logo ১৯ এপ্রিল ২০২৫
লেখালেখি আমার কাছে প্রার্থনার মতো: মোস্তফা কামাল
১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:৩৩:১৪
image



প্রায় পঁচিশ বছর ধরে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত মোস্তফা কামাল। মূলত কথাসাহিত্যিক। গল্প, উপন্যাস, রম্য ইত্যাদি লেখেন। লেখালেখির ক্ষেত্রে পাঠকপ্রিয়তাও পেয়েছেন বেশ। এ পর্যন্ত প্রায় ৮৫টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সাইন্স ফিকশন আছে ১০টি, রম্য আছে ৯টি এবং প্রবন্ধ আছে ১০টি। পেশায় সাংবাদিক। দৈনিক কালের কণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক। তার লেখালেখির নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সৈয়দ ঋয়াদ ও মরিয়ম চম্পা






কবে থেকে লেখালেখি শুরু করেছেন?






আমি আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে লেখালেখি করতাম। একদম কিশোর বয়সে। ছড়া, কবিতা এসব লিখতাম। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হতো। আর লেখক হিসেবে লেখালেখি শুরু করি ১৯৯১ সাল থেকে। তখন একজন লেখক হিসেবে প্রতিদিনই লেখার অভ্যাস তৈরি হয়ে যায়। এটা আমার কাছে প্রার্থনার মতো। আমি প্রতিদিন যেমন পড়ি তেমন লিখিও।






কথাসাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার কারণ?






আমি শুরু করেছিলাম কবিতা ও ছড়া দিয়ে। কবিতা পরিষদের সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম। কথাসাহিত্যে একটি বড় প্রেক্ষাপট থাকে। যেখানে অনেক কিছু বলা যায়। সাইন্স ফিকশন, রম্য, গোয়েন্দা উপন্যাস, কিশোর উপন্যাস, বড়দের জন্য সিরিয়াস উপন্যাস লিখেছি। বিভিন্ন বিষয়ে লিখেছি। পলিটিক্যাল উপন্যাস আছে, আবার জঙ্গিবাদ নিয়েও উপন্যাস আছে। নানা ইস্যুতে আমি লিখি। লেখক নিজেকে ভাঙ্গতে হয়।






উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা?






এক বছর আমার বড়দের উপন্যাস বেরিয়েছে। তখন ছোটো একটা বাচ্চা এসে বলল, ছোটদের বই নেই? এটা আমাকে একটু স্তম্ভিত করল। তখন আমি ঠিক করলাম শিশু-কিশোরদের জন্য লিখব। আসলে নিজ থেকে ঠিক করতে হয় না লেখককে কি লিখব। অনেক কিছু এমনিতেই সামনে চলে আসে।






 






সাংবাদিকতার মতো ব্যস্ত পেশায় থেকেও নিয়মিত লিখছেন, কীভাবে সময় বের করছেন?






আমি সাংবাদিকতা শুরু করি ১৯৯১ সাল থেকে। আমার বাড়ি বরিশালে। সেখানে হিজলার চর আছে। চরের জমিতে যারা চাষাবাদ করেন তাদের ধান লাঠিয়ালরা এসে কেটে নিয়ে যেত। এটা আমাকে খুব পীড়া দিত। বারবার যখন এটা হচ্ছে আমি তখন রিপোর্ট আকারে পত্রিকায় লেখা পাঠালাম। পত্রিকা পড়ার কারণে রিপোর্ট লেখার ধরনটা রপ্ত করতে পেরেছিলাম তখনই। তো আমার রিপোর্টটি স্থানীয় পত্রিকায় ছাপা হলো। তখন আমার উৎসাহটা আরও বেড়ে গেল। তখন আমাদের গ্রামে কমিউনিস্ট পার্টির ‘ক্ষেতমজুর সমিতি’ নামে একটি সংগঠন ছিল। ওদের নামে পত্রিকা যেত। সমিতির আহ্বায়ক ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। তিনি আবার আমাকে খুব স্নেহ করতেন। স্যার আমাকে পত্রিকাগুলো পড়তে দিতেন। তারপর দৈনিক সংবাদে আমার ক্যারিয়ার শুরু করি।






সাংবাদিকতা আসলেই একটা ব্যস্ত পেশা। কিন্তু আমি রুটিনমাফিক লিখি। সকালে না পারলে বিকেলে লিখি। প্রতিদিন এক ঘণ্টা আমাকে লিখতেই হবে। আমার মাথায় কোনো নির্দিষ্ট বিষয় না থাকলেও লেখার টেবিলে নিয়ম করে বসি। লেখার চেষ্টা করি, ধ্যান করি। এটা আমার কাছে প্রার্থনার মতো। কি নিয়ে লিখব এমন একটি বিষয় নিয়ে ভাববার চেষ্টা করি অন্তত। মাথায় একটা গল্প সাজাতে চেষ্টা করি। গল্পটা না সাজানো পর্যন্ত লেখাটা শুরু করি না। লিখতে লিখতে সময়টা আমার কাছে অনেকটা ঠিক হয়ে গেছে। আমাকে সময় বের করতে হয় না। বরং অফিসে আমি সবচেয়ে বেশি সময় কাজ করি। তারপরও লেখার জন্য ঠিকই আমার সময় থাকে। কারণ এটা আমার রুটিন ওয়ার্ক। না লিখলে আমার ভালো লাগে না। লিখতে না পারলে ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়। এক ধরনের অস্বস্তি ও অশান্তি কাজ করে। এটা না করলে আমার সাধারণ কাজগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। আমার অফিসের কাজগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। এজন্য আমাকে লিখতে হয়।






প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা যদি একটু বলেন।






আমার প্রথম বইটি ছিল গবেষণামূলক। এটি হলো, ‘আসাদ থেকে গণঅভ্যুত্থান’। ঊনসত্তরের শহীদ আসাদকে নিয়ে একটা সাপ্তাহিকে কভার স্টোরি করেছিলাম। তখন সাখাওয়াত আলী স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি আসাদ পরিষদেরও সভাপতি ছিলেন। আমি স্টোরি করার জন্য ওনার কাছে গেলাম। তো আসাদের ভাইয়ের কাছেও গিয়েছিলাম। আমার ওই প্রতিবেদনটা তখন প্রচ্ছদে দেওয়া হয়েছিল। প্রচুর হিট করে নিউজটি। হেডিংটা ছিল ‘আসাদ থেকে গণঅভ্যুত্থান’। এটা আমার দেওয়া। আসাদ বিশ তারিখে মারা যায়, ২৪ তারিখে গণঅভ্যুত্থান হয়। আসাদ মরে যাওয়ার চারদিন পর হয় গণঅভ্যুত্থান। এটার যে স্প্রিট, আন্দোলনের যে গতি এজন্য এটি সবার প্রশংসা পায়। সাখাওয়াত আলী স্যার তখন আমাকে বললেন, তুমি এটাকে বই করো। আমি বললাম, ছাপবে কে? অনেক খাটুনির কাজ। স্যার বললেন, ‘তুমি বইটা করো আমি ছাপব।’ আমি ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি, পিআইবির লাইব্রেরি, পাবলিক লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করে, অনেক পুরনো পত্রিকা পড়ে বইটি রেডি করেছি। তখন আসাদের গ্রামের বাড়িতেও দুবার গিয়েছিলাম। এজন্য আমাকে অনেক পেছনের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে হয়েছে। বইটি লেখার পর সে বছরই আসাদের শার্ট বাংলা একাডেমিতে উঠেছিল। ‘আসাদ থেকে গণঅভ্যুত্থান’ বইটি তখন খুব হিট করে। অন্য প্রকাশকরা আমাকে চিনতে শুরু করল। প্রকাশকদের কাছে গেলাম পা-ুলিপি নিয়ে, প্রকাশকরাও রাজি হলো। বের হলো আমার প্রথম উপন্যাস ‘পাপের উত্তরাধিকার’। একই বছর প্রকাশিত হলো গল্পের বই ‘বীরাঙ্গনার লড়াই’। প্রকাশকরা আস্তে আস্তে আমার লেখার প্রতি আগ্রহ দেখাল। এর পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের সব বনেদি প্রকাশকই আমার বই প্রকাশ করেছে একমাত্র ইউপিএল ছাড়া। প্রতীক, অবসর, পার্ল, অনন্যা, সময়, কাকলীর মতো সব বড় প্রকাশনীই আমার বই প্রকাশ করেছে। ফলে নতুন লেখকদের যে হেপাটা পোহাতে হয় সেটি আমার বেলায় হয়নি।






সমকালীন কথাসাহিত্য সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?






আমার কাছে মনে হয় সিরিয়াস কাজটা একটু কম হচ্ছে। কাজ করার প্রচুর বিষয় আছে। অনেকেই অনেক বিষয় নিয়ে কাজ করছেন, তারপরও অনেক বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে অনেক কাজ হতে পারে। ধরুন বাঙালির সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ, দেশভাগসহ আরও অনেক বিষয় আছে। এসব বিষয়ে অনেক সিরিয়াস কাজ করা দরকার। কিন্তু খুব একটা হচ্ছে না। সাহিত্য তো শুধু প্রেম-ভালোবাসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না। এর ব্যাপ্তি আরও অনেক বড়।






 






প্রযুক্তি যেভাবে এগুচ্ছে সেক্ষেত্রে বইয়ের ভবিষ্যৎ কী বলে মনে করেন?






অনেকের ধারণা বই সেলফেই থাকবে অথবা বড়লোকের ড্রয়িংরুমে শোভা পাবে। অবশ্য এখন বড় লোকের ড্রয়িংরুমেও বই থাকে না। আমি এটা নিয়ে কোনো শঙ্কা বোধ করি না। কারণ আপনি একটি নির্দিষ্ট সময় অনলাইনে থাকতে থাকতে বিরক্ত হবেন। কিন্তু ভালো বইয়ের আকর্ষণ আপনার কাছে কখনো ফুরাবে না। আপনার বিরক্ত লাগবে না। বরং পাঠকদের বই পড়তে পড়তে অবশ হয়ে গেলেও খবর থাকে না। তাই আমি মনে করি না বইয়ে আবেদন প্রযুক্তির কারণে একটুও কমবে। বরং আমার মনে হয় কোনো কোনো দিক থেকে সেটি বেড়েছে। প্রতিদিনই প্রচুর বই বিক্রি হচ্ছে। প্রকাশকের সংখ্যাও বাড়ছে। আর এসব পরিসংখ্যান বলছে বইয়ের পাঠক কমেনি, আরও বেড়েছে। আমি ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে বাংলা বইয়ের লাইব্রেরি দেখে বিস্মিত হয়েছি। বাংলায় যত রকম বই আছে সব সেখানে আছে। বাংলায় হেন কোনো লেখকের বই নেই সেখানে। তারা তো আমাদের আগে প্রযুক্তি পেয়েছে, তাহলে বইয়ের আবেদন তাদের কাছেও তো ফুরোয়নি। বড় জাতি মেধা ও মননে বড় হয়। যত উন্নত জাতি তাদের কাছে বইয়ের কদর তত বেশি। তাই প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বই হারিয়ে যাবে না। অনলাইন বা টিভি মিডিয়াকে ইরেজ মিডিয়া বলা হয়। কারণ সেখানে পত্রিকার মতো দৃশ্যমান সংরক্ষণের কিছু নেই। বই পড়ার যে টেস্ট সেটি কোনো কিছুতে নেই। সেটি আপনাকে টানবেই।






বইকে সর্বত্র পৌঁছে দেওয়ার জন্য কী উদ্যোগ প্রয়োজন?






এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমাদের দেশে শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক বই মেলা হয়। তবে দু-একটি জেলাতেও মাঝেমধ্যে হয়, সেটা নগণ্য। সরকারি উদ্যোগে প্রতিটি জেলা এবং থানায় বইমেলা হতে পারে। যেটা ব্যক্তির উদ্যোগে করা সম্ভব নয়। জ্ঞান- বিজ্ঞানকে এভাবেই ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে ঢাকা বইমেলার আমেজটা সারা দেশই উপভোগ করতে পারবে। জাতীয় পর্যায়ের লেখকদের সমন্বয়ে ও তাদের অংশগ্রহণে সরকার এটি চালু করতে পারে। তাহলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে আমরা বিকশিত হতে পারব।






নতুন লেখকদের সম্পর্কে কিছু বলুন?






নতুন লেখকদের পত্রিকা দিয়ে লেখা শুরু করা উচিত। প্রথমে বই প্রকাশ না করে নিজের নামটাকে একটু পরিচিত করানোর একটা বিষয় থাকে। পত্রিকায় ভালো লিখলে প্রকাশকরাই লেখকের বই প্রকাশ করতে আগ্রহী হবে। এটা সময়ের বাস্তবতা। লেখার পাশাপাশি প্রচুর পড়লে ভাষাটা আয়ত্ত হবে নতুন লেখকদের। ভাষা যদি পরিশীলিত না হয় তাহলে ভালো লেখক হওয়া সম্ভব নয়। লেখক অন্য সবার চেয়ে ভিন্নতর ভাষাশৈলী দিয়েই। আর নিয়মিত লেখার চর্চা তো আছে। এসবই একজন ভালো লেখকের বৈশিষ্ট্য। বরং প্রকাশনীর চেয়ে ভালো লেখকের সংখ্যা কম। প্রতি বছর কম করে হলেও একটি প্রকাশনী ত্রিশ-চল্লিশটি বই প্রকাশ করে কিন্তু সেই তুলনায় লেখক কই?






লেখালেখি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?






আমি বড় কিছু করার পরিকল্পনা করেছি। সামনে ইতিহাস নিয়ে একটা কাজের প্রস্তুতি নিয়েছি। সেটি পাকিস্তান-বাংলাদেশ সময়কাল। ভারত স¦াধীনতার পর পর গণতান্ত্রিক পথে হাঁটতে শুরু করে কিন্তু বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সে ধারায় টিকে থাকতে পারেনি। এই বিষয়গুলো নিয়েই প্রস্তুতি নিয়েছি। এটা হবে ঐতিহাসিক উপন্যাস। এটি তিন-চার খণ্ডের হবে। আশা করি সামনের বইমেলায় পাঠক এটি পাবে।