মেলা মানেই অন্যরকম একটি ব্যাপার। আর বইমেলা মানেই লেখক প্রকাশক আর ক্রেতাদের মিলনমেলা। মাসব্যাপী এই মেলায় শেষ মুহূর্তের কেনা বেচায় ব্যস্ত সবাই। মেলার পরিবেশ, বই বিক্রি এবং এই শিল্পের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন অন্বেষা প্রকাশনের প্রকাশক শাহাদাত হোসেন। ঢাকাটাইমসের পাঠকদের জন্য সাক্ষাতকারটি তুলে ধরা হলো-
অন্বেষা প্রকাশনের যাত্রা কবে শুরু হয়েছিল?
২০০৫ সালে। প্রকাশক হব এ রকম স্বপ্ন নিয়ে প্রকাশনায় আসিনি। শখের বসে এই জগতে পা রাখা। কালক্রমে এটা পেশা ও নেশা দুটোই হয়ে গেছে। স্কুলের ছাত্রাবস্থায় বাংলাবাজারে প্রচুর যাতায়াত ছিল আমার। সেখানে গিয়ে একটা জিনিস লক্ষ করলাম, যাদের একটা অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য বইয়ের দোকানে ভিড় করতাম, তারা প্রকাশকদের সঙ্গে বসে কথা বলছেন, চা খাচ্ছেন, আড্ডা দিচ্ছেন। এটা আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করে। তখন থেকেই আমার ভেতর একটা বিষয় কাজ করে, আমি যদি প্রকাশক হতে পারি তাহলে হয়ত তাদের সান্নিধ্য পাওয়া খুব সহজ হবে। সেই স্বপ্ন থেকেই মূলত প্রকাশনায় আসা।
তখন প্রকাশনা জগতের অবস্থা কেমন ছিল?
খুব ভালো ছিল। অনেক বেশি লেখক ছিল। তখন হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক, হুমায়ুন আজাদ, সেলিনা হোসেনসহ অনেক জনপ্রিয় লেখক ছিলেন; যারা প্রকাশনাকে অব্যাহত ধারা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
শুরুর দিকে কী কী প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিলেন?
কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। নতুন প্রকাশকদের বড় লেখকরা বই দিতে চান না। তার কারণ কাজটা কীভাবে হবে এজন্য। প্রকাশনা ব্যবসা শুরু করার সময় বিশিষ্ট রম্য লেখক আহসান হাবীবের কাছে পা-ুলিপির জন্য যাই। তখন তিনি প্রকাশনা সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়েছেন। তার প্রথম লেখা বই দিয়ে আমার প্রকাশনার যাত্রা শুরু। অন্বেষা প্রকাশনে তার প্রথম বই ছিল ‘লিখতে লিখতে লেখক’। তার পরামর্শ এবং সবার সহযোগিতায় মূলত এ পর্যন্ত আসা। অনেক সময় লেখক আমাদের হাতে একটি পা-ুলিপি দিয়ে দেয় সেটাকে বই রূপে রূপদান করতে। এতে অনেক কার্যক্রম পালন করতে হয়। প্রুফ রিডিং, কম্পোজ, এডিটিং বা সম্পাদনার কাজসহ অনেক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বই বাজারে আসে। প্রথম তো এই বিষয়গুলো বুঝতাম না যে, অনেক ধাপ পেরিয়ে তারপর ফাইনালি বইয়ের প্রকাশ। অজানা এসব বিষয়ই প্রথম প্রতিবন্ধকতা ছিল।
অন্বেষার সবচেয়ে বড় সফলতা কী?
ছাত্রাবস্থায় আমি কল্পনার জগতে হিমুর চরিত্রে বিচরণ করতাম। যখন হুমায়ূন আহমেদের সান্নিধ্য পাওয়া ছিল কল্পনার ব্যাপার, তখন থেকেই আমার চিন্তা ছিল যে, স্যারের কোনো বই আমি আমার প্রকাশনায় পাব কি না? শুরুতে আমার সাহস ছিল না তার কাছে যাওয়ার। যখন তার কাছে গেলাম, তিনি খুব সাদরে আমাকে গ্রহণ করেছেন। দু বছরের মাথায় তিনি আমাকে তিনটি অনুবাদ গ্রন্থ নিয়ে ‘তিন বিচিত্র’ প্রকাশ করতে দেন। এই তিনটি গ্রন্থ দিয়েই তার বই প্রকাশ শুরু করি। পরবর্তী সময়ে আমি প্রতি বছরই তার নতুন নতুন বই পেয়েছি। এ পর্যন্ত তার প্রায় ২৪টি বই আমার প্রকাশনায় আছে। এটিকে আমি আমার প্রকাশনার জন্য একটি বিশাল সফলতা মনে করি।
বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প সম্পর্কে আপনার অভিমত?
বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পকে শিল্প বলা যাচ্ছে না। কারণ বইকে এখনো শিল্প রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সরকারের কাছে আমাদের দাবি, প্রকাশনাকে যেন শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
তথ্যপ্রযুক্তি দিন দিন উৎকর্ষ হচ্ছে, সেক্ষেত্রে প্রকাশনার ভবিষ্যৎ কী?
তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভেতরে শুরুতে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। হয়ত পাঠক কাগজে ছাপানো বই থেকে অনেকটা দূরে সরে যাবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে ই-বুকের মাধ্যমে সর্বস্তরের পাঠকের কাছে খুব সহজেই আমরা বইটি পৌঁছে দিতে পারছি। প্রযুক্তির ফলে বইয়ের মান যাচাই করার সুযোগ পাচ্ছে পাঠক।
বইয়ের পাঠক কমছে, না বাড়ছে?
পাঠক সংখ্যা আসলে বেড়েছে। তবে এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সৃজনশীল বই খুঁজে পাওয়া যায় না। স্থানীয় লাইব্রেরিগুলোতেও পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোনো বই রাখছে না। প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় যদি বইমেলার আয়োজন করা যায় তা হলেই বইয়ের পাঠক আরও বাড়বে বলে আশা করি।
একটি সমাজের জন্য বই কেন জরুরি?
সমাজের উন্নয়ন ঘটাতে হলে বইয়ের বিকল্প কিছু নেই। পাশাপাশি সমাজের ভাবনাকে উন্নত করতে হলে সৃজনশীলতার বিকল্প নেই। বই সৃজনশীল মানুষ তৈরি করতে পারে। সেই হিসেবে একটা সমাজ বিনির্মাণে বইয়ের ভূমিকা অপরিহার্য।
প্রকাশনাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারের কোনো করণীয় আছে?
প্রকাশনাকে এগিয়ে নিতে সরকারের করণীয় অনেক কাজ আছে। প্রথমে প্রকাশনাকে শিল্পরূপ দিতে হবে। জেলা পর্যায়ে গ্রন্থকেন্দ্রগুলোতে নির্দিষ্ট সংখ্যক মানসম্মত ও ভালো বই ক্রয় করতে হবে। তাহলে প্রকাশকরা ভালো বই প্রকাশে উৎসাহিত হবে। এছাড়া সরকার যদি কাগজের ওপর ভর্তুকি প্রদান করেন তাহলে হয়ত প্রকাশনা শিল্প আরও এগিয়ে যাবে।
আপনার প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ইতিমধ্যে অন্বেষা বীরাঙ্গনাদের নিয়ে একটি বড় কাজ করেছে। যেটি সারা দেশে বিপুল সাড়া ফেলেছে। এমন অনেক নতুন বিষয় খুঁজে কাজ করতে চাই।