logo ২২ এপ্রিল ২০২৫
পথে পথে বাধায় বিএনপির মাঠে থাকা দায়!
২২ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:১৪:১০
image


বোরহান উদ্দিন

ঢাকা: রাজনীতির মারপ্যাঁচে বেকায়দায় পড়া বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় হিসেবে দেখছে পৌরসভা নির্বাচন। এ জন্য ‘কৌশলগত কারণে বিএনপি নির্বাচন থেকে সরেও দাঁড়াতে পারে’ এমন ঘোষণা দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে ঘোষণা এসেছে, ‘নির্বাচনের মাঝপথ থেকে সরে আসার প্রশ্নই আসে না।’ তবে তফসিল ঘোষণার পর থেকে নানামুখী বাধায় পড়েছে বিএনপি। পথে পথে বাধা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা যাবে কি না তা নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে শঙ্কা আছে।

শুরুতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমা দেওয়ার ক্ষেত্রেই কোনো কোনো পৌরসভায় বাধার মুখে পড়তে হয়েছে বিএনপির প্রার্থীদের। হুমকির মুখে বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থী মনোনয়ন তুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন বলেও অভিযোগ করছে দলটি। এখন দেশের বিভিন্নস্থানে গণগ্রেপ্তার, প্রার্থীদের ভয়ভীতি দেখানো, প্রচারে হামলা-হুমকির অভিযোগ করছেন নেতারা। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ তো আছেই।তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা নির্ভয়ে প্রচারে নামতে না পারায় কেন্দ্র গঠিত নির্বাচন মনিটরিং টিমের সদস্যরা এখনো এলাকায় যাওয়া শুরু করেননি। এছাড়া বিদ্রোহী প্রার্থীরাও বিএনপির জন্য দুশ্চিন্তার কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।

গত উপজেলা নির্বাচন এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগেও এসব নানা অভিযোগ তুলেছিল বিএনপি। তিন সিটি এবং বেশ কিছু উপজেলায় ভোটের দিন নির্বাচন থেকে সরেও দাঁড়ায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা। তবে পৌর নির্বাচনে ফলাফল ঘোষণার আগ পর্যন্ত নেতা-কর্মীদের মাঠে থাকার আহ্বান জানিয়েছে দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘আমরা জানি সরকার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো আচরণ করবে। তবুও এবার শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। কারণ মোটামুটি সুষ্ঠু ভোট হলে বিএনপির বেশিরভাগ প্রার্থীই জিতবে। আর ভোট বর্জন করলে সবই আওয়ামী লীগ দখল করে নেবে।’

গণগ্রেপ্তার ও হামলাই মূল শঙ্কা!

বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির চূড়ান্ত রায় ঘোষণার পর থেকে সারা দেশে শুরু হওয়া গ্রেপ্তার অভিযান চলছে এখনও।

পুলিশের দাবি, নাশকতার সঙ্গে জড়িত এবং বিভিন্ন মামলার আসামিদের পাকড়াওয়ে এই অভিযানে নেমেছেন তারা। আটককৃতরা সবাই নাশকতাসহ বিভিন্ন মামলার আসামি বলেও জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তবে গ্রেপ্তারের তালিকায় থাকাদের একটি বড় অংশই বিএনপি-জামায়াতের তৃণমূলের কর্মী। এ কারণেই বিএনপি বলছে, নির্বাচনে যেন তাদের প্রার্থীরা নির্ভয়ে প্রচারণা চালাতে না পারেন, সে জন্যই এই গ্রেপ্তার অভিযান শুরু হয়েছে। অভিযানে এখন পর্যন্ত প্রায় দশ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি বিএনপির।

গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত থাকায় পৌর নির্বাচনের স্বতঃস্ফূর্ততায় ভাটা পড়েছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। বিএনপির দাবি, অভিযান অব্যাহত থাকায় দেড় শতাধিক পৌরসভায় অনেকটা একতরফাভাবে চলছে প্রচার-প্রচারণা। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা যেখানে পোস্টার-ব্যানারে পুরো নির্বাচনী এলাকা ছেয়ে ফেলেছেন, সেখানে বিএনপির প্রার্থীরা মাঠে নামারই সাহস পাচ্ছেন না। বিভিন্নস্থানে প্রার্থীদের ব্যানার-পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করছে বিএনপি।

কেবল গ্রেপ্তার অভিযান নয়, বিভিন্নস্থানে বিএনপি সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী ও সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগও পাওয়া গেছে। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিন নোয়াখালীর চাটখিলে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীকে অপহরণ করে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাধ্য করার অভিযোগ করেছে বিএনপি। গত সপ্তাহে ঝিনাইদহের হরিণাকু-ুতে প্রচারণা চলাকালে বিএনপির মেয়র প্রার্থী জিন্নাতুল হকের ওপর সরকারি দল সমর্থকরা হামলা করেন বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। ১৩ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জে প্রচারণা চলাকালে বিএনপির প্রার্থী এ কে এম ইরাদত মানুসহ ১০ জন আহত হন। এর জন্যও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অভিযুক্ত করছে বিএনপি।

হামলা হয়েছে মনোহরদী পৌরসভার বিএনপির প্রার্থীর দুই সমর্থকের ওপর। স্থানীয় ছাত্রলীগ কর্মীরা তাদের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয় বলে অভিযোগ করছে ভুক্তভোগীরা। নোয়াখালীর চৌমুহনীতে বিএনপির প্রার্থী হারুন উর রশিদের ওপর ককটেল হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এতে প্রার্থী অক্ষত থাকলেও আহত হয়েছেন তিনজন। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে উপজেলার চৌমুহনী পৌরসভা নির্বাচনে প্রতিপক্ষ প্রার্থীর কর্মীরা বিএনপির মেয়র প্রার্থীর ওপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ আছে। এ সময় গুলির ঘটনাও ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ধানের শীষ প্রতীকের পক্ষে প্রার্থী জহির উদ্দিন হারুনের উপস্থিতিতে চৌমুহনী হাজিপুর নবদিগন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কর্মীদের নিয়ে উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। হঠাৎ হামলা হয় সেখানে। বরগুনার পাথরঘাটা পৌরসভায় গণসংযোগকালে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মল্লিক মোহাম্মদ আইউবের প্রচারে হামলা হয়। এসব প্রতিটি ঘটনাতেই বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করা হয়েছে। কমিশন ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেও বিএনপি তাতে নির্ভয় হতে পারছে না। কারণ এখন পর্যন্ত কমিশন বলার মতো কোনো পদক্ষেপই নিতে পারেনি।

১০৯ প্রার্থী মামলার আসামি

২৩৪টি পৌরসভার মধ্যে বিএনপির মেয়র প্রার্থী আছে ২২৪টিতে। বাকি ১০টির মধ্যে ৯টিতে প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে যাচাই-বাছাইয়ে আর একটিতে বিএনপির প্রার্থীই সরে দাঁড়িয়েছেন ভোট থেকে। বিএনপির প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১০৯ জনের বিরুদ্ধে নাশকতাসহ বিভিন্ন মামলা আছে। ২৭ জনের বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল কিন্তু তার সুরাহা হয়ে গেছে। বাকিদের বিরুদ্ধে কখনও কোনো মামলা হয়নি।

মামলা থাকা প্রার্থীদের মধ্যে হত্যা বা হত্যাচেষ্টার মামলা আছে ১৬ জনের বিরুদ্ধে। একজন একটি হত্যা মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা আছে কয়েকজনের বিরুদ্ধে। তবে বেশির ভাগের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক, সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত থাকা, নাশকতার কারণে মামলা হয়েছে। ৩৪ জনের বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নাশকতার অভিযোগে মামলা হয়েছে। এই মামলাগুলো বিচারাধীন আছে। এসব মামলার কারণে অনেক প্রার্থীই ফেরার। এই অবস্থায় নিজে নির্বাচনী মাঠে না থাকলে সর্মথকদের পক্ষে প্রচার চালিয়ে যাওয়া কতটা সহজ হবে তা নিয়ে সংশয়ে স্বয়ং বিএনপি নেতারাই।

বিএনপি-বিএনপিতে লড়াই

আওয়ামী লীগের মতো কঠোর হয়ে দল থেকে বহিষ্কার না করলেও বিদ্রোহী প্রার্থীদের বাগে আনতে অনেক চেষ্টা করেছে বিএনপি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব বিদ্রোহীকে বসাতে পারেনি বিএনপি। সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থতার পর দল বিপাকে থাকা অবস্থাতেও স্থানীয় নেতা-কর্মীরা একজোট হতে পারেননি। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব- রেষারেষির কারণে দলের প্রার্থীকেই চ্যালেঞ্জ করেছেন কেউ কেউ। আবার কোথাও কোথাও বিএনপি মনোনীত প্রার্থী প্রচারে নামতে না পারলেও বিদ্রোহীরা ঠিকই নির্বাচনী মাঠে সক্রিয়। আর এই ভোট ভাগাভাগির সুযোগ নেবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। শেষ পর্যন্ত বিএনপির প্রার্থী যেসব বিদ্রোহীকে মোকাবেলা করতে হবে তারা হলেন নারায়ণগঞ্জের তারাবতে শফিকুল ইসলাম, নরসিংদীর মনোহরদীতে আবদুল খালেক, টাঙ্গাইলের সখিপুরে ছানোয়ার হোসেন সজীব, কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে আনোয়ার আলী মৃধা রতন।

ময়মনসিংহের ভালুকায় মফিজ উদ্দিন সরকার, ফুলবাড়ীয়ায় চাঁন মাহমুদ, শেরপুরের শ্রীবরদীতে আবু রায়হান আল বিরুনী, জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে রহুল আমিন সেলিম ও শহিদুল ইসলাম। রাজশাহীর নওহাটায় রফিকুল ইসলাম, কাটাখালীতে সিরাজুল ইসলাম, তানোরে ফিরোজ সরকার, চারঘাটে কায়েম উদ্দিন ও আড়ানীতে নজরুল ইসলাম, বগুড়ার নন্দিগ্রামে আবুল কাশেম ও কামরুল হাসান জুয়েল, শিবগঞ্জে তাজুল ইসলাম, জয়পুরহাটের কালাইয়ে আনিসুর রহমান তালুকদার, চাঁপাইনবাবগঞ্জে আবদুল মতিন, পাবনা সদরে কামরুল হাসান মিন্টু, সুজানগরে কামাল হোসেন বিশ্বাস, সাঁথিয়ায় সাইফুল ইসলাম ও আশিক ইকবাল রাসেল, চাটমোহরে আবদুল মান্নান।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে হাসিন আফরোজ চৌধুরী ও জাকারিয়া হাবিব বিপ্লব, বড়লেখায় মতিউর রহমান ইরাজ, হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে আবদুল মজিদ বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দল মনোনীত নেতাকে চ্যালেঞ্জ করছেন। পটিয়ায় মোহাম্মদ ইব্রাহিম, রাঙামাটি সদরে রবিউল আলম রবি, কুমিল্লার দাউদকান্দিতে নুরুল আমিন সরকার নাঈম, হোমনায় হানিফ মিয়া ও আলমগীর সরকার, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে হেলাল উদ্দিন মজুমদার বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। এ ছাড়া যশোরের বাঘারপাড়ায় বিএনপির দলীয় প্রার্থীর বিপরীতে প্রার্থী হয়েছেন আবু তাহের সিদ্দিক।

তৎপরতা নেই মনিটরিং টিমের

নানা ধরনের শঙ্কা থাকলেও পৌর নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও প্রচারণায় আটটি বিভাগীয় দলসহ ১১টি দল গঠন করেছে বিএনপি। এর মধ্যে তিনটি কেন্দ্রীয় দল কৌশল নির্ধারণ, প্রচার ও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব পালন করবে। গত ১২ ডিসেম্বর দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে এ বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। বৈঠক সূত্র জানায়, খালেদা জিয়া জ্যেষ্ঠ নেতাদের স্পষ্ট বলেছেন, তিনি এ নির্বাচনে তাদের কাজ দেখতে চান।

বিএনপির পৌর নির্বাচন মনিটরিং সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নেতা জানান, ‘প্রতিটি দলের সদস্যদের দায়িত্ব ও নির্দেশনাসহ চিঠি দেওয়া হচ্ছে। তবে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে মাঠে নামেনি কোনো দল।’ বিজয় দিবসের পর কেন্দ্রীয় নেতারা সক্রিয়ভাবে নির্বাচনের মাঠে নামার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত সেভাবে নামতে পারেননি তারা। কথা ছিল নেতারা নিজ নিজ এলাকায় প্রচারে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি ছোটখাটো বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে জোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা-সমন্বয় করে মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে ভূমিকা রাখার কথা ছিল নেতাদের।-সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।