চট্টগ্রাম ব্যুরো: প্রায় ৩০০ বছর আগে নির্যাতিত বিদ্রোহীদের হাতে পর্তুগিজদের আধিপত্যের পতন হয়েছিল যেখানে, ঠিক সেই চট্টগ্রাম ও মহসিন কলেজে গতকাল বুধবার জামায়াতের সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের পতন দেখেছে চট্টগ্রামবাসী।
আর এ পতন ঘটিয়েছে ছাত্রলীগ। দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় পর ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো পূর্ণ শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছিল। তাদের শক্তিমত্তা দেখে দখলদারিত্ব ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে ছাত্রশিবির।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কলেজ ক্যাম্পাসে বিজয় দিবস পালনকে কেন্দ্র করে বুধবার দুপুরে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবির সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পরে পুলিশ এসে ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্রশিবির নেতাকর্মীদের মারধর ও ধরপাকড় শুরু করে।
সংঘাতের পর চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) দুপুরে অভিযানে নামে। এতে ছাত্রশিবিরের দখলে থাকা ছাত্রাবাসগুলোতে শিবিরের কোন কর্মী ছিল না বলে জানান নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য।
তবে কলেজ থেকে ছাত্রশিবির সন্দেহে ৬৬ শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশ। উদ্ধার করে অস্ত্র ও গোরাবারুদ। এ ঘটনায় চিহ্নিত অন্তত ১১৩ ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে পুলিশ। পুলিশ ছাত্রশিবিরের পলাতক আসামিদের ধরার জন্য চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসিন কলেজসহ আশপাশে বৃহস্পতিবারও অভিযান চালায়।
চট্টগ্রাম ও মহসিন কলেজ সূত্র জানায়, সংঘর্ষের পর শিবির অধ্যূষিত চট্টগ্রাম কলেজের চারটি এবং মহসিন কলেজের দুটি ছাত্রাবাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সকল ছাত্র-ছাত্রী এসব ছাত্রাবাস ছেড়ে চলে যাওয়ায় পরিস্থিতি এখন শান্ত রয়েছে।
সংঘাতের সূত্রপাত সম্পর্কে জানতে চাইলে নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি জানান, কলেজে বিজয় দিবসের শ্রদ্ধা জানানোর সময় বোমা নিক্ষেপ করে ছাত্রশিবির। এ সময় শিবিরের ক্যাডাররা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আত্মরক্ষায় মহসিন কলেজের সামনে আসলে সেখানেও মহসিন কলেজের শিবির ক্যাডাররা হামলা চালায়। পরে পুলিশ এসে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের রক্ষা করে।
পরে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা জড়ো হয়ে ছাত্রশিবির কর্মীদের তাড়া করে। এক পর্যায়ে নিজেদের রক্ষায় পিছু হটে ছাত্রশিবির। ছাত্রলীগের কয়েকশ কর্মী একযোগে চট্টগ্রাম কলেজের ভেতরে ফটক ভেঙে ঢুকে পড়লে ছাত্রবাস ছেড়ে পালায় ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা।
কিন্তু চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রশিবিরের সভাপতি নুরুল আমিন বলেন অন্য কথা। তিনি বলেন, ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে মারার অভিযোগ অজুহাত মাত্র। এ ধরনের কোন কাজে শিবির জড়িত নয়। এমনকি সংঘাতের আগে সাধারণ মানুষ বোমার শব্দ শুনেছে সেটাও বলতে পারবে না।
বরং ছাত্রলীগ ও পুলিশ পরিকল্পিতভাবে ছাত্রশিবিরের উপর হামলা চালিয়েছে। চট্টগ্রাম কলেজ দখলের লক্ষ্যে ছাত্রলীগ এ হামলা চালিয়েছে। সংঘাত এড়াতে ছাত্রশিবির ছাত্রাবাস ছেড়ে চলে যায় জানিয়ে তিনি বলেন, এ হামলার ষড়যন্ত্রে যারাই জড়িত খাকুক না কেন, তাদের সময়োচিত জবাব দেয়া হবে।
ছাত্রশিবিরের উত্থান:
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আশির দশক পর্যন্ত চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ প্রগতিশীল শক্তির ঘাঁটি ছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালে সুযোগ পেয়ে চট্টগ্রাম কলেজে রাজনীতি শুরু করে ছাত্রশিবির। তখন থেকে অশান্ত হয়ে উঠে চট্টগ্রাম ও মহসিন কলেজ।
চট্টগ্রাম মহনগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন জানান, ১৯৮১ সালের চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের এজিএস ও ছাত্রলীগ নেতা তবারক হোসেনকে শিবিরের ক্যাডাররা নির্মমভাবে হত্যা করে। শিবিরের অস্ত্রবাজিতে আর খুনের রাজনীতিতে ছাত্রলীগ, বাকশালপন্থী জাতীয় ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়নের কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত করে তোলে। ১৯৮৪ সালে রাতের আঁধারে হোস্টেলে দু‘জন মেধাবী ছাত্রকেও জবাই করে খুন করে শিবির।
সেই থেকে চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়। কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয় প্রগতিশীল শক্তি। নিয়ন্ত্রণ নেয় শিবির। হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজও শিবিরের দখলে চলে যায়। এরপর ছাত্রলীগ কিংবা অন্যান্য নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠনগুলো কখনোই আর চট্টগ্রাম কলেজের ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারেনি।
সূজন বলেন, ১৬১৬ সালে পর্তুগিজরা এই মহসিন কলেজে দুর্গ গড়ে তোলে আধিপত্য বিস্তার করে। সেখান থেকে তারা প্রজাদের উপর নির্যাতন চালাতো। নির্যাতিত মানুষের হাতেই এক সময় তাদের পতন ঘটে। একইভাবে পাকিস্তানের দোসর জামায়াত ইসলামীর সহযোগী সংগঠন ছাত্রশিবিরের পতন হয় গতকাল বুধবার।
ছাত্রলীগের সফলতা আসে যেভাবে: ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়। এরপর অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ক্যাম্পাসে রাজনীতি করে আসছে ছাত্রলীগ। এরমধ্যেও বারবার শিবিরের কাছ থেকে বাধা পেয়েছে। ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন কর্মী শিবিরের হামলার শিকার হয়েছে।
এরপর থেকে ছাত্রশিবিরের দুর্গ ভাঙতে চট্টগ্রাম কলেজের সব ছাত্রাবাস বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে। এ প্রসঙ্গে নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুল আজিম রনি বলেন, ছাত্রাবাসগুলোতে কোন বৈধ ছাত্র থাকে না। মহসিন কলেজে মেয়েদের হোস্টেলে ছেলেরা থাকে। হোস্টেলগুলো একেকটা অবৈধ অস্ত্র আর সন্ত্রাসী-জঙ্গিদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, গত ৫ বছরে এসব ছাত্রাবাসে পুলিশ একাধিকবার অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে প্রমাণ করে জঙ্গি আস্তানার। আমরা সেগুলো বন্ধের দাবি জানাচ্ছি। আমরা ক্যাম্পাসে সব ছাত্র সংগঠনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চাই। শিক্ষকদের শিক্ষা শান্তি ঐক্য আর প্রগতির পক্ষে অবস্থান নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।
ছাত্রাবাস বন্ধের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক জেসমিন আক্তার বলেন, ছাত্রাবাস বন্ধে একাডেমিক কাউন্সিলকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমার একার সিদ্ধান্তে ছাত্রবাস বন্ধ করার কোন এখতেয়ার নেই। আর পুলিশ চাইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে ব্যবস্থা নিতে পারে। পুলিশ তা নিচ্ছে না কেন?
আবদুল জলিল মন্ডলের বক্তব্য: চট্টগ্রাম ও হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে ছাত্রশিবিরের অপরাজনীতি সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার আবদুল জলিল মন্ডল ঢাকাটাইমসকে বলেন, ছাত্রশিবিরের সশস্ত্র রাজনীতির কারণে চট্টগ্রাম কলেজে সবসময় অশান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করে। এ কলেজে পুলিশ বছরে দুই-তিনবার অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করে। এরপরও শিবিরের ত্রাস কমে না।
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কলেজ কর্তৃপক্ষের যথাযথ সহযোগিতার অভাবে ছাত্রশিবিরের অপতৎপরতা বন্ধ করা যাচ্ছে না। কলেজ ছাত্রাবাস বন্ধেও তো কলেজ কর্তৃপক্ষের সহযোগিতার প্রয়োজন। অস্ত্রের ঝনঝনানি সত্ত্বেও কলেজ কর্তৃপক্ষ তো কোন সময় আইন-শৃঙ্খলার অবনতির কথা বলে তা রক্ষায় পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা চাইনি। এ অবস্থায় পুলিশ প্রশাসন, কি ব্যবস্থা নিতে পারেন।
(ঢাকাটাইমস/১৭ডিসেম্বর /আইকে/এআর/ঘ.)