মধ্যসত্তরের তারুণ্যদীপ্ত ও দ্রোহী কবিতা নিয়ে কাব্যজগতে প্রবেশ কবি কামাল চৌধুরীর। জীবন যাপনের কোলাহলের ভেতরেও কবিতাই তাঁর সঙ্গোপনে সাধনা। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু গদ্য লিখেছেন, সেটাও কবিতা-বিষয়ক। কবিতার বাইরে উৎসাহী সমাজ-সংস্কৃতি অধ্যয়ন ও গবেষণায়। কবিতার স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কাজের পাশাপাশি ইউনেস্কো নির্বাহী বোর্ডে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করছেন তিনি। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অঞ্জন আচার্য
আপনার শিক্ষাজীবনের পথচলা সম্পর্কে জানতে চাই
স্বাধীনতার পর আমরা আবার ফিরে আছি আদমজীতে। আবার সেই গোদনাইল হাইস্কুল। স্কুল ম্যাগাজিনে লিখলাম। একসময় দেখলাম যে, আমি প্রচুর লিখছি। পাঠ্যপুস্তক ফেলে সারাদিন শুধু কবিতাই লিখছি। আমার এসএসসি পরীক্ষার খাতা ভরে উঠতে লাগলো কবিতায়। কবিতা পথিক যেমন হওয়ার, তেমনটা হয়ে গেলাম। আব্বা খুব চিন্তিত ছিলেন পরীক্ষার ফল খারাপ হবে ভেবে। যদিও পরীক্ষায় আমার ফল খারাপ ছিল না, বরং ভালোই ছিল। পরীক্ষা পাসের পর থেকে কিছু কিছু লেখা পাঠাতে শুরু করলাম বিভিন্ন জায়গায়। এরপর ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম আমি। সেখানে ভর্তি হয়ে আমি কবিতার একটি বিশাল জগৎ পেলাম। ঢাকা কলেজে আমার দুই প্রিয় বন্ধু পেলাম। একজন কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, আরেকজন কবি জাফর ওয়াজেদ। এই দুই কবি বন্ধুর সঙ্গে আমার সারাদিন আড্ডা চলতো। দুই বন্ধুর ছিল দুই রকম প্রতিভা। জাফর ছিল চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া আর রুদ্র ছিল উদ্দাম-উত্তাল। রুদ্রের সঙ্গে যখন আমার প্রথম পরিচয় হয়, তখন সে বলেছিল, ‘আমি একটা পত্রিকা সম্পাদনা করি ‘অনামিকার অন্য চোখ’ নামে। সেটা দিলো আমাকে। ক্যান্টিনে সারাক্ষণ আড্ডা চলতো, পড়ালেখা তখন উচ্ছন্নে গেছে। সেসময়, বিশেষ করে ঢাকা কলেজের সময়ে, অর্থাৎ ’৭৪-’৭৫ সালে আমরা একই সঙ্গে সৃষ্টিশীলতা এবং অপচয়ের কাল হিসেবে কাটিয়েছি। অপচয় বলবো এ কারণে যে, যেসময়টা আমরা আরো ভালো কাজে লাগতে পারতাম, তা আমরা আড্ডা দিয়ে নষ্ট করেছি। তবে শিল্প-সাহিত্য নিয়ে লেখাপড়া আমাদের চলেছে সমান তালে। অন্যদিকে একাডেমিক লেখাপড়া থেকে আমরা দূরে সরে গিয়েছিলাম। ফলে প্রত্যেকের ফলাফলই ছিল খারাপ। কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবেরও আমাদের সঙ্গে ঢাকা কলেজে পড়তো। লেখক আলী রীয়াজ আমাদের আড্ডায় এসে যোগ দিত।
সাহিত্য জগতে প্রবেশ ও রাজনীতিকাল সম্পর্কে কিছু বলুন...
অধ্যাপক আবদুল্লাহ্্ আবু সায়ীদ স্যার প্রকাশ করতেন ‘কণ্ঠস্বর’ নামে একটি পত্রিকা। তখন সায়ীদ স্যার ছিলেন ঢাকা কলেজের শিক্ষক। কণ্ঠস্বর-এর শেষ সংখ্যায় আমার ও রুদ্রের কবিতা ছাপা হলো। এর আগে দুই-একটি পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। তখন বেশ কিছু সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতো, সেগুলোতে কবিতা প্রকাশ পায় আমার। তখন ‘আজাদ’ পত্রিকাটি ছিল বেশ জনপ্রিয়। আজাদ পত্রিকায় আমি একটা লেখা পাঠালাম। রুদ্র বললো, আজাদ-এ তারও একটি লেখা ছাপা হয়েছে। রুদ্র বললোÑ ‘আমি ওই পত্রিকার সম্পাদককে চিনি, চলো যাই।’ রুদ্রের সঙ্গে গেলাম, কবিতাটি পরে ছাপা হয়। এরপরে আমি ইত্তেফাকে লেখা দিলাম। রুদ্রও কবিতা দিয়েছিল। আমারটা ছাপা হলো, রুদ্রের কবিতা ছাপা হয়নি। রুদ্র খুব কষ্ট পেয়েছিল। এরপর কবি আহসান হাবীবের হাত দিয়ে আমার কবিতা ছাপা হলো দৈনিক বাংলায়। এভাবেই আমার সাহিত্য জগতে প্রবেশ। আমার পিতৃদত্ত নাম কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী হলেও শুরু থেকেই আমি কামাল চৌধুরী নামে লিখে আসছি।
ঢাকা কলেজের পাঠ শেষে ’৭৬-এ আমি ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকতাম ফজলুল হক হলে। প্রথমে ১৩ নম্বর, এরপর ৩০৯ নম্বর রুমে। দুই বন্ধু রুদ্র ও জাফর ভর্তি হলো বাংলা বিভাগে। আমি ও সাবের ভর্তি হলাম সমাজ বিজ্ঞানে। আমিও বাংলায় ভর্তি হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পওে ভেবে দেখলাম, বাংলা তো আমি এমনতেই পড়বো। এ মনে করে অন্য বিভাগে ভর্তি হলাম। ওই সময়ে আমাদের আড্ডাটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আড্ডা দিতাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গফুর মিঞার রেস্টুরেন্টে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের পাশে ছিল শরীফ মিঞার দোকান। তার পাশে ছিল গফুর মিঞার রেস্তোরাঁ। ৬০-এর কবি-লেখকরা আড্ডা দিতেন শরীফ মিঞার দোকানে। আর আমরা যারা সত্তরের দশকের লেখক তারা আড্ডা দিতাম গফুর মিঞার দোকানে। রুদ্র, জাফর, জ্যোতি, আলমগীর রেজা চৌধুরী, আলী রীয়াজ, আবিদ রহমান, মোহন রায়হান, অনুজ লেখক তুষার দাশসহ আরো অনেকে আড্ডা দিতাম সেখানে। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পরের সময়। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী তারা ভাবতাম, কী করা যায়? এভাবে প্রতিবাদহীন হয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায় না। প্রতিকূল পরিবেশ থাকা স্বত্ত্বেও আমরা মনে মনে ফুঁসে উঠতাম। সেসময় একদিন আমি গফুর মিঞার দোকানে বসে একটি শ্লোগান লিখলামÑ ‘মুজিব লোকান্তরে, মুজিব বাংলার ঘরে ঘরে’। সেসময় হায়দার আলী নামে এক ছাত্রনেতা ছিলেন। হায়দার ভাই ছিলেন আমাদের এক বছরের সিনিয়র। তাকে আমি শ্লোগানটা দিলাম। তিনি ছিলেন দেয়ালে চিকা মারায় উস্তাদ মানুষ। এক রাতের মধ্যে সারা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আমার এই শ্লোগানটি দেয়ালে দেয়ালে সাটিয়ে দিলেন তিনি। ওই সময় সেটা ছিল খুবই দুঃসাহসিক কাজ। আতঙ্কের ভেতর দিন কাটাতে হতো সবাইকে। যাই হোক, পরে আমার সেই শ্লোগানটি ‘এক মুজিব লোকান্তরে, লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে’Ñ এই হিসেবে ছন্দবদ্ধ করা হয়।
’৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে ছাত্র ইউনিয়নের ‘জয়ধ্বনি’ পত্রিকায় আমার একটি লেখা ছাপা হলো। ‘জাতীয়তাময় জন্ম-মৃত্যু’ শিরোনামের কবিতাটি ছিল এমনÑ ‘রক্ত দেখে পালিয়ে গেলে/ বক্ষপুরে ভয়/ ভাবলে না কার রক্ত এটা/ স্মৃতিগন্ধময়/ দেখলে না কার জন্ম-মৃত্যু জাতীয়তাময়।’ কবিতাটি প্রকাশের পরদিন দেখি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে আর দেয়াল পত্রিকায় ছেয়ে গেছে। ছাত্র রাজনীতি তখন উত্তাল হয়ে উঠলো। ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে লাগলো। তবে আমরা যারা সাহিত্যকর্মী তারা ‘রাখাল’ নামে একটি সাংস্কৃতিক ম্যুভমেন্ট শুরু করলাম। সমাজ বদলের প্রয়োজনে রাজনীতি ও সাহিত্যকে একীভূত করাই ছিল আমাদের কাজ। এমনকি মধুর ক্যান্টিনেও আমরা কবিতা পাঠের আসর করেছি। এর মধ্যে একটি বিষয় শেয়ার করতে চাই। ওই সময় ডাকসু’র নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হলো। আমরা তিন বন্ধু (রুদ্র, জাফর ও আমি) সদস্য পদের জন্য ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ ও জাসদ ছাত্রলীগ প্যানেলের হয়ে দাঁড়ালাম। ছাত্র রাজনীতিতে ওই সময় আমি ফুল টাইমার হয়ে গেলাম। বন্ধুরা মিলে এখানে-ওখানে যাই। পাশাপাশি লেখালেখি চলে। এসময় সত্তরের কবিদের একত্র করার লক্ষ্যে ‘নক্ষত্রবীথি’ নামে একটি পত্রিকা করলাম আমরা। বন্ধু রেজা সেলিম, আলী রীয়াজদের বাড়ি ছিল আমাদের আরো দুটি আড্ডার জায়গা। তো, নক্ষত্রবীথি পত্রিকা নিয়ে আমরা গেলাম বাংলা একাডেমিতে অগ্রজ কবি রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, মুহাম্মদ নূরুল হুদাসহ আরো কয়েকজনকে দিতে। একসময় ষাটের অগ্রজ কবিদের সঙ্গে আমাদের গড়ে ওঠে হৃদ্যতা।
এমন কোনো স্মৃতি আছে কি যা বলা হয়নি তেমন করে?
আমার জীবনের একটি ঘটনা এখানে বলতে চাই আমি। ’৭৭ সালের ২৬ শে মার্চ। আদমজী জুট মিল। আমার আব্বা তখন সেখানকার চিফ লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার (প্রধান শ্রমকল্যাণ কর্মকর্তা)। ওখানে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে আমাকে ডাকা হয় কবিতা পড়তে। আমি মঞ্চে উঠে প্রথমেই বললামÑ ‘বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ ছাড়া এভাবে ২৬ শে মার্চের অনুষ্ঠান হতে পারে না।’ আমার এ কথা শুনে সবাই খুব সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো। আমি যথারীতি বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে কবিতা পড়লাম। এটা আমার জন্য অনেকটা সাহসী পদক্ষেপ ছিল। যিনি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছিলেন তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘ও তো আমাদের ভাতিজা, কবি। সে তার নিজ দায়িত্বেই এটা পড়েছে।’ আমিও দৃঢ়তার সঙ্গে বলিÑ ‘হা, আমি নিজ দায়িত্বেই তা বলছি।’ তবে এর জন্য পরবর্তী সময়ে আমার আব্বাকে অনেক মাশুল গুনতে হয়েছিল, হয়রানির শিকার হতে হয়েছিল।
আরেকটা স্মৃতি মনে পড়ছে। অনার্স শেষ হলো। মাস্টার্সের শেষ পর্ব। আমার জানা নেই, কবিতা পড়ে কেউ ডিপার্টমেন্টের ভাইভা বোর্ড থেকে পাস করেছে কিনা। আমার সেই সৌভাগ্য হয়েছে। ক্লাস করিনি। শিক্ষকেরাও কেউ আমাকে তেমন চেনেন না। ভাইভা বোর্ডে আমাকে দেখে তাঁরা সবাই রীতিমতো অবাক। আমি আবার কে? এর মধ্যে এক শিক্ষক আমাকে চিনতে পেরে বলেনÑ ‘ও তো কবি, ক্লাস-টাস করে না। তবে ভালো ছাত্র।’ একসময় শিক্ষকদের অনুরোধে স্বরচিত কবিতা পাঠ করে আমি ভাইভা বোর্ড পার করি। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় আমার প্রথম বই। বইটির নাম ‘মিছিলের সমান বয়সী’। দ্রাবিড় প্রকাশনী নাম দিয়ে আমরা নিজেরাই সেটা বের করি। মুহাম্মদ নূরুল হুদা ভাই, রুদ্র ও আমি মিলে এই প্রকাশনার যাত্রা শুরু করলাম।
প্রথম কাবগ্রন্থটি সমকালে যেমন আলোচিত ও সমাদৃত হয়েছে, তেমনি আপনার খ্যাতি ও পরিচিতির বিপুল বিস্তার ঘটিয়েছে। এ গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলো ব্যতীত ঐ সময়ের বাংলাদেশের কবিতার পূর্ণাঙ্গ আলোচনা সম্ভব নয় বলেই মনে করি।
‘মিছিলের সমান বয়সী’ কবিতাগ্রন্থের কবিতাগুলোর রচনাকাল (১৯৭৬Ñ১৯৮০) দেখে আজকের পাঠক সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন যে, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে জাতিসত্তার বিপর্যয় ও অনিশ্চিতয়ার অস্থির চিত্রের প্রকাশ ঘটেছে এ গ্রন্থের অধিংশ কবিতায়। এক অস্থির ও প্রতিকূল সময়ের কথা বলতে চেয়েছি আমি। জাতীয় জীবনের সামগ্রিক সংকট ও অনিকেত বাস্তবতার ক্রান্তিকালে আমার রক্তাক্ত পঙ্ক্তিমালা তারুণ্যের দ্রোহকে জাগিয়ে তোলে সাহসী ও স্পর্ধিত ভাষায়। নতুন বিন্যাসে পৃথিবীকে গড়তে চেয়েছি; কথা বলেছি হত্যার বিরুদ্ধে; খুলে দিয়েছি প্রতিক্রিয়াশীলদের মুখোশ; স্বপ্ন দেখেছি বৈষম্যহীন এক সমাজেরÑ অপ্রেমিক মানুষের ভ্রƒকুটি তুচ্ছ করে জয়গান গেয়েছি মুক্তিযুদ্ধ, আবহমান বাংলা, বাঙালি ও শাশ্বত প্রেমের।
এবার কর্মজীবন সম্পর্কে আসা যাক।
একাডেমিক পড়াশুনা শেষে ভাবলাম কিছু তো একটা করতে হবে। ভেবেছিলাম সাংবাদিকতা পেশায় যাবো। কিন্তু তেমন সুবিধাজনক কিছু পেলাম না। তাই অনেকটা স্বল্পকালের জন্য (প্রায় তিন মাস) যোগ দিলাম ন্যাশনাল ব্যাংকে। এর পর বিসিএস পরীক্ষা দিলাম। পাস করলাম। তৎকালীন শাহবাগে সিভিল অফিসার্স ট্রেনিং একাডেমি (বর্তমান বিসিএস ভবন) প্রশাসনে ট্রেনিং নিলাম। এর মধ্যেই প্রণয়সূত্রে বিয়ে করি নিজেরাই। আমার স্ত্রী ইফ্্ফাত আরা কামাল তখন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের ছাত্রী (বর্তমানে যুগ্ম সচিব, স্থানীয় সরকার বিভাগ)। এই ফাঁকে আমার পারিবারিক অবস্থানটি বলে নিই। আমার দুই সন্তান। ছেলে অমিয় সদনম চৌধুরী লেখক ও ইউ.ল্যাব-এর ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক। তার দুটি প্রকাশিত উপন্যাস হলো : মহাকাল (বাংলা), উইংস (ইংরেজি)। পুত্রবধূ : ফারিহা ফাইরুজ চৌধুরী কর্মরত আছে বিশ্বব্যাংকে। আর মেয়ে প্রতীতি রাসনাজা কামাল এ লেভেল পাস কওে এখন উচ্চতর শিক্ষায় ভর্তির অপেক্ষায় আছে।
যাই হোক, বিসিএস টেনিং শেষে আমার প্রথম পোস্টিং হয় রাঙামাটিতে। এর ফলে লেখালেখির আড্ডা থেকে আমি একেবাওে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। সেখানে আমার একটি মজার অভিজ্ঞতা আছে, যা বলা যেতে পারে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে যে পিলার বসানো হয় তখন স্থানীয় ম্যাজিস্টেটদের উপস্থিত থেকে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে হয়। একবার রাঙামাটির এক দুর্গম এলাকায় এমন পিলার বসানো হবে। আমি তখন সেখানকার ম্যাজিস্টেট। আধা ঘণ্টার নোটিশে আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো সেখানে। আমি গেলাম। কাপ্তাই থেকে হেলিকপ্টারে গিয়ে পৌঁছালাম তৎকালীন বিডিআর ক্যাম্পে। সেখান থেকে কখনো পাহাড়ের উপর দিয়ে, কখনো গলা সমান পানি ভেঙে ওই জায়গায় গিয়ে পৌঁছি। পিলার চেক করে বিডিআর ক্যাম্পে আসতে আসতে রাত প্রায় দশটা বেজে যায়। পাহাড়ের উপর বিশাল হেলিপ্যাড। তার ওপর শুয়ে পড়ি। চারিদিকে তখন ধবধবে জ্যোৎ¯œায় ভরে যায়। আর আমার গা পুড়ে যায় প্রচ- জ্বরে। বেহুশ হয়ে পড়ে থাকি অনেকক্ষণ। তাবুতে থাকতে হয় রাতে। দুই দিন পর কিছুটা সুস্থ হলাম। তাবুতে বসেই আমি লিখলাম ‘অরণ্যে বিলীন’ নামে একটি কবিতা। সেটা আমি পোস্ট করলাম আমাদের খাবারবাহী হেলিকপ্টারে করে ঢাকায়। পরের সপ্তাহে সেটা ছাপা হলো ইত্তেফাকে।
রাঙামাটিতে আমি প্রায় তিন বছর ছিলাম। রাঙামাটিকে আমি বলি, সরকারি চাকুরে জীবনের প্রথম প্রেম। ভয়ঙ্কর নান্দনিক সৌন্দর্য্য আছে সেখানে। কোনো কোনো সৌন্দর্য্য আক্রান্ত করে। এরপর সেখান থেকে অনেক জায়গায় গিয়েছি। কক্সবাজার আমার আরেক প্রিয় জায়গা। সমুদ্র আমার একটি প্রিয় অংশ। আমার একটি সনেট কবিতার বই আছে ‘ভ্রমণকাহিনি’ নামে। সেখানে ছোট ছোট পরিসরে উঠে এসেছে চা-বাগান, মাধবকুণ্ডের ঝরণা, রাবার বাগানসহ নানা প্রকৃতি ও নিসর্গের কথা। অনেকে ভাবতে পারেন, এটা হয়তো কোনো গদ্যের বই। আসলে ভ্রমণযাত্রাটা হচ্ছে আমার কাছে কবিতার যাত্রা।
আপনার কবিতা ও সাহিত্য-বিষয়ক ভাবনাগুলো জানতে চাই
কবিতার কাজটি খুব সহজ নয়। একটি উদাহরণ টেনে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক। যেমন : শূন্য (০) সংখ্যাটি যদি ডিজিট হিসেবে ধরা হয় তবে এর কোনো মূল্য নেই। তবে এটিকে যদি একটা নাম্বার হিসেবে ধরি, তবে এর গুরুত্ব আছে। কারণ নাম্বারটা যোগ হচ্ছে। ডিজিটাও যোগ হচ্ছে, তবে সেটা নাম্বার হিসেবে যোগ হচ্ছে। শূন্য সংখ্যাটি কোনো একটি পূর্ণ সংখ্যার ডানে বসালে মূল্য বেড়ে যায়, আর বামে বসালে কমে যায়। তার মানে হচ্ছে যে, সব কিছুর মধ্যে একটা ভ্যালু অ্যাড (মূল্য যোগ) করতে হবে। সেক্ষেত্রে সাহিত্যের ভ্যালুটা কী? সাহিত্যের একটা লিটারেরি প্রোপাটি বা সাহিত্য মূল্য আছে। লেখাটি যখন শুধু লেখা মাত্রই থাকে, তখন সেটার কোনো মূল্য নেই। এটা একটা বর্ণনা হতে পারে, অন্তর্গত বোধ হতে পারে। কিন্তু লেখার ভেতর যখন সাহিত্য মূল্যটা থাকবে তখন এটাকে আমি বলবোÑ এটা শিল্প হয়ে উঠেছে; কবিতা হয়েছে। এজন্য কোনো কিছুর সঙ্গে আমরা যখন মূল্য যোগ করতে যাই, তখন কাজটা কঠিন। বাংলার ইতিহাসে শত শত কবিতা রচিত হয়েছে। চারণ কবিরা যে কবিতা রচনা করে গেছেন তার ওপরই কাজ করছি আমরা। ওটা ছিল আমাদের কবিতার ভিত্তি। কবিতার কাজটি বেশ কঠিন। কারণ কবিতা অনেকগুলো জিনিসকে এক জায়গায় করে। আমার যে অভিজ্ঞতা তা আমি দেখছি, অনুভব করছি। উক্তি ও উপলব্ধিকে আমি একটা জায়গায় আনার চেষ্টা করছি। আমি দেখছি সেখানে ছন্দটা কাজ করে কিনা, সেখানে মেটাফোর কাজ করে কিনা, নন্দনতত্ত্ব কাজ করছে কিনা। শব্দ-আঙ্গিক-বিন্যাস সব কিছু মিলে শেষে ভাষাটা কিন্তু আর ভাষা থাকছে না। একটা ভাষাকে আমি অনেকগুলো মাত্রায় দেখে তাকে অন্য একটি জায়গায় নেয়ার চেষ্টা করি। কথন বার্তা, লেখনি বার্তা ও কাব্যিক বার্তা কিন্তু এক নয়। এই কাজটি যখন করতে হয় তখন একজন কবিকে আত্মস্থ করতে হয় বহু কিছু। তাকে তার সময়কে, আত্মজীবনীকে আত্মস্থ করতে হয়। কবি যাই লেখেন তা তার আত্মজীবনীর অংশ, সেটা তার স্বপ্নের অংশ। কবি মেমোয়াস লেখেন, কিন্তু তা আরেক জনের মতো নয়। কবি মেমোয়াস লেখেন ছোট ছোট বিন্দু দিয়ে। সেই বিন্দু থেকে সিন্ধু হবে কিংবা আলাদা ব্যাখ্যা হবে তা সময়ই বলে দেবে। আমরা আমাদের যাপিত জীবনের বহু অভিজ্ঞতাকে এক জায়গায় কম্পোজ করার চেষ্টা করি। ফলে কবিতাকে সময়ের থেকে বিচ্যুত করা যাবে না। কিন্তু এও মনে রাখতে হবে, শুধু আত্মজীবনী কবিতা না, শুধু স্বপ্ন কবিতা না, শুধু বাস্তবতা কবিতা না। তাহলে কোথায় কবিতা? আমি মনে করি, স্বপ্ন ও বাস্তবতার পরে যে জায়গাটি তৈরি হয় তা-ই কবিতা। যার সবটুকু ব্যাখ্যা করা যায় না। সেজন্য কবিতাকে বলা হয় রহস্যময়, কবিতাকে বলা হয় মনোজাগতিক। অবজেক্টটিভলি লিখলে কবিতা হবে না, কবিতার বিষয়টি গাণিতিক কিন্তু তার অনুভব হচ্ছে মনোজাগতিক।