logo ২০ এপ্রিল ২০২৫
একক জবাবদিহিতামূলক কর্তৃপক্ষ না থাকায় জলজট
০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ১৯:০৩:১৭
image

একক জবাবদিহিতামূলক কর্তৃপক্ষ না থাকায় রাজধানী ঢাকা জলে ডুবছে বলে মনে করেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, এই মেগাসিটি ঢাকায় পানি ব্যবস্থাপনায় ১২/১৪টা সংস্থা কাজ করে।কারো কোনো জবাবদিহিতা নেই।নেই কোনো সমন্বয়ও। তাঁর প্রশ্ন-এরকম অব্যবস্থাপনা যেই সিটিতে থাকে সেটি জলে ডুববে না মধুতে ডুববে?


বৃহস্পতিবার তার কার্যালয়ে ঢাকার জলাবদ্ধতাসহ নানা বিষয় নিয়ে ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের মুখোমুখি হয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার নগরায়ণ ও সুশাসন-সংক্রান্ত কমিটির সম্পাদক। আলাপে ছিলেন মহিউদ্দিন মাহী।


ঢাকাটাইমস: দিন দিন ঢাকা বাস অযোগ্য হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে বৃষ্টি হলেই ঢাকার রাস্তায় পানি জমে যায়। ঐ দিনতো ৬০ মিলিলিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার পর ঢাকার অনেক স্থান কোমর পানিতে তালিয়ে তায়। এটা কেন?


ইকবাল হাবিব: আমাদের ঢাকার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভাল নয়। দীর্ঘদিনের অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অতিরিক্ত জনগোষ্ঠীর চাপ আর মুনাফালোভী ভূমি দুর্বৃত্তদের প্রবল পরাক্রমের কাছে ঢাকার অতীত সৌন্দর্য হারিয়ে গেছে।


 নানা সমস্যায় জর্জরিত ঢাকা এখন বসবাসের অযোগ্য নগরীতে পরিণত হয়েছে। জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে।


১৫০ মিলিলিটার বৃষ্টিপাত হলে স্বাভাবিক গতিতে পানি নিষ্কাশন হবে- এই পরিকল্পনায় আমাদের এগুতে হবে। সেই বিষয়টি আমরা ডিটেইল এরিয়া প্লানে বলেছিলাম। কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন হল না। ২০০৯ সালে সবচেয়ে বেশি- ৩৩৪ মিলিলিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল। এখন যদি সেরকম হয় তাহলে কি অবস্থা হবে- ভাবুন।


ঢাকাটাইমস: ডিটেইল এরিয়া প্লান নিয়ে এতো কাজ হলো এতো মিটিং-সিটিং হলো। কিন্তু আখেরে তা বাস্তবায়ন হল না, আপনিও তো এই প্লানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, সমস্যাটা কোথায়?


ইকবাল হাবিব:  ১৯৯৫ সালে প্রণীত ও গৃহিত ঢাকা মেট্রোপলিটন মাস্টার প্লানের অধীনে কাঠামো পরিকল্পনা ও স্বল্পমেয়াদী অঞ্চল পরিকল্পনা নীতিমালার ধারাবাহিকতায় ডিটেইল এরিয়া প্লান বাস্তবায়ন ১৩ বছরে করা যায়নি। মূলত জনসম্পৃক্ততা মূলক পরিকল্পনা প্রণয়নের অভাব ও উদাসীন মনোভাবের পাশাপাশি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বুঝে নেয়ার মত যোগ্য লোকবলের অভাবে এই প্রক্রিয়া প্রহসনে পরিণত হয়েছে।


ঢাকাটাইমস:  তার মানে ডিটেইল এরিয়া প্লানসহ আগেরকার পরিকল্পনা জনসম্পৃক্ততামূলক ছিল না?


ইকবাল হাবিব:  না সেটা না। দেখুন জনসম্পৃক্ততা মূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করলে সেটা নিয়ে কিন্তু মাঠে নামা যায়। জনগণকে নিয়ে ফাইট করা যায়। তা না হলে সেটা নিয়ে বেশি দূর এগুনো যায় না। ওই প্লানটাতে ছিল পানির লাইন সচল রাখার জন্য ৫ হাজার ৫০০ একর জমি। রিভার, ক্যানেলের জন্য ছিল ২০ হাজার একর। বন্যার পানি প্রবাহের জন্য ছিল ১৪ হাজার ৬৫০ একর জমি।কিন্তু সেগুলো তো মানা হল না।


ঢাকাটাইমস: এসব তো জনগুরুত্বপূর্ণ। কেন মানা হল না?


ইকবাল হাবিব:  এসব বাস্তবায়নের জন্য দরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক ভাবে দৃঢ় সিদ্ধান্ত না নিলে এসব বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কারণ আমরা যে পরিকল্পনা দিয়েছিলাম সেটা তো মানা হয়নি। উল্টো সারফেস ড্রেন, ওয়াটার ড্রেন, আন্ডার গ্রাউন্ট ড্রেন, খাল, ঝিল, ডোবা, নালা, জলাশয়, কঠিন বর্জ্য দিয়ে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এ কারণে এ নগরী ক্রমান্বয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। 


ঢাকাটাইমস: আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, সমস্যার কোনো শেষ নেই। তাহলে ঢাকাবাসীর জন্য কী কোনো আশার কথা নেই। আসলে আমাদেরকে কী করতে হবে, যদি বলতেন।


ইকবাল হাবিব:  প্রথম করণীয় হচ্ছে- এখন একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাজনৈতিক ডাক দিতে হবে। গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে- যাতে এ ধরনের কার্যক্রমে জনসম্পৃক্ততাকে বাধ্যতামূলক করা যায়। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে সবাই নেমে পড়বে। সকল ড্রেনেজ সিস্টেম পরিষ্কার করতে হবে। যাতে নদী পর্যন্ত পুরো লাইন ক্লিয়ার থাকে।


সকল খাল, বিল, ড্রেন, বক্স কালভার্ট, জলাভূমি সকল কিছু পরিষ্কার করে ঢাকার রাস্তাগুলোর সঙ্গে কানেকটিভিটির লাইন ক্লিয়ার রাখতে হবে। যাতে পানি সরল রেখায় প্রবাহিত হতে পারে। নদীয় পর্যন্ত এগুলো সচল রাখার সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।


দ্বিতীয় হচ্ছে- ঢাকার মেয়র এবং কাউন্সিলর যারা জনগণের মাধ্যমে নির্বাচিত তাদেরকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে মাঠে নামতে হবে। নেতৃত্ব দিতে হবে দুই মেয়রকে।


নগর পিতাদের প্রধান সমন্বয়ক ভূমিকায় রেখে একটি কার্যকর ‘ঢাকা মহানগরী ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা’ নেয়া খুব জরুরি। এ ক্ষেত্রে রাজউক, ওয়াসা, পাউবো ও জেলাপ্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টমহলগুলোর সমন্বয়ে ‘পেশাজীবী ও নাগরিক’ সমাজের সহযোগিতায় একটি জরুরি টাস্কফোর্স এর সূত্রপাত এখনই করতে হবে।


ঢাকাটাইমস: পানি নিষ্কাশনের জন্য আপনার বিশেষ কি সুপারিশ আছে?


ইকবাল হাবিব:  পানি নিষ্কাশনের জন্য চারটি পদক্ষেপ নেয়া যায়। প্রথমত. প্রাথমিক ড্রেনেজ সিস্টেমে পলিথিনসহ নির্মাণ শিল্প-বর্জ্য সরাসরি ফেলা দেয়ার চলমান ব্যবস্থা জরুরিভিত্তিতে বন্ধ করতে হবে। আংশিক উদ্ধারকৃত খাল ও জলাশয়সমূহকে কঠিন বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত করার সংস্কৃতি থেকে সরে এসে সারা বছর এদেরকে ‘সরল প্রবাহ ধারা’ হিসাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।


দ্বিতীয়ত. স্টর্ম ড্রেনেজ ব্যবস্থা, পাইপ, কালভার্টগুলোর সক্ষমতা পূর্ণ ব্যবহার ও সচল রাখতে হবে। ওয়াসার তথ্যানুযায়ী বর্তমানে সারা বছর গড়ে ড্রেনেজ ব্যবস্থার সম্পূর্ণ অংশের মাত্র ২০/২২ শতাংশ কার্যকর থাকে। জরুরিভাবে তা ৮০-১০০শতাংশে উন্নীত করতে হবে।


তৃতীয়ত. সকল বারিপাত ধারণ অঞ্চল জরুরি সংরক্ষণ ও ধারণ ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে অবশ্যই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পুকুর, খাল, জলাধার, বিল ও নিম্নাঞ্চলসহ সকল প্রাকৃতিক আধারগুলো এর মধ্যে পড়বে।


চতুর্থত. প্রকৃতিগত খালগুলোর ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে সচল রাখার নিরিখে সকল দখল অপসারণের নিত্য ব্যবস্থা রেখে এগুলোর পানি ধারণ ক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে হবে। ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া খালগুলোর বর্তমান বাস্তবতায় সংযোগ খাল তৈরি করে কার্যকর ও সক্ষম নিষ্কাশন ব্যবস্থা বা নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে।


ঢাকাটাইমস:  বাধের ফলে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এমন কথাও উঠছে।  


ইকবাল হাবিব: এটাও সত্য। অপরিকল্পিত বাধের ফলে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। আমরা জানি বাকল্যান্ড বাধ ও ডিএনডি বাধের কথা। এই বাধগুলো তৈরি করার সময় কিন্তু খেয়াল রাখার কথা ছিল যে- বাধের ভেতরে যে জলাশয় বা নিম্নাঞ্চল রয়েছে সেগুলোর যেন ভরাট না হয়। কিন্তু আমাদের এ অঞ্চলে কিন্তু সব জায়গাগুলো সমানে ভরাট করা হয়েছে। এজন্য কিন্তু ওই বাধ পেরিয়ে পানি বাইরে যেতে পারছে না। বাধের উদ্দেশ্য ছিল যাতে বন্যার পানি ভেতরে ঢুকতে না পারে। আবার বর্ষার মৌসুমে নদীর পানির লেভেল বেড়ে যাওয়ায় গ্রাভিটি ফ্লতে পানি নামতেও পারছে না। ফলে সমস্যা বাড়ছেই। এজন্য পাম্পিং করে পানি নামাতে হয়। এখন পাম্পিং করে আপনি কিভাবে পানি নামাবেন? যেখান থেকে পাম্পিং করবেন সেখানে তো পানি যেতে হবে। সেই যাওয়ার রাস্তাতো ক্লিয়ার রাখতে হবে। 


ঢাকাটাইমস:  আপনি হাতিরঝিল প্রকল্পের টিম লিডার ছিলেন। হাতিরঝিলের সঙ্গেও তো পানি প্রবাহের কানেকটিভিটি থাকতে পারে।


ইকবাল হাবিব:  হাতিরিঝিলে আগে মানুষ গন্ধে যেতে পারতো না। এখন দর্শনার্থীদের জন্য একটা প্রধান আকর্ষণ। এটা তো সম্ভব আমরাই করেছি। এখন আপনি যদি ঢাকার পানির লাইনগুলো যদি এই ঝিলের সঙ্গে সংযোগ ঘটান তাহলে কিন্তু সব আবর্জনা আর ময়লা এসে সেই আগের মতো গন্ধ তৈরি হবে। কারণ আমাদের ড্রেনের লাইনগুলোতে ময়লা ভরা। সেগুলো কিন্তু আলাদাভাবে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই।


ঢাকাটাইমস:  আলাদা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উপায় কী?


ইকবাল হাবিব:  বিষয়টি সহজ। আমরা সমন্বিত কর্তৃপক্ষের কথা বলেছি। সমন্বিত কর্তৃপক্ষ হলে এর মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ হবে আলাদা। আর পানি ব্যবস্থাপনা হবে আলাদা। কারো সঙ্গে সংঘর্ষ হবে না। এরপর যদি হাতিরঝিলে শুধু পানি আসে তাহলে তো কোনো সমস্যা নেই।


ঢাকাটাইমস: হাতিরঝিলের মতো আরও কি ঝিল হতে পারে?


ইকবাল হাবিব:  অবশ্যই। ঢাকার চলমান সংকট সমাধানে হাতিরঝিলের মতো আরও পাঁচটি ঝিল হতে পারে। এটি কিভাবে সম্ভব আমি ডিসিসির আলোচনা সভায় বলেছি। এটা কিন্তু স্বপ্ন নয়। এটা বাস্তবেই সম্ভব। ঢাকার মধ্যে সেই আগের তো নৌপথ তৈরি করতে হবে। তাহলে ঢাকা প্রাণ ফিরে পাবে। অনেক সমস্যার স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমাধান হবে।


ঢাকাটাইমস: নৌপথ চালু কিভাবে সম্ভব?


ইকবাল হাবিব:  আমরা যে হাতিরঝিল তৈরি করেছি। সেখানে খুব শিগগিরই নৌ চলাচল শুরু হবে। মগবাজার থেকে কেউ রামপুর বা গুলশান যেতে চাইলে সে নৌকায় যাবে। তাকে যানজট ঠেলে যেতে হবে না। এভাবে পুরো ঢাকাকেই এর আওতায় আনা সম্ভব। অসম্ভব বলতে কিছু নেই। শুধু জনসম্পৃক্তমূলক পরিকল্পনা করাই প্রধান কাজ।


(ঢাকাটাইমস/ ০৩ সেপ্টেম্বর /এমএম/ এআর/ ঘ.)