তখনও প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি। চলছিল দরপত্র মূল্যায়ন ও চূড়ান্ত পর্ব। সব ঠিকঠাক। কিন্তু কোটি কোটি বাঙালির ভাগ্যাকাশে সিঁদুরে মেঘ এনেছিল বিশ্বব্যাংক। প্রকল্প শুরুর আগেই দুর্নীতি- ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে ঋণচুক্তি থেকে পিছু হটেছিল আন্তর্জাতিক এই দাতা সংস্থা। একই পথ ধরে সরে গিয়েছিল জাইকা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক। কোটি কোটি মনে যখন পদ্মাসেতুর স্বপ্ন, তখন দাতাদের দূরে সরে যাওয়ায় হোঁচট খেতে হয়েছিল সরকারকে। তবে ঘুরে দাঁড়াতে খুব সময় লাগেনি। আর সময় লাগেনি বিশ্বব্যাংকের ভোল পাল্টাতেও। যেই বিশ্বব্যাংকের ‘ভিত্তিহীন’ অভিযোগে বাঙালির স্বপ্ন ভেঙে চৌচির হওয়ার দশা হয়েছিল, সেই সংস্থারই সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু কদিন আগে ঢাকায় বলে গেলেন, ‘নিজের ওপর ভরসা করে পদ্মাসেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে সক্ষমতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। ১০ বছর আগে হলে এটা ভাবা যেত না। তখন ভাবা হতো, এত বিদেশি মুদ্রা কোথায় পাব? এখন একটি স্বাস্থ্যবান বৈদেশিক মুদ্রার মজুত আছে।’
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বললেন, ‘অতীতে যাই হোক না কেন, এর ফলাফল খুব ভালো। এর একটি খারাপ ইতিহাস রয়েছে, তবে চূড়ান্তভাবে ফলাফলটা ভালো। বাংলাদেশ এখন অনেক ম্যাচিউর।’ দিনটি ছিল ১৫ ডিসেম্বর। বিজয় দিবসের একদিন আগে বিশ্বব্যাংকের বড় কর্তার এমন মন্তব্য জাতি হিসেবে বাঙালির আরেকটি বিজয়ই বলতে হবে। সত্যিই বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রমাণ পেয়েছেন কৌশিক বসু। ২০১৮ সালের মধ্যে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পদ্মাসেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা। এই সেতু হয়ে গেলে ঢাকাসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে যুক্ত হবে দক্ষিণ জনপদ। এই সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেনও চলবে। এশিয়ান হাইওয়ের রুট হিসেবেও এই সেতু ব্যবহার করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুর মূল কাজ উদ্বোধন করতে গিয়ে গত ১২ ডিসেম্বর সেই স্বপ্নের কথাই শুনিয়েছেন পদ্মাপারের মানুষকে। তিনি বলেছেন, ‘এই সেতু হলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে। মানুষের আর্থিক উন্নয়ন হবে। কর্মসংস্থান হবে। নতুন স্যাটেলাইট শহর গড়ে উঠবে। পদ্মার দুই পারে শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষের দুঃখকষ্ট থাকবে না।’ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তার আশ্বাস সরিয়ে নেওয়ার পর পদ্মাসেতু অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। কয়েক বছরের ব্যবধানে সেই অনিশ্চয়তা কেটেছে। বিশ্বব্যাংকও বুঝতে পেরেছে তাদের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না।’ তিনি বলেন, ‘পদ্মাসেতু হলে দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে। বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তির সক্ষমতা প্রমাণ মিলবে।’
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ বিশ্বব্যাংকের জন্য চপেটাঘাত বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘যেই বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতুতে অর্থায়ন করেনি, তাদেরই প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি উড়াল দেওয়ার পূর্বক্ষণে আছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা দেশের উদীয়মান অর্থনীতিকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাচ্ছি।’ হাছান মাহমুদ বলেন, ‘পদ্মাসেতুর নির্মাণকাজ শুরু হওয়ায় বিশ্বব্যাংক লজ্জা পেয়েছে। লজ্জা পেয়েছেন তারাও, যারা বিশ্বব্যাংককে অর্থায়ন না করতে প্ররোচিত করেছিল।’ তিনি বলেন, এটা বিশ্বব্যাংকের জন্য চপেটাঘাত বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। তোমরা টাকা দাওনি, আমরা নিজেদের টাকায় শুরু করে দিয়েছি।’ স্বপ্ন ছিল। শুধু দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার নয়, সারাদেশের মানুষেরই। পদ্মা নদীর ওপরে হবে সেতু। সেই সেতু বেয়ে মুহূর্তেই যাওয়া যাবে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে। শুধু মানুষই নয়, অর্থনীতিও এগিয়ে যাবে সেতু পেরিয়ে। জীবনযাত্রায় মান বাড়বে। রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়বে নদী অঞ্চলের মানুষের। সুযোগ সুবিধা বাড়বে শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা খাতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করে ফেরি পারাপারের ভোগান্তি লাঘবের রঙিন স্বপ্ন বহুদিন থেকেই দেখছে পদ্মার ওপারের মানুষ।
স্বপ্ন পূরণের পথে এসেছে অনেক বাধা। হতে গিয়ে শুরু হয়নি কাজ। অর্থ ঋণ, কারিগরি সহায়তা দিয়ে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে শেষ মুহূর্তে পিছু হটেছে বিশ্বব্যাংক, জাইকার মতো আন্তর্জাতিক দাতা গোষ্ঠী। দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের রোদে মুহূর্তেই এসে জড়ো হয়েছিল মেঘ। অভিযোগ ছিল, দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে। শুরুর আগেই প্রকল্পে দুর্নীতির সম্ভাবনা নাকি দেখতে পেয়েছিল বিশ্বব্যাংক! কিন্তু কী সেই দুর্নীতি? আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা হয়েছে এ নিয়ে। আদালত তথ্য-প্রমাণ তলব করেছে বিশ্বব্যাংকের কাছে। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে কোনো জবাব দিতে পারেনি বিশ্বব্যাংক। বরং সময় বাড়িয়ে নেওয়ার আবেদন করে পাশ কাটানোর চেষ্টা হয়েছে বারবার। শেষ পর্যন্ত নানা টালবাহানা করে কানাডার আদালতের তলবে আশানুরূপ সাড়া দেয়নি সংস্থাটি। আদালতের তলবে তারা তথ্য-প্রমাণ দিতে বাধ্য নয় বলেও জবাব দিয়েছে কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন ভঙ্গের খলনায়করূপী বিশ্বব্যাংক। দুর্নীতি-ষড়যন্ত্রের অভিযোগ যে গোটাটাই অসাড়, তা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছিল।
স্বপ্নভাঙা মানুষ সাময়িক আশাহত হলেও পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি। চোখেমুখে তখনও তাদের পদ্মাসেতু। বিশ্বদাতা সংস্থাগুলো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তাই বলে হবে না স্বপ্নের সেতু? কোটি কোটি মানুষের এমন আকাক্সক্ষার জবাব এলো সরকার তরফে। পদ্মাসেতু হবে। বিদেশি দাতারা ঋণ দেয়নি তাতে কী, প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নেই শুরু হবে কাজ। বাংলাদেশের সেই সক্ষমতা আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু সরকারের রাজস্ব আদায়ের বিভিন্ন খাতে গঠিত হয় তহবিল। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে হিসাব খোলা হয়। পদ্মাসেতু নির্মাণের নামে সেই তহবিলে দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ধনাঢ্যরাও অংশ নেয় সামর্থ্যরে মধ্যে। শুরু হয় নতুন করে স্বপ্ন দেখা। পরনির্ভরশীলতা নয়, স্বনির্ভর উদ্যোগ।
হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের এমন প্রকল্প আগে কখনও হয়নি বাংলাদেশে। তাতে কি, বাঙালি যখন একবার স্বপ্ন দেখেছে, পূরণ হবেই। সেই মানসিক শক্তি আর আত্মবিশ্বাস জাতি হিসেবে অনেক আগেই অর্জিত হয়েছে। কারণ ৯ মাসে দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসও যে এই জাতিরই ললাটে লেখা সোনালি হরফে। যে যাই বলুক, স্বপ্নটা বাস্তবেই ছিল আকাশ ছোঁয়া। চেষ্টাও ছিল বলতে হবে। তা না হলে বিশ্বব্যাংকের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর থমকে না গিয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেত না স্বপ্নের সেতু। জমি অধিগ্রহণের কারণে ভূমিহীনদের পুনর্বাসন, সেতু শুরুর আগে আনুষঙ্গিক কর্মযজ্ঞ শেষ করে মূল সেতুর কাজ শুরু হয়েছে। গত ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছেন মূল সেতু নির্মাণ কাজ।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদেই উঠেছিল পদ্মাসেতুর দাবি
পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদে। ওই সংসদে যোগাযোগমন্ত্রীর দাবির প্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে নদীগুলোর ওপর পর্যায়ক্রমে সেতু নির্মাণ করা হবে। এরপর থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে প্রথম শুরু হয় রাস্তাঘাট নির্মাণের কাজ। পরিকল্পনা নেওয়া হয় কয়েকটি সেতু নির্মাণের। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাজনীতির পালাবদলে সেসব পরিকল্পনা থেমে যায়। কিন্তু আশির দশক থেকে পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণের দাবি ওঠে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলো থেকে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পদ্মাসেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেয়। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ২০০১ সালে সেই দাবি পূরণের পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়। ওই বছরের ৪ জুলাই পদ্মাসেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।
১৯৯৮-৯৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর প্রি-ফিজিবিলিটি স¤পন্ন করেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরই ফেব্রুয়ারি মাসে পদ্মাসেতুর জন্য ডিজাইন কনসালট্যান্ট নিয়োগ করে। কনসালট্যান্ট ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রাথমিক ডিজাইন স¤পন্ন করে এবং সেতু বিভাগ প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহ্বান করে। ২০১০ সালের ২০ জুলাই দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ৫ জন দরদাতাকে প্রিকোয়ালিফাইড বিবেচনা করে প্রতিবেদন দাখিল এবং সেতু বিভাগ বিশ্বব্যাংকের অনাপত্তির জন্য প্রেরণ করে। একই বছরের ১০ অক্টোবর বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনের ওপর অনাপত্তি প্রদান না করে পুনরায় প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহ্বান করার অনুরোধ করে। সেতু বিভাগ পুনরায় প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহ্বান করে।
২৪ নভেম্বর ১০টি প্রতিষ্ঠান প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র দাখিল করে। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ৫টি প্রতিষ্ঠানকে প্রিকোয়ালিফাইড বিবেচনা করে ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি প্রতিবেদন দাখিল করে এবং সেতু বিভাগ বিশ্বব্যাংকের অনাপত্তির জন্য প্রেরণ করে। বিশ্বব্যাংক ১ জুলাই অনাপত্তি প্রদান করে এবং ২০১১ সালের ১৩ জুলাই সেতু বিভাগ থেকে মূল সেতুর বিড ডকুমেন্ট বিশ্বব্যাংকের সম্মতির জন্য প্রেরণ করে। বিশ্বব্যাংক সম্মতি প্রদান না করে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সেতুর ঋণ চুক্তি স্থগিত করে এবং পরে ঋণ চুক্তিটি বাতিল করে দেয়।
এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অদম্য প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থান, জোরাল মনোভাব এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টাই দেশি-বিদেশি নানা প্রতিকূলতা ও ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নেই আলোর মুখ দেখতে শুরু করে পদ্মাসেতু প্রকল্প। শেখ হাসিনার ইচ্ছায় জাতীয় বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। সমালোচকদের শত প্রশ্ন উপেক্ষা করে শুরু হয় ভূমি অধিগ্রহণ, নদীশাসনসহ সেতুর নির্মাণকাজ।
২০১৩ সালের ২৬ জুন মূল সেতুর প্রিকোয়ালিফাইড ঠিকাদারকে বিড ডকুমেন্ট ইস্যু করা হয়। ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ আর্থিক প্রস্তাব দাখিল করে। যার ব্যয় ১২ হাজার ১৩৩.৩৯ কোটি টাকা। ইঞ্জিনিয়ার্স এস্টিমেট অনুযায়ী সর্বসাকুল্যে ১৩ হাজার ৮৮৫.৮৫ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি এই আর্থিক প্রস্তাব যাচাই বাছাই করে। যাচাই বাছাইয়ে দেখা যায় চায়না মেজর ব্রিজের দেওয়া প্রস্তাবে সরকারি প্রস্তাবের নির্ধারিত ব্যয় থেকে শতকরা ১২ দশমিক ৬২ কম দিয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ফলে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি এই প্রস্তাব গ্রহণের জন্য সুপারিশ করে।
মূল সেতু নির্মাণের জন্য ঠিকাদারদের দাখিল করা আর্থিক প্রস্তাবটি ২০১৪ সালের মে মাসে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে আলোচিত হয় এবং ১২ হাজার ১৩৩.৩৯ কোটি টাকার অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে ২০১৪ সালের জুন মাসে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজের সঙ্গে চুক্তি হয় এবং ২৬ নভেম্বর কার্যাদেশ দেওয়া হয়। চুক্তি অনুযায়ী কাজের মেয়াদ ৪৮ মাস। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ কর্তৃপক্ষ এ বছরের মার্চে চীনের প্রথামতো মাওয়ায় পদ্মার পারে দুটি গরু, দুটি ছাগল ও দুটি মোরগ জবাই করে সেগুলোর রক্ত নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে নির্মাণকাজ শুরু করে। তার আট মাস পর সেতুর মূল পাইলিংয়ের কাজ উদ্বোধন হয়।
পদ্মাসেতু প্রকল্পের আওতায় পাঁচটি প্যাকেজে মূল সেতু নির্মাণ, সংযোগ সড়ক নির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, নদীশাসন ও পরামর্শক নিয়োগে এ টাকা ব্যয় হবে। সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর মধ্যে এক নম্বরে রয়েছে বহুমুখী পদ্মাসেতু নির্মাণ প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেই এর নির্মাণ কাজ সরাসরি মনিটরিং করা হচ্ছে। নির্মাণ প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের অনিয়ম যাতে না হয় সেজন্য নেওয়া হয়েছে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা। সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে কঠোর অনুশাসন দেওয়া হয়েছে।
পদ্মাসেতু ঘিরে হবে হংকংয়ের আদলে নগর
২০১৮ সালের মধ্যে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা। নিজস্ব অর্থায়নে এটি এ পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এর জন্য খরচ হবে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। এই সেতু হলে ঢাকার সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে যুক্ত হবে দক্ষিণাঞ্চল। এই সেতুতে ট্রেনও চলবে। এশিয়ান হাইওয়ের পথ হিসেবেও সেতুটি ব্যবহৃত হবে। পদ্মাসেতু ঘিরে হংকংয়ের আদলে নগর গড়ার পরিকল্পনার কথাও বলা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। মাওয়া থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত চার লেনের সড়ক হবে। রাজধানীর বিজয়নগর থেকে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে হবে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল সড়ক।
পদ্মাসেতুর মূল কাজের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আবদুল কাদের বলেন, ইতিমধ্যে প্রকল্পের ২৭ শতাংশ কাজ হয়েছে। এর মধ্যে সেতুর কাজের ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ, নদীশাসন কাজের ১৩ শতাংশ এবং উভয় প্রান্তে সংযোগ সড়কের প্রায় ৬০ শতাংশ স¤পন্ন হয়েছে। পদ্মাসেতুতে মোট পিলার থাকবে ৪২টি। এর মধ্যে ৪০টি পিলার থাকবে নদীর ভেতরের অংশে। দুটি থাকবে দুই প্রান্তে সংযোগ সেতুতে। নদীর ভেতরের ৪০টি পিলারের প্রতিটিতে ৬টি করে পাইল করা হবে। এ জন্য মোট ২৪০টি পাইল করতে হবে। সংযোগ সেতুর দুটি পাইলে ১২টি করে ২৪টি পাইল করতে হবে।
সাত চ্যালেঞ্জ
বিশ্বের সবচেয়ে বিশাল এবং প্রমত্তা নদীগুলোর একটি পদ্মার দুই তীরকে বাঁধতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে প্রকৌশলীদের। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে এসব চ্যালেঞ্জ।
১. পদ্মা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বিশাল এবং প্রমত্তা নদীগুলোর একটি। এই নদীর যে জায়গায় সেতুটি নির্মিত হবে, সেখানে নদী প্রায় ছয় কিলোমিটার প্রশস্ত। মূল সেতুর দৈর্ঘ হবে ছয় দশমিক পনের কিলোমিটার। এটি হবে দক্ষিণ এশিয়ার কোনো নদীর ওপর নির্মিত দীর্ঘতম সেতু।
২. পদ্মাসেতু শুধুমাত্র সড়ক সেতু নয়। একই সঙ্গে এই সেতুর ওপর দিয়ে যাবে ট্রেন। এছাড়াও যাবে গ্যাস পাইপলাইন এবং বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। দুই তলা ব্রিজের ওপর দিয়ে যাবে গাড়ি, আর সেতুর নিচের লেভেলে থাকবে ট্রেন লাইন।
৩. বর্ষাকালে পদ্মা নদীতে স্রোতের বেগ এত বেশি থাকে যে, সেতুর নকশা করার সময় প্রকৌশলীদের কাছে এটি এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। একদিকে গঙ্গা, আরেকদিকে ব্রহ্মপুত্রÑ দক্ষিণ এশিয়ার এই দুটি বিশাল এবং দীর্ঘ নদীর অববাহিকার পানি পদ্মা দিয়েই বঙ্গোপসাগরে নামছে। উজান থেকে নেমে আসা এই স্রোতের ধাক্কা সামলাতে হবে ব্রিজটিকে। সেই সঙ্গে নদীর দুই তীরে নদীশাসনে প্রচুর অর্থ খরচ করতে হবে।
৪. বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পলি বহন করে এই দুই নদী। বলা যেতে পারে এই দুই নদীর পলি জমেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল। এই সেতুর নকশা করার ক্ষেত্রে এই নদীবাহিত পলির বিষয়টিকে বিবেচনায় নিতে হয়েছে প্রকৌশলীদের।
৫. পদ্মা সেতু নির্মিত হচ্ছে এমন এক অঞ্চলে যেখানে ভূমিক¤েপর ঝুঁকিও আছে। এ নিয়ে সেতুর নকশা তৈরির আগে বিস্তর সমীক্ষা করা হয়েছে। কিছু সমীক্ষা করেছে বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। সেতুর নকশাটিকে এ জন্য ভূমিক¤প সহনীয় করতে হয়েছে।
৬. পদ্মাসেতুর ভিত্তির জন্য পাইলিংয়ের কাজ করতে হবে নদীর অনেক গভীরে। বিশ্বে কোনো নদীর এতটা গভীরে গিয়ে সেতুর জন্য পাইলিংয়ের নজির খুব কম। প্রকৌশলীদের জন্য এটাও এক বড় চ্যালেঞ্জ।
৭. এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প। খরচ হবে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগে এই প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ানোর পর বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এটি নির্মাণ করছে। বিদেশি সাহায্য ছাড়া নিজের খরচে এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের নজির বাংলাদেশে আর নেই।
বিজয়ের মাসে আরেক বিজয়
সেতুর মূল কাজ উদ্বোধনের পর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিজয়ের মাসে এটি আরেকটি বিজয়। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর এটি বাঙালির আরেক বিজয়। এক বিজয় ’৭১ সালে যার নায়ক মহাবীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর আরেক বিজয় পদ্মাসেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে যার নায়ক বঙ্গবন্ধুর বীরকন্যা শেখ হাসিনা। এটা তার অসম সাহসিকতার সোনালি ফসল। এই সেতু নির্মাণ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা বিতর্ক হয়েছে। এমনকি দেশীয় অর্থে পদ্মাসেতু নির্মাণ সম্ভব নয় এমন প্রচারণাও হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে যোগাযোগমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয়েছে সৈয়দ আবুল হোসেনকে। কিন্তু প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনা দমে যাননি। তিনি শত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় তিন কোটি মানুষের স্বপ্নের দুয়ার খুলে দিলেন।
ভাগ্য ফিরবে কোটি মানুষের
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে আরও আধুনিক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠার সুযোগ সৃষ্টি হবে। সুযোগ হবে কর্মসংস্থানের। ইতিমধ্যে অনেক উদ্যোক্তা এ সেতুকে ঘিরে নানা পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন। সেতু সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলো প্রথমে নানা অজুহাতে মুখ ফিরিয়ে নিলেও এখন তারা আবার নতুন করে পদ্মাসেতু নির্মাণ প্রকল্পে সহায়তার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সবুজ সংকেত না মেলায় অনেকটাই আশাহত এখন তারা। সরকারও কারও দিকে না তাকিয়ে নিজস্ব অর্থায়নেই সেতু নির্মাণে অনড়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব শুরু হয়েছে। পদ্মার দুই পারে নির্মাণাধীন সংযোগ সড়কে দেশীয় ইট, পাথর ও বালুসহ নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে। একইভাবে নদীর দুই পারে অবস্থিত তিন জেলা মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরে উন্নয়নের ধারা শুরু হয়েছে। স্থানীয়রা আধুনিক শহর গড়ে উঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। এছাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে পদ্মাসেতু প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় দেড় হাজার পরিবার প্লট পেয়েছেন। গ্রাম এলাকায় অবস্থিত এসব আধুনিক শহরের সুবিধা ভোগ করছেন তারা। সেতু প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে পদ্মার দুই পারে সাতটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে তিন হাজার প্লট দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যে প্রায় দুই হাজার প্লট হস্তান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে মাওয়া অংশে চারটি পুনর্বাসন কেন্দ্রের ৯১৪টি প্লটের মধ্যে ৭০০টি হস্তান্তর এবং জাজিরায় প্রায় ১ হাজার ৬০০টি প্লটের মধ্যে ৫৭০টি হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকিগুলো শিবচরে। পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে মসজিদ, খেলার মাঠ, মার্কেটসহ সব ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। -সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।