logo ২২ এপ্রিল ২০২৫
বিএনপির ২০১৫
গরমে শুরু, নরমে শেষ!
২৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ২০:২৬:২১
image


বোরহান উদ্দিন, ঢাকাটাইমস



ঢাকা: প্রতিষ্ঠার পর এর আগে এত বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকেনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। একই সঙ্গে দলের এমন বিপর্যয়ও আর কখনো দেখেনি তারা। ২০০৬ সালে ক্ষমতার বাইরে ছিটকে পড়া বিএনপি নানা হামলা-মামলা, বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে টিকে থাকলেও কোনো কিছুতেই রাজনৈতিক মাঠে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। এমনকি বারবার ঘোষণা দিয়েও সংগঠন গোছাতেও ব্যর্থ হচ্ছেন বিএনপি-প্রধান।

বিপর্যস্ত বিএনপির বিদায়ী বছরটা শুরু হয়েছিল নতুন জাতীয় নির্বাচনে সরকারকে বাধ্য করতে অবরোধের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তিন মাস ধরে চলা অবরোধ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলে বিদায়ী বছরে আর কোনো অবরোধ-হরতালের মতো কর্মসূচি থেকে নিবৃত্ত থাকে তারা।  

এরপর বছরজুড়ে দল ও নেতাকর্মীদের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ঝড়। রাজনৈতিক মাঠে কোণঠাসা দলটি বছর শেষে একটু আলো দেখছে ওঠে দাঁড়ানোর। প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত পৌরসভা  নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংগঠন গোছানোর একটা ধাপ ওপেল দলটি।  আর এর মাধ্যমে দীর্ঘ আট বছর কোনো নির্বাচনে বিএনপির দলীয় প্রতীক ধানের শীষের স্লোগান উঠল। 

রিজভীর অসুস্থতা,খালেদার আটকে পড়া এবং...

দশম সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তির দিনে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গণজমায়েতের ঘোষণা ছিল বিএনপির। এ নিয়ে দেশজুড়ে সৃষ্টি হয় উত্তেজনাকর পরিস্থিতির। গুঞ্জন ছিল-সরকার গণজমায়েতে বাধা দেবে, আর খালেদা জিয়া যেকোনো উপায়ে নয়াপল্টন যাবেন। এরই মধ্যে ৩ জানুয়ারি রাতে খবর পাওয়া যায় নয়াপল্টনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন রুহুল কবির রিজভী। দলের চেয়ারপারসন তাকে দেখতে যাওয়ার জন্য রাত ১১টার দিকে গুলশান কার্যালয় থেকে নয়াপল্টনের দিকে যেতে চাইলে তাকে আটকে দেয়া হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে তাকে কার্যালয়েই অবস্থান করতে হবে, এমন আশঙ্কা থেকে বাসা থেকে খালেদার জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র সেখানে নেয়া হয়। আর রাতেই উন্নত চিকিৎসার জন্য রিজভীকে হাসপাতালে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশ।

৫ জানুয়ারি বিকালের দিকে সঙ্গে থাকা নেতাদের নিয়ে নয়াপল্টনে যেতে গুলমান কার্যােলয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে বিপুলসংখ্যক পুলিশ দিয়ে গেটে আটকে দেয়। শুধু তাই নয়,তাদের নিবৃত্ত করতে ছোড়া হয় পিপার স্প্রে।

বাধার মুখে মূল ফটকের ভেতরে দাঁড়িয়েই সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক দেন খালেদা জিয়া। কিছুদিন যেতে না যেতেই খেই হারালেও বন্ধ হয়নি বিএনপি জোটের অবরোধ। কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে নাশকতার ঘটনায় উল্টো সমালোচনার ঝড় ওঠে দেশ-বিদেশে।

অনির্দিষ্টকালের অবরুদ্ধ অবস্থায় খালেদা জিয়াকে সঙ্গ দিয়েছেন দলের বেশ কিছু কেন্দ্রীয় নেতা। ৩ জানুয়ারি থেকে নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমানসহ ৪০ জনের মতো কর্মকর্তা-কর্মচারী খালেদা জিয়ার সঙ্গে ওই কার্যালয়ে আটকা ছিলেন। তাদের জন্য খাবার সরবরাহ করা হয় বাইরে থেকে।

তবে কিছুদিন পর বাইরের খাবার প্রবেশে বাধা দেয়া, বিদ্যুৎসংযোগ, ডিশ সংযোগ কেটে দেয়ার পাশাপাশি মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কও দুর্বল করে দেয়া হয়। এ নিয়ে অবশ্য সরকারকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।

অবরোধ শুরুর কিছুদিন পর অর্থাৎ ২৪ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া মেনে আসে ওই কার্যালয়ে। তবে মৃত্যুর পর এবং মরদেহ দেশে আনার দিনও অবরোধ অব্যাহত ছিল।

এদিকে পুত্রহারা খালেদা জিয়াকে সান্ত্বনা দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুলশান কার্যালয়ে গেলেও ফটক বন্ধ থাকায় মূল ফটক থেকেই তাকে ফিরে আসতে হয়। এ নিয়ে বিএনপির ব্যাপক সমালোচনা হয় বিভিন্ন মহলে।

এর মধ্যে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির সভাপতি অমিত সাহা টেলিফোনে খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানানোর খবর নিয়েও সমালোচনা হজম করতে হয় বিএনপিকে।

তবে দুর্নীতির মামলায় হাজিরা না দেয়ায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে গুঞ্জন ওঠে যেকোনো সময় গ্রেপ্তার হতে পারেন খালেদা জিয়া। কিন্তু সেই পরোয়ানা শেষ পর্যন্ত গুঞ্জনই থেকে যায়।

‘লাদেন স্টাইল’ বিবৃতি ও একজন রিজভী!

অবরোধের সময় মাঠে না থাকলেও ওই সময় গ্রেপ্তার আতঙ্কে দিন কাটিয়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। অনেককে খুঁজে খুঁজে গ্রেপ্তারও করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিাহিনী। ‘অসুস্থ’ রিজভীকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে তুলে নিয়ে অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করে গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু ৭ জানুয়ারি রাতে প্রহরারত পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান রিজভী। পরে অজ্ঞাত স্থান থেকে তিনি অবরোধ নিয়ে গণমাধ্যমে বিবৃতি, কখনো ভিডিও পাঠাতে থাকেন। কিন্তু ৩১ জানুয়ারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কৌশলের কাছে ধরা পড়তে হয় সাবেক এই ছাত্রনেতাকে। ওই সময় থেকে প্রায় ১১ মাস কারাগারে কাটানোর পর বছরের শেষ দিকে মুক্তি পান তিনি।

রিজভীকে তুলে নেয়ার পর থেকে ৯২ দিন বন্ধ ছিল বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়। তবে খালেদা জিয়া বাসায় ফেরার দিন ৫ এপ্রিল রাতে তালা কেটে ভেতরে ঢোকেন বিএনপি নেতারা।   গেটে তালা লাগিয়ে ওই কার্যালয় বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ।

হঠাৎ নিখোঁজ সালাহ উদ্দিন

রিজভী আটক হওয়ার পর অবরোধ নিয়ে দলের বক্তব্য তুলে ধরার দায়িত্ব পান আরেক যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ। অজ্ঞাত স্থান থেকে তিনি নিয়মিত বিবৃতি দিয়ে যান। এই অবস্থায় হঠাৎ ১০ মার্চ নিখোঁজ হন তিনি। তার পরিবার ও দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়,ওই দিন রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে উত্তরার একটি বাসা থেকে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে এ অভিযোগ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার নাকচ করে দেওয়া হয়। এরপর দুই মাস তিনি নিখোঁজ ছিলেন।

প্রায় দুই মাস পর ১১ মে ভারতের শিলংয়ে সালাহ উদ্দিনের সন্ধান মেলে। বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ভারতে প্রবেশের অভিযোগে ফরেনার্স অ্যাক্টের ১৪ ধারায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয় সেখানে। এখনো ভারতেই আছেন তিনি।

খালেদার বাসায় ফেরা

দুর্নীতি-সংক্রান্ত একটি মামলায় হাজিরা দিতে ৫ এপ্রিল বকশিবাজারের অস্থায়ী আদালতে হাজিরা দিতে কার্যালয় ছাড়েন খালেদা জিয়া। পরে সেখান থেকে সরাসরি নিজের বাসা ‘ফিরোজায়’ ফেরেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্য দিয়ে গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ৯৩ দিনের ‘অবরুদ্ধ’ অবস্থার অবসান ঘটে।  

খালেদার খুশি, সাকার ফাঁসি

নানামুখী চাপে বিপর্যস্ত বিএনপির জন্য ২০১৫ সালে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো দীর্ঘদিন পর দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ও পরিবারের সঙ্গে ঈদুল আজহা পালন। চোখ ও পায়ের চিকিৎসার জন্য ১৫ সেপ্টেম্বর লন্ডন যান তিনি। এর মধ্য দিয়ে আট বছর পর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার সুযোগ পান খালেদা।

অন্যদিকে গত ২১ নভেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর (সাকা) ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতের একাধিক নেতার ফাঁসি নিয়ে মুখ না খুললেও সাকার ফাঁসিতে দারুণ ব্যথিত হয়েছেন তার রাজনৈতিক সহযোদ্ধারা।

গতি আসেনি পুনর্গঠনে

আন্দোলনের মাঠে কার্যত ‘ব্যর্থ’ হয়ে দল পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন খালেদা জিয়া। ১০ আগস্ট কেন্দ্র থেকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে উপজেলা ও জেলা কমিটি করার সময় বেঁধে দিয়ে চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তার এবং দলীয় কোন্দলে সেই কার্যক্রম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত দল পুনর্গঠনে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।

শুধু মূল দল নয়, গুঞ্জন ছিল অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনেও নতুন নেতৃত্ব আনতে চান খালেদা জিয়া। কিন্তু বারবার উদ্যোগের খবর শোনা গেলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশার পাশাপাশি আছে ক্ষোভ।

পৌর ভোটে বছর শেষ

জাতীয় নির্বাচন বর্জন করলেও সব স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবি জানানো বিএনপি। যদিও ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মাঝপথে ভোট বর্জন করে দলটি। এবার দফায় দফায় বৈঠকের পর ৩০ ডিসেম্বরের পৌরসভা নির্বাচনে তারা অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এবার আর ভোট বর্জন করা হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে দলটির হাইকমান্ড।

সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কা থাকলেও বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। তাই শেষ পর্যন্ত তারা ভোটে থাকবেন।

এক বছরের অর্জন ও ব্যর্থতার বিষয়ে জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,“অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারলেও দীর্ঘসময় পর্যন্ত আন্দোলন টেনে নেয়াকে অর্জন বলতে হবে। কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেও দেশে-বিদেশে এই আন্দোলন সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। তবে অপ্রীতিকর ঘটনার সঙ্গে বিএনপি জড়িত নয়।”

পৌর নির্বাচনের পর নতুন বছরে কেন্দ্রীয় কাউন্সিলসহ দলকে শক্তিশালী করতে পুনর্গঠন কাজে বেশি মনোযোগ দেয়া হবে বলে জানান তিনি।

(ঢাকাটাইমস/২৭ডিসেম্বর/মোআ)