বোরহান উদ্দিন
দলীয় প্রতীকে পৌরসভা নির্বাচনের পক্ষে নয় বিএনপি। ভোট ১৫ দিন পেছাতে দলের দাবিও গ্রাহ্য করেনি নির্বাচন কমিশন। বিশেষ অভিযানের নামে দলের নেতা-কর্মীদেরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করছে অভিযোগ করে এই অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়- মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার আগে থেকেই বলে আসছেন নেতারা। তবে কোন দাবিই মানা হয়নি, এই অবস্থাতেও প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছে বিএনপি।
তবে কোন কোন পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থীদেরকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেয়া হয়নি-এমন অভিযোগও এসেছে দলটির কাছ থেকে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে অভিযোগ দিয়েও এসেছে দলটি।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর আওয়ামী লীগের অধীনে আর কোন নির্বাচনে যাবে কি না, এই প্রশ্নের মুখেই উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিএনপি। প্রথম দুই দফা ভোটে সরকার সমর্থকদের তুলনায় এগিয়ে থাকার পর তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ পর্বে পিছিয়ে পড়ে তারা। তবে পরের চার দফা ভোটে কারচুপির অভিযোগ তুলে ৩০টিরও বেশি উপজেলায় ভোটের দিন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন দল সমর্থিত প্রার্থীরা। একই দশা হয় ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। ভোটারদেরকে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়া, কেন্দ্র দখল করে নির্বাচনী এজেন্টদেরকে বের করে দেয়া আর সরকার সমর্থক প্রার্থীর পক্ষে সিল মারাসহ নানা অভিযোগ নিয়ে ভোট থেকে সরে দাঁড়ায় বিএনপি।
তবে এই দুটি নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হয়নি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একজন করে প্রার্থী সমর্থন দিলেও একেক জনের প্রতীক ছিল একেক রকম। তবে আইন সংশোধন করে এবার পৌরসভা নির্বাচন হচ্ছে দলীয় প্রতীকে। আর আগের মতো প্রার্থীকে সমর্থন না দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের মতোই মনোনয়ন দিয়েছে দলগুলো। বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার ঘোষণাও এসেছে। ফলে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের মতোই আবার দেশের দুই শতাধিক পৌর শহরে নৌকা ও ধানের শীষ প্রতীকের ‘যুদ্ধ’ শুরু হয়ে গেছে।
এখন চলছে কথার লড়াই। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে প্রচার, ১৪ ডিসেম্বর প্রতীক পাওয়ার পর শুরু হবে পুরোদমে ভোটারদের কাছে টানার প্রতিযোগিতা। রাজনৈতিক বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা এখন পর্যন্ত প্রচারে এগিয়ে আছেন। তবে বিরোধী দল বিএনপির প্রার্থীরা এখন পর্যন্ত অনেকটাই হাত গুটিয়ে বসে। নানা অভিযোগ, আর কেন্দ্র থেকে ‘সুষ্ঠু ভোট হলে আমরাই জিতবো’- এমন বক্তব্যই আসছে।
প্রতীক বরাদ্দের পর পরিস্থিতি পাল্টে যাবে, বলছেন বিএনপির নেতারাই। দলের প্রার্থীদের জিতিয়ে আনতে প্রচারে নামতে ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় নেতারাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এককভাবে প্রার্থী দিলেও জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার চেষ্টাও থেমে নেই।
তারপরও প্রশ্ন উঠেছে-শেষ পর্যন্ত বিএনপি ভোটে থাকবে তো? দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এরই মধ্যে বলেছেন, প্রসহনের নির্বাচন হচ্ছে পৌরসভায়। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেই। পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান গ্রেপ্তার অভিযান নিয়েও আপত্তি আছে দলটির।
মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ এবং বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকেই সারাদেশে নাশকতার জড়িত অভিযোগে অন্তত এক হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদের একটি বড় অংশই বিএনপি-জামায়াতের কর্মী। বিএনপির অভিযোগ এই সংখ্যাটি পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে। আর নাশকতা ঠেকানো নয়- নির্বাচনে বিএনপি যেন প্রচার চালাতে না পারে- ভোটের দিন কেন্দ্রে যেন কর্মীরা অবস্থান করতে না পারে, সে জন্যই এই অভিযান চলছে-এমন অভিযোগও করছেন দলটির নেতারা।
বিএনপির ভোট বর্জনের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়
তবে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো বা শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যাওয়া- কোন কিছুই এখন বলা কঠিন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এরই মধ্যে ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন যে, রাজনৈতিক কৌশলের কারণে ভোট থেকে সরেও দাঁড়াতে পারে তার দল। সে কৌশল কী এবং কেন তা নেয়া হবে- সে কারণ অবশ্য স্পষ্ট করেননি তিনি।
তবে ফখরুলের এই বক্তব্যের কারণেই বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে সংশয়। বিএনপির ভাষায় যদি এটা ‘প্রহসনের নির্বাচন’ই হয়, তাহলে সেখানে কেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে- সে প্রশ্নও আছে আরও কারও মনে।
তবে ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতা ভালো নয় বিএনপির জন্য। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতসহ বেশ কিছু দলের বর্জনের মুখে ভোট করে দুই সপ্তাহও ক্ষমতায় টিকতে পারেনি বিএনপি। ২০০৭ সালে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং বামপন্থি দলের বর্জনের ঘোষণার পর উদ্ভুত পরিস্থিতিতে নির্বাচনই হয়নি। এই অভিজ্ঞতা থেকে বিএনপি মনে করেছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোট তারা এবং তাদের জোটের শরিক এবং আরও কিছু দল বর্জন করলে আওয়ামী লীগও একই ধরনের কোনঠাসা অবস্থায় পড়বে।
বিএনপি-জামায়াত জোট কেবল ভোট বর্জন নয়, প্রতিহতের ঘোষণাও দিয়েছিল। লাগাতার অবরোধ আর ভোটের আগেই কেন্দ্রে হামলা, ভোটের দিন ভোটারদেরকে কেন্দ্র যেতে বাধা, ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের পরও নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হয় বিএনপি। আর সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের পর বিএনপির যে পরিণতি হয়েছিল, আওয়ামী লীগেরও একই পরিণতি হবে, বিশ্বাস ছিল ২০ দলের। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার গত প্রায় দুই বছরে নিজেদের অবস্থান সংহত করেছে আর এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর আন্দোলনে নেমে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি।
এই অবস্থায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করা আদৌ উচিত হয়েছে কি না-আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়েছে বিএনপিতেই। এই পরিস্থিতিতে যতই বিরুদ্ধ পরিবেশ হোক- পৌর নির্বাচনের ভোট বর্জন দলকে আরও নাজুক অবস্থানে ফেলবে কি না- সে কথাও উঠেছে দলে। তাই এবার তাড়াহুড়োর বদলে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে চান নেতারা।
আগামী ৩০ ডিসেম্বর দেশের ২৩৫টি পৌরসভায় নির্বাচনে ভোট হবে। জোটের শরিকদের দুটি বাদে বাকি পৌরসভায় প্রার্থী দিয়েছে বিএনপি। ১১টি পৌরসভায় তাদের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে। যদিও তারা প্রার্থিতা ফিরে পেতে নির্বাচন কমিশনে আপিল করেছেন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ভোট থেকে সরেও দাঁড়াতে পারেন প্রার্থীরা। মির্জা ফখরুলের এমন বক্তব্য দেয়ার উদ্দেশ্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে চাপে রেখে কিছু দাবি আদায়। আবার কোনো কারণে ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত হলে তা বাস্তবায়ন নিয়ে খোদ বিএনপিতেই শঙ্কা আছে। কারণ তিন সিটিতে মাত্র তিনজন প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু ২৩৫টি পৌরসভায় সমসংখ্যক প্রার্থীকে ভোটবর্জনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে রাজি করানো অসম্ভব বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত বিএনপির এক নেতার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে এই সময়কে তিনি বলেন, ‘দেখা যাক শেষ পর্যন্ত সরকার ও ইসির আচরণ কোথায় গিয়ে থামে। তবে এখন পর্যন্ত নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর কোনো কারণ নেই।’
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে তো ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর চিন্তুা করতেই হতে পারে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন দলের চেয়ারপারসন।’
গ্রেপ্তার অভিযান নিয়েই যত দুশ্চিন্তা
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকানো আর সরকারের এক বছর পূর্তির পর সরকার পতনের আন্দোলনে নাশকতার দায়ে বিএনপির শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যায়ের হাজারো নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও হয়েছে একাধিক মামলা। এসব মামলায় মির্জা ফখরুল কয়েক দফা জেল খেটে জামিনে বের হয়েছেন। দলের মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী আহমেদও দীর্ঘদিন ছিলেন কারাগারে। এ ছাড়া নীতি নির্ধারণী বহু নেতা মামলার কারণে নিজেদেরকে গুটিয়ে রেখেছেন।
এই অবস্থায় সাম্প্রতিক গ্রেপ্তার অভিযান নিয়ে চিন্তিত বিএনপি। দলটির অভিযোগ, তৃণমূল পর্যায়ে সক্রিয় নেতা-কর্মীরা যেন এলাকায় থাকতে না পারে সে জন্যই পুলিশ তাদেরকে নাজেহাল করছে। কেবল কর্মীরা নয়, বিএনপি মেয়র পদে যাদেরকে মনোনয়ন দিয়েছে তাদের কেউ কেউ নাশকতার মামলায় কারাগারে আছেন। পলাতক আছেন ৩০ জনেরও বেশি প্রার্থী।
বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, বিভিন্ন বাহিনীর অভিযানে গত এক মাসে বিএনপির পাঁচ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ফলে সারাদেশে দল ও জোটের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মাঝে ভীতি ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এরই মধ্যে খালেদা জিয়া কয়েকদফা বিবৃতি দিয়ে সারাদেশের ধরপাকড় বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।
চিন্তা ‘পোলিং এজেন্ট’ নিয়েও
ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বেশ কিছু কেন্দ্র দখল, জালভোট, বিরোধী প্রার্থীর এজেন্টকে বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটে। বিএনপি আগে থেকেই এমন অভিযোগ করে আসছিল। তবে ভোটের দিন এসব মোকাবেলায় বিএনপির কোনো প্রস্তুতি ছিল না।
শুধু তাই নয়, অনেক কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টও দিতে ব্যর্থ হয় বিএনপি। পৌরসভা নির্বাচনে এমন সমস্যায় পড়তে হতে পারে, এই বিষয়টিও দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে ভাবিয়ে তুলছে।
বিএনপির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপনের দাবি, ‘সম্ভাব্য পোলিং এজেন্ট, এবং নির্বাচনী প্রচারণার কর্মী-সমর্থকদের বড় একটি অংশই এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। অন্যরাও জুলুম-নির্যাতনের আশঙ্কায় এলাকাছাড়া হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে।’
(ঢাকাটাইমস/১০ডিসেম্বর/বিইউ/জেডএ)