বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে গত ২০ বছর ধরে কাজ করছেন তিনি। কথা বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির নানা দিকে নিয়েও। সম্প্রতি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি পাওয়া নিয়েও তিনি তার মতামত তুলে ধরেছেন গণমাধ্যমে। চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলায় জন্মগ্রহণকারী জাহিদ হোসেনের কথা বলছি। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ শাখার প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের সঙ্গে সম্প্রতি ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিনিধির কথা হয় বাংলাদেশর অর্থনীতির নানা দিক নিয়ে। আলোচনায় তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতির সমস্যা-সম্ভাবনা, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া এবং অগ্রযাত্রার পথে সুপারিশসহ নানা বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।
তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- সৈয়দ বাকের।
সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশটি ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
ঢাকাটাইমস: বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে এখন কোন খাতে সাহায্য করছে?
জাহিদ হোসেন: বিশ্বব্যাংক এখন মূলত বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ সামাজিক উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি সম্পৃক্ত। এছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো কিছু অবকাঠামো উন্নয়ন বিশ্বব্যাংক সহায়তা করছে।
ঢাকাটাইমস: সংস্থাটি সম্প্রতি বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বাধীনতার পর এটা এই প্রথম, এ সম্পর্কে জানতে চাইছিলাম-
জাহিদ হোসেন: বিশ্বব্যাংকের অপারেশনাল কাজের জন্য, যেমন ঋণ সহায়তা কর্মসূচি এবং ঋণ বহির্ভূত কর্মসূচি কাকে কিভাবে দেয়া হবে সেটা নির্ভর করে প্রার্থিত দেশটি আয়ের কোন পর্যায়ে আছে তার ওপর। প্রতিবছরই রুটিনওয়ার্কের অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাংক দেশগুলোকে মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে চার ভাগে ভাগ করে দেয়। এরমধ্যে ১০৪৫ মার্কিন ডলারের কম হলে নিম্ন আয়, এর থেকে বেশি এবং ৪১২৫ ডলার পর্যন্ত হলে নিম্ন মধ্যম আয়। বাংলাদেশ এতদিন পর্যন্ত নিম্ন আয়ের দেশ ছিল, এই প্রথম ১০৪৫ অতিক্রম করে গেল এবং তাও ২০১৪ অর্থবছরের আয়ের ভিত্তিতে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের নিম্ন পর্যায়ে ঢুকে গেল। এটা মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার ক্ষেত্রে একটি ছোট পদক্ষেপ মাত্র। সে হিসেবে এটাকে যেমন খুব বেশি খাটো করে দেখলে সুবিচার করা হবে না। এটা আমরা অতিক্রম করেছি। এখন পর্যন্ত ৩১টি দেশ আছে, যারা তা অতিক্রম করতে পারেনি। এর মধ্যে দক্ষিণ সুদান নিম্ন মধ্যম থেকে নিম্ন আয়ের দেশে নেমে গেছে। সে তুলনায় বাংলাদেশ ভালো করেছে।
আমরা তো এগুচ্ছি, এই অর্জন আমাদের অগ্রগতির আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি প্রাতিষ্ঠানিক-স্বীকৃতি। এটাকে যেমন খাটো করে দেখার সুযোগ নেই, তেমনি উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। আন্ততুষ্টিতে ভোগা কিংবা কেল্লা ফতে হয়ে গেছে মনে না করাই শ্রেয়। কেননা কেল্লা ফতে কিন্তু হয়নি, ঢুকেছি মাত্র। এই কেল্লাটা পঞ্চাশ তলা বিশিষ্ট। যেখানে লিফট বা কোনো শটকাট উপায় নাই। আপনাকে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে, প্রত্যেকটা সিঁড়ি স্পর্শ করে যেতে হবে। সেটা করতে গিয়ে প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হবে, এটা নির্ভর করবে অর্থনীতির স্বাস্থ্যের ওপর।
এটা সেক্টরভিত্তিক বিভিন্ন হবে। কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং উৎপাদন খাতে উন্নতি করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হবে। তবে বাংলাদেশ তা অর্জন করতে শুরু করেছে। এটার একটা স্বীকৃতি আমরা পেয়েছি।
ঢাকাটাইমস: এর ফলে কোনো সুবিধা বাতিল হবে কিনা, যেমনটা রপ্তানিকারকরা মনে করছেন-
জাহিদ হোসেন: না না, এখানে একটা বড় ধরনের ভুল বোঝাবুঝি আছে। আমরা নিম্ন মধ্যমে আয়ের দেশের পর্যায়ে পৌঁছেছি, কিন্তু সুবিধা যেটা বলা হচ্ছে, বিশেষ করে গার্মেন্টের ক্ষেত্রে। সেটা কিন্তু এর সাথে সম্পৃক্ত নয়, বা মধ্যম আয়ের দেশের সাথেও নয়। এটা নির্ভর করে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হওয়ার উপরে।
এখন পৃথিবীতে ৪৮টি দেশ আছে, যাদের এলডিসি বলা হয়। এই এলডিসি স্ট্যাটাস থেকে যদি আমরা বেরিয়ে যাই তাহলে এটা বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে, বাতিল হওয়া নয়। কিন্তু এলডিসি স্ট্যাটাস থেকে বের হওয়া সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।
জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) তা সুপারিশ করে, ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যল কাউন্সিল (ইকোসক) এটাকে যাচাই-বাছাই করে এবং জেনারেল অ্যাসেম্বলি এটাকে কনফার্ম করে। এটা প্রতি তিন বছর নবায়ন করা হয়। মোট তিনটি সূচকের ভিত্তিতে করা হয়, যার মধ্যে একটি জাতীয় আয়। এক্ষেত্রে তারা বিশ্বব্যাংকের তথ্য ব্যবহার করে কিন্তু সীমা অনেক বেশি। এলডিসি থেকে বের হতে হলে আয় হতে হবে ১২৪২ ডলারের বেশি হতে হবে। সম্ভবত ২০১৮ সালে আমরা এটা ক্রস করে যাবো। তখন সিডিপি সুপারিশ করবে যে বাংলাদেশ সীমা অতিক্রম করেছে। কিন্তু এটা দুইবার সুপারিশ করতে হবে। প্রথম বার ২০১৮ সালে এবং পরে ২০২১ সালে ওরা দেখবে যে আমরা ওইটা ধরে রাখতে পেরেছি কিনা যেটা আমরা অর্জন করেছি কিংবা সেটা সাসটেইনেবল কিনা।
এক্ষেত্রে তিন বছর আগের আয় বিবেচনা করা হবে, যেমন বিশ্বব্যাংক করেছে এক বছর আগের আয়ের হিসাবে। যেহেতু জাতিসংঘ তিন বছর আগের আয় হিসাব করবে, আগের বছরগুলোতে ইনকাম কম ফলে গড়টা কমে যাবে। সেটাও যদি ধরি আমরা অতিক্রম করলাম, তখন প্রথম সুপারিশ করবে। এরপর ২০২১ চূড়ান্ত সুপারিশ করবে। তারপরে ২০২৪ সালে দেখবে ওই তিন বছর আমরা টিকেছি কিনা, তারপর প্রস্তাব জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে পাঠানো হবে। জেনারেল অ্যাসেম্বলি তিন বছর সময় দেবে এবং সংশ্লিষ্ট দেশকে জিজ্ঞেস করবে যে তুমি এলডিসি থেকে বের হতে চাও কিনা। যদি বলে আমি প্রস্তুত না, তাহলে তিন বছর আরও সময় দেবে। এরপরেও সুবিধাগুলো আলোচনার মাধ্যমে বহাল রাখা যাবে, সাথে সাথে প্রত্যাহার করে নেবে না।
মূলকথা হলো- গরিব হিসেবে আমরা যেমন দান-দক্ষিণা পাই তেমনি গরিব থেকে বেরিয়ে গেলেও কিছু সুবিধা পাবো, যেমন আন্তর্জাতিক ক্যাপিটাল মার্কেটে সহজে ঋণ পাওয়া কিংবা আমাদের বাণিজ্যিক চুক্তি করা, রাজনৈতিক বিষয়ে জোর গলায় মত প্রকাশ করা ইত্যাদি। কারণ উন্নত বাংলাদেশ যদি উন্নত দেশের হয়ে যায়, তখন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় আমাদের অংশগ্রহণ-অবদান সবই বাড়বে। আমাদের গলা জোরালো হবে।
আমার কথা হচ্ছে বেকার থাকলে আপনি বেকার ভাতা পাবেন, বেকার না থাকলে সেটা চলে যাবে তাই বলে কি আপনি বেকার থাকবেন।
আমরা এলডিসি হিসেবে কিছু সুবিধা পাই ওই সুবিধা হারাবার ভয়ে কি আমরা সারাজীবন এলডিসি থাকবো?
এটা খুবই হতাশজনক যে অনেকে বলেছে যে, এটা ভাবার বিষয় যে আমরা এলডিসি থেকে বের হতে চাই কিনা। আরে ভাই না চাওয়ার তো কোনো প্রশ্নই হতে পারে না। আপনি কি উন্নয়নকে ধরে রাখবেন? আমরা যদি একটি শক্তিশালী জাতি হতে চাই তবে আমাদের অবশ্যই এগিয়ে যেতে হবে। তার সাথে যে ক্ষতি হবে তা আপনি আলোচনা করে বহাল রাখার সুযোগ পাবেন। যেমন শুল্কমুক্ত সুবিধা আঞ্চলিক চুক্তির মাধ্যমেও পাওয়া যেতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে যে সুবিধা পাচ্ছি তা টিকিয়ে রাখতে পারবো, কারণে এটা শুধু এলডিসিদের দেয়া হয় না।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শক্তিশালী অর্থনীতি গড়লে আলোচনার গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। তখন আমরা বড় বড় মার্কেটে প্রবেশ করা এবং চুক্তি করতে পারবো।
ঢাকাটাইমস: নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার সুবিধা কী হতে পারে-
জাহিদ হোসেন: এই স্বীকৃতির ফলে সরকারি ও বেসরকারিভাবে আন্তর্জাতিকভাবে ঋণ নেয়াটা সহজ হবে। কারণ যারা ঋণ দেবে তারা বিশ্বব্যাংকের স্বীকৃতিকে বিবেচনায় নেবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও উৎসাহিত হবে।
প্রধানত তিন কারণে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। এগুলো হলো- প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করে বিক্রি করা, স্থানীয় বাজারে প্রবেশ করা এবং সস্তা শ্রমকে কাজে লাগানো। এই তিনটি সুযোগই বাংলাদেশের আছে। কোনো দেশে তা গ্রহণ করার ক্ষমতা আছে কিনা তা অর্থনৈতিক সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। নিম্ন আয়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী বলেই আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছি। এখন শুধু পরিবেশটা দিলে হয়।
ঢাকাটাইমস: মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে আমাদের অগ্রগতি কতটুকু?
জাহিদ হোসেন: আমরা বারবারই বলে আসছি মধ্যম আয়ের দেশ মানে কী? কোন সূচকের ভিত্তিতে আমরা বলবো মধ্যম আয়ের হলেন কি হলেন না? এবারের বাজেট বক্তৃতায় প্রথমবারের মতো দেখলাম তা পরিষ্কার করে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে মধ্যম আয়ের দেশ মানে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণ। সে কারণে বাজেট বক্তৃত পরিশিষ্ট অংশে (৯৪ পৃষ্ঠা) একটা চার্ট দেয়া আছে। সেখানে অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা, মানবসম্পদ উত্তরণ ও মাথাপিছু জাতীয় আয়ের উত্তরণ প্রমাণ ও আমাদের বর্তমান অবস্থা দেয়া আছে।
আমি যেটা মনে করি, ২০২১ সালে আমরা চূড়ান্ত সুপারিশ পাবো। এ প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই, ২০১৮ সালে হয়তো আমরা প্রথম সুপারিশটা পাবো। তবে ২০২৪ সালের আগে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার সুযোগ নেই।
ঢাকাটাইমস: যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা অব্যাহত থাকে তাহলে এটা অর্জন সম্ভব কিনা?
জাহিদ হোসেন: যদি গত দুই বছরের ওপর আলোকপাত করি এবং এটা যদি পুনরাবৃত্তি ঘটে তাহলে মাথাপিছু আয়ে আমরা যে অগ্রগতি করেছি তা ধরে রাখতে পারবো কিনা সন্দেহ আছে এবং প্রশ্নবিদ্ধ হবে। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার উন্নয়ন আমাদের ঘটাতে হবে। এক্ষেত্রে গ্লোবাল শক কতটুকু মোকাবেলা করতে পারবো সেটা বিবেচনায় আনা হয়। এটা নির্ভর করে রপ্তানির ভাণ্ডার কতবড় এবং তার বৈচিত্র্যের ওপর। এখন বারো মাসের মধ্যে তিন মাস রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে এক্সপোর্ট বাস্কটে ডাইভারসিফাইড করবেন কিভাবে, বিনিয়োগ তো আসবে না। সে সুযোগ তো আমরা গ্রহণ করতে পারবো না। সে ক্ষেত্রে আমাদের ধুঁকতে হবে।
আরেকটি বিষয় হলো এলডিসি থেকে উত্তরণের বিষয়ে যে আশঙ্কা করা হয় আমরা সুবিধা হারাবো। সেক্ষেত্রে বলতে চাই আমরা যদি এলডিসি না হলে এলডিসি দেখানো হয় শুধু কাগজে কলমে এলডিসি হই বাস্তবে না হই তাহলে আমরা এলডিসি হবো না, সুবিধাও হারাবো। এটা তো গ্রহণযোগ্য না।
এটা একারণে বলছি যে আমরা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) গ্রোথের যে হিসেবগুলো আমরা দেখছি তাতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে কাউন্ট করা হয়নি, অর্থনৈতিক কত ক্ষতি হয়েছে তা আসেনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের পরিসংখ্যান স্ফীতি আছে। যেটাকে বলছি ব্যাড ফ্লেশন। এই পরিসংখ্যান স্ফীতির কারণে যদি সূচকগুলোতে আমাদের উন্নতি হয়, তাহলে তা শুধু কাগজে কলমে হবে, বাস্তবে না। এ ব্যাপারে পরিসংখ্যানের সঠিকতা একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয়। এজন্য পরিসংখ্যান প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হতে হবে, স্বাধীন নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে।
ঢাকাটাইমস: রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছাড়া আর কি সমস্যা আছে, যেমন রেমিট্যান্সে কোনো ঝুঁকি আছে কিনা-
জাহিদ হোসেন: আমাদের জনশক্তি রপ্তানি এখনও ইতিবাচক। প্রবাসীরা ফিরে আসছে কত সে সম্পর্কে কোনো তথ্য না থাকলেও যদি গণহারে প্রবাসীরা ফেরত আসতো তাহলে আমরা সেটা খেয়াল করতাম। সেরকম গণহারে কেউ ফেরত আসছে না, যেটা হচ্ছে তার মধ্যে স্বাভাবিক ফেরতও আছে। মধ্যপ্রাচ্যের বড় বড় অর্থনীতির দেশগুলোতে আমাদের কিছু সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে, এক্ষেত্রে ইকোনমিক ডিপ্লোমেসির কিছু ব্যর্থতা ছিল। এর সাথে যুক্ত হয়েছে মাইগ্রেশনের খরচের বিষয়ে আমাদের অতিরিক্ত উদ্বেগ।
এজন্য মাইগ্রশন বন্ধ করা দেয়া যায় না। দরকার হলে এর চেয়ে সস্তা কোনো উপায় বের করে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল।
মানুষ তো সুযোগের জন্য যায়। যদি ভালো সুযোগ থাকে তবে সে অবশ্যই যাবে। এদের তো মানসিক বিকৃতি হয়নি। এর মানে এই না যে আমাদের দেশে সুযোগ নেই, কিন্তু তারা ভালো সুযোগ চায়।
কিন্তু অর্থনৈতিক যে ঝুঁকির কথা বলছেন সে ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা আছে, যেমন বিদ্যুৎ সংযোগ, যা ব্যবসার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যুতের সুবিধা পাওয়া ক্ষেত্রে বিশ্বের ১৮৮টি দেশের মধ্য আমাদের অবস্থান ১৮৭তম। একটি বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে দেড় বছর সময় লাগে, কোনো কারণে ব্যবসায়িক বিরোধ হলে তা নিষ্পত্তি করতে চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগে। আপনি একটি জমি কিনলেন এটা নিয়ে কোর্টে কেউ রিট করে দিল আপনার বিনিয়োগ আটকে যাবে। এটা যদি আমরা নিরসন করতে না পারি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা যেভাবে বাড়ছে তার সাথে কিভাবে টেক্কা দেব।
আরেকটি সমস্যা হলো অবকাঠামোগত অবস্থা। বিশেষ করে ফিজিক্যাল ইনফ্রাস্টাকচারে আমাদের অবস্থান ভালো নয়।
ঢাকাটাইমস: এ সমস্যা নিরসনে আপনার সুপারিশ-
জাহিদ হোসেন: প্রথমে যেসব প্রকল্প শুরু করা হয়েছে তা শেষ করা উচিত। কারণ আমাদের ভালো ভালো উদ্যোগ আছে। পদ্মা সেতু ও ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের কাজ শেষ করা দরকার। এই হাইওয়ের কাজ ২০০৬ সালে শুরু হয়েছে, ৫ বছরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। অথচ এখনও ৬০ শতাংশ কাজ হয়েছে, এর ফলে ব্যয় বাড়েছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। কাজ ঠিকমত শেষ হলে যে সুবিধা পেতাম তা পিছিয়ে যাচ্ছে এবং যে দাম তা পেতাম তার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
শুধু চার লেন করলে হবে না, ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেস ওয়ে দরকার। এর সাথে বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। প্রবৃদ্ধি যে পরিমাণে বাড়ে বন্দরের সক্ষমতা তার দেড়গুণ বেশি বাড়ানো উচিত। অথচ আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর অবস্থা থেকে থেকে চলছে। আর যা আছে তার ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত। যে উদ্যোগগুলো নেয়া হয়েছে, সেগুলো সুষ্ঠুভাবে শেষ করা উচিত।
আরেকটি বড় উদ্যোগ আছে ইকোনমিক জোন। আমাদের শুধু জমির সমস্যা না, নানা জটিলতা আছে। এজন্য ইকোনমিক জোন করে দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ১৩টি ইকোনমিক জোনের অনুমতি দেয়া হয়েছে, যার মধ্য তিনটি ভারত, জাপান ও চীনকে দেয়া হয়েছে। কোরিয়াকে আগে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সে জমি আবার ফেরত নেয়া হচ্ছে। জমি দিয়ে ফেরত নেয়া হলে তা উদ্যোক্তাদের কাছে ভুল সংকেত দেবে। এটা খুব বড় ঝুঁকি। কারণ কেউ যদি টাকা বিনিয়োগ করে, তা যদি নিয়ে নেয়া হয় তাহলে আর কেউ আসবে না।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিকীর পরিকল্পনা শেষ হতে হতেই যদি আমরা তিনটি ইকোনমিক জোন স্থাপন করতে পারি, তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেকাংশে বেড়ে যাবে।
ঢাকাটাইমস: আগামী ১৬ বছরে গ্যাসে মজুদ শেষ হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সুবিধা দেয়া কিভাবে সম্ভব হবে-
জাহিদ হোসেন: গ্যাস আবিষ্কারের ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা পর্যাপ্ত নয়। আমাদের সমুদ্রসীমায় গ্যাসের বিশাল মজুদ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া তা সম্ভব নয়। বিদ্যুতের জন্য গ্যাসের দরকার আছে। আবার বিদ্যুৎ শুধু উৎপাদনে নয়, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নয়নে দরকার আছে। এখনও পর্যন্ত গ্যাসই আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল। গ্যাস দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। এজন্য গ্যাসে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। একইসাথে শক্তির বিকল্প উৎস খুঁজে বের করতে হবে।
ঢাকাটাইমস: বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে কী ব্যবস্থা নেয়া দরকার-
জাহিদ হোসেন: এ ব্যাপারে সরকার কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। তবে সমস্যাও আছে। যেমন কয়লানীতি এখনও প্রণয়ন করা হয়নি। দেশের কয়লা উত্তোলন করা না হলে বিদেশ থেকে কিভাবে আমদানি করা হবে তা ঠিক করা উচিত।
এছাড়া ট্রান্সফরমশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কিছু সমস্যা আছে। গত ব্ল্যাক আউটে তা টের পাওয়া গিয়েছিল। এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া উচিত।
ঢাকাটাইমস: রাজধানীর উন্নয়নে কী করা উচিত-
জাহিদ হোসেন: বাংলাদেশ সাসটেইন্যাবিলিটি রিস্ক ভোগে তার কারণ হলো অপরিকল্পিত নগরায়ন। আমাদের জিডিপির ৫০ শতাংশ আসে মাত্র দুটো শহর থেকে। এর মধ্য ঢাকা থেকে ৩৬ শতাংশ এবং চট্টগ্রাম ১৪ শতাংশ। ঢাকা এখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পৌঁছে গেছে। এজন্য প্রথমেই ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো উচিত, যাতে মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে না থাকে। এতে সময় ও তেলের অপচয় কমবে। রাস্তাগুলো ঠিক করা দরকার, কারণ এ রোডে চলতে গিয়ে গাড়ি নষ্ট হয়। জলাবদ্ধতা কমানো দরকার। দক্ষতা বাড়াতে হলে এগুলোর উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সে জন্য বড় পরিকল্পনা দরকার। ঢাকা থেকে বের হওয়া দরকার।
ঢাকাটাইমস: বিশ্বব্যাংকের সাথে সরকার দূরত্বের কথা শোনা গিয়েছিল, বিশেষ করে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে-
জাহিদ হোসেন: পদ্মা সেতুর প্রভাব ঋণ কর্মসূচিতে পড়েনি। পদ্মা সেতু ছাড়া গত দুই বছরেই বিশ্বব্যাংক সবচেয়ে বেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশকে দিয়েছে।
ঢাকাটাইমস: বিশ্বব্যাংকের সাথে চীনের নেতৃত্বে গঠিত এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক সাংঘর্ষিক হবে কিনা-
জাহিদ হোসেন: না, এ ব্যাংককে বিশ্বব্যাংক সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করছে। তাদের টাকা আছে, বিশ্বব্যাংকের আছে অভিজ্ঞতা।
ঢাকাটাইমস: আপনাকে ধন্যবাদ।
জাহিদ হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।
(ঢাকাটাইমস/৮জুলাই/এসবি/জেবি)