ঢাকা: মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মন্তব্যের পর মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মন্তব্যের পর বেকায়দায় বিএনপি। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে দলের জন্ম হয়নি সে দলের নেতারা কেন স্বাধীনতার চার দশক পর এমন বক্তব্য দিচ্ছেন-বুঝে উঠতে পারছেন না দলের কর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীরাই।
ইতিহাসবিদরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধে নৃশংসতা কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা বাংলাদেশিদের করার কথা না। যুদ্ধের পর পাকিস্তানি শাসকরা বারবার সত্য অস্বীকার করার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশেও তাদের দোসররা ইনিয়ে বিনিয়ে একই সুরে কথা বলেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল কেন একই সুরে কথা বলবে?
বিএনপি সমর্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের এক সমাবেশে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠে দেশে। দুদিন যেতে না যেতে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যা বললেন, তা বিশ্বাস হচ্ছে না শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের। রাজধানীতে এক আলোচনায় গয়েশ্বর বলেনন, ‘তারা (শহীদ বুদ্ধিজীবীরা নির্বোধের মতো মারা গেলো, আমাদের মতো নির্বোধেরা প্রতিদিন শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে ফুল দেয়। না গেলে আবার পাপ হয়।... উনারা যদি এতো বুদ্ধিমান হন তাহলে ১৪ তারিখ পর্যন্ত তারা নিজেদের ঘরে থাকে কী করে একটু বলেন তো’। শহীদ বুদ্ধিজীবীরা ‘পাকিস্তানের বেতন খোর’ বলেও কটূক্তি করেন গয়েশ্বর।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানেরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন এমন বক্তব্যে। শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ বলেছেন, শেষ দেখতে চান তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ক্ষোভ ঝেড়েছেন শহীদ সিরাজউদ্দিন হোসেনের ছেলে জাহিদ রেজা নূরও।
তবে বিএনপির নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, তারা যা বলছেন তা ভিত্তিহীন নয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রচলিত ইতিহাসের ‘বিভ্রান্তি’ দূর করতেই সঠিক ইতিহাস সামনে টেনে আনা হচ্ছে। জানতে চাইলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘‘বিএনপি চেয়ারপারসন মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের সংখ্যা কম-বেশি নিয়ে কোনো কথা বলেননি। তিনি যা বলেছেন তাতে তো সরকারের খুশি হওয়ার কথা। কারণ তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে’।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা বলে নিজেদেরকে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধার দল হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করে বিএনপি। কিন্তু ইতিহাসবিদরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিএনপির ভূমিকা বরাবর প্রশ্নবিদ্ধ। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর শাহ আজিজুর রহমান, আবদুল আলীমকে। গোলাম আযমকে দেশে ফেরত আসার অনুমতিও দেন জিয়াউর রহমান। তার আমলেই রাজনীতি করার সুযোগ পায় পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলামসহ সব কটি স্বাধীনতাবিরোধী দল।
১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপতি পদেও বসান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আরেক দোসর আবদুর রহমান বিশ্বাসকে। ২০০১ সালে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ক্ষমতায় আসার পর মন্ত্রী বানানো হয় দুই আলবদর কমান্ডার মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে ধরি মাছ না ছুঁই পানি ধাঁচের কৌশল নেয়া বিএনপি হঠাৎ মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা নিয়ে কটূক্তি করার পর দলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এতে পৌরসভা নির্বাচনে ভোটে প্রভাব ফেলবে বলেও মনে করেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিএনপির হঠাৎ ইতিহাসের কারণে অতীতেও অনেক সমালোচিত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। মূল ধারার রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির উচিত ছিল জাতিসত্ত্বা তথা স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে কোনো ধরনের বিকৃত মন্তব্য না করা। এমনিতেই যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে পতাকা তুলে দিয়ে বড় ধরনের অপরাধ করেছে তারা।’ তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জামায়াতে ইসলামী যেসব অসত্য প্রচার করতো এখন বিএনপি তা করছে। এটা রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য ভাল হবে না।’
গত ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ ও আলোচনা সভায় বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘বলা হয়, এত লক্ষ লোক শহিদ হয়েছে। এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে যে, আসলে কত শহিদ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে, এটা নিয়েও বিতর্ক আছে।’ এর সপ্তাহ খানেকের মাথায় শনিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘যারা পাকিস্তানের বেতন-ভাতা খাইসে শেষ দিন পর্যন্ত, তারা নির্বোধের মতো মারা গেলো। আর আমাদের মতো নির্বোধরা তাদের শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসাবে ফুল দেই প্রতি বছর। না গেলেও আবার পাপ হয়।’ তিনি আরও বলেন, উনারা যদি এতো বুদ্ধিমানই হয়ে থাকবেন তাহলে ১৪ তারিখ (১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১) পর্যন্ত তারা বাংলাদেশে নিজের ঘরে থাকেন কি জন্যে? একটু বলেন তো আমারে? আর তাদের যারা স্ব স্ব কর্মস্থলে প্রতিমাসে বেতন তুললো, পাকিস্তানের বেতন খাইলো, এইটা নিয়াও তো কথা বলা যায়, যায় কি না?’
(ঢাকাটাইমস/ ২৭ ডিসেম্বর/ এইচএফ/ডব্লিউবি)