পুলিশ সদস্যদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দমনে বাহিনীটির ব্যাপক সংস্কার (রিফর্ম) জরুরি বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান।
তিনি বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা পুলিশ বাহিনীর নিচের স্তরে সমস্যা ব্যাপক। মূলত ওই স্তরের সদস্যদের মাধ্যমেই অপরাধ কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়। বিচারহীনতা ও পুলিশকে রাজনৈতিভাবে ব্যবহারের প্রবণতা এ জন্য প্রধানত দায়ী। একই সঙ্গে পুলিশ সদস্যদের মানসিক উৎকর্ষ ঘটানোর মতো উন্নত প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। ফলে দীর্ঘ হচ্ছে এই বাহিনীর সদস্যদের অপরাধ কর্মকাণ্ড। এ থেকে বেরোনোর জন্য দ্রুতই বাহিনীটিকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার উদ্যোগ প্রয়োজন।
ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন এই অপরাধবিজ্ঞানী। তার সঙ্গে আলাপে ছিলেন মহিউদ্দিন মাহী।
ঢাকাটাইমস: এক ব্যাংক কর্মকর্তার পর ডিসিসির একজন পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শককে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে।
জিয়া রহমান: পুলিশ বাহিনীর যেসব সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে তারা নিচের সারির সদস্য। তাদের নিয়োগ দেয়া হয় টাকার বিনিময়ে। এ জন্য ভালো ছাত্র বা ভালো মানুষ এই জায়গায় নিয়োগ পায় না। টাকার বিনিময়ে যারা নিয়োগ পায়, তারা শুধু টাকার পেছনেই দৌড়ায়। সেখানে তাদের নৈতিক বিচার-বিবেচনা কাজ করে না।
ঢাকাটাইমস: তাহলে নিয়োগ-প্রক্রিয়াতেই সমস্যাটা বড়?
জিয়া রহমান: ঠিক, নিয়োগ-প্রক্রিয়াতেই সমস্যা। পুলিশে যারা বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ পান, তারা কিন্তু বাহিনীতে বেশ সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু নিচের স্তরে রাজনৈতিক সুপারিশে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পুলিশ নিয়োগ হয়। তাদের কাছ থেকে কীভাবে ভালো কিছু আশা করব আমরা। তাদের যেমন মানসম্মত কোনো প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না, তেমনি কোনো ধরনের মোটিভেশনই তারা পায় না। ফলে তাদের মানসিকতায় সমস্যা থেকেই যায়।
ঢাকাটাইমস: উপপরিদর্শকদের (এসআই) কিন্তু এক বছরের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
জিয়া রহমান: এক বছরে এসআইদের যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় সেটা তেমন কিছুই হয় না। ওখানে লেফট-রাইট করার মতো কিছু শারীরিক কসরত আর বন্দুক চালানোর বাইরে উন্নত মানসিক উৎকর্ষের জন্য কিছু করা হয় বলে জানি না। আসলে এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। আর সবচেয়ে বড় কথা, পুলিশ বাহিনী চলছে ব্রিটিশ আমলের আইন দিয়ে। তখনকার শাসক, শাসিত, পরিস্থিতি-পরিবেশের সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। তাই প্রয়োজন পুলিশ বাহিনীর আধুনিকায়ন।
ঢাকাটাইমস: সেটা কীভাবে সম্ভব?
জিয়া রহমান: ব্রিটিশ আইনটি সেই ১৮৬১ সালের। তখনকার শাসকরা পুলিশকে কাজে লাগাত ‘ফোর্স’ হিসেবে। স্বাধীন বাংলাদেশে এখনো সেই ফোর্স হিসেবেই রয়ে গেছে পুলিশ। সেবক হিসেবে তারা তৈরি হয়নি। ফলে পুলিশের মন-মানসিকতা আগের মতোই রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন খুবই জরুরি।
ঢাকাটাইমস: পুলিশ বাহিনীকে আধুনিকায়ন করলেই সমস্যার সমাধান হবে?
জিয়া রহমান: পুলিশ বাহিনীকে শুধু আধুনিকায়ন করলেই সব সমস্যার সমাধান হবে, তা না। একটা বড় অগ্রগতি হবে। সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হবে এই বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে পারলে। কারণ পুলিশকে সবাই রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে চায়। তারা পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে। এ জন্য পুলিশও সরকারের বাইরে কাউকে পরোয়া করতে চায় না। ফলে তারা ব্যক্তিগত অপরাধেও জড়িয়ে পড়ে।
ঢাকাটাইমস: পুলিশকে আধুনিক করে গড়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে অনেক দিন থেকে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। বাধা কোথায় বলে আপনি মনে করেন?
জিয়া রহমান: আসলে পুলিশকে আধুনিক ও চৌকস বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত ও দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু সব সরকারই তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশকে কাজে লাগানোর কারণে বিষয়টি সামনে এগোয় না।
ঢাকাটাইমস: পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতন-হয়রানির মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠছে। আগেও এমন অভিযোগ ছিল। কিন্তু থামছে না কেন?
জিয়া রহমান: বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অপরাধ বাড়ে। কোনো অপরাধের কারণে যদি কারো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হয়, তাহলে অন্য কেউ সেই অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা করে। তাই যে-ই অপরাধ করবে, তাকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। তাহলে এ ধরনের অপরাধ কমবে বলে আমি মনে করি।
ঢাকাটাইমস: আপনাকে ধন্যবাদ।
জিয়া রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।
(ঢাকাটাইমস/১৬জানুয়ারি/মোআ)