রংপুর: তারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তবে পদবির আগে ‘পুল’ বলে একটি শব্দ আছে। তারা ‘পুল শিক্ষক’।
সোনার হরিণ চাকরির পেছনে ছুটতে ছুটতে এই ‘পুল শিক্ষক’ হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের চোখে দেখা দিয়েছিল আলোর দিশা। কিন্তু দিন দিন সেই আলো ক্ষীণতর হচ্ছে। মাসে সাকল্যে ছয় হাজার টাকার বেতন, সঙ্গে বিদ্যালয়ের সহকর্মীদের নানা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। সহকর্মীরা তাদের উপহাস করে বলেন ‘দুইশ টাকার দিনমজুর’। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক অশান্তি আর মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়া পুল শিক্ষকরা।
সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বেতন কাঠামো থাকলেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী পুল শিক্ষকদের জন্য কোনো কাঠামো নেই। তাদের দেখারও কেউ নেই। যা আছে তা মানসিক পীড়া ছাড়া আর কিছু্ই নয়। সরকারের নতুন বেতন কাঠামোতে সর্বনিম্ন বেতন স্কেলই যেখানে ৮ হাজার ২৫০ টাকা, স্নাতক পাস একজন পুল শিক্ষক পান মাসে সাকল্যে ছয় হাজার টাকা। তার ওপর অসুস্থতা বা কোনো কারণে ছুটি নিলে প্রতিদিন ২০০ টাকা কাটা হয় এই ৬ হাজার টাকা থেকে।
অথচ একজন পুল শিক্ষক অন্য সহকর্মী স্থায়ী শিক্ষকের মতোই পূর্ণ সময় পাঠদানসহ অন্যান্য কাজ করে থাকেন। তারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের সঙ্গে উত্তীর্ণ অনেকে নিয়োগ পেলেও তাদের করা হয়েছে পুলভুক্ত। কোনো বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক দীর্ঘকালীন ছুটিতে গেলে সেখানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ পরীক্ষার লিখিত পরীক্ষায় ৪৪ হাজারের বেশি পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হন। মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ২৭ হাজার ৭২০ জন। তাদের মধ্যে নিয়োগ দেয়া হয় ১২ হাজার ৭০১ জনকে। বাকি ১৫ হাজার ১৯ জনকে পুল শিক্ষক হিসেবে রাখা হয়।
গত বছরের ৩০ মার্চে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটিকে পুল শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব দেয়া হয়। পুল শিক্ষকদের মাসিক বেতন ধরা হয় সাকল্যে ৬ হাজার টাকা। তারা যাতে কখনো আন্দোলন করতে না পারেন সে জন্য ৩০০ টাকার স্টাম্পে স্বাক্ষর নেয়া হয়। ৬ মাসের চুক্তিভিত্তিক মেয়াদ শেষ হলে অন্য কোনো স্কুলে কোনো শিক্ষক দীর্ঘকালীন ছুটি বা প্রশিক্ষণে তার স্থলে ওই পুল শিক্ষককে যোগদানের জন্য আবেদন করতে হবে। কর্তৃপক্ষ মনে করলে তাকে যোগদানের জন্য অনুমোদন দেন।
বিভিন্ন সুত্র বলছে, ওই ১৫ হাজার পুল শিক্ষকের মধ্যে অর্ধেকের বেশি শিক্ষক দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেন।
পুল শিক্ষকরা বলছেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের নতুন বেতন স্কেল ১৬ হাজার টাকার বেশি। একজন সহকারী শিক্ষক যা করেন সহকারী পুল শিক্ষকরাও তা-ই করেন। একই সময়ে স্কুলে যাওয়া এবং স্কুল ছুটি পর্যন্ত থাকলেও কারো বেতন স্কেল ১৬ হাজার আর কারো মোট বেতন ছয় হাজার টাকা। এটা পুল শিক্ষকদের জন্য লজ্জাকর ও অপমানজনক।
একাধিক পুল শিক্ষক দুঃখ করে অভিযোগ করেন, তারা যখন পাঠদানের জন্য স্কুলে যান, তখন অন্য সহকর্মীরা তাদের নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। স্কুলে প্রবেশ করা থেকে ছুটি পর্যন্ত এক নীরব মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় তাদের। রাস্তায় যানবাহনের কারণে একটু দেরিতে স্কুলে গেলে অশোভন বকাঝকা করেন প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে অন্য শিক্ষকরা। তাদের ভাষায় পুল শিক্ষকরা ২০০ টাকার মজুর।
পুল শিক্ষকরা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, স্নাতক পাস করা পুল শিক্ষকরা মাসে সাকল্যে পান ৬ হাজার টাকা, আর অষ্টম শ্রেণি পাস একজন পিয়ন এখন বেতন পাবেন ১৬ হাজার হাজার টাকা। এসব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে তারা উচ্চ আদালতে রিট করেছেন জানিয়ে পুল শিক্ষকরা বলেন, রিটের শুনানিও হয়েছে। এখন আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন তারা। তাদের আশা, আদালত তাদের পক্ষেই রায় দেবেন। চাকরি স্থায়ী হবে, নাকি সামাজিক ও মানসিক নির্যাতন বইয়ে বেড়াতে হবে তাদের, তা নির্ভর করছে আদালতের রায়ের ওপর।
জেসমিন আরা পারভিন মুক্তা নামের এক পুল শিক্ষক জানান, হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর মানবেতর জীবন যাপনের কথা বিবেচনা করে অচিরেই অন্তত যোগদানকৃত শিক্ষকদের স্থায়ী নিয়োগের ব্যবস্থা করা জরুরি। অন্যথায় তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।
পুল শিক্ষক কমিটির আহ্বায়ক সাফিউল ইসলাম সাফি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগের অপেক্ষায় থেকে অনেকের চাকরির বয়স শেষ হয়েছে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পর অনেক চাকরিপ্রার্থীর বিয়েশাদি হয়েছে। আমরা সাড়ে চার বছর ধরে অপেক্ষা করছি। আমরা চাই সবার নিয়োগ একসঙ্গে দেয়া হোক। অন্যথায় কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হব আমরা।”
(ঢাকাটাইমস/২৪ডিসেম্বর/মোআ)