logo ২২ এপ্রিল ২০২৫
রাজনীতির সুবাতাস
আল ফারুক ও হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
১২ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০৭:২৭
image

তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির। সময় সময় সংঘাত-সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে মানুষ। সম্পদের ক্ষতির তো কোনো হিসাবই নেই। ব্যক্তির তো বটেই রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। তবে টানা কয়েক বছরের সহিংসতা-নাশকতার পর সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাপ্রবাহে আশা দেখছে দেশবাসী। ক্ষীণ হলেও দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতার ইঙ্গিত দেখা দিচ্ছে। আর এটিই আশান্বিত করে তুলেছে দেশবাসীকে। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতদ্বৈধতার কুফল ভোগ করছে দেশবাসী। বিভিন্ন মহলের বারবার আহ্বান আর অনুরোধের পরও নিজ অবস্থান থেকে সরতে নারাজ দুই পক্ষ। এর মধ্যে সরকার পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক পথ নির্বাচনও বর্জন করে বিএনপি। কেবল বর্জন নয়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহতের চেষ্টায় নজিরবিহীন সহিংস আন্দোলন দেশজুড়ে ছড়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।


সহিংস প্রতিরোধের ডাকের মধ্যেই নির্বাচন করে ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের এক বছর পূর্তিতে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে আবারও সহিংসতা দেখে বাংলাদেশ। পেট্রল বোমায় ঝলসে যেতে থাকে মানুষের জীবন-সম্পদ। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারায় বহু মানুষ। এক পর্যায়ে সে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে এলেও রাজনীতি নিয়ে থেকে যায় উৎকণ্ঠা। দুই প্রধান রাজনৈতিক জোটের লড়াই থামার কোনো লক্ষণই দেখা যায়নি কিছুদিন আগ পর্যন্ত। আপাতত বিরোধী দল পিছু হটলেও আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে আবার কী হবে তা নিয়ে রয়ে গেছে নানা শঙ্কা। সমঝোতা না হলে আবারও সংঘাতের রাজনীতি শুরু হবে কি না, ভীত দেশবাসী।


কিন্তু হঠাৎ সুবাতাস। খানিকটা হলেও স্বস্তির ছোঁয়া দেশবাসীর মধ্যে। ভালো কিছুর আশা করছে সবাই। এর শুরুটা পৌরসভা নির্বাচন ঘিরে। সহিংসতার মামলায় বিপর্যস্ত বিএনপি দেশের ২৩৪ শহরে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরও নির্বাচনে তারা থাকবে কি না সে নিয়ে সংশয়-সন্দেহ ছিল শুরু থেকেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অল্প কিছু পৌরসভায় ভোট থেকে সরে দাঁড়ালেও বাকিগুলোতে লড়াইয়ে ছিল। ২৩৪ পৌরসভার মধ্যে ১৫৭টিতে আংশিক বা পুরোপুরি কারচুপির অভিযোগ করেছে বিএনপি। কিন্তু প্রায় ৭০ শতাংশ আসনে কারচুপির অভিযোগ তুললেও এর প্রতিবাদে কোনো কর্মসূচিই দেয়নি বিএনপি।


এরপর এলো দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই বছর পূর্তি ৫ জানুয়ারি ২০১৬। আবারও ভীত হতে শুরু করে দেশবাসী। এক বছর আগের অভিজ্ঞতায় জাগে উৎকণ্ঠা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয় সব কর্মসূচি। একটি প্রাণও হারায়নি অনাকাক্সিক্ষত সহিংসতায়। দুই প্রধান দল একই দিন রাজধানীতে সমাবেশ করল, কিন্তু বিশৃঙ্খলা হলো না কোথাও। সবচেয়ে বড় কথা, সব কিছু নিয়ে বিরোধিতায় মত্ত দুই দলের পক্ষ থেকেই এলো সমঝোতার ডাক।


আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, আমরাও চাই দেশে যেন একটা স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করে। বিএনপির উগ্রবাদী আচরণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তারা ভুল করে। সর্বশেষ এই ভুলের জন্য সারেন্ডার করে ৩০ ডিসেম্বর পৌরসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। তারা যে এখন সহিংসতার পথ পরিহার করছে বলে মনে হচ্ছে, এটা নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে। এটা তাদের আসল রূপ বলে মনে হচ্ছে না। তারা আবার দেশবাসীর ওপর আক্রমণ করতে পারে। আমরা তাদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছি। রাজনৈতিকভাবে তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।


বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, বিএনপি নাশকতার রাজনীতি করে না, পছন্দও করে না। যার প্রমাণ ৫ জানুয়ারির সমাবেশ। সরকার শেষ পর্যন্ত শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে আমাদের সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে। আশা করি আগামী দিনে সংকট সমাধানে আমাদের আহ্বান অনুযায়ী সংলাপে সাড়া দেবে।


তিন বছর পর শান্তিপূর্ণ ৫ জানুয়ারি


বছরের শুরুতে শান্তি-সমৃদ্ধির আশা করে সবাই। কিন্তু ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে বছরের শুরুর সময়টা ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। ২০১৩ সালের শুরুর দিকে সহিংসতার কারণ জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিকে ঘিরে। সরকারের সিদ্ধান্ত আসার পর পর এর প্রতিবাদে টানা দুই দিনের হরতাল ডাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি-জামায়াত জোট। ৫ জানুয়ারি কর্মসূচি ডাকার দিনই শুরু হয় গাড়িতে আগুন, ভাংচুর। হরতালের দুইদিনও ব্যাপক সহিংসতা দেখে দেশবাসী। রাজনীতির সাতপাঁচে নেই এমন মানুষের ওপর যখন শুরু হয় আক্রমণ তখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেশ ছাড়িয়ে পৌঁছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও। কিন্তু কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত সমঝোতার চেষ্টায় নামেন খোদ জাতিসংঘ মহাসচিব। এক প্রতিনিধিকে পাঠান সমঝোতার চেষ্টায়। ফায়দা হয়নি তারও।


পুরো বছরটিই গেল যুদ্ধাবস্থায়। আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই দায়িত্ব নিল নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারকে না মেনে অবরোধ-হরতাল চালিয়ে যেতে থাকে বিএনপি-জামায়াত জোট। চলতে থাকে সহিংসতা-প্রাণহানি। এর মধ্যে এলো ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের দিন। বিরোধী জোটের নির্বাচন প্রতিরোধের ডাক আর ক্ষমতাসীন জোটের ভোট করার ঘোষণার মধ্যে সংঘর্ষ-মারামারি-হামলা-পাল্টা হামলা চলল দেশজুড়ে। ১১ জেলায় ১৯ জনের প্রাণহানির মধ্যে শেষ হলো নির্বাচন। গঠন হলো নতুন সরকার। কয়েকদিন পর স্তিমিত হয়ে আসে সহিংসতা। বছর ঘুরে আবার আসে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি।


সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তিতে রাজধানীতে সমাবেশ করতে না পেরে লাগাতার অবরোধ এবং পরে অবরোধের পাশাপাশি হরতাল ডাকে বিএনপি-জামায়াত জোট। আবার শুরু হয় পেট্রল বোমার বিভীষিকা। সঙ্গে চলতে থাকে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান, গুলি, গুম। টানা তিন মাস চলে এই সংঘাত। পরে কোনো অর্জন ছাড়াই আন্দোলন থেকে পিছু হটে বিরোধী জোট। বছর ঘুরে আবারও আসে আরও একটি ৫ জানুয়ারি। আবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ ডাকে দুই দল। সহিংস কর্মসূচির অনুমতি মিলবে না জানায় পুলিশ। পরে আগের বছরের মতোই নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশের অনুমতি চেয়ে আবেদন করে বিএনপি। ১৮টি স্থানে সমাবেশের ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগও।


সব কিছুই হচ্ছিল হুবহু আগের বছরের মতোই। তবে কি আবারও একটি সহিংস ৫ জানুয়ারি আসছে? উৎকণ্ঠার মধ্যেই আগের দিন খবর এলো সমাবেশের অনুমতি পেয়েছে দুই দল। শর্ত ছিল শান্তিপূর্ণ সমাবেশ। শর্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন হয়েছে। কোনো অশান্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়নি।  কয়েক কিলোমিটার দূরে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে চলছিল আওয়ামী লীগের সভা। নেতা-কর্মীদের জমায়েতেও কম হয়নি। একই সময়ে রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের রাসেল স্কয়ারে আওয়ামী লীগের আয়োজনে আরেকটি সমাবেশ হয়েছে। দুটো সমাবেশই শান্তিপূর্ণ হয়েছে। অথচ দুটোর উপলক্ষ ৫ জানুয়ারি হলেও বিষয়বস্তুতে ছিল আকাশ-পাতাল ব্যবধান।


আওয়ামী লীগের দৃষ্টিতে ৫ জানুয়ারি যেখানে গণতন্ত্রের বিজয় দিবস সেখানে বিএনপির কাছে একই দিন গণতন্ত্র হত্যা দিবস। বিপরীতমুখী উপলক্ষ ঘিরে দুই দলের পাল্টাপাল্টি সমাবেশ নিয়ে বেশ আতঙ্ক ছিল নগরবাসীর মধ্যে। নয়াপল্টনে বিএনপি সভার মধ্যমণি ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। আর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সমাবেশের প্রধান বক্তা জনপ্রশাসনমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। দুজনের বক্তৃতা-বিবৃতিতে-সমালোচনা থাকলেও উসকানি ছিল না। বরং শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল ও সহনশীল রাজনীতির ইঙ্গিত দিয়েছেন।


একসঙ্গে কাজ করার ডাক দুই দলের


অতীতের অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে নমনীয় হয়ে আসছে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল। অতীতে একে অন্যের বিপক্ষে কড়া সমালোচনা করলেও গত মঙ্গলবারের সমাবেশের পর পরিস্থিতি ইতিবাচক দিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ সমাবেশ থেকে বিএনপি প্রধান এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দুজনই একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের বাক্য চয়নেও ছিল আন্তরিকতার ছাপ। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আমরা চাই আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান। গণতন্ত্রের জন্য একসঙ্গে কাজ করতে। আওয়ামী লীগের উচিত সবাইকে নিয়ে আলোচনা করে অবিলম্বে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা।...বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ; আমরা সবাই মিলেমিশে থাকতে চাই। সবাই মিলেই দেশকে এগিয়ে নিতে চাই।


অপরদিকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অপর একটি সমাবেশে সৈয়দ আশরাফ বলেন, আসুন, দেশকে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে নিয়ে যাই। নির্বাচন হবে, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। সে নির্বাচনে একটি প্রাণও হত্যার প্রয়োজন হবে না। জননেত্রী (শেখ হাসিনা) সেই গণতন্ত্রকে বিশ্বাস করেন। আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব। আমরা দেশকে আরও শক্তিশালী করব।


শুধু একসঙ্গে কাজ করার ডাকই নয়, সরকারকে ধন্যবাদ জানাতেও ভোলেননি খালেদা জিয়া। অনেকদিন পর নেতা-কর্মীদের সংস্পর্শে এসে উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করেছেন তিনি। বলছেন, অনেক দিন পর সামনে আসতে পেরে আমিসহ সবাই আনন্দিত ও উৎফুল্ল।


জামায়াতকে দূরে রাখার ইঙ্গিত


জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট করে রাজনৈতিকভাবে বেশ বেকায়দায় পড়েছে বিএনপি। এই অভিযোগে সরকার পক্ষও তাদের সঙ্গে অতীতে আলোচনায় বসতে রাজি হয়নি। বারবারই বলা হয়েছে, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করলে বিএনপির সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়। বিএনপি অবশ্য বরাবরই বলে এসেছে, জামায়াতের রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই। যে জোট হয়েছে এটি রাজনৈতিক। তবে গত মঙ্গলবারের সমাবেশ নতুন বার্তা দিচ্ছে। ওই সমাবেশে বিএনপির পাশে কোনো শরিক দল ছিল না। গত সাত বছরের ইতিহাসে এই ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম। কারণ, অতীতে বিএনপি যত সভা-সমাবেশ কিংবা কর্মসূচি ঘোষণা করুক না কেন, সব কিছুতেই অগ্রবর্তী দল ছিল জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা। এমনও নজির হয়েছে, ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের কারণে বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল সমাবেশের সামনে বসতে পারেনি। এ নিয়ে উভয় পক্ষ সংঘাতেও জড়িয়েছে একাধিকবার। অথচ ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশের কোথাও জামায়াতে ইসলামী কিংবা ছাত্রশিবির নেতা-কর্মীদের দেখা মেলেনি।


বিএনপি-জামায়াতের জোট হওয়ার পর কেবল আন্দোলন, নির্বাচন বা সরকার গঠন নয়, এমনকি বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনেও দুই দলের সমর্থকরা চেষ্টা করেছেন সমঝোতার। উপজেলা বা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নির্দলীয় ভোট হলেও সেখানেও সমঝোতা করেই ভোটে গেছে বিএনপি। তবে ঢাকার দুটি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে ভাটা পড়তে থাকে এই সমঝোতার। সর্বশেষ পৌর নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সমঝোতার কোনো চেষ্টাই দেখা যায়নি। রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় নির্বাচনে জামায়াতের অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু দলের নেতারা স্বতন্ত্র হিসেবে অংশ নিয়েছেন অন্তত ২৫টি পৌরসভায়। কিন্তু কোথাও বিএনপি তাদের ছাড় দেয়নি। আবার জামায়াত অংশ নেয়নি এমন আসনে বিএনপির পক্ষে প্রচারে নামেনি জামায়াতের কর্মীরা।  রাজনীতিবোদ্ধারা এতে ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত পাচ্ছেন। তারা বলছেন, জামায়াতকে ছাড়া আদপে বিএনপি কতটুকু সক্ষম সেটা যাচাইয়ের সময় এসেছে। বিএনপি হয়ত তাই করছে। এ কথা ঠিক যে, জামায়াতের সঙ্গে জোট করার ভোটের মাঠে বিএনপিকে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য বিএনপি যদি জামায়াতের সঙ্গে জোট ভেঙে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে এককভাবে অংশ নেয় তা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।


শুভবুদ্ধির উদয় হিসেবে দেখছেন বিশিষ্টজনেরা


হয়ত সময় এসেছে বলার, দেশের রাজনীতিতে এখন সুবাতাস বইছে। রাজনীতি বিশ্লেষকরাও বিষয়টিকে একইভাবে দেখছেন। সাম্প্রতিক নানা ঘটনাপ্রবাহে দুই প্রধান দলকেই ধন্যবাদ জানিয়েছেন শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান। তিনি বলেন, গত কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহ রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত হিসেবেই দেখতে চাই আমরা। সভ্যতার ভিত্তি হচ্ছে সহনশীলতা ও শ্রদ্ধা। এই ভিত্তিতেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আর দুই দলের এই মনোভাব আমাদের সাহায্য করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদও মনে করেন, দুই দল একে অপরকে খানিকটা ছাড় দিলে সারা দেশেই ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, এটা নিঃসন্দেহে ভালো লক্ষণ। এটাই রাজনীতি। আর বাকি যা হয় তা অপরাজনীতি-রাজনীতিহীনতা।


পেট্রল বোমার বিভীষিকা নেই


গত বছর ৫ জানুয়ারি বিএনপিকে সমাবেশ করতে দেওয়ার অনুমতি তো দূরে থাক বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে গুলশানের কার্যালয় থেকে বের হতে দেওয়া হয়নি। বছরখানেক আগে ওই দিনে রাজনৈতিক অঙ্গন বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। ডাক এসেছিল লাগাতার হরতাল-অবরোধের। টানা ৯০ দিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াও চলেছে। পেট্রল বোমা মেরে জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে ফেলার মতো নারকীয় তাণ্ডব চলেছে। সারা দেশে পেট্রল বোমা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। টানা ৯০ দিন গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়েই ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন।


সরকারের পতন না ঘটিয়ে বাসায় ফিরবেন না, এমন ঘোষণাও এসেছিল বিএনপি প্রধানের তরফে। তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো বিদেশে মারা যান আন্দোলন-কর্মসূচি চলাকালে। নিজের দাবিতে অনড় খালেদা জিয়া ছেলের মরদেহ আনতে বিমানবন্দরেও যাননি। মরদেহ গুলশানের কার্যালয়ে আনা হলে সেখানেই শেষ বিদায় জানান ছেলেকে। পরে তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। কিন্তু সেখানেও উপস্থিত ছিলেন না খালেদা জিয়া। রাজনৈতিক পরিস্থিতি এতটাই অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছিল যে, ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমবেদনা জানাতে গুলশানের কার্যালয়ের গেটে গেলেও খালেদা জিয়ার দেখা পাননি তিনি। তবে আন্দোলনের তিন মাসের মাথায় ধীরে ধীরে শিথিল হতে থাকে পরিস্থিতি। ৯০ দিনের মাথায় গুলশানের কার্যালয় থেকে আদালতে উপস্থিত হন বিএনপি চেয়ারপারসন। সেখান থেকে ফিরে যান গুলশানে নিজের বাসভবন ফিরোজায়। আন্দোলন শিথিল হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে অবরোধ তুলে নেয়নি বিএনপি। সে হিসাবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধ এখনও চলছে।


সিটি ও পৌর নির্বাচন : রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফেরার সুযোগ হিসেবে দেখছে বিএনপি


সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনের ডাক দিয়ে বিএনপি-জামায়াত যখন পিছু হটার মতো কোনো সুযোগ পাচ্ছিল না, তখনই ঘোষিত হয় ঢাকার দুটি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। অবরোধ স্থগিত করে ভোটে অংশ নেয় বিএনপি। কারচুপির অভিযোগে ভোট থেকে সরে এলেও সে আন্দোলনে আর ফিরে যায়নি বিএনপি।


সদ্য সমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেওয়াকেও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফেরার আরেকটি সুযোগ হিসেবে দেখছে বিএনপি। মামলা-হামলার কারণে এলাকা ছাড়া দলীয় নেতা-কর্মীরা কিছুটা হলেও সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পেয়েছে এই প্রক্রিয়ায়। ভোটার তথা দেশবাসীর কাছে যাওয়ার সুযোগও পেয়েছে বিএনপি। দীর্ঘদিন পর কেন্দ্রীয় নেতারা চষে বেড়িয়েছেন প্রত্যন্ত অঞ্চল।


পৌর নির্বাচন ঘিরে তফসিল পেছানো, সেনা মোতায়েনসহ নানা দাবি তুলে বিএনপি। নির্বাচন কমিশন কোনো দাবিতে সাড়া না দিলেও নির্বাচনী মাঠে ঠিকই ছিল বিএনপি জোট। নির্বাচনী প্রচারণা, প্রার্থী মনোনয়ন এবং শেষ মুহূর্তে ভোটের যুদ্ধে এতটুকু অবহেলা করেনি তারা। তবে নির্বাচন শেষে যথারীতি কারচুপি ও ক্ষমতাসীন দলের হস্তক্ষেপের বড়সড় অভিযোগ এনেছে। কিন্তু এই অভিযোগের পক্ষে জোরাল জনমত গড়ে তোলার জন্য কোনো কর্মসূচিই ছিল না তাদের।


রাজনীতির বোদ্ধারা ভেবেছিলেন, ৫ জানুয়ারির সমাবেশ থেকে কোনো কর্মসূচির ডাক দেবেন বিএনপি নেত্রী। কিন্তু সমাবেশের গোটা বক্তব্যে কোথাও কোনো কর্মসূচির ঘোষণা দেননি তিনি। বরং এই সরকারকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, জ্বালাও-পোড়াও-ভাংচুর নয়, তারা সত্যিকারের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চান।


সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, আসুন সংলাপ, আলোচনা করে সমাধান বের করে আনি। কারও বিরুদ্ধে আমাদের কোনো রাগ-ক্ষোভ-দুঃখ নেই। বিপরীতে বাণিজ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, আপনি (খালেদা জিয়া) বলেছেন, আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নয়, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন ঘটাবেন। বেগম খালেদা জিয়া আমরা ওই দিনটার জন্য অপেক্ষায় আছি। আপনার অবস্থা এবারের মেয়র ইলেকশনের মতো হবে। ওই নির্বাচনে আমরা বিজয়ী হব ইনশাল্লাহ।


সরকার পতনের আশা ছেড়েছে বিএনপি


বিরোধী দলের বর্জনের মুখে ১৯৯৬ সালে একতরফা নির্বাচন করে দুই সপ্তাহও টিকতে পারেনি বিএনপি। তখন আওয়ামী লীগের দাবি মেনে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করে ক্ষমতা ছাড়ে বিএনপি। প্রায় দুই দশক পর উল্টো চিত্র। এবার বিএনপি ও সমমনাদের বর্জনের মুখে নির্বাচন করেছে আওয়ামী লীগ। বিএনপির আশা ছিল ৯৬ সালের পুনরাবৃত্তির। কিন্তু দশম সংসদ নির্বাচনের দুই বছর হয়ে গেছে। আপাতত সরকার পতনের আশা বাদ দিয়েছে বিরোধী দল।


রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভোটের পর আওয়ামী লীগ সরকারের স্থিতিশীলতা নিয়ে সংশয় ছিল। কিন্তু দুই বছরে সরকার এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। কৌশলে ভুল আর প্রস্তুতি ছাড়া আন্দোলনের পরিকল্পনায় বিএনপি ডুবেছে বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার বলেন, দুই বছরে সরকার অনেক শক্তিশালী ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থায় আছে। এর অন্যতম কারণ শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাব। এটা গণতন্ত্রের জন্য কতটা ভালো সেটি নিয়ে প্রশ্ন আছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় সরকার দলের পাশাপাশি বিরোধী দলকেও হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষের এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন।


দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তিতে ২০১৫ সালের শুরুর দিকে লাগাতার আন্দোলনে নামে বিএনপি। কিন্তু যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছার আগ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দেয় বিএনপি। এরপর নানা ঘটনায় দলের সাংগঠনিক অবস্থা একেবারেই নাজুক হয়ে যায়। দলের ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নেও একাধিকবার ব্যর্থ হয়েছে দলটি। এমনকি প্রস্তুতি ছাড়া আন্দোলন নয় এমন ঘোষণাও এসেছে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কাছ থেকে।


রাজনৈতিক বিশ্লেষক মীজানুর রহমান শেলী বলেন, আপাত দৃষ্টিতে সরকারকে মজবুত অবস্থানে দেখা যাচ্ছে। সরকার দল বলছে, তারা দেশে উন্নয়নের আবহ তৈরি করেছে। কিন্তু বেসরকারি খাত এখনও সেভাবে শক্তিশালী অবস্থানে নেই। ব্যাংকে টাকা থাকলেও উদ্যোক্তার অভাবে এই টাকা বিনিয়োগে আসছে না। এর অন্যতম কারণ ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। এই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে এবং তার মীমাংসা হয়নি।  এক প্রশ্নের জবাবে শেলী বলেন, বাংলাদেশে যখন যে দলই ক্ষমতায় থাকে তারা বিরোধী দলকে মোকাবেলা করতে প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে। এবারও সে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এটা চলতে থাকলে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।


আওয়ামী লীগের অবস্থান সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার বলেন, আওয়ামী লীগের একটি মতাদর্শ আছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে এই সাংগঠনিক ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়নি। তারা এখন দিবসভিত্তিক কিছু কর্মসূচি পালন করছে। নানা কারণে দলের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ¦ নিরসনে দলকে অনেক বেশি সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। এ কারণে বিরোধী দলকে মোকাবেলায় তারা প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।


জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, সাংগঠনিক দক্ষতা ও জনপ্রিয়তায় আওয়ামী লীগ এখন তুঙ্গে। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি গণবিরোধী তৎপরতার ফল ভোগ করছে বিএনপি। পৌর নির্বাচনেও এর প্রমাণ মিলেছে।


২০১৯ সালে সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে জাতীয় নির্বাচন হবে না জোর দিয়ে বলছেন সরকার দলের নেতারা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, বিরোধী দল নির্বাচনে না এলেও জনগণ আওয়ামী লীগকে পাঁচ বছরের জন্য ভোট দিয়েছে। ভোটের আগে জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সে কথা রাখতে হবে। আগেভাবে নির্বাচন দেয়ার সুযোগ নেই। বিএনপিও মনে করছে, আপাতত সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর পরিস্থিতি নেই। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান এই সময়কে বলেন, আমরা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে যেতে থাকব। আমরা মনে করি, জনগণের দাবি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। সে দাবি আদায়ে আমাদের নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি চলবে।


বর্তমান বাস্তবতায় আন্দোলনে সফল হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন কি না জানতে চাইলে মাহবুবুর রহমান বলেন, সময়ই বলে দেবে আমরা কতটুকু পারি। কিন্তু এটা বলতে পারি, বর্তমানে গণতন্ত্র সুসংহত অবস্থানে নেই। গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এখানে হারজিতের কিছু নেই।


শেখ হাসিনাকেও মানতে রাজি বিএনপি


সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের পর বিএনপির অবস্থান ছিল একটিই, আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। যে করেই হোক তত্ত্বাবধায় সরকার লাগবে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রস্তাব আসে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। তখন বিএনপি আপত্তি তোলে শেখ হাসিনার বিষয়ে। তাতে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে নির্বাচনে না যাওয়ার অবস্থানে অটল থাকে বিএনপি। তবে সমঝোতার স্বার্থে সে অবস্থানেও ছাড় দিতে প্রস্তুত এখন বিএনপি। শেখ হাসিনাকে রেখেও নির্বাচন হতে পারে বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত এমাজউদ্দীন আহমদ একাধিকবার গণমাধ্যমে জানিয়েছেন সে কথা। ৫ জানুয়ারির সমাবেশে খালেদা জিয়া পরোক্ষভাবে হলেও স্বীকার করেছেন, আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব। উপজেলা নির্বাচনের প্রথম দুই দফার ও পাঁচ সিটি করপোরেশন সুষ্ঠু হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রমাণ হয়েছে নির্বাচন একটু সুষ্ঠু হলে বিএনপি জয়ী হয়। যদিও এর আগে ভোটে জিতেও কারচুপির অভিযোগ তুলেছিল বিএনপি। রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি সরকার পুরোপুরি আশ্বস্ত করতে পারে যে, তাদের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, তা হলে বিএনপি সেখানে যাবে।


জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, বিএনপি এখন নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে। তারা যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে না গিয়ে বড় ভুল করেছে তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। তিনি বলেন, বিএনপি ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তা না হলে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোনোটিতেই তারা অংশ নিত না। তাদের এই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই প্রমাণ করে তারা আগামীতে নির্বাচন থেকে পিছপা হবে না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান অবশ্য মনে করেন, জাতীয় আর স্থানীয় সরকার নির্বাচন এক নয়।


তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে শুরুর দিকে সরকার খুবটা হস্তক্ষেপ না করে নিজেদের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করেছিল। তারা দেখেছে হস্তক্ষেপ না করলে তাদের বড় ধরনের ভরাডুবি হবে। জনরোষে সরকারের পতন ত্বরান্বিত হবে। যে কারণে গত উপজেলা নির্বাচনের তৃতীয় ধাপ থেকে পঞ্চম ধাপ পর্যন্ত ভোট কেন্দ্র ছিনিয়ে নিয়ে নিজেদের জয় নিশ্চিত করেছে।


সাবেক এই সেনাপ্রধান বলেন, বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। গণতান্ত্রিক একটি দল। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হলে আমরা জয়ী হব, এই বিশ্বাস আমাদের আছে। বিগত পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং প্রথম দুই দফা উপজেলা নির্বাচনে তার প্রমাণ আমরা দিয়েছি। সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচনেও যেখানে আওয়ামী লীগ হস্তক্ষেপ করতে পারেনি সেখানে বিএনপি জয়ী হয়েছে। তবে তার এসব অভিযোগ আমলে নিচ্ছে না আওয়ামী লীগ নেতারা। তারা বলছে, বিএনপির প্রতি জনগণের আস্থা তলানীতে ঠেকেছে। সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচন তার জ্বলন্ত প্রমাণ। দলটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেন, সরকারি দল যদি হস্তক্ষেপ করত কিংবা জোর করে ছিনিয়ে নিত তা হলে বিএনপি একটি পৌরসভাতেও জয়ী হতে পারত না। অথচ তারা কুড়িটিরও বেশি পৌরসভায় জয়ী হয়েছে। এ থেকেই প্রমাণ হয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে।


দাবি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন


নির্বাচন কমিশনের ওপরই সব ক্ষোভ বিএনপির। সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থার সংকটের কথা জানিয়েছে দলটি। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, এমনটিও স্পষ্ট বলেছে বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা। তারা মনে করে, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার পূর্বশর্ত একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। গত মঙ্গলবারের সমাবেশ থেকেও একই ইঙ্গিত দিয়েছেন খালেদা জিয়া। তিনি এই নির্বাচন কমিশনকে অথর্ব বলেও অবহিত করেছেন। পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জয়ী করতে নির্বাচন কমিশন সব ধরনের ব্যবস্থা করেছে এমন অভিযোগ করে খালেদা জিয়া বলেন, দলীয় প্রতীকে পৌরসভায় মেয়র নির্বাচন দিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেদের জনপ্রিয়তা দেখাতে চায়। জনপ্রিয়তা দেখানোর জন্য নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া উচিত। তখন বুঝবেন অবস্থাটা। নির্বাচন কমিশনের কঠোর সমালোচনা করেন খালেদা জিয়া। তিনি নির্বাচন কমিশনকে অথর্ব, আজ্ঞাবহ, মেরুদণ্ডহীন আখ্যা দিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগ আর নির্বাচন কমিশন মিলে গণতন্ত্র হত্যা করেছে।


পৌর নির্বাচনের আগে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে কমিশনারের সাক্ষাৎ না করার সমালোচনা করে বিএনপিপ্রধান বলেন, তিনি (সিইসি) কী এমন লাটসাহেব হয়েছেন যে দেখা করতে পারেন না। ... সে নাকি অসহায়। অসহায় হলে পদত্যাগ করা উচিত। পদ ধরে আছে কেন? নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিএনপিকে আস্থায় আনার ক্ষেত্রে সরকারের প্রধান কাজ হবে নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠন করা। এক্ষেত্রে বিএনপির মতামতও নেওয়া প্রয়োজন। তা হলে পরবর্তী সময়ে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ পাবে না দলটি।


সাপ্তাহিক এই সময় এর সৌজন্যে