ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেনের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়, ১৯৬৮ সালে। পৈতৃক নিবাস ওখানেই। পড়াশোনা করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। এ স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন ১৯৮৩ সালে। এরপর ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতক সম্মান কোর্সে। ১৯৮৯ সালে এ বিষয়েই কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ১৯৯৫ সালে।
ড. দেলোয়ার একই বিষয়ে দ্বিতীয়বার স্নাতকোত্তর করেন ২০০১ সালে, জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের স্কলার হিসেবে। আর পিএইচ-ডি ডিগ্রি নেন জাপানেরই ফেরিস ইউনিভার্সিটি থেকে, ২০০৭ সালে, মনবুশো স্কলার হিসেবে। বিষয় ছিল বিশ্বায়ন ও আঞ্চলিক সহযোগিতা। ড. দেলোয়ার হোসেন নিয়মিত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে বাংলা ও ইংরেজি দু’ভাষাতেই লেখালেখি করেন। তাঁর গবেষণার মূল ক্ষেত্র বিশ্বায়ন, নিরাপত্তা, পররাষ্ট্র্রনীতি ও উন্নয়ন সহযোগিতা। ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা বই- ‘গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড নিউ-রিজিওনালিজম ইন সাউথ এশিয়া’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যাপনার পাশাপাশি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। বর্তমানে তিনি বিভাগের অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করছেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বাংলাদেশে বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও নাসিমের সীমিত গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা চেয়েছেন। আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার ড. মাহাথির বিন মোহাম্মদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে খোলামেলা কথা হয়েছে অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মহিউদ্দিন মাহী।
ঢাকাটাইমস: মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির বিন মোহাম্মদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলুন।
অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন: ড. মাহাথির বিন মোহাম্মদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছিল সাধারণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মতোই। তবে তিনি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের দিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তার দল ক্ষমতায় ছিল বেশি দিন। সেই জন্য তিনি সুযোগও পেয়েছেন বেশি। ঐ সময়ের প্রয়োজনের তিনি অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন-যেটা দেশের জন্য ভাল হয়েছে।
ঢাকাটাইমস: ড. মাহাথিরের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বাংলাদেশে কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব?
অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন: মালয়েশিয়া পঞ্চাশের দশকে স্বাধীনতা লাভ করেছে। সেদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা আর বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এক নয়। ড. মাহাথির যেই পদ্ধতিতে দেশ শাসন করেছেন সেটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়ন মোটেই সম্ভব নয়।
ঢাকাটাইমস: কেন সম্ভব নয়?
অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন: ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই মালয়েশিয়ার বড় চ্যালেঞ্জ ছিল জাতিগত ও ধর্মীয় বিভাজনের সমস্যা মোকাবিলা করে রাজনৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করা। এ ভারসাম্য রক্ষার তাগিদেই সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু অনগ্রসর মালয় সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি চীনা ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে কি সেই অবস্থা আছে? বাংলাদেশে আদিবাসীরাও সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। তাহলে কিভাবে সেই মডেল এখানে বাস্তবায়ন হবে?
ঢাকাটাইমস: মালয়েশিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থা কেমন ছিল?
অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন: মালয়েশিয়ার একটি দলই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতায় ছিল। আর সেটি হচ্ছে মাহাথিরের দল। আর সেখানে শক্তিশালি বিরোধী দলও সেভাবে ছিল না। যার কারণে সরকার বিরোধী আন্দোলনও তেমন হয়নি।
ঢাকাটাইমস: তার মানে কি মালয়েশিয়ায় দুর্বল গণতন্ত্র ছিল?
অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন: সেটা কেন হবে? মালয়েশিয়ায় প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সেদেশ বিরোধী দলের শক্তিশালি অবস্থান ছিল না।
ঢাকাটাইমস: বাংলাদেশে উন্নয়নে মাহাথিরের মডেল কেমন ভূমিকা রাখতে পারে?
অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন: বাংলাদেশের উন্নয়নে শুধু সরকারই ভূমিকা রাখে না। এখানে সব শ্রেণি পেশার মানুষ উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। বিরোধী দলেরও উন্নয়নে অবদান আছে। তারাও লম্বা একটা সময় ক্ষমতায় ছিল। সুতরাং বাংলাদেশে উন্নয়ন বাংলাদেশের নিজস্ব মডেলেই করতে হবে। অন্য কোনো মডেল এখানে যুতসই হবে না।
ঢাকাটাইমস টাইমস: ড. মাহাথিরের মডেল নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের বক্তব্যকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন: স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথিরের মডেল নিয়ে যে কথা বলেছেন সেটা রাজনৈতিক বক্তব্য বলে আমার কাছে মনে হয়। কারণ আওয়ামী লীগ সরকারও সেটা চাইবে না। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হল- বাংলাদেশে উন্নয়ন মডেল বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়েই করতে হবে। এখানে অন্যদেশের কাছ থেকে আমরা সাহায্য-সহযোগিতা নিতে পারি। কিন্তু সেটাই যে আমাদের অনুসরণ করতে হবে তা নয়।
ঢাকাটাইমস: তাহলে কি আমরা অন্যদেশের উন্নয়ন মডেল অনুসরণ করবো না?
অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন: তা করবো না কেন? অবশ্যই করবো। কিন্তু অনুসরণ করার আগে আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের বিশ্লেষণ এবং যেই দেশের মডেল অনুসরণ করবো সেটার আর্থ-সামাজিক অবস্থান বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। তারপর অনুসরণের বিষয় আসবে।
ঢাকাটাইমস: মালয়েশিয়ায় মাহাথিরের বিরুদ্ধে বিরোধী দল দমনেরও অভিযোগ আছে। আছে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকারও অভিযোগ।
অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন: মালয়েশিয়ার তৎকালিন আর্থ-সামাজিক অবস্থার কথা চিন্তা করেই ড. মাহাথির বিন মোহাম্মদ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি তো জোর করে ২২ বছর ক্ষমতায় থাকেননি। তিনি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় ছিলেন। এছাড়া দীর্ঘদিনের ক্ষমতায় থাকার উদাহরণ জাপানেও আছে। সেখানকার ক্ষমতাসীন দল ৩৭ বছর ক্ষমতায় আছে। তাহলে কি আমরা বলবো সেখানে গণতন্ত্র নেই। বরং এই দেশগুলোতে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আছে। আর সেই নেতৃত্বের কারণেই তারা এগিয়ে যাচ্ছে।
ঢাকাটাইমস: আমাদের দেশে কি তাহলে বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাব?
অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন: বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাব তো আছেই। বিচক্ষণ নেতৃত্ব একটি দেশকে উন্নত করতে পারে। আবার অবনতিও করতে পারে। তাই শক্তিশালি ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আমাদের দেশে থাকলে আমরাও এগিয়ে যাবো।
ঢাকাটাইমস: আপনাকে ধন্যবাদ।
অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।