logo ০৬ মে ২০২৫
‘ওষুধ শিল্পে নৈরাজ্য চলছে’
০৫ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০৩:৫৩
image




ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মাসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর পাশাপাশি গণমাধ্যমেও নানা দিক নিয়ে লেখালেখি করেন। সরকারি কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টাও করছেন নানা প্রক্রিয়ায়। তার মতে, পেশাদারি, মানুষের প্রতি মমত্ববোধের অভাব আর দুর্নীতির কারণে এ দেশে ওষুধ শিল্পে বিশৃঙ্খলা চলছে। সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে নানা দিক। তার সঙ্গে কথা বলেছেন মহিউদ্দিন মাহী।



ওষুধের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন কি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে?



দুঃখজনক হচ্ছে, ঔষধ প্রশাসনের দায়িত্বে যারা রয়েছেন, ওষুধ সম্পর্কে তাদের তেমন কোনো ধারণা নেই। ফলে তারা মান নিয়ন্ত্রণ এবং অনুমোদনের ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না।



সম্প্রতি কিছু ওষুধের অনুমোদন বাতিল হয়েছে। এটা কেন?



সরকার তিনটি ওষুধের অনুমোদন সরকার বাতিল করেছে, এর ৫১টি ব্র্যান্ড নাম আছে। সেগুলো বাতিল করা হয়েছে। গণমাধ্যমে অনেকে লিখছেন নাপা, এইচ বন্ধ হয়ে গেছে। এগুলো কিভাবে বন্ধ হয়? বন্ধ হয়েছে নাপা প্লাস, মেথিওনিন। প্যারাসিটামল প্লাস মেথিওনিন প্রোডাক্ট বন্ধ হয়েছে। এগুলো বন্ধ হয়েছে অন্য কারণে।



কী কারণ?



মেথিওনিনের উপস্থিতির কারণে কম্বিনেশন প্রোডাক্টটা বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে ক্ষতিকারক পদার্থ পাওয়া গেছে। এটা তৈরি হয়েছে নাপার সঙ্গে ক্যাফেইনের মিশ্রণের মাধ্যমে।



এটাতে কী কী ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে?



মেথিওনিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে ক্যান্সার, হেপাটিক এনসেফালোপ্যাথি, মস্তিষ্কের ক্ষতি, অ্যাসিডোসিস, প্রান্তিক শিরা-উপশিরার রোগ, ইশকিমিয়াজনিত হৃদরোগ, স্ট্রোক, রক্তক্ষরণ বন্ধে অস্বাভাবিকতা, রক্তনালির ক্ষয়ক্ষতি, এন্ডোথেলিয়ামের কার্যকারিতা হ্রাস বা বিলুপ্তি, রক্তনালির মসৃণ পেশির বিস্তার, অ্যাথেরেসক্লোরোসিসের মতো সমস্যা ইত্যাদি।



২০১১ সালে অনুমোদন দেওয়ার সময় এসব ওষুধ কি পরীক্ষা হয়নি?



আমার তো তা-ই মনে হয়। কারণ, একসময় যুক্তরাজ্যে প্যারাসিটামল ওভারডোজ (ভুল বা ইচ্ছাকৃতভাবে নির্দেশিত মাত্রার বেশি ওষুধ গ্রহণ) নিয়ন্ত্রণের জন্য প্যারাসিটামল ও মেথিওনিনের কম্বিনেশন প্রোডাক্টটির প্রচলন ছিল। কিন্তু বিভিন্ন অস্বাভাবিকতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা বিবেচনা করে ১৯৯৭ সালে কম্বিনেশন প্রোডাক্টি বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।



১৯৯৭ সালে যে ওষুধটি যুক্তরাজ্য বাতিল করল, ২০১১ সালে বাংলাদেশের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটি সেই ওষুধটি উৎপাদন ও বাজারজাত করার অনুমতি দিল কোন যুক্তিতে, তা আমার বোধগম্য নয়। এই কম্বিনেশন ওষুধটি যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) কর্তৃকও অনুমোদিত নয়।



তাহলে কি বলব যে ঔষধ প্রশাসন এসব অনুধাবনে ব্যর্থ?



ঔষধ প্রশাসনে একজন মহাপরিচালক আছেন। এই পদে বহুকাল ধরে সেনা কর্মকর্তাদের বসানো হতো। সম্প্রতি এর দায়িত্ব একজন চিকিৎসককে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনিও ওষুধ বিশেষজ্ঞ নন। তাহলে তারা কিভাবে ওষুধের গুণাগুণ যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেবেন।



তাহলে করণীয় কী?



আমার কথা তো কেউ শোনে না। বহুকাল থেকেই বলছি। কিন্তু কেউ কানে নেয় না। এরপরও আমি বলে যাব। সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গাটাতে সঠিক লোককে বসাতে হবে। কারণ আগেকার তথ্য-উপাত্ত থেকে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, ড্রাগ টেকনিক্যাল সাবকমিটি ও ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটির বিশেষজ্ঞ প-িতদের বিদ্যাবুদ্ধি, তথ্য-উপাত্ত, জ্ঞান ও দায়িত্ববোধের ঘাটতি রয়েছে।



শুধু যোগ্য ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিলেই সমস্যার সমাধান হবে?



যোগ্য ও পেশাদার লোক দিলেই হবে না। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়তে সরকারের প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে। তা না হলে ওই লোকটি কাজ করতে পারবে না। তাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।



ওষুধ অনুমোদনের প্রক্রিয়াটা কী?



প্রথমে ড্রাগ টেকনিক্যাল সাব কমিটি সুপারিশ করে। এরপর ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটি চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। কিন্তু কথা হলো, যারা এ অনুমোদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত তারা তো কেউ ওষুধ সম্পর্কে বোঝেন না। শুধু হ্যালো হলেই অনুমোদন দিয়ে দেন। এভাবে তো চলতে পারে না।



নিয়ম হচ্ছে, একটি কোম্পানি তার নতুন প্রোডাক্টের অনুমোদনের জন্য ঔষধ প্রশাসন বিভাগে আবেদন করবে। এই আবেদন যাচাই-বাছাই করবে অধিদপ্তর। এ জন্য বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন করা যায়। তারা এর বিচার-বিশ্লেষণ করে সুপারিশ করবেন।   



তারা তো বলছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এ রকম হয়। অনুমোদন দেওয়ার পর ত্রুটি ধরা পড়লে আবার বাতিল করা হয়।



বিতর্কিত ওষুধটি অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন দেশকে অনুসরণ করা হয়েছিল? ওষুধটির যখন অনুমোদন দেওয়া হয়, তখন বিশ্বের কোন দেশে এটি প্রচলিত ছিল? এমন কোনো তথ্য তারা দিতে পারেনি। আগে যেমন বলা হয়েছে, ১৯৯৭ সালে যুক্তরাজ্য সরকার ওষুধটি বাতিল করে বাজার থেকে তুলে নেয়।



আমার জানা মতে, ১৯৯৭ সালের পর পৃথিবীর কোনো উন্নত দেশে এই ওষুধটি প্রচলিত ছিল না; যুক্তরাষ্ট্রে তো নয়ই। এরপরও ২০১১ সালে এই ক্ষতিকর ওষুধের মিশ্রণটি বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো উৎপাদন ও বাজারজাত করার অনুমতি পেল কী করে?



ওষুধের দাম তো লাগাম ছাড়া। নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ পর্যন্ত নেই...



 এ দেশে মানুষ গণতন্ত্রের জন্য রাস্তায় নেমে গুলি খায়। কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য কয়জন এ পর্যন্ত গুলি খেয়েছে। কেউ কি এজন্য আন্দোলন করেছে? করেনি।



ভালো মানের ওষুধ বানাতে উপাদান বিদেশ থেকে আনতে হয়। এজন্য খরচ বেড়ে যায়। এ কারণে ওষুধের দাম বাড়াটা অস্বাভাবিক নয়। আমাদের দেশে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় ওষুধের দাম অনেক কম। আমরা যে ওষুধ ৪০ টাকায় কিনি সেই ওষুধের দাম আমেরিকাতে ২০০ ডলার।



ওষুধের মান নিয়েও তো বড় ধরনের প্রশ্ন আছে...



আমাদের দুটি ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি আছে। তাদের কাজ হচ্ছে- প্রতিটি ব্যাচের ওষুধ পরীক্ষা করা। প্রতিবছর তারা তিন থেকে চার হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ পরীক্ষা করতে পারে। কিন্তু প্রতিবছর এক লাখ ব্র্যান্ডের ওষুধ বাজরে আসে। প্রতিটি কোম্পানি প্রতিবছর তিন চারটা ব্যাচে ওষুধ বাজারে আনে। তাহলে কীভাবে তারা এত ওষুধের মান যাচাই করবে?



সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, আপনারা ওষুধের মানের কথা বলেন কেন? ভালো কোম্পানির ওষুধ খেলেই তো হয়। এটা উনি কিভাবে বলেন? আপনি কি জনগণকে বলবেন বড় বড় ৩০টি কোম্পানির ওষুধ খান! এটা তো হতে পারে না। আর এ কারণেই প্যারাসিটামলের সঙ্গে মিথেইন দিচ্ছে, ক্যাফেইন দিচ্ছে।



অ্যান্টিবায়োটিকে কোনো কাজ করছে না। এটা কি মান খারাপের জন্য?



যে ওষুধে কাজ করছে না সেটার মান খারাপ, এটা তো বলাই যায়। আমাদের দেশে ঔষধ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করেন যেসব ব্যক্তি তারাই এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এখন যেই ব্যক্তি ওষুধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তিনি যদি অনুমোদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকেন তাহলে কিভাবে মান রক্ষায় ভূমিকা রাখবেন?



চিকিৎসকদের কাছে গেলেই অতিরিক্ত ওষুধ দেওয়ার অভিযোগ আছে। এটা কতটা সত্য?



চিকিৎসকরা ওষুধ কোম্পানির কাছে চুক্তিবদ্ধ হয়ে পড়েছেন। তারা সকালে লেখেন একটি প্রতিষ্ঠানের ওষুধ, তো বিকেলে লেখেন অন্যটির। এভাবে তারা সব কোম্পানিকেই খুশি রেখে কাজ করতে চান। তারা রোগীর স্বার্থের কথা কখনো চিন্তা করেন না।



এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?



এ থেকে উত্তরণে কোনো পথ নেই। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের লোকরাও দুর্নীতিতে জর্জরিত। কোনো সঠিক নির্দেশনা নেই। দেশের প্রভাবশালী মহলই ওষুধ শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমি একবার অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর থাকাকালে এক চিকিৎসকের কাছে গেলাম, তিনি আমাকে দুটি ওষুধ দিলেন। এর একটি ভিটামিন। এর কারণ জানতে চাইলে বললেন, এটা খেলে তো কোনো সমস্যা নেই। আমি বললাম, ‘এর দাম আপনি দেবেন?’। তখন তিনি রেগে গেলেন। তখন আমার পরিচয় দিয়ে চ্যালেঞ্জ করলাম। তখন তিনি ভিটামিন বাদ দিলেন। আমি না হয় ফার্মাসিস্ট। কিন্তু সাধারণ মানুষের কী অবস্থা একটু ভেবে দেখুন।  



এর জন্য দায়ী কারা?



আমাদের সমাজের ৫ শতাংশ লোকের কাছে ৯৫ শতাংশ মানুষ জিম্মি। এরাই হচ্ছে আমাদের নীতিনির্ধারক। এদের হাতেই ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগও রয়েছে। তারাই এজন্য দায়ী। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর নামক প্রতিষ্ঠানটিতে এক রহস্যজনক ও গুপ্তখেলা চলছে; প্রতারণা, জালিয়াতি আর দুর্নীতির হরিলুট চলছে। অনন্তকাল ধরে এখানে নিরীহ জনগণের স্বাস্থ্যসেবাকে প্রাধান্য না দিয়ে ওষুধ কোম্পানি আর চিকিৎসকদের ব্যবসায়িক স্বার্থকেই মূলত প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।