logo ২৪ এপ্রিল ২০২৫
অসঙ্গতির বেতন স্কেল বনাম প্রশাসনিক অসঙ্গতি
অনন্ত মাহফুজ
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০৬:০৭
image

সরকারি কর্মচারীদের জন্য ৮ম জাতীয় বেতন স্কেল ‘চাকরি (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ, ২০১৫’ নামে ঘোষণা করা হয়েছে। গত বছরের ২১ ডিসেম্বর জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন সরকারের কাছে বেতন ও ভাতাসংক্রান্ত সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন। প্রায় এক বছর পর বেতনের প্রজ্ঞাপন জারি করা হলো। কমিশনের প্রতিবেদন জমা এবং এ সংক্রান্ত আদেশ জারির মধ্যকার সময়ের পার্থক্য আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বেতন স্কেলের প্রজ্ঞাপন জারির পর সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে স্বস্তি এলেও নানা অসঙ্গতির কারণে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে।


কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর সিলেকশন গ্রেড এবং টাইম স্কেল তুলে দেওয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় পরিষদ আন্দোলন করেছে। অর্থমন্ত্রী তাদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে, তাদের আর্থিক এবং চাকরি ক্ষেত্রে মর্যাদা কোনোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। বেতন স্কেল ঘোষণার পর দেখা গেল অর্থমন্ত্রীর সেই আশ্বাস রাখা হয়নি। অনেক বিষয়ে অসঙ্গতি এবং অস্পষ্টতা থাকার কারণে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া নতুন স্কেলে বেতন পাওয়ার উচ্ছ্বাস কর্মচারীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে স্বস্তিদায়ক। প্রায় দ্বিগুণ বেতন বৃদ্ধির নজিরও এই প্রথম। এতে সরকারি কর্মচারীদের কষ্টকর জীবনযাপনে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য আসবে। তবে গতর বছর চাউর হয়ে যাওয়া বেতন বৃদ্ধির খবর ইতিমধ্যে বাজারে প্রভাব ফেলেছে, বরাবর যেমন হয়ে থাকে।


অষ্টম বেতন স্কেলে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বেশ যৌক্তিক এবং মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। চক্রবৃদ্ধি হারে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলতে সহায়তা করবে। জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশনের চেয়ারম্যান ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘শুধু শেখ হাসিনার সরকার বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। তাঁর অসীম সাহসের কারণেই জনসেবায় নিয়োজিত কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির জন্য এ যাবৎকালের সবচেয়ে ভালো বেতন কাঠামোটি হলো। একটি দ্রুতলয়ের অগ্রসরমান অর্থনীতির গণতান্ত্রিক দেশে যে ধরনের মানব সম্পদ উন্নয়ন কর্মকা-কে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং তাদের জন্য যে ধরনের বেতন কাঠামো দরকার, নতুন বেতন কাঠামোতে যথাসম্ভব তা আছে বলেই আমার মনে হচ্ছে।’


কমিশনের চেয়ারম্যানের এই কথার সঙ্গে সবাই একমত পোষণ করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসম সাহসিকতায় দেশে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমান বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন জাতীয় বাজেটের ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রয়োজন হবে। নিঃসন্দেহে এই বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন সাহসিকতার কাজ। তবে বেতন কাঠামো ২০১৫ সালের প্রজ্ঞাপন জারির আগে যেসব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন আন্দোলন শুরু করেছিল তার প্রায় সবই বেতন কাঠামোতে অমীমাংসিত থেকে গেছে। পেশাজীবীরা বলে আসছেন তাদের আন্দোলন আর্থিক সুবিধা লাভের জন্য নয়, বিষয়টি মর্যাদার। চাকরি (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ, ২০১৫ অনুচ্ছেদ ৮-এ বলা হয়েছে, ‘আপাতত বলবৎ এতদসংক্রান্ত অন্য কোনো বিধিবিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কর্মচারীরা ১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণিতে বিভাজনের বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তে বেতন স্কেলের গ্রেডভিত্তিক পরিচিত হইবেন।’


সরকারি কর্মচারীদের ১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণিতে বিভাজন ঔপনিবেশিক এবং বৈষম্যমূলক। পরিচিতির এই প্রথা বাতিল হয়েছে। যেহেতু সরকারি কর্মচারীরা কর্মক্ষেত্রে গ্রেডের মাধ্যমে পরিচিতি লাভ করবেন সেহেতু গ্রেডের প্রাপ্যতা কর্মচারীদের মর্যাদার পরিচায়ক হবে। দেখা যাচ্ছে, এই জায়গায় বড় অসঙ্গতি রয়ে গেছে। এ নিয়ে নতুন বেতন আইনে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যাও নেই। চাকরি (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ, ২০১৫ গেজেটে প্রকাশের দিন থেকে অর্থাৎ ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫ সাল থেকে সিলেকশন গ্রেড ও উচ্চতর স্কেল (টাইম স্কেল) বা কোনো স্কেলের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছানোর এক বছর পর পরবর্তী উচ্চতর বা টাইম স্কেল প্রদান সংক্রান্ত বিধানাবলি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে (অনুচ্ছেদ ৬)।


ভাষাগত ও শব্দগত জটিলতা এবং অস্পষ্টতা বাদ দিলে অনুচ্ছেদ ৭-এ যা বলা হয়েছে তা নি¤œরূপ : ক. কোনো স্থায়ী কর্মচারী পদোন্নতি ব্যতিরেকে একই পদে দশ বছর পূর্তিতে এবং চাকরি সন্তোষজনক হওয়া সাপেক্ষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১১তম বছরে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেডে বেতন পাবেন। খ. কোনো স্থায়ী কর্মচারী তার দশ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেডে বেতন প্রাপ্তির পর পরবর্তী ছয় বছরে পদোন্নতি না পেলে চাকরি সন্তোষজনক হওয়া সাপেক্ষে সপ্তম বছরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেডে বেতন পাবেন। গ. উপানুচ্ছেদ (১) ও (২)-এ উল্লিখিত সুবিধা বেতনস্কেলের ৪র্থ গ্রেড পর্যন্ত প্রযোজ্য হবে। ৪র্থ গ্রেড বা তদূর্ধ্ব গ্রেডের কোনো কর্মচারী এই সুবিধা গ্রহণ করে ৩য় বা ২য় গ্রেডে বেতন প্রাপ্ত হবেন না। ঘ. কোনো কর্মচারী দুই বা ততোধিক সিলেকশন গ্রেড বা উচ্চতর গ্রেড (টাইম স্কেল) বা কোনো স্কেলের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছানোর এক বছর পর পরবর্তী উচ্চতর স্কেল পেয়েছেন তিনি এই অনুচ্ছেদের অধীন উচ্চতর গ্রেড পাবেন না।


বেতন আইন ২০১৫ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, স্বাভাবিক পদোন্নতির ক্ষেত্রে এই সুবিধা প্রযোজ্য হবে না। কোনো কারণে পদোন্নতি না পাওয়া গেলে বা যে পদে স্বাভাবিক পদোন্নতি নেই সে পদে কর্মরত কর্মচারীরা এই সুবিধা পাবেন। তবে যেসব কর্মচারী জাতীয় বেতন স্কেল ২০০৯ ইতিমধ্যে একটি বা দুটি সিলেকশন গ্রেড আ টাইম স্কেল পেয়েছেন তারা এই সুবিধা পাবেন না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা বিশ বা একুশতম বিসিএসে নবম গ্রেডে প্রভাষক হিসেবে চাকরিতে প্রবেশ করেছেন, চাকরির চার বছরের মাথায় একটি সিলেকশন গ্রেড পেয়ে সপ্তম গ্রেড, একটি পদোন্নতি পেয়ে ষষ্ঠ গ্রেড এবং তারপর একটি সিলেকশন গ্রেড পেয়ে পঞ্চম গ্রেডে বেতন পান, তিনি তার সারা চাকরি জীবনে অর্থাৎ অধ্যাপক পর্যন্ত আর মাত্র একটি গ্রেড অর্থাৎ চতুর্থ গ্রেড পাবেন। বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী তিনি আর কোনো উচ্চতর গ্রেড পাবেন না।


এই বেতন স্কেলে বলা আছে, অধ্যাপকদের তৃতীয় গ্রেড পাওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে আইন সংশোধন করতে হবে। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ মনে করেন এ ধরনের বিধান বৈষম্যমূলক। তারা মনে করেন অন্যান্য ক্যাডারের ৩য়, ২য় ও ১ম গ্রেডের সব পদে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়নের জন্য এই কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে সরকারি মহাবিদ্যালয়গুলোর অধ্যক্ষ পদে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দেখা যাবে। ইতিমধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক থেকে নিচের দিকের প্রায় সবকটি পদে তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। সামনের দিনগুলোতে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাধ্যমিক শিক্ষা ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, নায়েমসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সবকটি পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে।


চাকরির শুরুতে ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে গ্রেডের পার্থক্য আরেকটি বৈষম্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী চাকরির শুরুতে একজন নন-ক্যাডার কর্মকর্তা একজন ক্যাডার কর্মকর্তা থেকে এক গ্রেড নিচে বেতন পাবেন। এতে বৈজ্ঞানিক এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেধাবীরা আসতে নিরুৎসাহিত বোধ করবেন। এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের বেতন ও ভাতার বিষয়ে অস্পষ্টতা থাকলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানিয়েছে, এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ নতুন পে-স্কেল অনুসারে বেতন-ভাতা প্রাপ্য হবেন। এছাড়া জাতীয় অধ্যাপকদের জ্যেষ্ঠ সচিবদের কাতারে নামিয়ে আনা এবং জাতীয় অধ্যাপকদের গ্রেড ১-এ বেতন প্রদান অনাকাক্সিক্ষত এবং এই বরেণ্য ব্যক্তিদের অপমানের শামিল বলে অনেকে মনে করছেন।


নতুন বেতন স্কেল ২০১৫ বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বেতন স্কেলে যে অসঙ্গতি আছে তা অনেকটা ইচ্ছাকৃত। এটি আমাদের জনপ্রশাসনের অসঙ্গতি এবং বিশেষ এক শ্রেণির কর্মকর্তাদের আজীবন সুবিধা লাভের প্রবণতাকে তুলে ধরে। তারা সর্বোচ্চ সুবিধা এবং মর্যাদা নেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকেন। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ মনে করেন, নতুন বেতন স্কেলে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য অধিকতর সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে। অন্য ক্যাডারের জন্য গ্রেড-১ ও গ্রেড ২-এ বেতন-ভাতা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এই প্রসঙ্গে তারা জনপ্রশাসন বিশেষ করে ক্যাডার সার্ভিস সংস্কারের তীব্র প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। ক্ষুব্ধ এই কর্মকর্তাদের বক্তব্য সংক্ষেপ করলে দাঁড়ায়, সব ক্যাডারের জন্য চাকরির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমানসংখ্যক ধাপ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।


সব ক্যাডারের গ্রেড-১ পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকারের পদ উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদে পদায়নের জন্য উপসচিব পর্যায়ে  উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সব ক্যাডার থেকে যোগ্য, প্রতিভাবান এবং সৎ কর্মকর্তাদের নিয়োগের বিধান করা প্রয়োজন। প্রশাসন ক্যাডার বাদে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সব বিষয়ে জ্ঞান থাকার কথা নয়। ইতিমধ্যে প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ একটি দাবি উত্থাপন করেছেন। তাদের দাবি হলো কৃত্ত পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা। এতে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাগণ তাদের পেশাভিত্তিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারবেন এবং দেশ উপকৃত হবে। যথাযথ প্রশাসনিক সংস্কার করা হলে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।


লেখক: সহকারী পরিচালক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর