‘আগস্টের ১৬ কি ১৮ তারিখে আমি ভারতের কল্যাণী উপশহরে মুক্তিযুদ্ধের প্রশাসনিক হেডকোয়ার্টার গেলাম। গিয়ে দেখি মেজর এম এ মঞ্জুর সেখানে বসে আছে। মঞ্জুর এসেছিল পাকিস্তান থেকে। তাকে দেখে অবাক হলাম। আমি জানি না যে সে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছে। প্রশ্ন করলাম, ‘কোত্থেকে আসলে তুমি?’ সে সব কথা বলল। জানাল সে একটা চিঠি নিয়ে সেখানে এসেছে। চিঠিটি ছিল ওসমানী সাহেবের। ওই চিঠিতে লেখা, ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে মেজর মঞ্জুরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মুজিবনগর সরকারের লজিস্টিক প্রধান করে। অথচ এ ধরনের কোনো পদ সেখানে ছিল না। এ ঘটনায় আমি বিস্মিত হলাম। কেন ওসমানী সাহেব এটা করলেন? তার সঙ্গে আমার কথা হল। তিনি স্পষ্ট বললেন, ‘আমি যা করেছি তাই হবে।’ জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকালীন সম্পর্কের টানাপড়েনের শুরুটা এভাবে তুলে ধরেন যুদ্ধকালীন ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী। তার কথায় এমএ মঞ্জুর ছিলেন জেনারেল ওসমানীর প্রিয়ভাজন। যে কারণে, পদোন্নতির দৌড়ে বরাবরই এগিয়ে ছিলেন তিনি। অথচ পদোন্নতির পাওয়ার যোগ্যতা থাকলেও বারবার বঞ্চিত হয়েছেন আবু ওসমান।
সম্প্রতি ঢাকার ধানমন্ডিতে নিজ বাসায় বসে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন যুদ্ধকালীন ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার। যেখানে উঠে এসেছে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতির ঘাতপ্রতিঘাত। ২১ ফেব্রুয়ারির সেই স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বল তার মানসপটে। ‘আনুমানিক চারটার দিকে প্রথম গুলি হলো। ভাগ্যবশত অথবা দুর্ভাগ্যবশত আমাদের গ্রুপের পরের গ্রুপের একটা ছেলের মাথায় লাগল গুলিটা লাগল। সঙ্গে সঙ্গে মাথার খুলিটা উল্টে গেল। সে পড়ে গেল। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তার ব্রেনটা (মস্তিষ্ক) খুলে পড়ে গেল মাটিতে। পরে আমরা তিনজন তাকে ধরে হাসপাতালের বিল্ডিংয়ের দিকে নিয়ে গেলাম। একটা ছেলে পড়ে যাওয়া ব্রেনটিকে দুই হাত একসঙ্গে করে তুলে হাসপাতালের দিকে দৌড় দিল। পরে শুনেছি ওটাই ছিল রফিকের লাশ।’ তার নেতৃত্বেই ২৬ মার্চ চুয়াডাঙ্গায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) প্রথম বিদ্রোহ করেছিল। সেই ঘটনা বলতে গিয়ে, ৪৫ বছর আগে ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। ‘উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বললাম, আপনাদের সামনে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমরা বিদ্রোহ করলাম। আপানারা পাশে থাকলে লড়াইয়ে জয়ী হবো আমরাই।... সবাই জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে আমাদের সঙ্গে সম্মতি জানালো।’ কথায় কথায় উঠে এসেছে ব্যক্তি জীবনের টুকরো টুকরো নানা স্মৃতিও। তবে পদোন্নতি বঞ্চিত আবু ওসমান পরে সঠিক মূল্যায়ন পেয়েছিলেন। সেটি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃতি। ‘বঙ্গবন্ধু তখন আমার আবেদনের ওপর দুটি ছত্র লিখলেন, এক- ‘অ্যালিগেশন অ্যাগেইনস্ট মেজর ওসমান ইজ বেজলেস।’ তখনই আমি জানলাম আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছিলেন ওসমানী সাহেব। দ্বিতীয় বাক্য হলো, ‘হিজ প্রমোশন ইজ গ্রান্টেড।’
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
আপনি কোথায় জন্মগ্রহণ করেছেন?
১৯৩৫ সালের ১ জানুয়ারি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানার মদনেরগাঁও গ্রামে চৌধুরী পরিবারে জন্মগ্রহণ করি। বাবা আব্দুল আজিজ চৌধুরী। তিনি স্কুলশিক্ষক ছিলেন। মা মাজেদা খাতুন। তিনি হাজীগঞ্জের কাঁঠালি গ্রামের কাজী পরিবারের মেয়ে।
বিয়ে করেছেন কত সালে?
১৯৬০ সালের ২৫ মার্চ নাজিয়া খানমকে বিয়ে করি। তার বাড়ি কুমিল্লার মৌলভীপাড়ায়। আমার মেয়ে নাসিমা ওসমান ও ফওজিয়া ওসমান। নাসিমা ওসমানের স্বামী ডা. তারেকউদ্দিন আহমেদ, তিনি একজন শিল্পপতি। ফওজিয়া ওসমানের স্বামী ইসমাইল মনসুর। তিনি ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের একজন কর্মকর্তা।
আপনার শৈশবটা কীভাবে কেটেছে?
শৈশব বলতে শুধু মাকে আমার মনে পড়ে। আমার বয়স যখন আড়াই বছর তখন তিনি মারা যান। তার কথা বেশি মনে রাখতে পারিনি। পরে শুনেছি অনেক সুন্দর ছিলেন তিনি। সেসবের ওপর ‘জীবন-জিজ্ঞাসা’ নামে আমার একটা কবিতা আছে। এর মধ্যে কয়েকটি লাইন মাকে নিয়ে লিখেছি-
‘তিনি ছিলেন পদ্মা-পূর্ব -পারের সুন্দরী,
আমি নাকি পেয়েছি তার মাত্র কানা-কড়ি।
সবার মুখে একই কথা ‘হুরপরী কি ছার’
রূপের অমন বাহার নাকি কেউ দেখেনি আর।
নিজ-দেহ- দৈর্ঘ্য-সম তাঁর মেঘবরণ চুল,
কান্তি বরণ দুধে-আলতা দুর্লভ তার তুল।’
আপনার চোখে পানি...
এ কবিতাটা পড়লে আমি আবেগ ধরে রাখতে পারি না। খুব কষ্ট হয়। মায়ের কথা মনে পড়ে। তাই কবিতাটা কম পড়ি। তবে আমার মায়ের সৌন্দর্যের কথা মুখে মুখে সব সময় বর্ণনা করি। আমার মনে থাকে।
মা মারা যাওয়ার পর আপনার বাবা আবার বিয়ে করেছিলেন...
হ্যাঁ, বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সৎমায়ের কথা মনে আছে। ‘জীবন-জিজ্ঞাসা’ কবিতার শুরুর দিকেও আমি এই বিষয়গুলো এনেছি। লিখেছি-
ফরিদগঞ্জের ছেলে আমি মা ডাকতেন ‘আবু’
মায়ের অকাল মৃত্যু মোরে করলো ভারী কাবু।
ছিলেম মোরা তিন ভাইবোন মায়ের আমানত,
রেখে গেলেন বাপের কোলে করতে হেফাজত।
ছ’মাস না যেতেই বাবা করলেন আরেক বিয়ে,
আমার মায়ের রেখে-যাওয়া গয়নাগাটি দিয়ে।’
আমি তো এসব গয়নাগাটি দেখিনি, শুনিনি। কিন্তু কবির কল্পনা থেকে কথাগুলো এসে গেছে। কিন্তু আমার সৎ ভাই কবিতাটা পড়ে জ্বলে আগুন হয়ে গেছে।
কেন তিনি রেগে গেলেন কেন?
ভাই এটা নিয়ে মায়ের (সৎমা) কাছে গিয়ে বলছে। হয়ত মা বলেছেন, না এ রকম কিছু হয়নি। আমার ভাই যখন আমার ওপর এটা নিয়ে রেগে গেলেন তখন আমি তাকে বলেছি, আমি তো কবি, আমার তো একটা কল্পনা আছে। সেখান থেকেই আমি এটা লিখেছি। এটার সত্যতা খোঁজার প্রয়োজন নেই।
কবিত্বকে নিজের ভেতরে লালন করে কি আনন্দ পান?
তা তো পাই। পাই বলেই কবিতা লেখি। আমার প্রতিটি কবিতাতেই ছন্দের মিল আছে। জীবনের উপলব্ধিগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছি কবিতায়।
খুব কম বয়সে মাকে হারিয়েছেন, তাহলে বুঝতে শেখার পর সৎমায়ের কাছেই বড় হয়েছেন?
হ্যাঁ, সৎ মায়ের ব্যাপারে সমাজে যত দোষ শোনা যায়, আমি এত দোষ আমি দেখিনি। তবে আমি দেখেছি বাবা আমাকে যতটা আদর করতেন মা ততটা আদর করতেন না। যা হোক, পরবর্তী সময়ে আমি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি। আমরা মায়ের গর্ভে আমরা দুই ভাই এক বোন। আমি ছোট থাকতেই বোনটা মারা গেছে। বড় ভাই আমার থেকে ছয়-সাত বছরের বড় ছিলেন। তার সঙ্গে সৎ মায়ের খুব একটা মিল ছিল না। যে কারণে লেখাপড়াও করেননি।
তাহলে আপনার ভাইয়ের জন্য পরিবারে থাকা কষ্টই ছিল বোধ হয়?
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বড় ভাই আসাম চলে যান। সেখানে যুদ্ধরত বিদেশি সৈন্যদের সঙ্গে ছিলেন। বেশ কিছুদিন পর সেখান থেকে বাড়ি ফিরে এসেছেন। কিন্তু তারপরও মায়ের সঙ্গে খুব একটা মিল হয়নি। সেই ভাই পরে পুলিশ বিভাগে ঢুকেছিলেন। সেখানে খুব তাড়াতাড়ি হাবিলদার হন।
আপনার বাবা তখন কী করতেন?
১৯৫৪ সালের দিকে আমাদের জমিদারি লোপ পায়। তখন আমার বাবা বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরতে বের হতেন। একসময় তিনি রাজবাড়ীতে যান। যেটা আগে ফরিদপুরের অধীনে ছিল। এখন আলাদা জেলা। সেখানে এক হিন্দু জমিদারের বাড়ি পেলেন। তিনি এটা কেনার জন্য বায়না দিয়ে বাড়ি এসে আমাদের জায়গা-জমি যা ছিল সব বিক্রি করে দিলেন। আমরা ছোট ছিলাম, যে কারণে আমাদের কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করেননি।
তিনি জায়গা-জমি বিক্রির টাকা নিয়ে কী করলেন?
বাবা সব টাকা নিয়ে ওই বাড়ি কিনলেন। বাড়ি ও আশপাশে মিলিয়ে মোট ৩০০ বিঘা জমি ছিল। এত বড় সম্পত্তি কে সামলাবে? আমার বাবা বড় ভাইকে বললেন, ‘তুমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে আস। তা না হলে এগুলো সামলাবে কে?’ এটা আমার কানে এল। তখন আমি চাঁদপুর কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিচ্ছি। পরীক্ষা চলছিল। আমি ভাইকে বললাম, আপনি চাকরি ছেড়ে আসবেন না। আমার পরীক্ষা অমুক তারিখ শেষ হবে। তারপর আমি আসছি।
আপনার ভাই কোথায় থাকতেন?
ভাই থাকতেন চট্টগ্রামের পুলিশ লাইনসে। সেখানে তার একজন বন্ধুও ছিল। তার নামটা ভুলে গেছি। তিনি খুব ভালো ছিলেন। পরীক্ষা শেষ করে ওই দিনই ট্রেনে করে সন্ধ্যা সাড়ে চারটা-পাঁচটার দিকে চট্টগ্রাম গিয়ে পৌঁছালাম। তখন মার্চ মাসের দিকের কথা। উঠলাম, চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনসে। গিয়ে দেখি আমার ভাই নেই, তার সেই বন্ধু আছে। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। আমি জিজ্ঞাস করলাম কী হয়েছে? তিনি বললেন, ‘আজই চাকরি ছেড়ে দিয়ে তোমার ভাই চলে গেছে।’ মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। চাকরি ছেড়ে তিনি যে বাড়িতে গেলেন, এটা তার জন্য কাল হলো। কারণ, তার সঙ্গে তো সৎ মায়ের সম্পর্ক ভালো ছিল না।
আপনার পড়াশোনা শুরু হয়েছিল কোন বিদ্যালয়ে?
আমি ১৯৪৪ পর্যন্ত আমার গ্রাম মদনেরগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছি। সেখান চার বছর পড়ার পর পঞ্চম শ্রেণিতে উঠলাম। পরে পাশের গ্রামে মানিকরাজ নি¤œ মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হলাম। সেখানে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলাম। সেখানে তো আর সপ্তম শ্রেণি নেই। ছাড়পত্র নিয়ে ভর্তি হলাম চাঁন্দ্রা ইমাম আলী হাই ইংলিশ স্কুলে।
এটা কত সালের কথা?
১৯৪৭ সালের কথা। তখন কিন্তু ভারত ভাগ হচ্ছে। ভারত ভেঙে পাকিস্তান হলো। পাকিস্তান এটাকে পূর্ব পাকিস্তান করল। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়ে গেল। এসব কারা লাগাল, কেন লাগল এগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আমার নেই। আমার শিক্ষকদের বেশির ভাগই হিন্দু। তখন মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাই ছিল না বলতে গেলে। দেখলাম, হিন্দু শিক্ষকরা আমার চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছেন।
চাঁন্দ্রা ইমাম আলী হাই স্কুলে কতদিন পড়াশোনা করেছিলেন?
১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ দীর্ঘ চার বছর চাঁন্দ্রা ইমাম আলী হাই ইংলিশ স্কুলে লেখাপড়া করি। আমার জ্যাঠা (বাবার বড় ভাই) আব্দুল হাকিম মিয়া ১৯১৮-২০ সালে তিনি কলকাতা থেকে পাস করে এলেন। তৎকালীন সময়ে তিনি ছিলেন গোটা চাঁদপুর বিভাগের প্রথম মুসলিম গ্রাজুয়েট। আমার জ্যাঠাতো ভাই নুরু ছিলেন ফরিদগঞ্জ থানার প্রথম এমএ পাস। আমাদের বাড়ি থেকেই মূলত মুসলমানদের বিদ্যার শুরু। কিন্তু খুব দুর্ভাগ্য যে, এখন ওই বাড়িতে বিদ্বান লোক একজনও নেই।
তখন ওই স্কুলের শিক্ষকদের কথা মনে আছে?
আমার জ্যাঠা ছিলেন চাঁন্দ্রা স্কুলের হেডমাস্টার। অত্যন্ত দোর্দ- প্রতাপের মানুষ ছিলেন। তার সময়ে স্কুলের সার্বিক শৃঙ্খলা ছিল অনেক ভালো। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে ছিল খুবই মধুর সম্পর্ক। ১৯৪৭ সালে অসুস্থতার কারণে তিনি স্কুল থেকে অব্যাহতি পান। তারপর হেডমাস্টার হন হাজীগঞ্জ নিবাসী আবদুল গণি সাহেব। তিনি ছিলেন শিক্ষার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। মেধাবী ছাত্রদের তিনি অত্যন্ত ¯েœহ করতেন এবং যতœসহকারে তাদের বিশেষভাবে পড়িয়ে পরীক্ষার জন্য গড়ে তুলতেন। তার ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও পরিচালনায় আমরা অনেক কিছু শিখেছি। যা পরবর্তী জীবনে কাজে লেগেছে।
প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন কবে?
১৯৫১ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত প্রবেশিকা পরীক্ষায় (মাধ্যমিক পরীক্ষা) আমি প্রথম বিভাগে পাস করি। সে বছর আমরা তিন বন্ধু আবদুল মান্নান মিয়া (মারা গেছেন), লুৎফর রহমান তফাদার এবং আমি প্রথম বিভাগ পেয়েছিলাম। দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেছিলেন ছয়জন।
প্রথম বিভাগে পাসের খবর পেয়ে আপনার অনুভূতি কেমন ছিল?
যখন পাসের খবর পেলাম তখন আমি মানিকরাজ স্কুলে হাডুডু খেলছিলাম। একজন এসে আমাকে বলল, পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে তুমি তো ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করেছ। শুনেই যে শার্ট খুলে খেলছিলাম সেটা নিয়ে এক দৌড়ে বাড়িতে গেলাম। গিয়েই হাত মুখ ধুয়ে আবার শার্টটা পরে স্কুলে গিয়ে দেখলাম কথা ঠিক আছে। আমি ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছি। তখন যে কী খুশি লেগেছে তা আর এখন বোঝানো যাবে না। আমার আগে আমার বাড়িতে কেউ প্রথম বিভাগে পাস করেনি। যে জ্যাঠার কথা বলেছি তিনিও সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করেছিলেন। আর নুরু ভাই ফরিদগঞ্জের প্রথম এমএ, তিনিও সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করেছেন। আমিই প্রথম আমার পুরো পরিবারে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছি।
স্কুলজীবনের সহপাঠীদের কথা মনে আছে?
আমরা একসঙ্গে ৪০ জন ছাত্র ছিলাম। কিন্তু কয়েক যুগ পরে এসে আবদুল মান্নান, লুৎফর রহমান, আবদুর রশীদ, আবুল হোসেন (খারখাদিয়া), আবুল হোসেন (সেকদী), আবিদ মিয়া বকাউল ছাড়া আর কারো নাম বিশেষভাবে মনে পড়ছে না। তবে হ্যাঁ, ক্লাস ছিটকে পড়া একজনের নাম খুব মনে পড়ছে, মদনেরগাঁও বুড়িয়ার বাড়ির আবুল হোসেন। যাকে আমরা ‘আবুইল্লা’ বলে ডাকতাম। সে খুব ভালো ফুটবল খেলত। মনে আছে, বাঁ পায়ের শটে সে স্কুলের চাপকল ভেঙে ফেলেছিল।
আপনিও কি ফুটবল খেলতেন?
খেলতাম। এ নিয়ে একটা অম্লমধুর স্মৃতিও আছে। স্কুলের ফুটবলদলে আমি মূলত ফুলব্যাক ও লেফট আউটে খেলতাম। ১৯৫১ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার দুই মাস আগে আমাদের দল কৃষ্ণপুর গ্রামের বিরুদ্ধে খেলতে গিয়েছিল। আমি ফুলব্যাক হিসেবে প্রতিপক্ষের দিক থেকে আসা একটা উড়ন্ত বলকে হেড দিয়ে নিচে পড়ার আগে প্রতিপক্ষের একজন খেলোয়াড় আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। সে খুব মোটা ছিল। আমি বাঁ হাতের কনুইয়ের ওপর ভর করে পড়েছিলাম। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার যে, সঙ্গে সঙ্গে আমার কনুই ও কব্জির মাঝখানের হাড় ভেঙে বাঁকা হয়ে যায়। বন্ধুরা দৌড়ে এসে আমার বাঁকা হাতটি পায়ের নিচে রেখে জোর করে সোজা করেছিল।
তারপর কী হলো? চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়নি?
বন্ধুরা হাতে জলপট্টি বেঁধে আমাকে ধরে ধরে হাঁটিয়ে চাঁন্দ্রাবাজার বসন্ত ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। বসন্ত ডাক্তার হাত দেখে একটা মলম মাখিয়ে দিলেন। কিন্তু হাড় ভেঙে যাওয়ার কারণে আমার হাত এমনভাবে ফুলে গিয়েছিল যে কাপড়-চোপড়ও নিজে পরতে পারতাম না অন্যের সাহায্য ছাড়া। এভাবে ২০ দিন কাটানোর পর প্রায় ১২ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে কোনো এক গ্রামের মুরব্বির স্বপ্ন পাওয়া ওষুধের খোঁজ পেলাম। কিন্তু সে পর্যন্ত আমার হাড় বাঁকা অবস্থায়ই জোড়া লেগে গিয়েছিল। যা হোক, ওই স্বপ্ন পাওয়া ওষুধের গুণে মাত্র এক মিনিটের মধ্যে আমার হাতের ফোলা ও ব্যথা একেবারে ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেল। কিন্তু বাঁকাভাবে জোড়ালাগা হাড় আর সোজা হয়নি। এটা অবশ্য মুরব্বি সাহেব আগেই বলেছিলেন। পরে সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে নির্বাচনী স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা প্রশিক্ষণকালীন কঠিন ধকলেও আমার হাতের কোনো অসুবিধা হয়নি। এটা স্কুলজীবনের মধুর কিন্তু মর্মান্তিক স্মৃতি বটে।
আপনাদের সময় তো এত সুযোগ-সুবিধা ছিল না। অনেক কষ্ট স্বীকার করে পড়াশোনা করতে হয়েছে নিশ্চয়ই?
খুব কষ্ট করে পড়তে হয়েছে। বিদ্যুৎ ছিল না। কুপির আলো ছিল ভরসা। সেগুলো না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। নিজে গাছে উঠে কলাপাতা কেটেছি লেখার জন্য। ঘরে কুপির ওপরে সেই কলাপাতা ধরেছি, কালি পড়েছে। ওই কালি গুলিয়ে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে কলম বানিয়ে লিখেছি। এ রকম কষ্ট করে পড়েছি।
পরে কলেজে ভর্তি হলেন কোথায়?
আমার জ্যাঠাতো ভাই (নুরু ভাই) আমাকে বললেন, তোমাকে ঢাকা কলেজে ভর্তি হতে হবে। অবাক হলাম। কারণ, তখন তো ঢাকা কলেজ পুরো পূর্ব পাকিস্তানের সেরা কলেজ। বললাম, এটা কি সম্ভব? তিনি বললেন, ‘সমস্যা নেই তোমার সার্টিফিকেট আছে। তুমি যোগ্য।’ এবার টাকা-পয়সা? গ্রামের বাড়ি ধান-চাল সবই আছে কিন্তু টাকা কোথায়? আব্বা নুরু ভাইয়ের সে কথা রেখেছেন। তিনি লোক লাগিয়ে দিলেন ধান বানতে। ধান ভেঙে চাল করার কাজে। এভাবে পাঁচ মণ চাল বের করেছে। এই পাঁচ মণ চাল বিক্রি করে তিনি আমাকে টাকা দেন। সেই টাকা নিয়ে আমি ঢাকায় চলে আসি।
ভর্তি হতে কোনো সমস্যা হয়েছিল?
স্কুলের সার্টিফিকেট দেখালাম। ভর্তি হতে কোনো অসুবিধা হয়নি। সায়েন্সে ভর্তি হলাম। যেটাকে আইএসসি বলা হতো। আমি পরীক্ষা দেওয়ার দেড় মাস পরে আমাদের রেজাল্ট বের হয়েছে। তাই ঠিক সেশনে ভর্তি হতে পারলাম ১৯৫১ সালে। পরীক্ষাও দিয়েছি চাঁদপুর গিয়ে। এখন তো স্কুলেই হয়। এই স্কুলের সেন্টার, মাদ্রাসার সেন্টার কিন্তু আমি আনিয়ে দিয়েছি। আমি তখন ওখানকার কর্মকর্তা।
ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থাকতেন কোথায়?
ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম জুলাইয়ের শেষভাগে। নুরু ভাই তখন বংশাল রোডের একটা মেসে থাকেন। ওই মেসে আবার আমার অনেক বড় একজন বোনের স্বামী থাকতেন। তিনি তখন ওখানকার একটা সিনিয়র মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। সেখানে থেকে খরচ চালানোর একটা ব্যাপার তো আছে। খাওয়াদাওয়া আছে, মেসের ভাড়া আছে। বাবাকে তো আর অত চাপ দেওয়া যায় না। তখন আমি একটা টিউশনি নিলাম একটা ছেলেকে পড়াব। তারা এক বেলা খাওয়াবে। আর হয়ত কিছু টাকা-পয়সা দেবে। ৫১ সালের কথা তো কত টাকা দিয়েছিল বা কোন বাড়িটা এখন আর মনে নেই। পড়ানোর সময়টা মনে নেই, তবে দুপুরের খাবারটা ওখানে খেতাম। দুপুরের খাবারের একটা অভিজ্ঞতা সেখানে আছে।
কী সেই অভিজ্ঞতা?
এগুলো লেখার মতো নয়। তারপরও বলি, প্রথম দিন যখন খাবার আনল তখন একটা প্লেটে ভাত আরেকটা প্লেটে তরকারি নিয়ে এল। আমি তো তখন যুবক। ওই ভাত তিন লোকমায় খেতে পারি। ভদ্রতা দেখাতে গিয়ে কিছু ভাত রেখে বাকিগুলো আলাদা প্লেটে তুলে নিয়ে খেলাম। পরদিন আবার খাবার সময় হলো। আমি বুঝে গেলাম গত দিন যত ভাত কমিয়েছি আজকে তারা অতটুকু ভাত কমিয়ে এনেছে। তারপরও আমি ওই দিন কিছু ভাত রেখে দিলাম। সব ভাত খেয়ে ফেলতে নিজের কাছে লজ্জা লাগছিল। তৃতীয় দিন দেখলাম ভাত আরও কমিয়ে দিয়েছে। আমি মনে মনে ভাবলাম এভাবে চলতে থাকলে তো আমি শেষ হয়ে যাব। আমার খাবারই তো শেষ হয়ে যাবে। সেদিন আমি সব ভাত খেলাম। এটাই তাদের স্ট্যান্ডার্ড হয়ে গেল এভাবেই তারা দিত।
এরপর তো এল ১৯৫২ সাল...
হ্যাঁ, ১৯৫২ সাল। মনে আছে, স্কুলজীবনে আমরা সভা তো করতাম না, মিছিল করতাম রাষ্ট্রভাষার জন্য। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এসব স্লোগানের কথা মনে আছে। তো, ফেব্রুয়ারি মাস এল। এর আগে অনেক মিছিল হয়েছে, সেখানে আসা-যাওয়া করেছি। কিন্তু আমার ওপর অনেক নিষেধাজ্ঞা ছিল। নুরু ভাই ও আমার দুলাভাই দুজনেই আমার মুরব্বি। তারা মিছিলে যেতে নিষেধ করতেন। আবার কলেজে গেলে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ঠিকই যেতাম। এভাবে ২১ ফেব্রুয়ারি এল।
২১ ফেব্রুয়ারি ঘটনা মনে আছে?
ঘোষণা হলো, পূর্ব পাকিস্তানের সব স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকবে। সেখানে মিটিং, মিছিল হবে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে। তখন নুরুল আমিন সরকার বোধ হয়। এই সরকার নতুন একজন জেলা প্রশাসক আনল ঢাকায়। সেই ডিসি ১৪৪ ধারা জারি করল ২১ ফেব্রুয়ারিতে। যখন ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার আগে আগে মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে, পরদিন থেকে ১৪৪ ধারা।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে কমিটি হয়েছিল...
হ্যাঁ, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার আন্দোলনের কমিটি হয়েছে। সব ছাত্র মিলে মিটিং করল। সেই মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হলো ১৪৪ ধারা ভাঙব না। ভাঙলে অসুবিধা আছে। কিন্তু এটা অলি আহাদ, গাজীউল হক, এম আর আকতার মুকুলরা মানলেন না। তারা বেরিয়ে এলেন। তাদের সঙ্গে আরও সমর্থকরা বেরিয়ে গেল। পরে ভোটাভুটি হলো, কারা কারা ১৪৪ ধারা ভাঙতে চাও না? অনেকে হাত তুলল। অর্থাৎ ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষেই বেশির ভাগ। সিদ্ধান্ত হলো মিছিল বের হবে না।
পরদনি কী হল?
পরদিন সকাল ৭টার দিকে আমরা কলেজে গিয়ে দেখি সব বন্ধ। আমরা চলে গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায়। ওখানে একজন-দুজন করতে করতে কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী হয়ে গেল। একসময় ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) ড. সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেনসহ অন্য অধ্যাপকরা এসে বললেন, ‘তোমরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করো না। এতে শান্তি নষ্ট হবে। মারামারি হবে এতে ভালো না। তখন ছাত্ররা ভিসিকে বলল আপনি যদি আমাদের মিটিংয়ের সভাপতিত্ব করেন তাহলে আপনার কথা মানতে রাজি আছি।’
ভিসি কি সভাপতিত্ব করেছিলেন?
এটা তো সম্ভব ছিল না। ছাত্রদের সঙ্গে ভাইস চ্যান্সেলর আন্দোলন করবে- এটা তো হয় না। তখন ওনার যাওয়ার পর এম আর আকতার মুকুল একটা টেবিলে লাফ দিয়ে উঠে ঘোষণা দিলেন, আজকের সভা এখন শুরু হবে এবং সভায় সভাপতিত্ব করবেন গাজীউল হক। কমরুদ্দিন আহমদ প্রস্তাব সমর্থন করেন। সভা শুরু হলো। সবাই সিদ্ধান্ত নিল আমরা ১৪৪ ধারা ভাঙব। তা না হলে আমাদের বাংলা ভাষার আন্দোলনের গতি বন্ধ হয়ে যাবে।
১৪৪ ধারা ভাঙার কর্মসূচি কীভাবে শুরু হল?
সিদ্ধান্ত হল, ১০ জন করে আমরা একেকটি দলে বের হব এবং প্রথম গ্রুপ হবে মেয়েদের। এভাবে প্রথম গ্রুপ গেল। পুলিশ সব মেয়েকে ধরে গাড়িতে উঠিয়ে ফেলল। দ্বিতীয় ব্যাচ গেল ছেলে। সেটাও গাড়িতে তুলে ফেলল। তৃতীয় ব্যাচকে ধরার আর সুযোগ পেল না। ওটা দেখে সব ছেলে একসাথে বের হওয়া শুরু করল। তখন আর ব্যাচের আর কোনো চিন্তা নেই। কাজেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করল। এদিক থেকে শুরু হলো ইটপাটকেল ছোড়া। পুলিশ ছাড়ছে কাঁদানে গ্যাস। দুর্ভাগ্যবশত ওই দিন ওদের দিক থেকেই বাতাস আসছিল। পুলিশ ওখানে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে আর সব বাতাসে আমাদের দিকে উড়ে চলে আসে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটা পুকুর ছিল। ওখান থেকে বালতিতে করে পানি আনা, চোখে পানি দেওয়া চলল একদিকে অন্যদিকে ইটপাটকেল যুদ্ধ তো চলছেই।
এই লড়াই কতক্ষণ চললো?
তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার গেট একটাই। পাশেই হলো মেডিকেল কলেজের একটা বিল্ডিং। তখন এই একদিক দিয়ে ওদের সাথে যুদ্ধটা সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় আর মেডিকেলের মাঝখানে একটা ইটের দেয়াল ছিল। দেয়াল ভেঙে ছাত্ররা বিদ্রোহে গর্জে উঠল। চেষ্টা করল ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেট দিয়ে বের হবে। সারাদিন ইটপাটকেল যুদ্ধ করার পর সবাই ক্লান্ত হলো।
মিছিল বের হয়েছিল কখন?
কোনো একটা সময় ছাত্রদের একটা মিছিল বের হলে সেটার ওপর হামলা হলো। পরে তিনটা-সাড়ে তিনটার দিকে পরিস্থিতি একটু শান্ত হলো। আমরা সবাই মেডিকেল এলাকায়। তখন মেডিকেলে সব শেড বিল্ডিং হয়নি। শেডের নিচে দোচালা ঘর। এই ঘরগুলোর দেয়াল অর্ধেক তার ওপর ছাউনি। আমরা সেখানে পরে আমাদের পদক্ষেপ কী হবে, সবাই চার-পাঁচজনের গ্রুপ করে আলোচনা, কথাবার্তা বলছি। আনুমানিক চারটার দিকে প্রথম গুলি হলো। ভাগ্যবশত অথবা দুর্ভাগ্যবশত আমাদের গ্রুপের পরের গ্রুপের একটা ছেলের মাথায় লাগল গুলিটা লাগল। সঙ্গে সঙ্গে মাথার খুলিটা উল্টে গেল। সে পড়ে গেল। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তার ব্রেনটা (মস্তিষ্ক) খুলে পড়ে গেল মাটিতে। এমন আচমকা ঘটনাটা ঘটল যে আমরা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। পরে আমরা তিনজন তাকে ধরে হাসপাতালের বিল্ডিংয়ের দিকে নিয়ে গেলাম। একটা ছেলে পড়ে যাওয়া ব্রেনটিকে দুই হাত একসঙ্গে করে তুলে হাসপাতালের দিকে দৌড় দিল। পরে শুনেছি ওটাই ছিল রফিকের লাশ। কিন্তু তার সাথে আমাদের তেমন জানাশোনা ছিল না।
আন্দোলনের প্রথম শহীদ কি রফিকই ছিলেন?
আমরাও মনে করেছিলাম ওই আন্দোলনের প্রথম শহীদ রফিক। কিন্তু আমরা মেডিকেল কলেজের করিডরে যাওয়ার পর দেখলাম আরো একজনকে গুরুতর আহতাবস্থায় জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়েছে, তার নাম বরকত। এরপর আমরা সরে যেতে যেতেই আরো কিছু লাশ পড়ে গেল। একের পর এক গুলি হচ্ছে। তারা বাইরে থেকে মারছে। ছেলেরা তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলাপ-আলোচনা করছে এসব গ্রুপের মধ্যেই গুলি মারছে। গুলিবিদ্ধদের রক্তমাখা শার্টগুলো খুলে বাঁশের মাথায় বেঁধে ওপরে তুলে ধরা হচ্ছে। ভেতরে আন্দোলন হচ্ছে। ইটপাটকেল তো চলছে। এভাবেই শেষ হলো ওই দিনটা।
আন্দোলনের পরিবেশ যখন ঠা-া হয়ে এল তখন আপনি তখন কোথায় ছিলেন?
এর কিছুদিন পর আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমার জ্বর হয়েছে। আস্তে আস্তে যখন জ্বর বাড়ছিল তখন আমাকে বাড়িতে নিয়ে গেল আমার বাবা। একনাগাড়ে আমি এক বছরেরও বেশি সময় আমি অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে ছিলাম। ধরা পড়ল ম্যালেরিয়া। এই সময়ের মধ্যে ম্যালেরিয়া কালাজ্বরে পরিণত হলো। আমার মনে আছে চাঁন্দ্রাবাজারে অশ্বিনী ডাক্তার ছিলেন। তিনি বললেন, এখন আমার কাছে চিকিৎসাটা সহজ হয়ে গেছে। যেহেতু এটা কালাজ্বরে পরিণত হয়েছে। এখন ১২টা ইনজেকশন দিতে হবে। প্রতিদিন একটা করে তলপেটে। এই চিকিৎসা শুরুর ১২ থেকে ১৩ দিনের মধ্যে আমার জ্বর কমে গেল। আমি সুস্থ হলাম।
দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন, পড়াশোনার কী হল?
আমি যখন অসুস্থ হই তখন ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উঠব এমন সময়। আমার সেশন ছিল ১৯৫২-৫৩ সাল। অসুস্থতার কারণে সময় চলে গেল। ’৫৪ সালের পরীক্ষা সামনে। আমি সুস্থ আছি, কিন্তু ভর্তির সময় চলে গেছে। তখন আমার সেই নুরু ভাই এবং আরেক ফুফাতো ভাই দুজনে মিলে পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা বোর্ড থেকে বিশেষ একটা অনুমতিপত্র এনে দিলেন। বলল, ‘এটা দেখিয়ে তুমি ভর্তি হও যেখানে তোমার সুবিধে হয়।’ ভর্তি হলাম চাঁদপুর কলেজে। সায়েন্সে ভর্তি হলাম না, হলাম মানবিক বিভাগে। পরীক্ষা হওয়ার কথা এপ্রিলে। আমি ভর্তি হয়েছি খুব সম্ভব আগের বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে। হাতে খুব কম সময়।
চাঁদপুর কলেজে ভর্তি হয়ে থাকতেন কোথায়?
চাঁদপুরে মদনেরগাঁও গ্রামের চৌধুরীবাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে শেখদি হয়ে ফেরি পার হয়ে চাঁদপুরে চলে আসতাম। সকালে রওনা হয়ে হেঁটে আসতাম ক্লাস করে আবার বিকেলে ফিরে যেতাম। দৈনিক ১২ মাইল আসা-যাওয়া করতাম পায়ে হেঁটে। সতেরো কি আঠারো দিন এভাবে আসা-যাওয়া করার পর ইচলীতে একটি ছেলেকে পড়ানোর শর্তে একটি বাড়িতে উঠলাম গৃহশিক্ষক হিসেবে। ১৯৫৪ সালের কথা। এখন আর মনে করতে পারব না কোন বাড়ি বা কার বাড়িতে ছিলাম। তারপর ওই ছেলেকে পড়াচ্ছি আবার সেই বাড়িতে সন্ধ্যার সময় মসজিদে আজান দিতে হতো। তারা যে কয়জন আসত তাদের ইমামতি করতাম। আবার কোনো একসময় তারা নৌকা নিয়ে মেঘনায় যাচ্ছে ইলিশ মাছ ধরতে। একদিন আমি বললাম, আমাকে নিতে পারবা? তারা বলল, ‘হ্যাঁ চল’। গিয়েছি। ইলিশ মাছ ধরেছি। সেটা কী আনন্দ বোঝাতে পারব না। সেই ইলিশ মাছ পেয়ে সেখানে কেটে তাজা ইলিশ মাছ ভাজি করে খাওয়া সেটা যে কী স্বাদ, সেই স্বাদ এখন আর নেই মাছে।
পরীক্ষাও কি ওই বাড়িতে থেকেই দিয়েছেন?
না, তিন মাস পরে মেসে খালি হলো নুরু ভাই আমাকে এখানে নিয়ে এলেন। সেখানে আমি পরীক্ষা পর্যন্ত ছিলাম। আমার রুমমেট নয় পাশাপাশি একই মেসমেট আবদুল মালেক ছিল। সাঁতারু আবদুল মালেক। ওই যে সাঁতরে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়েছিল। ব্রজেন দাসকে ছাড়িয়ে সেই আবদুল মালেক। ব্রজেন দাস দুবার পার হয়েছে আর আবদুল মালেক একবার পার হয়েছে। আমার মনে আছে, তার সঙ্গে গোসল করতে যেতাম। নদীতে নামার জন্য একটা ঘাটলা ছিল। সেখানে আবদুল মালেক আমাকে সাঁতার শিখিয়েছে। যা হোক এগুলো অনেক কথা। তারপর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষার পর চলে গেলাম।
ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে কোথায় ভর্তি হলেন?
ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর চলে গেলাম কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। কুমিল্লা যাওয়ার পেছনে দুটি কারণ ছিল। এক. সেখানে তো গ্রাজুয়েশন আছে। দ্বিতীয়ত, আমার জ্যাঠাতো বুবু সুফিয়া থাকত। ঠাকুরপাড়ায় তার বাসা ছিল। আমি সেখানে উঠলাম। আমার দুলাভাই পুলিশের ইন্সপেক্টর। বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেন। মাঝেমধ্যে ছুটিতে এখানে আসেন। তার আবার সাত মেয়ে। পরে এক ছেলে হয়েছে। ওই ছেলের সেবা-শুশ্রƒষার কাজ আমাকেও করতে হয়েছে। রাত ১২টাতেও যদি কেঁদে ওঠে তাহলে বলত, ‘যাও দৌড় দিয়ে ডাক্তার নিয়ে আসো।’ কারণ আমিই ছিলাম ওই বাড়িতে একমাত্র পুরুষ। এই অবস্থায় সময় কেটেছে। আবার অনেক সময় বুবুর সাথে রাগ করে চলে গিয়েছি। গিয়ে হোটেলে উঠেছি। দুলাভাই এসে শুনে আবার আমাকে ফিরিয়ে এনেছেন। যাই হোক, গ্রাজুয়েশন পরীক্ষা দিলাম।
পরীক্ষা শেষে কী করলেন?
তখন নুরু ভাই হাজীগঞ্জের কাছে বলাখাল হাই স্কুলের শিক্ষক। পরীক্ষার পরে তিনি আমাকে বললেন, ‘তুই এখানে চলে আয়। দুই মাস বসে থেকে কী করবি?’ তার কাছে গেলাম। আমি স্পেশাল ইংলিশের ছাত্র। বলাখালে যাওয়ার পর আমাকে ক্লাস নাইন- টেনের ইংরেজির দায়িত্ব দিল। তাদের পড়াতাম আবার বিকেলে ফুটবল খেলতাম তাদের সঙ্গেই। এভাবে এক মাস কাটতে না কাটতে আমার সময় হলে গেল, আমি চলে গেলাম। একটা ইন্টারভিউ দিয়েছি ঢাকা এয়ারপোর্টে অফিসার হিসেবে। ইন্টারভিউতে আমি ফার্স্ট হলাম। তারা আমাকে নিয়োগ দিল।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে কমিশনের জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলেন...
এর মাঝে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশনের জন্য আন্তঃবাহিনী নির্বাচন বোর্ডে (আইএসএসবি) পরীক্ষা দিলাম। সেই লিখিত পরীক্ষায় আমি পাস করলাম। তখনকার সময় শুরুতেই ছিল লিখিত পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় যারা পাস করবে তাদের বোর্ডে ডাকা হয়। পরীক্ষায় তখন ফল প্রকাশ হয়নি। এই ফাঁকে আমি ঢাকা এয়ারপোর্টে অফিসার হিসেবে যোগ দিলাম। সেখান থেকে আমাকে এক মাসের প্রশিক্ষণে পাঠানো হলো। এভাবে সাত থেকে দশ দিন প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর আইএসএসবি থেকে কল এল। আমি পাস করেছি তারা আমাকে সেখানে ডেকেছে। তখন আমি তিন দিনের ছুটি নিয়ে আইএসএসবিতে গেলাম। যেভাবেই হোক আইএসএসবির পরীক্ষায় আমি খুব ভালো করেছি। স্কুল-কলেজজীবনে খেলাধুলা, শরীরচর্চা করতাম। সেই অভ্যাস ছিল। এটা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছিলেন...
যখন আইএসএসবিতে আমি ফার্স্ট হয়ে গেলাম তার আগেই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে ভর্তি হওয়ার জন্য পরীক্ষা দিলাম। সেখানেও আমি সেকেন্ড হয়েছি। তারা আমাকে ভর্তি হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে আইএসএসবির চিঠি চলে এল। সেখানে চলে গেলাম। সব বাদ দিতে হয়েছে।
আইএসএসবিতে ক্যাডেট হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর কী করতে হল?
আইএসএসবিতে ক্যাডেট হিসেবে নিয়োগের পর জানানো হলো, ১৯৫৮ সালের ২ জানুয়ারি থেকে প্রশিক্ষণ শুরু হবে। তার আগেই সেখানে আমাকে পৌঁঁছাতে হবে। এয়ারপোর্টের চাকরি (সিভিল এভিয়েশন) ছেড়ে আইএসএসবিতে চলে গেলাম তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের কোহাটে অফিসার্স ট্রেনিং স্কুলে (ওটিএস)। এখন আইএসএসবিতে যাওয়ার মতো আমার ভালো কোনো স্যুট ছিল না। যা হোক, আব্বা সব ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি গেলাম। সেখানে প্রশিক্ষণেও আমি খুব ভালো করেছি। এই প্রশিক্ষণের বিষয়ে অনেক কথা আছে।
কী কথা?
একটা কথা বলি, সফলভাবে প্রশিক্ষণ শেষ করার পর ক্যাডেটদের পাসিং আউট হয় ৯ থেকে ১০ মাস পর। পাসিং আউটের সময় এসে গেছে। ১৯৫৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পাই। তার এক মাস আগে প্রত্যেক ক্যাডেটের কাছে ফরম পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে পূরণ করে জমা দেওয়ার জন্য। সেখানে একটা কলাম আছে যে, তুমি কোন রেজিমেন্টে যেতে চাও। তার নাম দিতে হবে।
আপনি কোন নামটা দিলেন?
রেজিমেন্ট বলতে ইনফেন্টিকে বোঝায়। ইনফেন্টি হচ্ছে সশস্ত্র যোদ্ধাদল। তারা দেশের জন্য যুদ্ধ করে। তাদের সাহায্য করার জন্য আছে আরমাডকোর আর্টিলারি, ইঞ্জিনিয়ার সিগন্যালস এই আমর্সগুলো। ট্যাংক, আর্টিলারি সব ইনফেন্টিকে সাহায্য করার জন্য। আবার সার্ভিসেস সাইডে আছে এএসসি, এওসি, ডিএমপি এসব। এএসসি অর্ডিন্যান্স কোর, সার্ভিস কোর, মেডিকেল কোর এগুলোও ইনফেন্টির সাহায্যের জন্য। আমি খুব ভালো করেছি। আমরা পাসিং আউট করব। প্লাটুন আন্ডার অফিসার হিসেবে আমার নিয়োগ হবে। এগুলো ক্যাডেটে নিয়োগ। কিন্তু আমি তখনও ক্যাডেট। ক্যাডেটপ্রাপ্তদের সুবিধা হচ্ছে তারা যেই আর্মসে যেতে চায় সাধারণত সেখানে যেতে পারে, যদি সুযোগ থাকে। আবার সবাই আমর্সে গেলেও হবে না, সার্ভিসেও তো লোক লাগবে। ফরমে তিনটির নাম দিতে হয়। আমি তিনটির নাম না দিয়ে একটাই লিখলাম, ‘ইনফেন্টি’ ব্রাকেটে লিখে দিলাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।
তারপর কী হল?
কদিন পর ফরমটি ফেরত এল। বলল, তোমাকে তিনটি নাম দিতে হবে। সেখানে লেখা আছে। আমি কি লেখা বুঝি না? তিনটার নাম না দিয়ে একটি দিয়ে বাকিগুলো কেটে দিলাম। আবারও ফেরত এল। এবার আমি গোয়ার্তুমি করে লিখে দিলাম, ‘ইনফেন্টি (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) অনলি’। এ ধরনের গোয়ার্র্তুমির কারণে তো আমার চাকরি থাকার কথা নয়। কিন্তু কথায় আছে, রাখে আল্লাহ মারে কে। যা হোক, তারা এটাকে ইগনোর করল। আমাকে আর ইনফেন্টিই দিল না। দিল সিনিয়র সার্ভিস কোর। যেটাকে আর্মি সার্ভিস কোর (এএসপি) বলে।
সেখানে যোগ দিলেন?
কোনো উপায় নেই, যা দিয়েছে তাই করতে হবে। চাকরি করছিলাম। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের আগে জুলাই মাসে আমার পোস্টিং হলো চট্টগ্রামে অ্যাম্বারশন হেডকোয়ার্টারে। এখানে স্টাফ ক্যাপ্টেন হিসেবে এলাম। তখনকার দিনে ইস্ট-ওয়েস্ট পাকিস্তানের সৈন্য আদান-প্রদান হতো। হয়ত, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ফার্স্ট বা সেকেন্ড বেঙ্গল চলে গেছে। তাদের বদলে একটা পাঞ্জাব ব্যাটালিয়ান আসত। এ রকম হতো। অ্যাম্বারশন হেডকোয়ার্টার এগুলো নিয়ন্ত্রণ করত।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় কী করেছিলেন?
তখন তো আম্বারশন হেডকোয়ার্টারেই ছিলাম। সেখানে তো কোনো যুদ্ধ ছিল না, গোলাগুলিও ছিল না। ইউনিফর্ম পরে পোচে পিস্তল রাখতাম। পিস্তল পোচ বেল্টের সঙ্গে লাগানো থাকত। এভাবে গেল ’৬৫ সাল। ১৯৬৭ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ধরপাকড় শুরু হয়ে গেল। সেখানে নাজমুল হুদাকে ধরা। যিনি পরে কর্নেল হায়দারের সঙ্গে মারা যান। মেডিকেল কোরের মেজর শামসুল আলমকে আটক করল। তিনি কুমিল্লাতে ছিলেন। কিন্তু চট্টগ্রামে আসা-যাওয়া করতেন। মেজর নূরুজ্জামানকে আটক করল। যিনি মেজর কে এম সফিউল্লাহর পরে ৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হয়েছিলেন।
ধরপাকড়টা কেন করা হচ্ছিল?
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাদের সন্দেহভাজন হিসেবে ধরা হচ্ছিল।
আপনাকেও ধরার চেষ্টা হয়েছিল?
আমাকে আর ধরল না। কারণ আমার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। কিন্তু আমিও তাদের কাছে আসা-যাওয়া করতাম। তাদের সঙ্গে সম্পর্কে আছে দেখে আমাকে আগেই পাঠিয়ে দিল পাকিস্তানের কোয়েটাতে আর্মির একটি ইউনিটে। নিয়ম অনুযায়ী চট্টগ্রামে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত আমার থাকার কথা ছিল। কিন্তু তার এক বছর আগেই আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।
রওনা হলেন কীভাবে?
আমরা সড়কপথে কোয়েটার উদ্দেশে রওনা হলাম। তখন আমার একটা গাড়ি ছিল। সেটা আমি চট্টগ্রাম থেকে বুক করে পাঠিয়ে দিলাম করাচি। সেখান গিয়ে গাড়িটা রিসিভ করে সেটা ঠিকঠাক করে আমরা সড়কপথে রওনা হলাম। করাচি থেকে একদিনে চাখ্খার। চাখ্্খার থেকে আর একদিনে চলে গেলাম কোয়েটা। গাড়ি তখন নিজেই চালাতাম। কোয়েটাতে ১৯৬৯ সালে আমার পদোন্নতি হলো মেজর পদে এবং পোস্টিং হলো লাহোরে। ওই গাড়িতে করেই সড়কপথে লাহোর চলে গেলাম। ৭০০ মাইল গাড়ি চালিয়ে একদিনেই চলে গেলাম। সকালে যাত্রা করে সন্ধ্যায় পৌঁছেছি। জীবনে বহু কষ্ট করেছি।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথা বলছিলেন। আসলে পাকিস্তানিরা কী চাইছিল?
বঙ্গবন্ধুকেও তারা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়াল, বিচার করার জন্য। তাকে দিল এক নম্বর আসামি। যখন বঙ্গবন্ধুর বিচার করতে যাবে তখন এ দেশে ছাত্র বিক্ষোভ শুরু হলো। এটা ১৯৬৯ সালের কথা। ছাত্রদের গণবিদ্রোহের মুখে তথাকথিত বিচারক কমিটির লোকজন পাকিস্তানে পালিয়ে গেল। তারা আর সুবিধা করতে পারল না। শেষ পর্যন্ত তারা বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিল। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তোফায়েল আহমেদরা রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সভা করলেন। যেখানে ঘোষণা দেওয়া হলো, আজ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হলো। এখন থেকে তিনি বঙ্গবন্ধু। আমার কবিতায় লিখেছি-
‘ক্ষমতার লোপাশঙ্কায় পশ্চিমা কান্ডারি
মুজিবকে স্তব্ধ করার ঘৃণ্য জারিজুরি,
শুরু করলো আগরতলা ষড়যন্ত্র দিলে
বাঙালি মীরজাফরের সহায়তা নিয়ে
আটষট্টির সতেরতম দিবাগত যামে
বন্দি করলো মুজিবকে সেই ষড়যন্ত্রের নামে
ঊনসত্তরে ছাত্র জনতা করে আন্দোলন
আইয়ুবের লৌহ ফটক করে উন্মোচন
মুজিবকে আনলো ছিনে, আশীর্বাদে তার
মুজিব পেলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ গণউপহার।’
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের কোনো ঘটনা মনে আছে?
সেই নির্বাচনে সুপার মেজরিটি পেল আওয়ামী লীগ। অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তান পেল মাত্র দুটি পেল আসন আর বাকি সব আওয়ামী লীগ পেল। তাতে সরকার গঠন করবে আওয়ামী লীগের প্রণেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু পাকিস্তান তা করতে দিল না।
আপনি তখন কোথায় ছিলেন?
যখন নির্বাচনে জিতল তখন আমি পরিবারসহ লাহোরে। আনোয়ারুল্লাহ নামে একজন মেজর ছিলেন, বাঙালি। তিনি ছিলেন জিএসকিউতে (চ্যানেল হেডকোয়ার্টার) এমটি ডিরেক্টর, যেটা আর্মি হেডকোয়ার্টার হিসেবে পরিচিত। তার পরিবারসহ আমরা একত্রিত হতাম। ক্যাপ্টেন হেশামউদ্দিন ছিলেন। তিনি ছিলেন আর্টিলারি অফিসার। তিনি পরে মেজর হন। তখন হেশামউদ্দিন ছিলেন অবিবাহিত। আমরা মাঝেমধ্যে এক হয়ে আড্ডা দিতাম। সেখানে একবার আলোচনা হলো, আমরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের টুকটাক যেসব কথা শুনেনি তাতে মনে হয়েছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। যদি তারা ক্ষমতা না দেয় তাহলে তো বাংলাদেশে রক্ত গঙ্গা হয়ে যাবে। আনোয়ারুল্লাহ বললেন, ‘ইয়েস, হবে।’ আমি বললাম, আনোয়ার ভাই আপনি তো হেডকোয়ার্টারে আছেন। আমাকে আবার পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেন। তিনি শুনে হাসলেন। বললেন, ‘সেখানে গিয়ে তুমি কী করবে, অসহায় হয়ে একা।’ বললাম, স্যার এই দেশে অসহায়ের মতো মরব কেন? ওই দেশে গিয়ে যদি দুটাকে মেরে আমি মরতে পারি তাও তো লাভ আছে। ঠিক এই কথাগুলো আমি বলেছি। দেখেন আমাকে পাঠাতে পারেন কি না।
পূর্ব পাকিস্তান ফিরে আসতে পেরেছিলেন?
ভাগ্য ভালো জিএসকিউতে মিলিটারি সেক্রেটারিয়েট ব্রাঞ্চ (এমএস) তারাই অফিসাদের পোস্টিং, ট্রান্সফার, প্রমোশন সবই তাদের হাতে। সেখানে ছিল ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন, তিনি বাঙালি। আনোয়ার ভাই তাকে বললেন, ‘তুমি বদলির আদেশে ওর (আবু ওসমান) নামটা দিয়ে দাও।’ সে চেক করে দেখল তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তানে আমাকে কোরে অ্যাডজাস্ট করার মতো কোনো খালি পদ নেই। আমাকে দিতে পারবে না।
তখন আপনি কী করলেন?
আমি বললাম, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) পাঠিয়ে দেন। ইপিআর হলো পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র মিলিশিয়া। এই মিলিশিয়ার শতভাগ সৈন্য বাঙালি হওয়ার কথা। কিন্তু বাঙালিদের কোণঠাসা করে রাখার জন্য তারা ৪০ শতাংশ অবাঙালি রেখেছিল। ৬০ ভাগ রাখল বাঙালি। এটা একটা। দ্বিতীয়ত, ইপিআরের কোনো নিজস্ব অফিসার নেই, সবই আর্মির। আর্মি থেকে ডেলিগেশনে পাঠায়। আমি বললাম, আমাকে ডেলিগেশনে ওখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। জিয়াউদ্দিন বলল, ‘এটা তো (অবাঙালি) প্রাইজ পোস্টিং তাদের জন্য। আমাদের (বাঙালি) তো সহজে দেয় না। এই পোস্টিংগুলো এতই লোভনীয় ছিল যে, একটা আর্মি অফিসার প্রাইজ পোস্টিং নিয়ে ইপিআরে দু-তিন বছর থেকে একটা বাড়ি, একটা গাড়ি করে নিয়ে যায়। তারা এটা দেবে না।’ আনোয়ার ভাই বললেন, ‘দিয়ে দাও নামটা। আমরা চেষ্টা করে দেখি না হয় কি না।’ তখন নামটা দিয়ে দিল। একটা নামের জন্য তো আর তালিকা পাঠায় না। অনেক নাম থাকে। যখন ফাইল পুটআপ করেছে তখন এমএস সই করে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করেনি, কে কোনটা। আমার পোস্টিং এল ইপিআরে।
ইপিআরে কী দায়িত্বে এসেছিলেন?
একটা ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলাম। আমার সিও ছিল অবাঙালি এবং বাঙালিবিরোধী। সে চেষ্টা করল আমার পোস্টিং বাতিল করার জন্য, পারল না। তখন সে বলল, ‘ওসমান ভাই আমাকেও নিয়ে চল তোমার ওখানে।’ বললাম, তোমাকেও নেব আগে তো আমি গিয়ে বসি। আমি সেখানে স্থায়ী হয়ে তোমাকে নেব। সে তো এটা শুনে মহাখুশি। আমার টাকা পয়সা যা পাওয়ার সব কিছুর ব্যবস্থা করে দিল। ৭১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় লাহোর এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের ঢাকার উদ্দেশে উড়ে আসার কথা। কিন্তু এর আগে পাকিস্তান ইন্ডিয়ান একটা উড়োজাহাজ হাইজাক করে। লাহোরে নামাল। পরে সবাইকে বিদায় দিয়ে ওই উড়োজাহাজটাকে পুড়িয়ে ফেলে। এতে ভারত বলল, আমার দেশের ওপর দিয়ে তোমার উড়োজাহাজ পাকিস্তান এয়ারলাইনস চলতে পারবে না। রুট বন্ধ করে দিল। বন্ধ করল যেই ফ্লাইটে আমি যাব সেই ফ্লাইট থেকে।
তাহলে আপনাদের ফেরার কী হলো, কীভাবে ফিরলেন ঢাকা?
আমরা তো কিছুই জানি না। আমার দুই মেয়ে আর স্ত্রী খুব ভোরে তৈরি হয়ে বসে আছে। পরে আমার কোম্পানির একজন বাঙালি হাবিলদার (কোয়ার্টার মাস্টার ছিল) এসে আমাকে জানাল, ‘স্যার সব ফ্লাইট সাসপেন্ডেড।’ আপনারা যেতে পারবেন না। শুনেই তো স্ত্রী ও মেয়েরা কান্নাকাটি শুরু করে দিল। আমি ওদের থামিয়ে ক্যান্টনমেন্টের কাছেই এয়ারপোর্টে গেলাম। আমার যতদূর মনে পরে, পুরনো গাড়িটা বিক্রি করে নতুন একটা গাড়ি কিনেছিলাম। এয়ারপোর্টে যাওয়ার পর তারা বলল, ‘এখানে কিছু নেই। মলরোডে যান। সেখানে তাদের হেডকোয়ার্টার। সেখান থেকে যা করার করতে পারেন। মলরোডে গিয়ে তাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে টিকিট নিলাম। পরদিন ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে ফ্লাই করব। ঘরে ফিরলে আমার স্ত্রী বলল, ‘তোমাকে ৬ তারিখ পর্যন্ত থাকতে দেবে কে এখানে? ওরা যখন শুনবে তুমি যেতে পারোনি তখনই তোমাকে আটকে দেবে। তুমি কি জানো না তোমার সিও কত খারাপ?’
কঠিন বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন বোধ হয়?
চিন্তায় পড়ে গেলাম। জীবনে কেউ যা করে না, একদিনের জন্য আর্মি থেকে পলাতক হয়ে গেলাম। তখন আমার ব্যাটম্যানকে (সাহায্যকারী) বললাম, টাঙ্গা (এক ঘোড়ায় টানা গাড়ি) ডাকো। টাঙ্গা নিয়ে এল। ওটাতে করে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে চলে গেলাম এক জায়গায়। উঠলাম একটা হোটেলে। সেখানে মেয়েদের খাওয়া-দাওয়া করিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখার পর আমরা দরজা বন্ধ করে চলে গেলাম মলরোডে। সেখানে তাদের বড় সাহেবরা বসে। তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বললাম, এ রকম গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। আমাকে তো কাল ঢাকায় রিপোর্ট (উপস্থিতি জানাতে হবে) করতে হবে। যদি তুমি আজ আমায় না পাঠাও তাহলে কীভাবে রিপোর্ট করব? আর্মি অফিসার হিসেবে আমরা তখনও টুরিস্ট ক্লাসে টিকিট পাই, ফার্স্ট ক্লাস পাই না। ওই বড় সাহেব বললেন, ‘টুরিস্ট ক্লাসের টিকিট নেই। ফার্স্ট ক্লাস দিতে পারব।’ ভারতের আকাশপথ বন্ধ করে দেওয়ায় প্লেন কলম্বো ঘুরে যায়। আমি বললাম, ‘ফার্স্ট ক্লাসই দাও। টাকা যা লাগে দিয়ে দেব।’
একটা উপায় হলো তবে?
তা হলো। কিন্তু এদিকে আমরা একটা কাজ করে ফেলেছি। যত টাকা পেয়েছি তা দিয়ে স্ত্রীর জন্য সোনার বেঙ্গল বানিয়ে ফেলেছি। কারণ ওখানে স্বর্ণ ৯০ টাকা এক ভরি। আর দেশে ১২০ টাকা ভরি। আমরা কিছু স্বর্ণ এভাবে কিনে ফেললাম। সব কেনাকাটা করে আমার কাছে তখন মাত্র চার থেকে পাঁচশ টাকা আছে। অথচ আমাদের তিনজনের প্লেনের টিকিটে অতিরিক্ত দিতে হবে পাঁচ শয়ের বেশি।
টাকা পেলেন কোথায়?
যেখানে থেকে অলঙ্কারগুলো বানিয়েছি সেখানে চলে গেলাম। তাদের একটা বেঙ্গল দিয়ে বললাম, এটা নিয়ে যে টাকা পাব তা দিয়ে দাও, আমাদের টাকার দরকার। ওরা বলল, ‘আপনাদের কত টাকা দরকার?’ আমি বললাম, পাঁচশ টাকা হলেই চলবে আমার। ওরা বেঙ্গলটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটাও রাখেন আর পাঁচশ টাকাও নিয়ে যান। ফিরে এসে টাকাটা ফেরত দিয়েন।’ তাদের কাছ থেকে পাঁচশ টাকা নিয়ে এসে প্লেনের ভাড়া পরিশোধ করার পর তিনটা ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট আমাদের দিয়ে দিল। ওই রাতেই ফ্লাইট। আমরা খুব খুশি। আল্লাহর কাছে বলছি, ধরা যেন না পড়ি। কারণ, যেই বাড়িতে থাকি তা বুঝিয়েও দিয়ে আসিনি। কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে এসেছি।
করাচি পৌঁছালেন কখন?
পরে রাত ১০টার দিকে ফ্লাই করে ১১টার দিকে করাচি পৌঁছল। করাচিতে যখন নামিনি তখন আমার স্ত্রী আল্লাহর কাছে দোয়া করছে, ‘আল্লাহ আমরা বেঁচে গেলাম, চিন্তামুক্ত হলাম।’ তখন আমি বললাম, এখন ভয় কাটেনি। কারণ করাচিতে গিয়ে যদি বলে ঢাকায় যাওয়ার ফ্লাইট দেরি হবে। তোমাদের থাকতে হবে তাহলে তো সমস্যা। কিন্তু আল্লাহ ভাগ্যে রেখেছে, করাচি পৌঁছেই কানেকটেড ফ্লাইট পেয়েছি। ওই ফ্লাইটে ট্রান্সফার করে ঢাকায় চলে এলাম। ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় ঢাকায় এসেছে নেমেছে।
ঢাকায় পৌঁছে কোথায় গেলেন, ইপিআরে?
তখন ১০ দিনের ছুটি ছিল। মালপত্র সব ইপিআরে রেখে আমরা চলে গেলাম কুমিল্লায় আমার শ্বশুরবাড়িতে। তখন আমাদের কাছে অনেক টাকা। অনেক টাকা বলতে আমাদের একটা ডিএসওপি ফান্ড আছে। সরকার ওই ফান্ড থেকে ৮০ ভাগ টাকা ঘরবাড়ি করার জন্য ওঠানোর অনুমতি দিয়েছে। এই ৮০ শতাংশ টাকা প্রায় ৪০ হাজার টাকার মতো। তখনকার ৪০ হাজার টাকা কিন্তু অনেক টাকা। সোনার গহনা বিক্রি করলাম। আরও টাকা হলো। কুমিল্লাতে একটা বাড়ি ঠিক করেছিলাম ৪০ হাজার টাকা দিয়ে কিনব। ছোট বাড়ি ওয়াল আছে ভেতরে একটা পুকুরও আছে। কিন্তু ছুটি শেষ হয়ে যাওয়ায় এটা কেনার প্রক্রিয়া শেষ করতে পারলাম না। পরে বললাম, এটা থাকুক। পরে এক মাস ছুটি নিয়ে এসে এটা কেনার কাজ করা যাবে।
তারপর তো এসে ইপিআরে যোগ দিলেন...
ইপিআর হেডকোয়ার্টারে যোগ দিলাম। সেখান থেকে ইন্টারভিউ নিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দিল চুয়াডাঙ্গাতে ফোর উইংয়ের (বর্তমান ফোর ব্যাটালিয়ন) কমান্ডার হিসেবে। সেখানে গিয়ে একজন অবাঙালি মেজর ছিল তাকে বিদায় করে ২৫ ফেব্রুয়ারি আমি দায়িত্ব বুঝে নিলাম। ঘটনাচক্রে চুয়াডাঙ্গার ইতিহাসে আমিই প্রথম বাঙালি কমান্ডার ছিলাম। এর আগে কোনো বাঙালি কমান্ডার সেখানে দেওয়া হয়নি। চিন্তা করে দেখো কী অবস্থা করে রেখেছিল পাকিস্তানিরা! বাঙালি কমান্ডার হিসেবে আমার কাছে তাদের অনেক চাওয়া-পাওয়ার আছে। কিন্তু আমি তো সময়ের অভাবে তাদের সঙ্গে ঠিকভাবে দেখাই করতে পারিনি। যা হোক, খবর এল করাচি থেকে আমি যে গাড়ি পাঠিয়েছিলাম সেটা ঢাকা এসে পৌঁছেছে। আমি ড্রাইভার পাঠিয়ে দিলাম। সে গিয়ে গাড়ি চালিয়ে চুয়াডাঙ্গায় নিয়ে এল ২০ মার্চ।
চুয়াডাঙ্গা থেকে পরিবার নিয়ে কুষ্টিয়া গিয়েছিলেন কেন?
আমরা কখনও কুষ্টিয়া দেখিনি। পরিবারের লোকজন চাইলে কুষ্টিয়া ঘুরে দেখবে। কুষ্টিয়াতে আমার কাজও ছিল। ঠিক করলাম ২৪ মার্চ সকালে আমরা যাব সন্ধ্যার আগে ফিরে আসব। কাজ হলো, আমি যে বাড়িতে থাকব সে বাড়িটাকে সংস্কার করতে হবে। এ কাজগুলো হয় জেলা প্রশাসকের অধীনে। তখন বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন চলছে। কেউ কাজ করে না। অফিস-আদালতে যায় না।
কুষ্টিয়া রওনা হলেন কখন?
২৪ মার্চ সকালে রওনা করলাম। আমার গাড়িতে আমার স্ত্রী ও মেয়েরা। আমি গাড়ি চালাচ্ছি। পেছনে একটি জিপে একজন হাবিলদারসহ স্কোয়াড আছে নিরাপত্তার জন্য। ওখানে সার্কিট হাউসে বলে দিলাম আমাদের আটজনের খাবার তৈরি করতে। আমরা চারজন। আর জিপের চালকসহ অন্যরা চারজন। চুয়াডাঙ্গা থেকে মেহেরপুর সেখান থেকে কুষ্টিয়া যাওয়া যায়। আবার মেহেরপুর থেকে ঝিনাইদহ হয়েও রাস্তা আছে। আমরা মেহেরপুর হয়ে রওনা হলাম। মেহেরপুরে যাওয়ার পর আমাদের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল। ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল।
আবারও বিপদে পড়লেন...
আমি চেষ্টা করলাম গাড়িটি ঠিক করার। কিন্তু পারলাম না। খবর পেলাম মেহেরপুরে কোনো ভালো মেকানিক নেই। যেতে হবে চুয়াডাঙ্গা। জিপে করে কয়েজন চলে গেল চুয়াডাঙ্গায় মেকানিক আনার জন্য। আমরা ওখানে একজন স্থানীয় লোকের বাড়িতে উঠলাম। তারা আমাদের ভালোই আদর-আপ্যায়ন করল। চুয়াডাঙ্গা থেকে মেকানিক নিয়ে এসে গাড়ি ঠিক করতে করতে দেড়টা বেজে গেছে। গাড়ি ঠিক হলে আমি আবার রওনা করলাম। কিছুদূর যাওয়ার পরে গাড়িটা আবার খারাপ হয়ে গেল। এখন তো আর কোনো উপায় নেই। পাঠালাম আশপাশের বাড়িতে পাট নিয়ে আসতে। পাট দিয়ে রশি বানিয়ে আমার গাড়িটা জিপের পেছনে বেঁধে নিয়ে যাব। এছাড়া কোনো গতি ছিল না।
কুষ্টিয়া পৌঁছেতে তো বেশ দেরি হয়ে গেল, তাই না?
বিকেল হল। মার্চে মাসে তো দিন-রাত মোটামুটি সমান হয়। কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত আটটা বেজে গেল। খাওয়া-দাওয়া করে সেখানে রাতে থেকে গেলাম। আমাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র সবই ছিল। পরনে ইউনিফর্ম ছিল। আমার সঙ্গে পিস্তল।
যে কাজে গিয়েছিলেন সেটার কী অবস্থা?
পরদিন ২৫ মার্চ সকাল ১০টায় গেলাম ডিসির কাছে। ডিসি বলল, অফিসারকে ডাকতে হবে। তাকে চেকের কথা বলতে হবে। আমি বললাম, যদি বলতে হয় বলুন। ডাকুন কোন অফিসার আছে। যা হোক সে এল, তাকে বলা হলো। সে আদালতে গিয়ে চেকবই এনে আমাদের দিতে দিতে দুপুর ২টা বেজে গেল। অসহযোগ আন্দোলনের সময় ব্যাংক দুই ঘণ্টার জন্য খুলত। ১২টা থেকে দুই ঘণ্টার জন্য ব্যাংক খুলত। ২টার পর লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওই দিন চেকটা ক্যাশ করতে পারলাম না।
২৫ মার্চ রাতে তবে কুষ্টিয়াতেই থাকতে হলো আপনাদের?
১৯৬০ সালের ২৫ মার্চ আমি বিয়ে করেছি। ২৫ মার্চ রাত ছিল আমাদের বিয়ের রাত। ইচ্ছা ছিল ওই দিন সবাইকে দাওয়াত করে অনুষ্ঠান করার। কিন্তু সম্ভব হলো না। আমার স্ত্রী বলল, দুদিন পরে অনুষ্ঠান করলে তো অসুবিধা নেই। তবুও এখানের কাজটা শেষ করে যাওয়া। এজন্য কুষ্টিয়াতে রয়ে গেলাম।
২৫ মার্চে পাকিস্তান আর্মির অপারেশন সার্চলাইটের ব্যাপারে কিছু বুঝতে পেরেছিলেন?
অপারেশন সার্চলাইট শুরু হলো ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম সব জায়গায় একসঙ্গে গণহত্যা শুরু করল। আমরা টের পেলাম না। ২৬ মার্চ ভোরে আমি নামাজ পড়ব বলে জেগে বারান্দায় এলাম। সার্কিট হাউসের পাশের রাস্তাটি ঝিনাইদহের দিকে গেছে। সার্কিট হাউসের পরে দুইটা ভবন, তার পর গ্রাম। দেখি খোলা আর্মি জিপ, ড্রেস পরা সৈনিকরা চার-পাঁচজন একটি জিপে। কাগজের তৈরি বোম্বা বানিয়ে তা দিয়ে তারা ঘুরে ঘুরে ঘোষণা দিচ্ছে ৩০ ঘণ্টা কারফিউ। আশ্চর্য হলাম। কারণ আমাদের হিসাব ছিল জুন বা জুলাই দিকে এমনটা হতে পারে। এখন দেখি মার্চ মাসে শুরু করেছে! দৌড়ে গেলাম টেলিফোনের কাছে। গিয়ে দেখি লাইন বিচ্ছিন্ন করা। এখন তো আর আমাদের উপায় নেই।
যখন বুঝতে পারলেন পরিবেশ অনুকূলে নেই, তখন কী করলেন?
সার্কিট হাউসের পেছনে ছিল জেলা স্কুল। উঁকি দিয়ে দেখি আর্মিরা সেখানে ঘোরাফেরা করছে। তখন শুনেছি, অপারেশন সার্চলাইটের মধ্যে যত ডিস্ট্রিক্ট হেডকোয়ার্টার আছে, চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা এ চারটা ছাড়া বাকি যে ১৩টি জেলা হেডকোয়ার্টার আছে সেগুলো সৈন্যদের দ্বারা তাদের কন্ট্রোলে রাখা হবে। সে অনুযায়ী ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১২টার পর ২৭ বেলুচি রেজিমেন্ট যশোর থেকে এসে কুষ্টিয়ায় ঘাঁটি গেঁড়েছে। কোনো গোলাগুলি হয়নি। পুলিশকে বলেছে তারা ছেড়ে দিয়েছে। কাজেই আমরাও বুঝতে পারিনি। আমরা একটু ঘাবড়ে গেলাম। একটা টু-ইন ওয়ান ছিল। ওটাতে ঢাকা রেডিও ধরিয়ে রাখলাম। সকাল ৮টার সময় রেডিওতে শুনলাম মার্শাল ল চলছে। আরও নতুন নতুন ধারা ঘোষণা হচ্ছে। বুঝলাম যা মনে করেছিলাম সেটা আরও আগেই হয়ে গেছে।
আপনারা কি যুদ্ধের আশঙ্কা করেছিলেন?
হ্যাঁ, তা তো ছিলই। মনে করেছিলাম, সংলাপ যেহেতু চলছে এটা আরও চলবে। মে-জুনের দিকে কিছু একটা হবে। কিন্তু আগেই তো সব শুরু হলো।
এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ হয়ে গেল। তখন আপনি কোথায় ছিলেন?
আমি তখন চুয়াডাঙ্গায় ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনেছি রেডিওতে। ওই দিন তো প্রচার হয়নি। ৮ মার্চ প্রচার হয়েছে। সেখান থেকে রেকর্ড করে রেখেছিলাম।
কুষ্টিয়া থেকে ফিরলেন কীভাবে?
জিলা স্কুলে যারা এসে ঘাঁটি গেঁড়েছিল ভাগ্য ভালো তারা সার্কিট হাউসে আসেনি। যদি এখানে এসে আমাদের দেখা পেত, ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় পেলে তো মেরে ফেলত। তারা শহরের উত্তর-পশ্চিম কোনায় পুলিশ লাইনসে এক প্লাটুন আর্মি পাঠাল। পূর্ব দিকে এক প্লাটুন ওয়ালেসের দিকে। তিন প্লাটুন দিয়ে তারা গোটা শহর ঘিরে ফেলল। আর অতিরিক্ত এক প্লাটুন দিয়ে তারা হেডকোয়ার্টার ঠিক রাখল। দেখে শুনে, স্কোয়াড কমান্ডারকে বললাম গাড়িগুলো প্রস্তুত করো। আমার গাড়িটি তো তখনও নষ্ট হয়ে আছে। সেটাকে অন্য একটি গাড়ির পেছনে বাঁধা হলো। আমি ইশারা দিলেই যাত্রা শুরু হবে।
ফিরলেন কোন পথে?
মেহেরপুর হয়ে এসেছি। এখন যাব ঝিনাইদহ হয়ে। এখান থেকে আড়াআড়ি পার হতে পারলে এক-দুই মিনিটেই শহরের বাইরে চলে যাব। যারা ঘোষণা দিচ্ছে তারা শহরের বাইরে যায় না। সকালে নাশতা করার সময়ও পেলাম না। রওনা হলাম আনুমানিক সকাল ৮টা-৯টা হবে। আমাদের ইউনিফর্ম পরাই ছিল। হাতিয়ারও সঙ্গেই ছিল। তাদের আসা যাওয়ার সুযোগ নিলাম। তারা যখন ঘোষণা দিতে দিতে সার্কিট হাউস পার হয়ে গেল তখন বের হলাম। কিছুদূর গিয়ে শহরের বাইরে যখন গেলাম তখন পেছন ফিরে দেখলাম কেউ আমাদের অনুসরণ করছে কি না, দেখলাম না, কেউ নেই।
ঝিনাইদহে পৌঁছে কী দেখলেন?
আনুমানিক ১০টা কি সাড়ে ১০টার দিকে আমরা পৌঁছে গেলাম ঝিনাইদহের চৌরাস্তায়। সেখানে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। গাড়ি দেখে তারা পথ আটকে দিছে। ড্রাইভারকে বললাম, থামাও। আমি নামলাম। তারা আমাকে দেখে ভয় পেয়ে গেল। আমার গায়ের রং বেশ উজ্জ্বল ছিল। তারা বুঝতে পারছিল না, আমি বাঙালি নাকি অবাঙালি। আমি তাদের বললাম, ‘এদিকে আসেন।’ বাংলা শুনে তারা যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেল। সবাই আমাকে ঘিরে ধরল। আমি পরিচয় দিলাম। তারা বলল, স্যার আমরা সব কিছু জানি। তাদের বললাম, এখন আর সময় পার করে লাভ নেই। কুষ্টিয়াতে কী হচ্ছে দেখে এসেছি। ঢাকায় কী হয়েছে তাও তোমরা জানো। এখানেও যে এমনটা হবে না তার নিশ্চয়তা নেই। এখন যদি পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে ধরতে হয় জনগণ আমাদের সঙ্গে থাকবে কি না? জবাবে সবাই একসঙ্গে, ‘জয় বাংলা’ বলে সম্মতি জানাল। আমি তাদের বললাম, প্রস্তুত ও সতর্ক থাকো। আমি হেডকোয়ার্টারে ফিরে যাচ্ছি। সেখানে গিয়ে দেখি কী হচ্ছে। তারপর কী করা যায় সিদ্ধান্ত নেব।
চুয়াডাঙ্গায় এলেন কখন?
এখন ঝিনাইদহ থেকে চুয়াডাঙ্গা যাব। কিন্তু জনগণ রাস্তার পাশের বড় বড় গাছগুলো কেটে সড়ক অবরোধ করে রেখেছে। এখন গাড়ি চালানো শুরু হলো ক্ষেত-খামার দিয়ে। এভাবে আনুমানিক একটা থেকে দেড়টার দিকে চুয়াডাঙ্গা হেডকোয়ার্টারে পৌঁছালাম। আমাকে দেখে উইং হাবিলদার মেজর মুজিবুর রহমান দৌড়ে এল। স্যালুট করে খবর দিল, ঢাকায় হত্যাকা- শুরু হয়েছে। এই প্রথম শুনলাম যে হত্যাকা- চলছে। আরও শুনলাম ২৫ মার্চ বিকেলবেলায় ফোর উইং আর ফাইভ উইং খুলনাতে। এই দুই উইং মিলে একটা সেক্টর হলো। এই সেক্টরের হেডকোয়ার্টার হলো যশোর শহরে। সেক্টরের কমান্ডার ও সেকেন্ড ইন কমান্ড হলো অবাঙালি। দুজন ক্যাপ্টেন আছে বাঙালি। এখন সেই অবাঙালি সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর আবদুল কাদের একটা জিপ নিয়ে এসেছিল চুয়াডাঙ্গায় আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তখন মেজর মুজিব তাকে বলেছে, স্যার তো চুয়াডাঙ্গায় নেই। শুনে ওই কমান্ডার ধমক দিল। বলল, নাই বললে তো হবে না। জরুরি কনফারেন্স আছে। তাকে যেতে হবে। তখন মেজর উত্তর দিল, স্যার তো কুষ্টিয়াতে আছে।
আপনার অধীনে বাঙালি অফিসার আর ছিল না?
আমার অধীনে দুজন ক্যাপ্টেন ছিল। একজন বাঙালি, অন্যজন অবাঙালি। ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী ছিল বাঙালি সেও আবার সেদিন ছিল না। সে গিয়েছিল বর্ডারে আমাদের যে চারটি কোম্পানি আছে সেগুলো পরিদর্শনে। রয়ে গেছে শুধু অবাঙালি ক্যাপ্টেন সাদেক। সে আবার বিবাহিত। তার একটা সন্তান আছে। আমি যখন ছিলাম না তখন ওই সেকেন্ড ইন কমান্ড সেই অবাঙালি ক্যাপ্টেন সাদেকের বাড়িতে উঠল।
তাহলে আবদুল কাদের ওই রাতে চুয়াডাঙ্গাতেই ছিল?
সে তো জানত যে রাত ১২টার পর কুষ্টিয়ার কন্ট্রোল নেওয়া হবে। আর কন্ট্রোল নেওয়ার পর তো আমরা আটক হব। তাই রাত ১২টা পর্যন্ত তারা খবর নিয়েছে আমরা আসছি কি না। খবর হলো, ওই কামান্ডারসহ ২৬ মার্চ সকাল চারটায় ক্যাপ্টেন সাদেক তার স্ত্রী, সন্তান এবং জিপে করে যতটুকু মালামাল নেওয়া গেছে তা নিয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্টে চলে গেছে। আরেকটা খবর দিল। এখানে যত অবাঙালি সৈন্য, সিভিলেও কিছু অবাঙালি ছিল, চুয়াডাঙ্গার একজন জিও ছিল অবাঙালি তার স্ত্রীরও অবাঙালি সবাইকে নিরস্ত্র করে একটা ভবনে আটকে রাখা হয়েছে। কারো হুকুম ছড়াই নিজের বুদ্ধিতে মেজর মুজিব এ কাজটি করেছে। কারণ, তখন আমিও নেই। ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীও নেই। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ খবর হলো, মুজিব আমাকে জানাল অস্ত্রাগারে যত অস্ত্র ছিল সব তারা আমবাগানে নিয়ে লুকিয়ে রেখেছে। যেন কেউ আমাদের হঠাৎ আক্রমণ করতে না পারে। মুজিব বলল, স্যার আমরা আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। বললাম, ঠিক আছে সতর্ক থাকো।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নিলেন কীভাবে?
তখন আমি থাকি ওয়াপদা রেস্ট হাউসে। ওখানে গিয়ে আমি একটা চেয়ারে বসে চিন্তা-ভাবনা করছি। দেখলাম, আমার সৈন্যরা যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়ে আছে। এক পা বাড়িয়ে রেখেছে। এখন কথা হচ্ছে, যাদের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করব তারা পাকিস্তানি আর্মি। তাদের আমি ভালো করে চিনি। এখন যেই ব্যাটালিয়ন এখানে আছে তারা সাপোর্ট ব্যাটালিয়ন। একটা ইনফেন্টি ব্যাটালিয়নের চেয়ে দ্বিগুণ ফায়ার পাওয়ার তাদের থাকে। এখন আমি করব? তাছাড়া আমার ওপর কোনো নির্দেশ নেই। এখনও কেউ আমাকে কিছু বলেনি। এখন যা করব আমার নিজের দায়িত্বে করতে হবে। এমন সময় মনে পড়ল ৭ মার্চের ভাষণের কথা। পুরোটা আবার শুনলাম। দেখলাম, এখানে তো সবই আছে, হুকুমও আছে। স্বাধীনতার ঘোষণাও আছে। তখন লোক পাঠালাম যে আধা ঘণ্টার মধ্যে আমরা একটা বৈঠক করব।
বৈঠকে কারা কারা ছিলেন?
সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান, পুলিশপ্রধান ও রাজনীতিবিদদের বৈঠকে ডাকলাম। আমার উদ্দেশ্য পরীক্ষা করে দেখা, তারা কতটুকু রাজি এবং প্রস্তুত আছে। বৈঠক হলো। উদ্বোধনী বক্তব্যে বললাম, ‘ভাইসব পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদেরই মাটিতে বসে সুপরিকল্পিতভাবে আমাদের হত্যা করছে। দেশের শাসনভার হস্তান্তরের দেন-দরবার সব ভাওতাবাজি। বরং বুলেটের মাধ্যমে তারা বাংলার মানুষকে ঠা-া করে সারা জীবনের জন্য গোলাম করে রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে। কসাই নামে কুখ্যাত টিক্কা খানের হাতে সেই নীলনকশা হস্তান্তর করে ইয়াহিয়া পালিয়ে গেছে তার দেশে। আপনারা শুনেছেন ইতিমধ্যে তারা ইপিআর হেডকোয়ার্টার পিলখানা ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনসকে ধূলিসাৎ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের হত্যা করে গণকবর দিয়েছে। সারা দেশ থেকে আমরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আমরা জানি না, দেশের আর কোথাও কেউ এই গণহত্যার প্রতিবাদ করেছে কি না। আমরা জানি না কেউ তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে কি না। এ অবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা আত্মহত্যার শামিল। তবুও আমরা জীবন দিয়ে হলেও এই জঘন্যতম গণহত্যার প্রতিবাদে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করব। পৃথিবীর স্বাধীনতাকামী মানুষ যেন বলতে না পারে যে বাঙালি ভয়ে গোলামিকেই বেছে নিয়েছে।’ বললাম, এ অবস্থায় যদি আমরা বিদ্রোহ করি তাহলে আপনাদের বলেই করব। কারণ আমাদের আছে থ্রি নট থ্রি রাইফেল। আর তারা পুরো আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। আমি তাদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারব না, যদি না আপনারা বাঁশের লাঠির খেলা না দেখান।
সবাই কি সেদিন সাড়া দিয়েছিলো আপনার আহ্বানে?
সবাই বলল, ‘আমরা জীবনে-মরণে আপনাদের সাথে আছি এবং আপনারা যেখানে, যেভাবে খুশি আমাদের ব্যবহার করতে পারেন।’ এই আশ্বাস পেয়ে আমরা বের হয়ে দেখি হাজার হাজার লোক। সবাই ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করছে।’ লোকজনদের নিয়ে আমার অস্ত্রগারে এলাম। পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ফেললাম। আমাদের পতাকা তৈরি করা ছিল। সবই তৈরি করে রাখা হয়েছিল। এই পতাকা তুলে গার্ড অব অনার দিলাম। আমার আজও মনে আছে, ওই দিন মানুষের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে সব কাঁপছিল। ওই দিন আমি ‘জয় বাংলার’ আসল মর্ম বুঝতে পেরেছি, তেজ বুঝতে পেরেছি। তারপর আমি বললাম, আপনারা সবাই যান। আপনাদের সামনে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমরা বিদ্রোহ করেছি। এখন আমাদের প্রয়োজনীয় কাজ করতে দেন। যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হলো।
যুদ্ধের প্রস্তুতি কি শুরু হয়ে গেছে?
হ্যাঁ, সেই পরিকল্পনাই তো করছিলাম। কোনখানে এলএমজি হবে, কোনখানে মেশিনগান হবে, কোথায় ব্যারিকেড দেব, সব আমি দেখিয়ে দিলাম। এগুলো করতে করতে রাত ১১টা বেজে গেল। এটা ২৬ মার্চের কথা। এর মধ্যে আমার যে চারটা কোম্পানি বর্ডারে আছে তাদের সাথে আমি যোগাযোগ করতে পারিনি। সময় পাইনি। রাত ১১টায় ফ্রি হয়ে গিয়ে বসলাম অফিসে। তাদের সাথে যোগাযোগ করলাম। দেখলাম তারা কিছুই জানে না। ঢাকার কী অবস্থা, তাদের জানালাম। আমরা যে বিদ্রোহ করেছি সেটাও জানালাম। তাদের বললাম, তোমরাও মনে করো যে যুদ্ধক্ষেত্রে আছ। সতর্ক থাকো। পরবর্তী সময়ে কী নির্দেশনা হয় সেটি পালন করবে। তারা বলল, ‘স্যার বর্ডার কী করব?’ বললাম, এখন আর বর্ডার বলতে কিছু নেই। সব বাদ দাও। এসব করতে করতে সকাল হয়ে গেল।
ওই রাতে ঘুমোতে পারেননি বোধ হয়?
বাসায় গিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেছি ঘুম হয়নি। ২৭ মার্চ ভোরে খবর এল, দক্ষিণের কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার আবদুল মজিদ মোল্লা ওয়্যারলেসে বলল, ‘স্যার ক্যাপ্টেন সাদেক তিনজন সৈন্য নিয়ে আমাদের এখানে এসেছে।’ ওটা ছিল যাদবপুরে কোম্পানি এলাকায় মাসলিয়া বিওপি। বললাম, দেখো কী করতেছে। সাবধান থাকো। যখন একজন সেন্ট্রিকে ক্যাপ্টেন সাদেক কোনো নির্দেশ দিয়েছে কিন্তু সে পালন করেনি। তখন সাদেক তাকে গুলি করেছে। পিস্তলের গুলি লাগেনি, মিস হয়েছে। এরপর সে দেখে সবাই তৈরি হয়ে গেছে। অবস্থা ভালো না দেখে সে জিপ নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
সে পালিয়ে যেতে পেরেছিলো?
সঙ্গে সঙ্গে মজিদ মোল্লা আমাকে ওয়্যারলেসে বলল, ‘স্যার, আমার একজন গার্ডকে গুলি করে ক্যাপ্টেন সাদেক এখন ভাগছে।’ বললাম, ‘তুমি তাকে যেতে দিচ্ছ কেন? যে করেই হোক তাকে ধরো। জীবিত অথবা মৃত তাকে ধরো। সঙ্গে সঙ্গে সে ওয়্যারলেস রেখে দিয়ে পরবর্তী বিওপিতে যোগাযোগ করল। বলল, ‘একটা গাড়ি আসতেছে, তাকে আটক করো।’ তাকে দুই দিক থেকে আক্রমণ করা হলো। দুদিকের ফায়ারে ক্যাপ্টেন সাদেক ও সঙ্গীরা মারা গেল। ঘটনাচক্রে তাদের জিপের ড্রাইভারটা ছিল বাঙালি। সে বেঁচে গেল। মজিদ আমাকে ঘটনাটা জানাল। আমি দেখলাম, সে কাঁপছে। আর্মির একজন ক্যাপ্টেনকে তারা মেরে ফেলেছে, এটা ভেবেই ভয় পাচ্ছে। আমি বললাম, তুমি ভয় পাচ্ছো কেন? এটা তো খুশির সংবাদ। তোমরা তো গর্ব করার উচিত যে আর্মির একজন ক্যাপ্টেনকে তুমি মারতে পেরেছো। তুমি বিরাট কাজ করেছো।
কুষ্টিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কেন?
সবাইকে তৈরি করলাম। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি কুষ্টিয়া আক্রমণ করব। পরিকল্পনা করলাম। সে অনুযায়ী ধোপাখালী এলাকায় সুবেদার খায়রুল বাসারের বি কোম্পানি, বৈদ্যনাথতলার সুবেদার মুকিতের সি কোম্পানি ও যাদবপুর এলাকার সুবেদার মজিদ মোল্লার ডি কোম্পানিকে ২৭ মার্চ রাতের মধ্যে চুয়াডাঙ্গায় হাজির হতে বললাম। প্রাগপুরে এলাকার সুবেদার মুজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন এ কোম্পানিকে ২৮ মার্চ রাতের মধ্যে কুষ্টিয়ার কাছেই হাজির হওয়ার নির্দেশ দিই। মোজাফরকে বললাম, তুমি ওমুক জায়গায় আসো। তোমার সাথে যোগাযোগ করবে ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী। আমি কী করব, তুমি কী করবে সব তার কাছে শুনতে পাবে। এটাই নির্দেশ।
মূল আক্রমণে গেলেন কীভাবে?
সবাই এসে গেল। পরিকল্পনা করলাম, তিন দিক থেকে কুষ্টিয়া আক্রমণ করব। আক্রমণ করতে হলে পাকিস্তানিদের পথ বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ যশোর ক্যান্টনমেন্টের পথ বন্ধ করতে হবে। ঝিনাইদহের দক্ষিণ দিকে ৩-৪ মাইল পরে একটা খাল ও বিশাখালী ব্রিজ ছিল। আজম চৌধুরীসহ দুই কোম্পানির সৈন্য আমি পাঠিয়ে দিলাম কুষ্টিয়ার দিকে। এক কোম্পানি সৈন্য ঝিনাইদহের দক্ষিণে বিশাখালী ব্রিজের এই পাড়ে। অবস্থান নিতে বললাম। যেন কেউ এদিকে আসতে না পারে। আর সুলতানের কোম্পানি উত্তরে যেটা ছিল তাকে বললাম, তুমি অপেক্ষা কর। আমি পরিকল্পনা করলাম, ৩০ মার্চ সকালে এই তিন দিক থেকে লোক নিয়ে আক্রমণ করতে হবে।
স্থানীয়দের সহযোগিতা পেয়েছিলেন ওই যুদ্ধে?
অল্প সময়ের মধ্যে, চুয়াডাঙ্গাতে আমার প্রধান উপদেষ্টা করে নিলাম স্থানীয় একজন এমপিকে। তার নামটা মনে আসছে না। তবে ওই উপদেষ্টাদলে ছিলেন ডা. কোরেশি, অ্যাডভোকেট ইউনুস, ব্যারিস্টার বাদল রশীদ। আমার সঙ্গে বৈঠক করে বললাম, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমাকে যদি সফলভাবে যশোর ক্যান্টনমেন্টের মুখোমুখি হতে হয় তাহলে আগে পেছনের শত্রু নিধন করতে হবে অর্থাৎ কুষ্টিয়া আক্রমণ করতে হবে। আক্রমণ হবে তিন দিক দিয়ে। তাদের বললাম, আপনাদের কাজ হবে আমার সৈন্যদের পেছনে প্রায় দুই হাজার করে লোক দিতে হবে। যারা পেছনে পেছনে থাকব। যার যা আছে তাই নিয়ে আসবে। তিন দিকে মোট ছয় হাজার। তারা পারবে কি না জিজ্ঞেস করলাম। তারা সম্মতি দিল।
যুদ্ধে কাকে কী দায়িত্ব দিয়েছিলেন?
ডা. কোরেশিকে মেডিকেল বিভাগের দায়িত্ব দিলাম। যদি যুদ্ধে কেউ আহত হয় তাকে সেবাশুশ্রƒষা দিতে হবে। সে রাজি হলো। প্রধান উপদেষ্টাকে বললাম, পরদিন ৩০ মার্চ ভোর চারটায় আক্রমণ করব। দুপুরে যোদ্ধাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পাতিলে করে ভাত-তরকারি দিলে হবে না। শুকনো খাবার। সবাইকে হাতে হাতে পৌঁছে দিতে হবে। কারণ তারা তো যুদ্ধক্ষেত্রে থাকবে। এভাবে সবকিছু প্রস্তুত করেছি। আর যে ছয় হাজার লোক আমাদের পেছন পেছন ছিল তাদের হাতে লাঠিসোঁটা, দা, ছেনি যার যা আছে সব নিয়ে চলে এসেছি। ঠিক সময়ে আমরা আক্রমণ করলাম। যোদ্ধাদের বলেছিলাম, আস্তে আস্তে তোমরা এগিয়ে যাবে। কোনো হাঙ্গামা করা যাবে না। পাকিস্তানি সৈন্যরা যেন বুঝতেই না পারে আমরা তাদের আক্রমণের জন্য আসছি। পাকিস্তানিরাও কিন্তু চিন্তা করেনি যে আমরা থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে তাদের আক্রমণ করতে যাব। এটা তাদের ভাবনাতেই ছিল না। তারা মনে করেছিল, আমরা কিছুই করতে পারব না, করবও না। কাজে তারা নিশ্চিতে অনেকেই ঘুমিয়েছে।
আক্রমণটা তবে হয়েছিল ভোরে?
হ্যাঁ, ভোর চারটায় হঠাৎ আক্রমণ করলাম। সৈন্যরা ফায়ার করতে শুরু করল। পাকিস্তানিদের কেউ ঘুম থেকে উঠেছে, কেউ তখনই গুলি লেগে পড়ে গেছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনেকে পড়ে গেছে। কেউ দৌড়ে বাঁচতে গিয়ে পড়ে গেছে। পাকিস্তানিদের বড় অস্ত্রগুলো ছিল জিপের ওপর। প্রথমে পুলিশ লাইনসে তারা একটা জিপের ওপর অস্ত্র বসিয়েছে ফায়ার করার জন্য। তার আগেই যারা ফায়ার করবে তাদের গুলি করে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কাজেই তারা সেটা করতে পারেনি। যারা পালিয়ে বাঁচল তারা হেডকোয়ার্টার জেলা স্কুলে গেল। আনুমানিক ৫০ জন সৈন্য পালিয়ে বেঁচেছে। আমার কাছে খবর আসছে।
আপনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কীভাবে?
আমি কন্ট্রোল রুম খুলে বসেছি পোড়াদহের গাছতলায়। ওখানে এক্সচেঞ্জ করে দেওয়া হয়েছে। খবর এল গোটা শহর আমাদের হাতে। শুধু জিলা স্কুলটা বাকি। বললাম, আক্রমণ চালিয়ে যাও।
পরের দিন ৩১ মার্চ সকাল থেকে শুরু হলো যুদ্ধ। ফায়ারিংয়ের কারণে কেউ এগোতে পারছে না কেউ পেছাচ্ছেও না। এদিকে আমাদের ওয়্যারলেসে ধরা পড়ল পাকিস্তানি সৈন্যরা রেনফোর্সমেন্ট চাচ্ছে। বাধ্য হয়ে পাকিস্তানিদের অধিনায়ক মেজর শোয়েব ওয়্যারলেসে যশোর সেনানিবাসের কাছে সাহায্য চাচ্ছে। বলছে, আমরা বিপদে আছি আমাদের কাছে সৈন্য পাঠাও। কিন্তু জবাবে যশোর থেকে বলা হয় ‘জবরহভড়ৎপবসবহঃ হড়ঃ ঢ়ড়ংংরনষব, ঃৎু ঃড় ষরাব ড়হ ুড়ঁৎ ড়হি’ অর্থাৎ রেনফোর্সমেন্ট পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। তোমরা নিজেরাই বাঁচার চেষ্টা কর। সারাদিন গোলাগুলির পর কোনো উপায় না পেয়ে সন্ধ্যার পর তারা গাড়ি একত্র করল। দুটি জিপ, দুটি ডজ গাড়ি একত্র করল। তারা চারজন অফিসার ছিল। একজন মেজর, দুইজন ক্যাপ্টেন, একজন লেফটেন্যান্ট। দুইজন করে দুই জিপে বসল। অফিসারসহ ৪০-৫০ জন পাকিস্তানি সেনা ওই গাড়িগুলোতে করে রাতের অন্ধকারে তীব্র গতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের বাধা অতিক্রম করে ঝিনাইদহের দিকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল।
তারা কি পালিয়ে যেতে পেরেছিল?
প্রশ্নই আসে না। আগে থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা শৈলকুপা সেতুর গোড়ার দিকে বিরাট গর্ত করে বাঁশের চাটাই দিয়ে ঢেকে আলকাতরা মেখে পিচঢালা পথের মতো করে রাস্তার দুই পাশে ওত পেতে বসেছিল। পাকিস্তানিদের গাড়িগুলো তীব্র গতিতে এসে পর পর দুটি জিপই নিচে পড়ে যায়। মুক্তিবাহিনীও আঘাতের পর আঘাত হানতে থাকে। মেজর শোয়েবসহ কয়েকজন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। বাকি সৈন্যরা আহত অবস্থায় আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসীর চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা জীবিত ফিরতে পারেনি।
ওই যুদ্ধের একটা ঘটনা আপনি প্রায়ই বলেন, একটা কিশোর ছেলের গল্প। যে কিনা একটা এলএমজি নিয়ে আপনার কাছে এসেছিল...
পরদিন পয়লা এপ্রিল আমার কাছে ১৭-১৮ বছরের একটি ছেলে এল এলএমজি হাতে নিয়ে। বলল, আমি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এসেছি। আমার নাম সুলতান আলী জোয়ার্দার। সে বলল, আমার বাড়ি ঝিনাইদহের একটা গ্রামে। গতকাল রাত ১১টার দিকে দেখলাম একটা লোক দৌড়াচ্ছে তার হাতে এই এলএমজিটা ছিল। আমার একটা একনলা বন্দুক ছিল। ওইটা নিয়ে তার পেছনে দৌড়াতে থাকলাম। সে আমাকে দেখেও গুলি করল না। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি তার কাছাকাছি পৌঁছে আমার একনলা বন্দুক দিয়ে তাকে গুলি করলাম। তাকে মেরে এলএমজিটা নিয়ে এলাম। প্রমাণস্বরূপ তার কনিষ্ঠ আঙুলটা কেটে নিয়ে এসেছি। এই হলো আঙুল, আর এই হলো এলএমজি। আপনার জন্য নিয়ে এসেছি।
কুষ্টিয়া তখন শত্রুমুক্ত হলো?
সেদিন এভাবে তাদের পরাস্ত করা হয়েছিল যে, কেউ পালিয়ে ঝিনাইদহে পৌঁছতে পারেনি। দুই দিনের যুদ্ধে কুষ্টিয়ার পাকিস্তানি বাহিনী সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। ১ এপ্রিল কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত হয়। যুদ্ধে আমাদের চারজন শহীদ হন। বেশ কিছু লোক আহত হয়। পাকিস্তানিদের ২-১ জন যারা বেঁচে ছিল তাদের কুষ্টিয়াতেই জেলে রাখা হলো। আমরা সব দখলে নিলাম। অনেক অস্ত্রশস্ত্র, বড় বড় গান পেলাম পাঁচটা। পাঁচটি জিপের ওপর রাখা। গানের যে লকেট এগুলো পেলাম প্রায় এক রুম। কুষ্টিয়া জিলা স্কুল ঘাঁটিতে সব পাওয়া গেল। জিপার আরোহী ছয়টি ১০৬ মিলিমিটার ট্যাংকবিধ্বংসী কামান, ৮টি ভারী মেশিনগান, ১৯টি হালকা মেশিনগান, ৪৮টি সাব-মেশিনগান, ৮৯ স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ২৪টি গাড়ি ছাড়াও অনেক গোলাবারুদ আমরা পেয়েছিলাম। যা দিয়ে পরে ৯ নম্বর সেক্টরকে সশস্ত্র করা হয়। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকেও পুনর্গঠিত করে তৈরি করা হয়।
যুদ্ধের সময় খবর সংগ্রহের জন্য কোনো গণমাধ্যম কর্মীদের আপনারা পেয়েছিলেন?
৩ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গাতে ফরাসি টেলিভিশনের তিন-চারজন লোক আমাদের কাছে আসে। আরও অনেক আগে এসেছে। আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছে। আমার ছোট মেয়ে পতাকা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছে। আহত সৈন্যদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। কোথায় গুলি লেগেছে জিজ্ঞেস করেছে। এরা যখন তাদের কাজ শেষ করে ফিরবে এমন সময় ওই ২৪ গাড়ির কনভয় এসে গেল।
আপনারা ওই অপারেশনে কাউকে আটক করতে পেরেছিলেন?
আমরা চারজন কর্মকর্তার একজনকে ধরতে পেরেছি। লেফটেন্যান্ট আতাউল্লাহ শাহ্। তাকে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে। সেখানে ব্যান্ডেজ লাগানো। তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসা হয়েছে। টেলিভিশনের লোকজন তাদের দেখে উৎসাহিত হলো। আতাউল্লাহ শাহ্র সাক্ষাৎকার নিল। এটা করার পর তারা আবার ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন সময় আকাশপথে আমার ওপর আক্রমণ হলো। আমাদের তো এন্টি এয়ারক্রাফট গান নেই। আমাদের কিছু এলএমজি, এসএমজি আছে। সেগুলো আমরা কোনো কোনো হেডকোয়ার্টার বা বিল্ডিংয়েংর ওপর ফিট করে রেখেছি। উড়োজাহাজ লক্ষ্য করে মারবো। কিন্তু এটা উড়োজাহাজের বিপরীতে এটা খুব বেশি কার্যকর হয় না। তবু সান্তনা হিসেবে এগুলো তাক করে রেখেছি। পাকিস্তানিরা ওপর থেকে গুলি করছে। আমরা নিচ থেকে গুলি করছি। ফরাসি টেলিভিশনের লোকজন গাছে উঠে সব ছবি তুলেছে। ওই সময় আমাদের হেডকোয়ার্টারের পাকিস্তানিরা একটা নাফাম বোমা ফেলেছিল। বোমাটা এমনভাবে ফেলেছে যে আমাদের এখানে না পড়ে পাশের গ্রামে পড়ল। গ্রাম জ্বলে গেল। এগুলোর ছবিও তুলল তারা। সঙ্গে সঙ্গে এগুলো পাঠিয়ে দিল প্যারিসে। ওটাই ছিল প্রথম যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি, যেটা টেলিভিশনে প্রচার হয়েছে। পরে তারা এগুলো কপি করে বিবিসিসহ বিশ্বের ৫০টি দেশে পাঠিয়েছে।
এই খবর আপনি কোথায় পেলেন?
সাবেক রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে আমার একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে কথা হয়। তিনি বলেন, ২৪ এপ্রিল বিসিসিতে দেখেছি। এটা দেখেই নাকি তারা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তারা তখন বুঝতে পেরেছেন, যুদ্ধ লেগেছে, যুদ্ধ হবে আর বসে থাকার উপায় নেই।
তারপর তো বিশাখালী যুদ্ধ ও লেবুতলা অ্যাম্বুশ হলো...
৫ এপ্রিল হলো বিশাখালী প্রতিরোধ যুদ্ধ। ৭ এপ্রিল লেবুতলার অ্যাম্বুশ হলো। সেখানে পাকিস্তানিদের ১০-১২ জন মারা গেল। খুব অত্যাচার করেছে তারা। মৃতদেহ ফেলে তারা পালিয়ে গেল। ১৩ এপ্রিল খবর এল পাটুরিয়া থেকে লঞ্চ-ট্রলারে করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আসছে। আমি সাথে সাথে এক প্লাটুন সৈন্য পাঠিয়ে দিলাম একজন সুবেদারের অধীনে। এক প্লাটুনে থাকে ৫০ জন সৈন্য। নির্দেশ দিলাম সেখানে আরও সৈন্য তুমি পাবে। সেখানকার যত পুলিশসহ অন্যরা এসে যোগ দেবে। সেখানে তখন ছিলেন ডা. আবদুল মালেক। যিনি পরে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হয়েছিলেন। তিনি সেখানে ছিলেন। বলে দিলাম, তার সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করতে হবে। এমন প্রস্তুতি নিতে হবে যাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা লঞ্চ থেকে নামতে না পারে। গোয়ালন্দের পাড়ে প্রস্তুতি নিতে বললাম। ওখানে একটা অ্যান্টি ট্যাংকগান ছিল। ওটা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ের, আধুনিক নয়। ওটা দিয়ে গোলা ছুড়ে তাদের একটা লঞ্চ ডুবিয়ে দেওয়া হয়। ওই লঞ্চে যত সৈন্য ছিল সব পদ্মার ¯্রােতে ভেসে গেছে। তখন তো পদ্মা খুব বিধ্বংসী। যাই হোক, ওরা আর ওখানে নামতে পারেনি। তাদের অনেকে ফিরে গেছে।
মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের জীবন্ত সাক্ষী আপনি, সেদিন কী হয়েছিল?
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। তখন আমার হেডকোয়ার্টার নিয়ে যাওয়া হয়েছে মেহেরপুরের পেছনে ইছাখালী বিওপিতে। খবর এল ১০ এপ্রিল তো সরকারের ঘোষণা হয়েছে। ওই দিন গোটা বাংলাদেশের যুদ্ধক্ষেত্রকে চারটা অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান; কুমিল্লা-নোয়াখালী অঞ্চল, কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ; ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল অঞ্চল, কমান্ডার মেজর সফিউল্লাহ ও কুষ্টিয়া-যশোর অঞ্চল, কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরী।
শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন তো আপনি করেছিলেন?
আমাকে জানানো হলো, ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আ¤্রকাননে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের শপথ হবে। সব ব্যবস্থা করার জন্য বলা হলো। আমি সব ব্যবস্থা করলাম। প্রকাশ্যে শপথ অনুষ্ঠানে ৩৯টি দেশের সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। শপথের পর যুদ্ধক্লান্ত এক প্লাটুন ইপিআর সৈন্য নিয়ে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের ‘রাষ্ট্রীয় গার্ড-অব অনার’ দেওয়া হয়। সেখানে আমি ছিলাম, অন্যরাও ছিলেন। সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে সারা বাংলার নারী জাতির প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন একমাত্র সেক্টর অধিনায়কের পতœী বেগম নাজিয়া ওসমান, আমার স্ত্রী।
তাজউদ্দীন আহমদরা তখন কোথা থেকে এসেছিলেন?
তাজউদ্দীন সাহেবরা ভারত থেকে এসেছিলেন। শপথ গ্রহণ উপলক্ষে কলকাতায় যত হাইকমিশন আছে সেখান থেকে প্রতিনিধিদের ১৬ এপ্রিল রাতের মধ্যে কৃষ্ণনগর আসতে বলা হয়েছিল। সেখান থেকে পরদিন সকাল ১০টার দিকে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানস্থল বৈদ্যনাথতলায় চলে আসে। শপথ গ্রহণের পর তারা আবার মুজিবনগরে সরকারি হেডকোয়ার্টারে চলে যায়। ওই শপথ অনুষ্ঠানে তৎকালীন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এমএজি ওসমানীকে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান অধিনায়ক নিয়োগ করা হয়। এছাড়া চারটি অঞ্চলের কমান্ডারদের নামও ঘোষণা করা হয়।
আপনার সেক্টরের হেডকোয়ার্টার পরিবর্তন করা হয়েছিল...
আমার দুটি হেডকোয়ার্টার ছিল। অপারেশন হেডকোয়ার্টার ছিল বেনাপোলে। ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর ১৮ এপ্রিল ইছাখালী থেকে হেডকোয়ার্টার নিয়ে গেলাম বেনাপোলে। প্রশাসনিক হেডকোয়ার্টার ছিল ভারতে কল্যাণী উপশহরে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের অভিযাত্রী পরিবারের সদস্যদের রাখা হয়েছে। আমার জন্য আমি একটা দোতলা বাসা নিয়েছি। কে এম সফিউল্লাহর পরিবারকে রেখেছিলাম দোতলায়, আমরা থাকতাম নিচতলায়। আমি সেখানে যেতাম মাঝেমধ্যে। আর না হয় বিভিন্ন ফ্রন্ট লাইনের কোম্পানিতে থাকতাম। তখন আমার সাতটা সাব সেক্টর ছিল, সাতক্ষীরা অঞ্চলে।
বেনাপোল গিয়ে কী করলেন?
১৪ এপ্রিল যখন চুয়াডাঙ্গা থেকে চলে আসি তখন ৭৫ ট্রাংক ভরা টাকা নিয়ে এসেছিলাম। এগুলো এনে রাখলাম ভারতীয় কাস্টমসের একটি গুদামে। আমরা বুঝেছিলাম, সামনে টাকা-পয়সা লাগবে। আর এগুলো না নিয়ে এলে পাকিস্তানিরা সব নিয়ে যাবে। আটজনের একটা সাব-কমিটি করে মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরের ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা এবং ২৮ কেজি স্বর্ণ আমরা পেলাম। তখন আমার সঙ্গে তৌফিক এলাহী ও মাহবুব ছাড়া কোনো অফিসার ছিল না। তাদের দিয়েই টাকাগুলো রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। অফিসার আজম চৌধুরী তো একটা সাব-সেক্টর কমান্ড করছে। মুজিবনগর সরকারের অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং অর্থসচিব আনিসুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকাগুলো জমা রেখেছিলাম।
শোনা যায়, জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে আপনার সম্পর্কের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল...
আমি ফ্রন্ট লাইনের কোম্পানিগুলোর কাছে সব সময় যাই। সাব-সেক্টরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখভাল করি। তবে ফ্রন্টেই বেশি ছিলাম। একবার আগস্টের ১৬ কি ১৮ তারিখে আমি ভারতের কল্যাণী উপশহরে প্রশাসনিক হেডকোয়ার্টার এলাম। গিয়ে দেখি মেজর এম এ মঞ্জুর বসে আছে। তাকে আমি ভালো করে চিনি। মঞ্জুর এসেছিল পাকিস্তান থেকে। সে ইস্ট বেঙ্গলের কামান্ডার ছিল। সেখানে ছিল ক্যাপ্টেন হিসেবে। বাংলাদেশে এসে মেজর হয়েছে। লেফটেন্যান্ট কর্নেলও হয়েছে। তাকে আমি হেডকোয়ার্টারে দেখে অবাক হলাম। আমি জানি না যে সে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছে। প্রশ্ন করলাম, ‘কোত্থেকে আসলে তুমি?’ সে সব কথা বলল। জানাল সে একটা চিঠি নিয়ে সেখানে এসেছে। চিঠিটি আমাকে দেখাল। চিঠিটি ছিল ওসমানী সাহেবের। ওই চিঠিতে লেখা, ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে মেজর মঞ্জুরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে মুজিবনগর সরকারের লজিস্টিক প্রধান করে। অথচ এ ধরনের কোনো পদ সেখানে ছিল না। কারণ লজিস্টিকের জন্য আমরা তখনও ভারতীয় বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। কিন্তু ওসমানী সাহেব আমাকে সরিয়ে দিয়ে মঞ্জুরকে ৮ নম্বর সেক্টরে বসিয়ে আমাকে সেখানে নিয়ে গেল। এ ঘটনায় আমি বিস্মিত হলাম। কী কারণে তিনি এটা করলেন? এর আগে মে মাসের শেষ দিকে এম এ জি ওসমানী দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনকে দুই ভাগ করেন। ৮ নম্বর এবং ৯ নম্বর সেক্টর। ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার করা হয় আমাকে।
আপনাকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্তে সৈন্যদের মধ্যে কোনো প্রভাব পড়েছিল?
আমাকে ৮ নম্বর সেক্টর থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে আমার সৈন্যদের মধ্যে বিদ্রোহ সৃষ্টি হলো। আমি সুবেদারদের ডেকে বললাম, তোমরা এটা করতে পারো না। কমান্ডার আসবে, কমান্ডার যাবে। আমি চলে গেলে মেজর মঞ্জুর চালাতে পারবে না, তা নয়। কিন্তু প্রশ্ন আমার মনেও আছে তোমাদের মনেও আছে। এ নিয়ে বিদ্রোহ করার কিছু নেই।
জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে আপনার এ নিয়ে কথা হয়নি?
আমার সঙ্গে ওসমানী সাহেবের কথা হলো। তিনি স্পষ্ট বললেন, ‘আমি যা করেছি তাই হবে।’ বললাম, মঞ্জুরকে যদি বসাতে হয় তাহলে ৬ নম্বর সেক্টরে বসাতে পারেন। কারণ ৬ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার তো এয়ারফোর্সের অফিসার এম কে বাশার। তাকে সেখান থেকে আনলে তো এ কে খন্দকারের হাত শক্ত হবে। এতে সুবিধাও হবে। ওসমানী সাহেব আবারও বললেন, ‘নো, আমি যা করেছি তাই হবে।’ তখন খন্দকার সাহেব সেখানে ছিলেন। তিনি আমাদের দুজনের মধ্যে বাগ্্বিত-া শুনেছেন। এসব দেখে তিনি বললেন, ‘তুমি চলে আসো, অসুবিধা নেই। তুমি তো জানোই কমান্ডার পরিবর্তন হতেই পারে।’ বললাম, স্যার সবকিছু করল আমাকে জিজ্ঞেস করে। আর এখন বদলির ব্যাপারে আমার সঙ্গে কথা বলা হলো না। তার পরও আমি দায়িত্ব ছাড়িনি। দুদিন ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। তবে ভারতীয় বাহিনীর অফিসাররা যখন বলল, ‘ভাই এভাবে ঝুলিয়ে রেখো না। এটা ভালো নয়। এটা তোমার জন্য খারাপ হবে।’ পরে আমি ২৩ আগস্ট মঞ্জুরের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছি।
যুদ্ধ চলাকালে তো আপনার পদোন্নতি আটকে দেয়া হয়েছিল। এর পেছনে কি জেনারেল ওসমানী ছিলেন?
তিন বাহিনীর সদস্যদের পদোন্নতিগুলো ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে হয়েছে। আমার নামও সেখানে ছিল। কিন্তু জেনারেল ওসমানী সাহেব আমাকে পদোন্নতি দেননি। ওই যে তার সঙ্গে বাগ্্বিত-া হয়েছিল, সেই কারণে। আমি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে গেলাম। তাকে সব বললাম। ওসমানী সাহেব পদোন্নতির তালিকায় সাত নম্বরে আমার নাম লিখেছিলেন, আবার কেটে দিয়েছেন। আমার বিরুদ্ধে তো কোন অভিযোগ নেই। যতটুকু বুঝি, পাকিস্তান আর্মিতে মেজর মঞ্জুর আমার থেকে এক দিনের সিনিয়র ছিল। জুলাই মাসে যদি আমার লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পাই তাহলে তো সে আমার জুনিয়র হয়ে যায়। মেজর মঞ্জুরকে বাঁচানোর জন্য তিনি আমার নামটা কেটে দিয়েছেন। এটা আমি জানতে পারলাম সেখানে। ওসমানী সাহেবের কাছে আমি গিয়েছিলাম, তিনি বললেন, ‘এটা ঠিক আছে।’ তাকে বললাম, স্যার আপনি এটা করতে পারেন না, এটা স্বেচ্ছাচারিতা। এটা বলে আমি সেখান থেকে বের হয়েই প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী আমাকে বললেন, ‘এটা নিয়ে আমরা অগ্রসর হতে চাই না। যেহেতু যুদ্ধ চালানোর ভার তাদের হাতে, আমরা শুধু নির্দেশনা দিচ্ছি। এখন আমরা এটা নিয়ে ‘হ্যাঁ’, ‘না’ কিছু বলতে পারব না। যদি স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশে যেতে পারি তাহলে তোমার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।’ যাই হোক আমি ফিরে এলাম।
১৬ ডিসেম্বরের পর তো মেজর মঞ্জুরকে ওসমানী আবারও পদোন্নতি দিয়েছিলেন?
১৬ ডিসেম্বর যখন পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করে তখন ওসমানী সাহেব সিলেটে ছিলেন। সিলেট থেকে তিনি এলেন ২০ ডিসেম্বর। এসেই এককভাবে মঞ্জুরকে একটা পদোন্নতি দিয়ে গেলেন। আমাকে দিলেন না। এর মধ্যে মঞ্জুরের তিন মাস হয়ে গেছে। যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেলেন, হেডকোয়ার্টার গুছিয়ে তুমি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে চলে আসো। এখানেই গোলমাল হলো মঞ্জুরকে নিয়েই। ওসমানী আমাকে বঞ্চিত করেছেন মঞ্জুরের কারণেই। পদোন্নতির তালিকায় সাতজনের নাম লেখা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, কে এম সফিউল্লাহ, শওকত, সি আর দত্ত, জামান এবং সাত নম্বরে আমি। এদের মধ্যে আমি ছিলাম জুনিয়র।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী যখন আত্মসমর্পণ করে তখন আপনি কোথায় ছিলেন?
ওই সময় আমি ছিলাম মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর ৮ নং থিয়েটার রোড, কলকাতায়। বিজয়ের খবর পেয়েছি বিজয় দিবসের ৯ দিন আগেই। আমার ৮ নং সেক্টরের যোদ্ধারা ৭ ডিসেম্বরই যশোর গারিজন ও শহরে ঢুকে পড়েছে বিজয়ীর বেশে। ৭ ও ১৬ ডিসেম্বর দুটো বিজয়ের খবরই পেয়েছিলাম মুক্তিবাহিনী সদর দপ্তরে ভারতীয় বাহিনীর লিয়াঁজো অফিসার ব্রিগেডিয়ার দাশগুপ্তর মাধ্যমে। খবর শুনে উল্লসিত হয়েছি, কিন্তু তা শুধু ক্ষণিকের জন্য। মুহূর্তেই মন আমার যশোর গ্যারিজন ও ঢাকা রেসকোর্স ময়দানের মধ্যে উল্কার মতো ছোটাছুটি করতে থাকে। অফিসে শুধু ছটফট করেছি।
যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে কোথায় ফিরলেন?
সব গুছিয়ে চলে এলাম ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট হেডকোয়ার্টারে। ১৯৭২ সালের মার্চের শুরুর দিকের কথা। তখন ওসমানী সাহেবের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হওয়ার একটা গুজব উঠল। তিনি কর্নেল ছিলেন, জেনারেল হওয়ার জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করলেন। পরে সরকারই তাকে জেনারেল উপাধি দিয়েছে। জেনারেল র্যাংকটা পরেই তিনি নাজমুল হুদাকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি দিলেন। নাজমুল হুদা আমার থেকে চাকরিতে ৫ বছরের জুনিয়র এবং আমারই কোরের অফিসার। তাকে যুদ্ধে আমিই এনেছি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণে তাকে ক্যাপ্টেন অবস্থায় বের করে দিয়েছিল পাকিস্তানিরা। সেই তাকে, আমার অফিসার হিসেবে ফিরিয়ে এনেছিলাম। সেও খুশি হয়ে এসেছিল।
১৯৭১ সালের জুলাইয়ে তার পদোন্নতি হলো। ক্যাপ্টেন থেকে মেজর হলো সে। এখন জেনারেল হওয়ার পর ওসমানী সাহেব আমার পাঁচ বছরের জুনিয়র এই কর্মকর্তাকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল বানিয়ে আমার ওপরে পদায়ন করলেন। আমি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতিপত্র জমা দিলাম ওসমানী সাহেবের কাছে। তিনি সেটি প্রসেসিং না করে পকেটে রেখে দিলেন। তার ধারণা ছিল তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হলে ওটাকে পুঁজি করে আমাকে বাদ দেবেন। কিন্তু তার আর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তিনি মন্ত্রী হতে পারলেন না। চিফ অব স্টাফ হয়ে আসলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল কে এম সফিউল্লাহ। তার অফিসে গিয়ে শুভেচ্ছা জানালাম। বললাম স্যার, আমি তো চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়ে পত্র জমা দিয়েছি। আমার আবেদনটি কী অবস্থায় আছে? তিনি অনেক খুঁজে সেটা পেলেন না। নতুন করে আরেকটি অব্যাহতিপত্র প্রসেসিং করে তার কাছে পাঠালাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
তারপর বঙ্গবন্ধু কী করলেন?
বঙ্গবন্ধু তখন চুয়াডাঙ্গার সব এমপি, এমএলএদের ডাকলেন। সবার সঙ্গে আমার বিষয়টি নিয়ে কথা বললেন। চুয়াডাঙ্গার সবাই আমার পক্ষে দাঁড়াল। কারণ তারা জানে আমি সেখানে কী করেছি। তাদের নিয়েই করেছি। কোনোটাই তাদের বাদ দিয়ে করিনি। সবাই আমার পক্ষে কথা বললেন। বঙ্গবন্ধু তখন আমার আবেদনের ওপর দুটি ছত্র লিখলেন, এক- ‘অ্যালিগেশন অ্যাগেইনস্ট মেজর ওসমান ইজ বেজলেস।’ তখনই আমি জানলাম আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছিলেন ওসমানী সাহেব। দ্বিতীয় বাক্য হলো, ‘হিজ প্রমোশন ইজ গ্রান্টেড।’ সরাসরি তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে আমার পদোন্নতি দিলেন।
১৯৭৫ সাল এবং পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কি মনে আছে আপনার?
’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে পরাজিত শত্রুরা প্রতিশোধ নিয়েছিল। তারপর অনেক কূটকৌশলী পদক্ষেপ শেষে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এল। ১৯৭৭-এর এপ্রিলে হ্যাঁ-না ভোটের নামে রাষ্ট্রপতির আসন ছিনতাই করে জিয়া হলেন রাষ্ট্রপতি। আর ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের নিয়েই তার মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকাররাজ শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী এবং ঘাতকরাজ মাওলানা মান্নানকে ধর্মমন্ত্রী বানিয়ে ছিলেন। দেশের প্রশাসনিক ক্ষেত্রের সব বড় বড় পদে নিয়োগ করে সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের প্রতিষ্ঠিত করেন। যে জামায়াতে ইসলামী ছাত্রসংঘ (বর্তমানে ইসলামী ছাত্রশিবির) ও অন্যান্য সাম্প্রদায়িক দলগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা ও দুই লাখ ৬৯ হাজার বাঙালি মা-বোনের সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি লক্ষ রেখে বঙ্গবন্ধু সরকার সেই সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে বাংলার মাটিতে নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপতি জিয়া সেই নিষেধ প্রত্যাহার করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে এ দেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। যে বাঙালি জাতীয়তার অহংকার নিয়ে আমরা পাকিস্তানিদের এ দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিলাম, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তার সামরিক শাসনের দুষ্ট বেয়নেটের খোঁচায় আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সেই জাতীয়তাকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে রূপ দেন।
তাহলে বলছেন জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই স্বাধীনতা বিরোধীরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে?
অবশ্যই। ইতিহাস বিকৃতির বীজ বুনে জিয়াউর রহমান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার মূল্যবোধকে চরমভাবে ভূলুন্ঠিত করে ইতিহাসের সব চিহ্নকেও মুছে ফেলার চেষ্টা করেছেন। তার পরে ৯ বছর স্বৈরাচারী এরশাদও ৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের পোষণ ও তোষণ অব্যাহত রাখেন। দুঃখজনক হলো সত্য, সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীতে চাকরিরত বীর মুক্তিযোদ্ধারা ওই সব যুদ্ধাপরাধীকে ’৭১-এ তাদের পাশবিক কৃতকর্মের জন্য শাস্তিদানের পরিবর্তে স্যালুট দিতে বাধ্য হন। যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অর্জনকে খাটো করা হয়েছে। বাঙালি জাতির ইতিহাসে জিয়াউর রহমান এই যে কলঙ্কের কালি লেপে দেন দুই সামরিক সরকারের পনেরো বছর শাসনকাল বাঙালি জাতি সেই লজ্জা, সেই অপমান, সেই কলঙ্কের বোঝা বয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে তো দীর্ঘ সামারিক শাসনের অবসান হয়েছিল...
গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে দীর্ঘ সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি ১৯৯১-এ যে গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করেছিল, সে সরকারের কাছে মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের আশা ছিল অনেক। কিন্তু তা হয়নি। সামরিক স্বৈরতান্ত্রিক দুঃশাসনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারও ৭১-এর যুদ্ধাপরাধী কুখ্যাত ঘাতক-রাজাকার-আলবদরদের তোষণ-পোষণনীতি অব্যাহত রেখে জনগণের সব আশায় ছাই ছিটিয়ে দিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিএনপি ৭২-এর নিষিদ্ধ দল জামায়াতে ইসলামীর সহায়তা নিয়েই সরকার গঠন করে। তারপর বিএনপি ৭১-এর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বিশ্বাসকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনয়ন ও নির্বাচন করে। রাজাকার আবদুল মতিন চৌধুরীকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বানায়। পদাধিকারবলে রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস হয়ে গেলেন মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যবাহী সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। পদাধিকারবলেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরীও বাংলাদেশ পুলিশ ও বাংলাদেশ রাইফেলসের সালাম পান। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও কষ্টার্জিত স্বাধীনতার মূল্যবোধের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বড় অভিশাপ। এর চেয়ে বড় উপহাস আর কিছু হতে পারে বলে আমার জানা নেই।
আপনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকা-ে জড়িত আছেন...
যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত গণআদালাতের বিচারক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। ফরিদগঞ্জ-শহীদ-স্মৃতিস্তম্ভের প্রতিষ্ঠাতাও আমি। ঢাকাস্থ ফরিদগঞ্জ থানা সমিতির প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সেক্টর কমান্ডারস ফোরামে কাজ করে যাচ্ছি। এছাড়া চাঁদপুর জেলা পরিষদ প্রশাসক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছি।
আপনার বেশকিছু রচনাও রয়েছে। সেগুলো কী কী?
নিজের ভেতরের তাড়নায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশকিছু বই লিখেছি। এছাড়া সমসাময়িক অনেক বিষয়েও আমার লেখা আছে। অন্যতম কাজ হচ্ছে, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম (১৯৭১)’. এটি মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল। এছাড়া এক নজরে ফরিদগঞ্জ (১৯৯০), সময়ের অভিব্যাক্তি (১৯৯৬) সোনালী ভোরের প্রত্যাশা (১৯৯৬) এবং বঙ্গবন্ধু: শতাব্দীর মহানায়ক (১৯৯৬)।
বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে বেশকিছু স্বীকৃতিও মিলেছে আপনার...
জীবনের বড় প্রাপ্তি স্বাধীনতা পদক। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আমাকে রাষ্ট্রীয় এই সম্মানে সম্মানিত করেছেন। এছাড়া ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ১৯৯৩ সালে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ থেকে পুরস্কৃত হয়েছে। একই বছর ফরিদপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সংস্থা থেকেও আলাওল সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।
ছবি: রাজিব নূর খান