পুলিশের বিশেষ শাখার কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী আয়েশা রহমান স্বপ্না হত্যা মামলায় “ডাবল ফাঁসি” হয়েছে তাদের একমাত্র মেয়ে ঐশীর রহমানের। রায়ের পর সমাজের বিভিন্ন স্তরে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন সমাজে এরকম হাজারো ঐশী রয়েছে। একজন ঐশীকে ফাঁসি দিয়ে ওদের নির্মূল করা যাবে না।এ নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানউল্লাহ।তিনি বলেছেন, সমাজে হাজারো ঐশী রয়েছে, এক ঐশীকে ফাঁসি দেয়া সম্ভব হলেও ঘরে ঘরে হাজারো ঐশীকে ফাঁসি দেয়া সম্ভব নয়।
তিনি বলেন- শুধু ফাঁসি নয়, পরিবার ও সমাজে যতোদিন নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত না হবে ততোদিন ঐশীরা শেষ হয়ে যাবে না।
ঐশীর ফাঁসি এবং সমাজ বাস্তবতা নিয়ে ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বলেছেন আমানউল্লাহ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মহিউদ্দিন মাহী।
ঢাকাটাইমস: সস্ত্রীক পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলায় ঐশী রহমানে ফাঁসির রায় হয়েছে।আলোচিত এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে আপনি যদি কিছু বলেন ?
এ এস এম আমানউল্লাহ: ঐশীর ঘটনা কেবল শুরু। এর অনেক কিছুই এখনও বাকি। ঐশীর ফাঁসির রায় হয়েছে। তবে আদালতের আরও কিছু করার ছিল না। এটা আইনি বিষয়। এটা নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশে কিন্তু ফাঁসির বিধান রহিত হয়ে যাচ্ছে। অনেক দেশেই এটি রহিত আছে। ফাঁসি দিয়ে কোনো অপরাধ বন্ধ করা যায় না। দরকার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যকার আমূল পরিবর্তন। আইনের মাধ্যমে সমাজের একজন ঐশীকে হয়তো ফাঁসি দেয়া যায়। কিন্তু সমাজে লুকিয়ে থাকা হাজারো ঐশীকে কি ঘরে ঘরে ফাঁসি দেয়া যাবে?
ঢাকাটাইমস: চাঞ্চল্যকর এই মামলায় ঐশীদের জন্য আদালতের আর কী-ইবা করার ছিল বলে মনে করেন?
এ এস এম আমানউল্লাহ: আদালত তার রায়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রর জন্য কিছু দিকনির্দেশনা দিতে পারতেন। এটা গাইড লাইন হিসেবে কাজ করতো।এ গুলো নিয়ে রাষ্ট্র কাজ করতে পারতো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য কেউ কোনো কিছুই করলো না। না করল সরকার, না আদালত, না এনজিও, না বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলো নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু হয়নি।
ঢাকাটাইমস: গবেষণা কারা করবে?
এ এস এম আমানউল্লাহ: গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় আছে। তারাও তো কোনো কিছুই করেনি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যদি ভাল একটা গবেষণা হতো সে আলোকে সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের সুযোগ থাকতো।
ঢাকাটাইমস: বিরাজমান সমস্যার জন্য দায়ী কারা?
এ এস এম আমানউল্লাহ: এর জন্য প্রথম দায়ী পরিবার ও সমাজ। এরপর বৃহত্তম ক্ষেত্রে রাষ্ট্র। পরিবারে সদস্যদের অবহেলা, সতর্কতামূলক পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে সন্তানরা বিপথগামী হয়ে পড়ে। সন্তানদের ভাল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজ ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের সমাজের মধ্যে ব্যাধি ঢুকে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিক মূল্যবোধ শেখানো হয় না। রাষ্ট্রযন্ত্র অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ছে। ফলে নৈতিক অবক্ষয়ের হাত থেকে সমাজকে বাঁচানো যাচ্ছে না।
ঢাকাটাইমস: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিকতা কী শেখানো হয় না?
এ এস এম আমানউল্লাহ: বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিকতা শেখানো হয় না। ষাট, সত্তর এমনকি আশির দশকেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক মূল্যবোধকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হতো। কিন্তু এখন সেই পাঠক্রম নেই। নৈতিক শিক্ষার জন্য পাঠ্যপুস্তকে আমূল পরিবর্তন আনা দরকার।
ঢাকাটাইমস: বলা হচ্ছে- ঐশীর বাবা-মাকে খুনের পেছনের কারণ মাদক। মাদকই সবকিছুর মূল। এ থেকে কি বের হওযার উপায় নেই?
এ এস এম আমানউল্লাহ: আসলে ঐশী কিন্তু তার বাবা-মাকে খুন করেনি। কোনো বাবা-মাকে সন্তান খুন করতে পারে না। ঐশী খুন করেছে তার প্রতিপক্ষকে। সে নেশাগ্রস্ত ছিল। নেশায় বাধা দেয়ায় সে খুন করে। সমাজে যদি লক্ষ্য করেন দেখবেন- আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা এবং আইনপ্রণেতা থেকে শুরু করে সমাজের নামিদামি মানুষই কোটি টাকার মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাহলে এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কে নেবে। রাষ্ট্রনীতিই অজান্তে এই ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। ফলে এ থেকে উত্তরণের কোনো উপায় নেই।
ঢাকাটাইমস: একটা সমাজ তো এভাবে চলতে পারে না। তাহলে এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
এ এস এম আমানউল্লাহ: আমরা একজন ঐশীকে জানি। হাজারো ঐশীরা এখন আমাদের পরিবার আর সমাজে বিরাজমান। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এদের সংখ্যা। এখনই এর লাগাম টেনে না ধরলে সামনে এটি মহামারী আকার ধারণ করবে। এজন্য কিশোর আইন পরিবর্তন দরকার। স্কুলগুলোতে নৈতিক শিক্ষা চালু করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে আমূল পরিবর্তন দরকার। দেশব্যাপী প্রচার-প্রচারণা দরকার। সবাই মিলে বসা দরকার। এ ছাড়া মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিকতা নিয়ে বিশেষ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। রিডিও, টেলিভিশনে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।
ঢাকাটাইমস: ধন্যবাদ আপনাকে।
এ এস এম আমানউল্লাহ: আপনাকেও ধন্যবাদ।