প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে দেশে তাপপ্রবাহ বইছে। সঙ্গে ভাপসা গরম। এ সময় কিছু না কিছু বৃষ্টি হওয়ার কথা। কিন্তু বৃষ্টির দেখা নেই। তাপমাত্রা বাড়ছে রেকর্ড পরিমাণ। এটি আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণ। বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন বলছেন, এর কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি। আর এ জন্য দায়ী শিল্পোন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ, পরিবেশের প্রতি মানুষের বিরূপ আচরণ।
পঞ্চম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত সমাজবিজ্ঞান বইয়ের অন্যতম লেখিকা মাহবুবা নাসরীন আবহাওয়া ও দুর্যোগ বিষয়ে গবেষণায় কাটিয়েছেন অনেক সময়। দেশের সাম্প্রতিক আবহাওয়া ও আমাদের করণীয় সম্পর্কে তার সঙ্গে কথা হয় ঢাকাটাইমসের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সামসুদ্দোহা মৃধা।
ঢাকাটাইমস: দেশে আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যাচ্ছে। এর কারণ কী বলে মনে করছেন?
মাহবুবা নাসরিন: এটা আসলে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। সারা বিশ্বে বিরূপ হচ্ছে আবহাওয়া। যখন ঠান্ডা পড়ার কথা তখন ঠান্ডা পড়ে না, অথবা বেশি ঠান্ডা পড়ে। যখন গরম পড়ার কথা, তুলনামূলক বেশি গরম পড়ছে। এটা বিশ্ব উষ্ণায়ন, অর্থাৎ গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফল। বিশ্বে যত বেশি শিল্প স্থাপিত হচ্ছে, তত বেশি কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বললে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহারের কথা উল্লেখ করতে হয়। এ ছাড়া ঘনবসতি, পরিবহণ অন্যতম কারণ। তবে প্রধান কারণ বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ; যার ফল আবহাওয়ার এই অস্বাভাবিক আচরণ।
ঢাকাটাইমস: আবহাওয়ার অস্থিতিশীলতার জন্য কাকে দায়ী করবেন?
মাহবুবা নাসরীন: আবহাওয়ার এই অস্থিতিশীলতা আসলে মানুষের পরিবেশবিধ্বংসী কার্যকলাপের বিরূপ প্রভাব। মানুষ গাছপালা কেটে ফেলছে। গাছপালা গরমের দিনে উষ্ণতা থেকে রক্ষা করে, আবার শীতের দিনেও একটা আচ্ছাদন তৈরি করে। আমরা সেটা নষ্ট করছি। এর জন্য দায়ী করলে করতে হয় বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর আবহাওয়া বিমুখতা ও আমাদের অসচেতনতা।
ঢাকাটাইমস: আবহাওয়ার এই বিগড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে শিল্পায়ন কতটা দায়ী?
মাহবুবা নাসরীন: আবহাওয়া সমস্যার এক নম্বর কারণ হিসেবে দাঁড় করানো যেতে শিল্পায়নকে। শিল্পায়নের প্রক্রিয়া যেদিন শুরু হয়েছে, সেদিন থেকেই আমরা ফরেস্ট্রির উপরে, বায়োডাইভারসিটির উপরে, এক কথায় প্রকৃতির উপরে চাপ ফেলছি। কমার্শিয়াল লগইন হচ্ছে। এটাই হচ্ছে সব চেয়ে বড় কারণ। শিল্পোন্নত দেশগুলোই কার্বন নিঃসরণ করে বেশি। তারা আগে কোনো দূষণ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহার করত না। কিছুদিন আগেও তারা এটা করত না। এখনো অনেক শিল্পোন্নত দেশে দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও পানি পরিশোধন ডিভাইস ব্যবহার হয় না। এ ক্ষেত্রে তুলনামূলক কম দায়ী দরিদ্র দেশগুলো।
ঢাকাটাইমস: প্রতিবছরই কি এভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি হতে থাকবে?
মাহবুবা নাসরিন: আমরা যদি কার্বন দূষণ না কমাই, তাহলে বছর বছর তাপমাত্রা রেকর্ড ছাড়িয়ে বাড়তে থাকবে। বিশেষজ্ঞরা এমনটাই জানিয়েছেন ইন্টার গভানর্মেন্টাল অন ক্লাইমেট-এর সর্বশেষ সম্মেলনে। এ ক্ষেত্রে যেটা হবে, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলো একের পর এক শিকার হবে। যারা ধনী তারা আরও বেশি এয়ার কন্ডিশনারের ব্যবহার বাড়াবে, এর উত্তাপ বাইরে ছড়িয়ে সাধারণ মানুষের আরও দুর্ভোগের কারণ হবে। আমাদের মতো দরিদ্র দেশগুলোর উচিত হবে শিল্পোন্নত দেশগুলোর প্রতি চাপ সৃষ্টি করা যাতে করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
ঢাকাটাইমস: বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাসের সংকেত অনেক সময় মেলে না। এর কারণ কী হতে পারে?
মাহবুবা নাসরীন: এখন এমনটা বেশি হয় না। আবহাওয়া পূর্বাভাস সঠিক হওয়ার জন্য যেসব যন্ত্র প্রয়োজন, অনেকটাই আমরা সরবরাহ করতে পেরেছি। আগে বন্যা সম্পর্কিত পূর্বাভাস আমরা পেতাম না, এখন সেটা আট দিন আগেই দেয়া যাচ্ছে। বর্তমানে ঘূর্ণিঝড় ও সাইক্লোন সতর্কতা সম্পর্কে যে পূর্বাভাস পাচ্ছি, আমি বলব সেটা সন্তোষজনক। ওয়েদারের সিগন্যাল দেয়া যেটা, সেটা ঠিকভাবে হয় না। অনেক সময় দেখা যায় সংকেত সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। আবহাওয়া বার্তায় মানুষকে সহজে বোঝানোর জন্য যে ভাষা দরকার, সেটা হচ্ছে না।
ঢাকাটাইমস: রাজধানীর পরিবেশের কথা বলুন। অসহনীয় গরমে মানুষ বৃষ্টি আকাঙ্ক্ষা করে। কিন্তু আকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি নামার পর পথে পথে সেটা আবার অস্বস্তির কারণ হয়।
মাহবুবা নাসরিন: আসলে এ সমস্যা এক দিনে তৈরি হয়নি। বহুদিন ধরে চলে আসছে সমস্যাটা। এর পেছনে আছে আমাদের নাগরিক দায়িত্ববোধের ঘাটতি। আমরা নানা বর্জ্য ড্রেনে ফেলি। আর একটি বড় ক্ষতিকর বস্তু ফেলি-পলিথিন। ড্রেনের জায়গায় জায়গায় এগুলো আটকে ময়লা বা বৃষ্টির পানি নিঃসরণে বাধার সৃষ্টি করে। ফলে বৃষ্টি ছাড়াও অনেক সময় ড্রেন উপচে পড়ে ময়লা পানি। আবার ড্রেন পরিষ্কারের দায়িত্ব যাদের, তাদের অবহেলাও অনেকাংশে দায়ী। ড্রেনের কোথায় কোথায় পানি আটকাচ্ছে, কিংবা পানি নিঃসরণ হচ্ছে না, সেটা চিহ্নিত করে তারা ড্রেন পরিষ্কার করছে না। বৃষ্টিতে ঢাকা শহরবাসীর এই অস্বস্তি থেকে বাঁচতে আমি মনে করি, সিটি করপোরেশন ও জনগণের সচেতনতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি জরুরি।
ঢাকাটাইমস: আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহবুবা নাসরীন: ঢাকাটাইমসকেও ধন্যবাদ।
(ঢাকাটাইমস/২৬এপ্রিল/মোআ)