উত্তম সরকার: গাইবান্ধা জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা মবিনুল হক জুবেল ’৭১ সালের শুধু বীরযোদ্ধাই নন, তিনি একজন পরোপকারী, সমাজসেবক, উদারচিত্তের মানুষ। গাইবান্ধার বাদিয়াখালীর বহুভাষা শিক্ষাবিদ হোমিও চিকিৎসক তৎকালীন কংগ্রেস নেতা মাওলানা সিরাজুল হকের ছোট ছেলে মবিনুল হক জুবেল। বাবার মতো তিনিও দুঃখী মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত-নিবেদিত। বাবা মাওলানা সিরাজুল হক ছিলেন ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসার তৎকালীন টাইটেল পাস মেধাবী ছাত্র এবং গাইবান্ধা ইসলামিয়া হাইস্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক।
মাওলানা সিরাজুল হক আসামে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বহু আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। এমন এক পরিবারের সন্তান মবিনুল হক জুবেল ছাত্রাবস্থায় থেকেই সহকর্মী, সহপাঠীদের লেখাপড়ার বিষয়ে নানারকম সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। বর্তমানে তিনি গ্রামের অসহায় মানুষের জন্য নানারকম সাহায্য-সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক এক প্রশ্নের উত্তরে মবিনুল হক জুবেল বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা একদিনে আসেনি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে পাকিস্তানি চক্রের বিরুদ্ধে বীর বাঙালি গর্জে উঠেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় বাঙালির লড়াকু মনোবলের বহিঃপ্রকাশ ৬ দফা ও ছাত্রসমাজের মহান ১১ দফা আন্দোলন। তৎকালীন আন্দোলনের অন্যতম নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশ ও জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। সেই সময়ের স্বাধিকারের আন্দোলন চলে যায় স্বাধীনতার আন্দোলনে।
তিনি বলেন, ‘আমি তখন ছাত্র। বয়স ১৮-১৯ হবে। দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। পাড়ি দিলাম সীমান্তের ওপারে। ভারতের (আসাম) মানকারচরে তৎকালীন আওয়ামী লীগ জেলা নেতা লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ছোট-বড় অনেকে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম।’ তবে ২৭ নভেম্বর ’৭১ সালের ঘটনা আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ১১ নং সাব সেক্টর কমান্ডার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হামিদুল্লাহ মোল্লারচর হামিদ পালোয়ানের ক্যাম্পে আসেন। আমি তখন প্লাটুন কমান্ডার। আমার ক্যাম্প ছিল কালাসোনাচরের মকছুদ (পরবর্তী সময়ে চেয়ারম্যান) ভাইয়ের বাড়িতে। কমান্ড হলো রোস্তম কোম্পানি মোল্লারচর হতে রতনপুর বাঁধ, রঞ্জু কোম্পানি উড়িয়া হতে কেতকিরহাট বাঁধ, কালাসোনা হতে আমার প্লাটুন কাইয়ারহাট, পালোয়ান ভাই এক কোম্পানি নিয়ে রসুলপুর বাঁধে একই দিকে অবস্থান নিবে। সুযোগ মতো আরো ক্লোজ হবে এবং গাইবান্ধা শহরের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। কমান্ড অনুযায়ী একদিনে একই সময়ে ভোর বেলা সবাই অবস্থান নিলাম।
সকাল ৭টার দিকে পাকবাহিনী কঞ্চিপাড়া একাডেমি থেকে আমার প্লাটুনের ওপর সরাসরি আক্রমণ শুরু করল। উভয় পক্ষের প্রায় ৩ ঘণ্টার প্রচ- গুলিবিনিময় হয়। গাইবান্ধা শহরের পাকবাহিনী ভেবেছিল যে, মুক্তিযোদ্ধারা শহর দখল করে নিবে। দুটি জঙ্গি বিমান আমাদের অবস্থানে গোলাবর্ষণ করতে লাগল। আমার ক্যাম্পের পরই রসুলপুরে পালোয়ানের অবস্থানের ওপর গোলাবর্ষণ শুরু হয়। বর্ষীয়ান ভাসানী ন্যাপ নেতা মতি ভাইকে আমি সেদিন একজন সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছিলাম। একদিকে আমার প্লাটুনের ওপর বোমাবর্ষণ, অন্যদিকে পাঞ্জাবি সেনারা হিফপজিশনে গুলি করতে করতে আমার প্লাটুনের দিকে আসছিল। সে সময়ই আমাদের গোয়েন্দা ইনফরমার এসে বলল জুবেল ভাই পালোয়ান আহত হয়েছে। রসুলপুর থেকে ওরা উইড্র করেছে। আরো বলল কেতকিরহাট বাঁধ হতে রঞ্জু কোম্পানিও উইড্র করেছে। ততক্ষণে পাঞ্জাবি সেনারা কাউন্টার আক্রমণ শুরু করেছে আমার প্লাটুনের ওপর। সবাই যখন উইড্র করেছে তখন আর ভারী অস্ত্র ছাড়া ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না ভেবে বিলম্ব না করে আমার মাথায় বাঁধা স্বাধীন বাংলার পতাকা হাতে সহযোদ্ধাদের কমান্ড দিলাম। যেভাবে পার জীবন নিয়ে নিরাপদ কোথাও চলে যাও। পরে জীবন বাঁচিয়ে সেদিন আবার একত্রিত হলাম কালাসোনার চরে। পরদিন মোল্লারচরে। আজও ভুলতে পারিনি একাত্তরের সেই সব দিনের কথা।
হাজারো মানুষের ত্যাগ, শত মায়ের অশ্রু আর স্বজন হারানোর ব্যথায় অর্জিত এ দেশটি আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। আজ এই মহান দিবসের প্রাক্কালে সেই একই প্রশ্ন? আমাদের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি শত শোষণ বঞ্চনা থেকে অর্থনৈতিক মুক্তির সেই লক্ষ্যে? এ প্রশ্ন আজ আমারসহ হাজারো মুক্তিযোদ্ধার। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অনেক বিচ্ছিন্ন ঘটনা আজ মনে পড়ছে। এই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে যদি কারও নাম ভুলক্রমে এসে না থাকে তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। মুক্তিযোদ্ধা মবিনুল হক জুবেল আরও বলেন, জীবদ্দশায় একজন মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধকালীন বিরক্তগাঁথা ইতিহাসে স্থান পাওয়া প্রয়োজন। ১০-১৫ বছর পর অনেক মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাবেন। তাই লেখক সমাজ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে স্ব-স্ব এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠ থেকে মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে আলোকচিত্র ও ভিডিও ধারণের মাধ্যমে সঠিকভাবে তুলে ধরা হোক এটিই আমার প্রত্যাশা।