logo ২০ এপ্রিল ২০২৫
শামীম ওসমান যে কোটি কোটি টাকা লুট করেছে তার কী হবে
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
২৮ অক্টোবর, ২০১৫ ২০:৫৯:১৬
image


নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন কাজে দুর্নীতি ও অনিয়মের যে অভিযোগ স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমান এনেছেন তার কোনোটাই সত্য নয় বলে জানিয়েছেন মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনি বলেন, ‘তিনি (শামীম ওসমান) আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে গেছেন। সেখান থেকে তদন্ত হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্ট লেখা আছে যে, আর্থিক কোনো দুর্নীতির প্রমাণ মেলেনি। কিন্তু শামীম ওসমান তারপরও ওই অভিযোগ নিয়ে কেন দুর্নীতি দমন কমিশনে গেলেন, আমার বোধগম্য নয়।’ সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে নিজ কার্যালয়ে বসে ঢাকাটাইমসকে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।  



 





সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘তিনি (শামীম ওসমান) মন্ত্রণালয়কে দিয়ে একটা বিষয়ে তদন্ত করিয়েছেন। এতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু দুদকের এটা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি জনসভা ডেকেছেন, সেখানে শত শত মানুষের সামনে আমাকে প্রতীকী ফাঁসির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। প্রশ্ন, দুদক কি কাউকে ফাঁসি দিতে পারে? একজন জনপ্রতিনিধি হয়ে আরেকজন জনপ্রতিনিধিকে প্রতীকী ফাঁসি দেয়ার বিচার আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে চাই। নারী হওয়ায় তিনি আমাকে নিয়ে যেভাবে অশ্লীল ভাষায় কথা বলেন, তা কি তিনি করতে পারেন?’



 





পাল্টা অভিযোগও করেন নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র। বললেন, ‘আমার বিরুদ্ধে শামীম ওসমানের অনেক অভিযোগ। কিন্তু তিনি যে টেলিকমিউনিকেশনের মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকা লুট করেছেন, তার কী হবে?’



 





তাহলে শামীম ওসমান কেন আপনার বিরুদ্ধে এসব বলে বেড়াচ্ছেন? জবাবে আইভী বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের এলজিইডি কার্যালয় থেকে শুরু করে প্রতিটি কার্যালয় তার দখলে। একমাত্র সিটি করপোরেশন তিনি দখলে নিতে পারছেন না। সিটি করপোরেশনকে দখলে নেওয়ার জন্য এবং আগামী মেয়র নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি এসব মিথ্যা প্রচারণায় নেমেছে। তাকে অনুরোধ করব মিথ্যা প্রচার না চালিয়ে আমি যদি সত্যিকার অর্থে কোন দুর্নীতি করে থাকি সেটা তুলে ধরুন।’



 





নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন ‘ছিনতাই’য়ের অভিযোগও তুলেছেন মেয়র। বলেছেন, ‘আমি নারায়ণগঞ্জবাসীর বিনোদনের জন্য একটি পার্ক করেছি। শামীম ওসমান সেটার কৃতিত্ব ছিনতাই করেছেন। পার্ক বানিয়েছি আমি, উদ্বোধন করেছেন তিনি। তিনি নিজেও একটা পার্ক তৈরি করতে পারতেন। তখন জনগণ বুঝতো তিনি কাজ করেছেন। আমাদের মধ্যে কাজের প্রতিযোগিতা থাকতে পারে। কিন্তু এভাবে মিথ্যা প্রচার-প্রচারণার মানে কী?’



 





রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ার হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘বলা চলে, আমি নিরবে নিভৃতে জনগণের সাথে মিশে কাজ করছি। এমনকি দলীয় পদপদবির জন্য যদি কোন ঝামেলা হয়, তাই সেই পদ-পদবিও চাই না। এসব নিয়ে কোনো বিতর্কে আমি কখনো যাইনি। জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আমি মায়ের মত শ্রদ্ধা করি। তিনিও আমাকে ¯েœহ করেন। জয়বাংলা, জয়বঙ্গবন্ধু ছাড়া কোথাও যেতে পারব না। তাই দলীয় পদ-পদবীর জন্য কখনও বাড়াবাড়ি করিনি করবও না।’



 





সিটি করপোরেশনের মেয়র হওয়ার আগে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মেয়রও ছিলেন সেলিনা হায়াৎ। মেয়র হওয়ার পর গত চার বছরের উন্নয়ন কর্মকা- নিয়েও কথা বললেন তিনি। ‘গত চার বছরে নারায়ণগঞ্জ শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থার দিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। রাস্তাঘাট, পয়োনিষ্কাশন ড্রেন লাইন ইত্যাদি বেশি হয়েছে। মা ও শিশু হাসপাতাল করেছি। এতে অর্থায়ন করেছে সরকার, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং সিডাক। জলাশয় সংরক্ষণের প্রকল্প নিয়েছি। শহরের ভেতরে শীতলক্ষ্যার যে খাল রয়েছে সেটি ভরাট হয়ে গিয়েছিল। সেটি খনন করে সৌন্দর্য বর্ধনের উদ্যোগ নিয়েছি। এটা প্রায় ১০০ কোটি টাকার প্রকল্প।’ তিনি বলেন, ‘সিদ্ধিরগঞ্জে একটা বড় জলাশয় আছে। সেটি আমরা সংরক্ষণের জন্য জাইকার প্রকল্প হাতে নিয়েছি। জলাবদ্ধতা নিরসন একা করা সম্ভব নয়। এই প্রকল্পটি জুলাই থেকে শুরু হবে। ড্রেন করার পাশাপাশি ওপর দিয়ে মানুষের হাটা চলার ব্যবস্থা করে দেয়া হবে।’



 





শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর পাড়ের কদমরসুল অঞ্চলটিও সিটি করপোরেশনের মধ্যে। অথচ ওই এলাকাটি ইতিপূর্বে উন্নয়নের ছোঁয়া পায়নি। মেয়র জানালেন, উন্নয়ন কাজের একটা বড় অংশ ছিল কদমরসুল এলাকাকে ঘিরে। তিনি বলেন, ‘সিদ্ধিরগঞ্জ আর নদীর ওপার- এই দুইটা অঞ্চল একবারে অনুন্নত ছিল। সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভা কিন্তু ২০০৩ সাল থেকে। তাই সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভা ও কদমরসুলকে প্রাধান্য দিয়ে আমাকে কাজ করতে হচ্ছে। সেখানেও অনেক কাজ হয়েছে চোখে পড়ার মতো। তারপরও অনেক কাজ বাকি। তারমধ্যে মূল সড়কগুলো করার চেষ্টা করছি। আরও ছয় থেকে সাত মাস পর কাজগুলো চোখে পড়বে। ডিএনডির ভেতরে সারা বছরই পানি জমে থাকে। এই জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের অচিরেই আলাদা প্রকল্প নেওয়া উচিত।’ তিনি জানান, নদীর ওপাড়ে কদম রসুল অঞ্চলে অনেক রাস্তাঘাট ও ড্রেন হয়েছে। ১০০ ফুটের একটি রাস্তা হচ্ছে। রাস্তাটি মদনগঞ্জ থেকে মদনপুর পর্যন্ত। শহরের মাঝখান দিয়ে নয়টি ওয়ার্ডের সঙ্গেই সংযুক্ত হবে। এই রাস্তার কাজ চলছে। সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ৩০ কোটি টাকার কাজটি সেখানে হচ্ছে।



 





শীতলক্ষ্যার উপরে একটি সেতু করার পরিকল্পনার কথাও জানালেন মেয়র আইভী। বললেন, ‘শীতলক্ষ্যার পাঁচ নম্বর ঘাট দিয়ে একটি সেতু করতে যাচ্ছি এলজিইডির অর্থায়নে। তারা সম্ভাবতা যাচাই করে গেছে। অবকাঠামোগত নকশাও করা হয়েছে। প্রায় ৪২০ কোটি টাকার মতো লাগবে। আমরা সরকারের কাছে এ বিষয়ে লিখেছি। দাতা সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক ও জাইকার কাছে চিঠি দিয়েছি। আশা করি যেকোনো একটি দিক থেকে সাড়া পাবো। এছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জে একটি কমিউনিটি সেন্টার করছি। নদীর ওপারে কদম রসুল অঞ্চলে আরেকটি করার চেষ্টা করছি।’



 





আয়বর্ধক প্রকল্পও আছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের। ইতিমধ্যে এ কাজ অনেকটা এগিয়েছে। মেয়র বললেন, ‘নারায়ণগঞ্জে সিটি করপোরেশনের আয় বাড়ানোর জন্য মার্কেট কাম অ্যাপার্টমেন্ট করছি। শহরের মধ্যে সিটি করপোরেশনের কিছু জায়গায় অবৈধ দখলে ছিল। সেগুলো উদ্ধার করে সেখানে এই স্থাপনা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ১০ তলা করে তিনটি ভবন হয়ে গেছে। ফ্ল্যাট বিক্রি করেছি। আরও দুটোর কাজ চলছে।’



 





নারায়ণগঞ্জ শহরে নি¤œ ও মধ্যম আয়ের মানুষের আবাসন সংকট নিরসনে প্রকল্প হাতে নেয়ার চিন্তা চলছে। এনিয়ে আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন সেলিনা হায়াৎ। তিনি বলেন, ‘আবাসন সমস্যা দূর করার জন্য কম খরচে আবাসনের ব্যবস্থা করছি। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কথা হয়েছে। বস্তিবাসী, নি¤œ আয়ের মানুষের জন্য কম খরচে আবাসন করার চিন্তা করেছি। সরকারের কাছে কম খরচের আবাসিক প্রকল্পের প্রস্তাব জমা দিয়েছি। এটা আমাদের সুইপারদের জন্য। ঋষিপাড়া বস্তি নামে একটা এলাকা আছে। এদেরকে সাহায্য করার জন্য আমরা ইতিমধ্যে চারটি বড় ভবনের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছি।’



 





সময় খুব বেশি নেই। এক বছরের কিছু বেশি সময় হাতে আছে। এই সময়ের মধ্যে উন্নয়ন কাজগুলো কতটুকু গুছিয়ে আনতে পারবেন বলে মনে করেন? জবাবে মেয়র আইভী বললেন, ‘সব কাজ তো শেষ করা যাবে না। তবে শহরের তেমন কোন কাজ নেই। এখন শুধু শহরের সৌন্দর্যবর্ধন করা, সিটি সেন্টার নামে ২৫ তলার একটি বহুতল ভবন করা। এই কাজগুলোই শহরে হচ্ছে।’



 





শীতলক্ষ্যা নদীর দূষণ নিয়ে পরিবেশবিদরা বেশ সচেতন। এ নিয়ে সিটি করপোরেশনের কোনো উদ্যোগ আছে কি না? জবাবে সেলিনা হায়াৎ বলেন, ‘শীতলক্ষ্যার পানি দূষণরোধে আমরা জনসচেতনতা বিষয়ক কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। তার মধ্যে নদীর পাড়ে হাঁটার রাস্তা করে দেওয়া। ইতিমধ্যে বিআইডব্লিউটিএ কিছু করেছে। আমরা নদীর ওপাড়ে রাস্তা করব। এই পরিকল্পনাটা বাস্তবায়ন করতে পারলে দূষণ কমে আসবে। কারণ ৬০ শতাংশ দূষণ হচ্ছে শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য।ে শিল্প মালিকদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে দূষণ রোধ হবে না। তবে আমি যতটুকু জানি বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় একটা বড় অংকের পরিকল্পনা নিয়েছে ঢাকা শহরের আশেপাশে বুড়িগঙ্গা, বালু নদী, শীতলক্ষ্যা এসব নদীর পানি দুষণ রোধে।’



 





নারায়ণগঞ্জবাসীর বিনোদনের জন্যও আছে সিটি করপোরেশনের প্রকল্প। খেলার মাঠ, পার্ক স্থাপন করা হচ্ছে নগরবাসীর জন্য। মেয়র বললেন, ‘সিটি কর্পোরেশনের বিপরীতে একটা খেলার মাঠ আছে। এটা এক ধরনের  স্টেডিয়াম। আমরা ইতিমধ্যে এর চারপাশে হাটার রাস্তা করে দেয়ার জন্য দরপত্র আহ্বান করেছি। আর অন্যান্য ওয়ার্ডে যে সব খালি জায়গা আছে সেগুলোও আমরা জেলা প্রশাসনের কাছে চেয়েছি। কিছু গাছ লাগিয়ে মানুষ যেন অন্তত খালি জায়গায় হাটতে পারে এরকম ব্যবস্থা করব।’ তিনি বলেন, ‘শহরে একটি পার্ক করা হয়েছে। এছাড়া নদীর ওপাড়ে আরেকটি পার্ক করা হচ্ছে। ওটার নাম দেয়া হয়েছে শেষ রাসেল ইকো পার্ক। এরই মধ্যে সীমানা দেয়াল করা হয়েছে। দরপত্র আহ্বায়ন করা হয়েছে। বাকি কাজ ধীরে ধীরে হবে। ১০ তলা নগর ভবন করার জন্য দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছি। আমাদের সাত থেকে আটটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে থাকার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। তিনি সময় দিলেই কাজ শুরু হবে।’