে তা বন্ধ হয়ে গেছে।


ঢাকাটাইমস: কেমন বাংলাদেশের প্রত্যাশা করেন?


কামাল লোহানী: একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। ভবিষ্যতে সেটা হবে কিনা জানিনা। কারণ আমরা প্রতিনিয়ত খারাপের দিকে যাচ্ছি। খুব ভালো হবে বলে মনে হয় না। একটি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার ক্ষমতায় থেকে কেন অগ্রহণযোগ্য কিছু কাজ করে বিরোধী রাজনৈতিক দলকে সুযোগ করে দিচ্ছে তা ভাবলে আমার বিস্ময় লাগে।


ঢাকাটাইমস: আপনাকে ধন্যবাদ।


কামাল লোহানী: ঢাকাটাইমস ও এইসময়কেও ধন্যবাদ।


(ঢাকাটাইমস/২৭আগস্ট/বিইউ/টিএ/এআর)