logo ২০ এপ্রিল ২০২৫
যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ রপ্তানি হলে অনেক এগিয়ে যাবো আমরা: শফিউজ্জামান
২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ১০:৪৭:২০
image


যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ রপ্তানির চেষ্টা করছে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো। রপ্তানি আদেশ পেলে বাংলাদেশের জন্য বিরাট অর্জন বলে মনে করছেন এই খাত সংশ্লিষ্টরা। এমনটি হলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি ওষুধ শিল্প বিকাশে বিশাল অর্জন হবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি। সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান খোকন বলছেন, এই শিল্পে জনশক্তি তৈরিতে বাংলাদেশ এখন অনেকটাই সাবলম্বী। কাজেই এই দিক থেকে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।

এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘ওষুধ শিল্পে জনশক্তি দিন দিন বাড়ছে। শিক্ষিত লোকদের একটা বড় অংশ এ শিল্পে কাজ করছে। বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সাথে যুদ্ধ করে এদেশের ওষুধ শিল্প টিকে আছে। বার্ষিক টার্নওভার বিবেচনায় দেশের এক থেকে ১০টি ওষুধ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি নেই।’ ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে হার্টসন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, দেশের দুটি প্রতিষ্ঠান আমেরিকায় ওষুধ রপ্তানির অনুমতি পেয়েছে। আমেরিকার বাজার তো অনেক বড়। আরো তিন-চারটি কোম্পানি অনুমোদন পেতে চেষ্টা করছে। এটা আমাদের জন্য বড় অর্জন। ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআইয়েরও পরিচালক তিনি।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

বর্তমানে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

স্বাধীনতার পরে ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশের অনেক সফলতা আছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে। তবে আমার মতে, এই খাত যে উন্নতি হয়েছে তা বিস্ময়কর। কারণ, দেশের ১৭/১৮ কোটি মানুষ আমাদের তৈরি ওষুধই খাচ্ছে। আবার পৃথিবীর ৯২টিরও বেশি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছি। এটা খুব সহজ কাজ নয়।

বিশ্ববাজারে দেশের ওষুধ এখনও কি আমরা পর্যাপ্ত বিপণন করতে পারছি?

এর আগে আমি ওষুধ শিল্প সমিতির সভাপতি ছিলাম। ওষুধের অনেক বাজার ঘুরে দেখেছি। সেখানে বিপণনের দিক থেকে আরও সম্ভাবনা আছে। তবে আমরা এটাকে সমস্যা হিসেবে দেখি না। ধীরে ধীরে কাজ করে আমাদের অনেক উন্নতি হয়েছে। আমরা এখন গুণগত মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরি করি।

ওষুধের দাম নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। আসলে বিশ্ববাজারের তুলনায় দেশের বাজারে ওষুধের দাম কী অবস্থায় রয়েছে?

পৃথিবীর সব দেশের চেয়ে আমরা সস্তায় ওষুধ তৈরি করি। এমনকি ভারতেও চেয়েও সস্তায়। ভারতে যে প্যারাসিটামল ২ টাকায় বিক্রি করে, এখানে সেটা ১ টাকার কমে বিক্রি করি। অ্যান্টিবায়োটিকও ভারতের চেয়ে অনেক কম দামে বিক্রি হয়। এটা একটা বিশাল অর্জন।

ওষুধ শিল্পখাতে আমাদের দেশের জনশক্তি কী বাড়ছে?

অবশ্যই বাড়ছে। জনশক্তি তৈরিতে আমরা এখন অনেক সাবলম্বী। ওষুধ শিল্পের কর্মীরা শিক্ষিত। শিক্ষিত লোকদের একটা বড় অংশ এ খাতে কাজ করছে। বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুদ্ধ করে এদেশের ওষুধ শিল্প টিকে আছে। বার্ষিক টার্নওভার বিবেচনায় দেশের এক থেকে ১০টি ওষুধ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো বহুজতিক কোম্পানি নেই।

বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কোন দিক থেকে পিছিয়ে আছে?

এটি বার্ষিক টার্নওভার বিবেচনায়। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর টার্নওভার বেশি। সেদিক থেকে তারা অনেক পিছিয়ে।

ওষুধ কোম্পানিগুলো পরিচালনায় আমরা কি এখনও পরনির্ভরশীল?

বহুজাতিক কোম্পানির আগে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) যারা থাকত তারা সবাই কিন্তু এ দেশের নাগরিক। যেমন জিএসপি, সানোটি এভেন্টিস। এগুলো এমডিগুলো কিন্তু বাংলাদেশি। এর অর্থ হচ্ছে দেশের ফার্মাসিউটিক্যালস ব্যবসা দেশের লোকই করছে। যেমন- ক্যামিস্ট, ফার্মাসিস্ট সবাই দেশি। অর্থাৎ পরনির্ভরশীল হয়ে থাকার অবস্থা আর বাংলাদেশের নাই।

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে পোশাক তৈরি শিল্প এগিয়ে। ওষুধ শিল্পের বৈদেশিক আয় আরও বাড়ানোর উপায় কী?

পোশাক শিল্পের সাথে ওষুধ শিল্পের তুলনা করা ঠিক হবে না। বিদেশিরা একটা স্যাম্পল দিলে সেই অনুযায়ী বানিয়ে দিতে হয়। এখানে কারিগরি তেমন কিছু নেই। ফার্মাসিউটিক্যালস হলো পুরোপুরি কারিগরি বিষয়। আরেকটা বিষয় হচ্ছে পোশাক শিল্পের জন্য পৃথিবীর কোথাও নিবন্ধন লাগে না। যেমন- আমাদেরকে এখন জিএসপি সুবিধা দেয় না কিন্তু আমরা তো ঠিকই পোশাক বিক্রি করছি। ওষুধ পৃথিবীর কোনো দেশেই নিবন্ধন ছাড়া রপ্তানি করা যায় না। যে দেশে রপ্তানি করবেন সে দেশের আইন অনুযায়ী আবেদন করতে হবে। সব নিয়ম মেনে তারপর রপ্তানি করতে হবে।

বাংলাদেশ থেকে এখন কী পরিমাণ ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে?

পৃথিবীর ৯২টি দেশে ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। ২০১৩ সালে ছিল ৬০০ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে কিছুটা বেড়েছে। প্রত্যেক বছরই রপ্তানিতে অগ্রগতি আছে।

কোন দেশগুলোতে বেশি রপ্তানি হয়?

ফিলিপাইন, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, মঙ্গোলিয়া, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে।

ইউরোপ-আমেরিকার কোন দেশে কি বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হয়?

ইউরোপে হয়। গত মাসে দেশের দুটি প্রতিষ্ঠান আমেরিকায় ওষুধ রপ্তানিরও সুযোগ পেয়েছে। বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস এবং স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। আমেরিকার বাজার তো অনেক বড়। ওখানে বছরে তিন-চারটি অর্ডার পেলে খুব বেশি কিছু লাগবে না। আরো তিন-চারটি কোম্পানি অনুমোদন পেতে চেষ্টা করছে। এটা আমাদের জন্য বড় অর্জন।

ওষুধ শিল্প পার্কের কথা অনেকদিন থেকে শোনা যাচ্ছে। বর্তমানে এটি কী পর্যায়ে রয়েছে?

ওটা ওষুধ নিয়ে নয়, ওষুধের কাঁচামাল তৈরির করার জন্য হওয়ার কথা। এখানে আমাদের একটা সুবিধা আছে যে, আমরা এফজিসির সদস্য। এফজিসি হলো ৫০টা দেশের একটা সংগঠন। শিল্প পার্কে প্লট বরাদ্দ দেয়া শিগগির শুরু হবে বলে আশা করছি। এরপর সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করা হবে।

এফজিসির সদস্য হওয়ার সুবিধা কী?

এফজিসির সুবিধা হলো আমরা যে কোনো ধরনের ড্রাগ তৈরি করতে পারবো। গরিব দেশ হিসেবে এই সুবিধা আমরা পেয়েছি। আমরা বানালে খরচ কম হবে।

ওষুধ শিল্প পরিচালনা করতে গিয়ে আপনার কোনো ধরনের বাধার মুখোমুখি হচ্ছেন?

বড় কোনো সমস্যা নেই বললেই চলে। যেহেতু ওষুধ একটি স্পর্শকাতর বিষয় তাই সরকারও এ ব্যাপারে সতর্ক। কথা বলতে চাইলে সরকারের পক্ষ থেকে সময় দেয়া হয়। আমরা বলেছিলাম যে জিএফসি হলে আমাদের সুবিধা হয়। সরকার দিয়েছে এটা দেশের ইতিহাসে আলাদা একটা বিষয়।

দেশে এখন কতগুলো কোম্পানি ওষুধ উৎপাদন করছে?

ওষুধ কোম্পানির লাইসেন্স আছে ২৩০টি। অপারেশনে আছে ১৭৩টি।

বাকিগুলো এখনো উৎপাদনে আসেনি?

হয়তো অনেকে মূলধন জোগাড় করতে পারেনি। ঋণ পায়নি। আবার অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে।

কদিন আগে ওষধু প্রশাসন ঘোষণা দিয়ে বেশকিছু ওষুধের নিষিদ্ধ করেছে। ইতিপূর্বে যেগুলোর নিবন্ধন ছিল এবং ওইসব ওষুধ বিক্রি হতো।

হ্যাঁ, সরকার কিছু ওষুধের নিবন্ধন বাতিল করেছে। আসলে আমরা তো কোনো ওষুধ নিযে গবেষণা করি না। বিশ্বের উন্নত দেশে এগুলো নিয়ে গবেষণা হয়। যেসব ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এগুলো বিশ্ব বাজারেও নিষিদ্ধ হয়েছে। অথচ এক সময় তারাই এটা নিবন্ধন দিয়েছে। সেই অনুযায়ী আমাদের দেশেও নিবন্ধিত হয়েছে, উৎপাদন হয়েছে।

এখন কেন এগুলো নিষিদ্ধ হল?

আমেরিকা তাদের গবেষণায় দেখেছে যে এসব ওষুধ ক্ষতিকর। যেমন-প্যারাসিটামলের সঙ্গে মিথাইন নামের একটা পদার্থ মেশানো হতো। এটা একসময় অনুমোদিত ছিল। কিন্তু পরে গবেষণা করে দেখা গেছে, এটা মানবদেহের জন্য ক্ষতি ডেকে আনতে পারে, তাই উন্নত বিশ্ব এটাকে নিষিদ্ধ করেছে। সেই অনুযায়ী বাংলাদেশেও এগুলো নিষিদ্ধ হয়েছে।

কিন্তু এসব ওষুধ তো এতদিন  মানুষ খেয়েছে। তাদের কী স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে?

চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছেন বলে রোগী খেয়েছে। আর চিকিৎসক অতটুকুই পরামর্শ দিয়েছেন যেটা তার দেহের জন্য ক্ষতির কারণ হবে না। বেশি খেলে তো সব কিছুই ক্ষতির কারণ হতে পারে।

বাংলাদেশে ওষুধ নিবন্ধনের প্রক্রিয়া কী? চাইলেই যেকোনো ওষুধের নিবন্ধন পাওয়া সম্ভব?

না, চাইলেই সব ওষুধের নিবন্ধন পাওয়া যাবে না। ওষুধের নিবন্ধন নিতে হলে প্রথমে ওষুধ প্রশাসনে আবেদন করতে হবে। শুধু পৃথিবীর উন্নত দুটি দেশে নিবন্ধিত ওষুধই উৎপাদনের জন্য অনুমোদনের আবেদন করা যাবে। তখন কারিগরি কমিটি সেটা মূল্যায়ন করে আপনাকে অনুমোদন দিতেও পারে। আবার নাও দিতে পারে।

বাংলাদেশে অ্যাসেনসিয়াল ড্রাগের তালিকা তো বেশ পুরোনো, এখন এটা কী অবস্থা?

ওষুধ তো সবই অ্যাসেনসিয়াল। দরকার নেই এমন কোন ওষুধ নেই। আমার জানা মতে, ৩৫০টি ওষুদের একটি তালিকা আছে। এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে নির্ধারণ করা। সেখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট দেশ আলাদা তালিকা করে।

অনুমোদনহীন ওষুধ নিয়ে এখন বেশ তোলপাড় হচ্ছে। কদিন আগে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করা হয়েছে অনুমোদনহীন ওষুধ বিক্রি বা রাখার জন্য...

বেশির ভাগই ভারতীয় ওষুধ। যেগুলো অনুমোদন নেই সেগুলো তো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হবেই।

অনুমোদনহীন ওষুধের বাজারজাতকরণ বন্ধে ওষুধ শিল্প সমিতি কোনো উদ্যোগ আছে কি-না?

সারাদেশে আমাদের প্রতিনিধিদের বলা আছে, যেখানেই অনুমোদনহীন ওষুধের খবর পাবেন, আমাদের জানাবেন। আমরা এটা ওষুধ প্রশাসনকে জানাই। তারা অভিযান পরিচালনা করে। তাছাড় বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী কদিন আগে বলেছে, ভেজাল ও অনুমোদনহীন ওষুধের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। এটি অব্যাহত থাকলে এগুলো অনেকাংশে কমে আসবে।