দেশে জেএমবির যেসব সদস্য গ্রেপ্তার হচ্ছে, তারা শীর্ষপর্যায়ের কেউ না। মধ্যম ও নিচু স্তরের নেতাকর্মী। তাদের গ্রেপ্তারের সময় কোনো পাল্টা আক্রমণের মুখে পড়ে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর অর্থ হলো তারা যথেষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। এখনই তাদের মূলোৎপাটন করতে হবে। তারা যখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে যাবে, তখন এটি মোকাবেলা করা কঠিন হবে।
এমনটাই মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরে জেএমবি সদস্যদের গ্রেপ্তারে পুলিশি অভিযান, সম্প্রতি জেএমবির কার্যক্রম দৃশ্যমান হওয়াসহ দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বলেছেন এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার এই টেলিফোন আলাপে ছিলেন মহিউদ্দিন মাহী।
ঢাকাটাইমস: মনে হচ্ছে দেশে জেএমবির নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হচ্ছে।
এম সাখাওয়াত হোসেন: জেএমবির নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হচ্ছে এটা এখন আর মনে করার পর্যায়ে নেই। বাস্তবেই জেএমবির নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হচ্ছে। এ কারণেই রাজধানীর মতো জায়গায় তারা আস্তানা গাড়ছে। মিরপুরের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় থেকে কীভাবে তারা এত দিন জঙ্গি কার্যক্রম চালিয়ে আসছে, সেটি বিস্ময়ের উদ্রেক করছে।
ঢাকাটাইমস: এত মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে্ কীভাবে তাদের কার্যক্রম চালানো সম্ভব হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?
এম সাখাওয়াত হোসেন: এটা তো পরিষ্কার যে, জেএমবি দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের দেশে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। বিভিন্ন সময় তাদের সদস্যদের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়েই সেটি প্রমাণিত। তারা অনেক চতুরতার সঙ্গে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে থাকছে। বিভিন্ন পরিচয়ে তারা বাসা ভাড়া করে কার্যক্রম চালাচ্ছে। কিন্তু এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক দায় আছে বলে আমি মনে করি।
ঢাকাটাইমস: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়ের বিষয়ে আরেকটু পরিষ্কার করে যদি বলেন।
এম সাখাওয়াত হোসেন: বৃহস্পতিবার মিরপুরে একটি বাসায় বড় অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের দাবি কয়েকজন জেএমবি সদস্যকেও সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো- খোদ রাজধানীতে তারা জঙ্গি কার্যক্রম চালাচ্ছে, কিন্তু পুলিশ এত দিন টের পায়নি। এর চেয়েও ভয়াবহ অবস্থান যে রাজধানীতে জেএমবির নেই পুলিশ সেটা নিশ্চিত করতে পারছে না। পুলিশের দায়িত্ব নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সেটা কিন্তু আমরা পাচ্ছি না।
মাঝে মাঝে জেএমবি গ্রেপ্তারের খবর জানা যায় বটে, কিন্তু শুধু বিচ্ছিন্নভাবে এই গ্রেপ্তার আর রিমান্ডে জেএমবি বা জঙ্গি দমন করা যাবে না। তাদের মূলোৎপাটন করা না গেলে সমস্যার সমাধান হবে না। এ ক্ষেত্রে পুলিশকে আরও দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে।
ঢাকাটাইমস: তার মানে জঙ্গি দমনে পুলিশের দক্ষতায় ঘাটতি আছে?
এম সাখাওয়াত হোসেন: পুলিশের দক্ষতায় ঘাটতি আছে, সেটা বলছি না। তাদের আরও বেশি প্রশিক্ষণ দিতে হবে। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সঙ্গে তাদের পরিচয় থাকতে হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, সন্ত্রাস দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেভাবে মনোযোগ দেয়া দরকার, সেভাবে তারা দিতে পারছে না। কারণ দেশে রাজনৈতিক টানাপোড়েন চলছে। সেদিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে পুলিশের আসল কাজের জায়গায় ঘাটতি পড়ে যাচ্ছে।
ঢাকাটাইমস: দেশে জেএমবির কার্যক্রমের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের কোনো যোগসাজশ আছে কি না?
এম সাখাওয়াত হোসেন: আমার মনে হয় বাংলাদেশে জেএমবি বা জঙ্গিরা যে ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলাচ্ছে, তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের আদর্শিক মিল থাকতে পারে। ফিজিক্যাল সম্পর্ক আছে কি না সেটা বলা কঠিন। তবে আদর্শিক সম্পর্ক যে আছে, সেটা অনুমান করা যায়।
ঢাকাটাইমস: সরকার বলছে দেশে কোনো জঙ্গি নেই।
এম সাখাওয়াত হোসেন: সরকার তো অনেক কথাই বলে। কিন্তু বাস্তবে তো আমরা দেখছি জঙ্গি আছে। পুলিশ অভিযান চালিয়ে জঙ্গিদের ধরছে। তাহলে সরকারের মন্ত্রীরা কীভাবে বলে দেশে জঙ্গি নেই।
ঢাকাটাইমস: বাংলাদেশে জেএমবির সাংগঠনিক কাঠামো কোন পর্যায় আছে বলে আপনি মনে করেন?
এম সাখাওয়াত হোসেন: সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে জেএমবি তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করছে। তবে এখনো তারা ভয়াবহ কিছু করার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি বলে মনে হয়। তারা সংগঠিত হচ্ছে। ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তাদের নেতাকর্মীরা মোটিভেশন প্রসেসের মধ্যে আছে। আজ মিরপুরের ঘটনায় মনে হচ্ছে, এখনো স্ট্রংলি মোটিভেটেড হতে পারেনি তারা। তাই এখনই তাদের লাগাম টানা দরকার।
ঢাকাটাইমস: জেএমবি ও জঙ্গি নির্মূলে করণীয় কী?
এম সাখাওয়াত হোসেন: জেএমবি ও জঙ্গি নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিতে হবে। রাজনৈতিক টানাপোড়েন পরিস্থিতির সমাধানও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে জঙ্গি দমনে। জঙ্গি সম্পর্কে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয় দরকার। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পন্ আর অত্যাধুনিক ডিভাইস ব্যবহার করে জঙ্গিদের আস্তানা শনাক্ত করতে হবে। শুধু পুলিশের বিচ্ছিন্ন অভিযান হলেই হবে না, যৌথ অভিযান পরিচলনা করে তাদের ধরতে হবে। এভাবে নানা কার্যকর পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে জঙ্গি নির্মূল হতে পারে।
ঢাকাটাইমস: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
এম সাখাওয়াত হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।
(ঢাকাটাইমস/২৫ডিসেম্বর/মোআ)