মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম,বীর প্রতীক। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। পরে রণাঙ্গনের তৃতীয় সেক্টর হয়ে এস ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত হন এই সেনা কর্মকর্তা।
চট্টগ্রামের ছেলে এই মুক্তিযোদ্ধা ১৯৯৬ সালে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসরে যান। ২০০৭ সালে ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি গঠনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে পা রাখেন।
মহান বিজয় দিবসে রণাঙ্গণের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা তার যুদ্ধকালের স্মৃতিচারণা করেছেন ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে।
টেলিফোনে নেয়া সাক্ষাৎকারভিত্তিক স্মৃতিচারণাটুকু তুলে ধরছেন নিজস্ব প্রতিবেদক বোরহান উদ্দিন।
ঢাকাটাইমস: কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেন?
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম: পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আমার চাকরি শুরু গাজীপুরের জয়দেবপুরে। তখন গাজীপুর জেলা ছিল না। জয়দেবপুরে অবস্থিত ঐতিহাসিক ভাওয়াল রাজাদের রাজপ্রাসাদে আমরা থাকতাম। দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে আমি ছিলাম কনিষ্ঠতম অফিসার। চাকরির সাড়ে সাত মাস সময়ে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। প্রথম দিনেই আমরা গাজীপুরে বিদ্রোহ করি। গোটা রেজিমেন্ট মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। ময়মনিসংহ, কিশোরগঞ্জ, ভৈরববাজার হয়ে আশুগঞ্জ থেকে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ শুরু করি পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।
মেজর শফিউল্লাহ ছিলেন অধিনায়ক। প্রথম দিকে বেশ কিছুদিন আমি তার স্টাফ অফিসার হিসেবে সঙ্গে ছিলাম। ফলে তৎকালীন হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ায় চা-বাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে ৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অপারেশনাল সভায় অংশ নেয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। এতে মেজর জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ প্রমুখ বৈঠকে ছিলেন। সেই সভায় কিছু সামরিক ও অসামরিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। একটি সিদ্ধান্ত ছিল, এম এ জি ওসমানী কলকাতায় গিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বলবেন, তারা রাজনীতিবিদরা যেন অতিসত্বর রাজনীতির কাঠামো স্থির করেন এবং দেশ চালনা ও স্বাধীন বাংলাদেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। অর্থাৎ সৈনিকরা যুদ্ধ শুরু করলেও রাজনীতিবিদদের সম্মান জানিয়ে তাদের জায়গায় বসানোর আহ্বান ছিল সেটি। পরে আমরা তেলিয়াপাড়া যুদ্ধ শুরু করি। পাঁচ সপ্তাহ যুদ্ধ হয়। তবে তা হাতছাড়া হওয়ায় আমরা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের অংশে চলে যেতে বাধ্য হই। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট রূপান্তরিত হয়ে তৃতীয় সেক্টরে পরিণত হয়।
২৯ মার্চ থেকে প্রতিনিয়ত তরুণ, কৃষক, শ্রমিকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে থাকেন। তাদের স্বাগত জানানো, খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করা, প্রশিক্ষণ দেয়ার দায়িত্ব ছিল আমার। এটা এক স্মরণীয় ব্যাপার। আমৃত্যু স্মরণ থাকবে আমার। ওই তরুণরাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চালিকাশক্তি।
ঢাকাটাইমস: কোন কোন এলাকা আপনাদের দায়িত্বে ছিল?
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম: বর্তমান উত্তরপূর্বে সিলেটের শ্রীমঙ্গল, ভারতের খোয়াই শহর; এপারের আখাউড়া ও ওপারের আগরতলার উপর অংশ; ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, গাজীপুর জেলার অংশ, নেত্রকোনা ও জামালপুর জেলার অংশ আমাদের দায়িত্বাধীন এলাকা ছিল।
আমরা কখনো রাতে, কখনো দিনে যুদ্ধ করতাম। সেটা ছিল গেরিলা যুদ্ধ। আগস্ট-সেপ্টেম্বরের পর থেকে আবার প্রথাগত যুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুকে মোকাবেলা করতে শুরু করি। নতুন ব্রিগেড গঠিত হওয়ার পর আমি এস ফোর্সে ছিলাম। সেটা মেজর সফিউল্লাহর নামে হয়েছিল।
৩০ নভেম্বর মধ্যরাত থেকে প্রস্তুতি নিয়ে প্রথাগত যুদ্ধ করি আমরা। ১ ডিসেম্বর ভোররাতে আখাউড়া থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার উত্তরে
ভারত সীমান্তবর্তী আজমপুরে পাকিস্তানিদের অবস্থানে আক্রমণ করি। সকালের মধ্যে আমাদের দখলে আসে আজমপুর। অনেক হতাহত হয় ওই যুদ্ধে। আমাদের অনেকে আহত হলেও পাকিস্তানি পক্ষে নিহত হয় অনেক। পরে সম্মিলিতভাবে আখাউড়া দখলের জন্য যুদ্ধ শুরু করি। তিন দিক থেকে আক্রমণ করে তিন দিন তিন রাত যুদ্ধের পর আখাউড়া দখলে আসে। এই যুদ্ধে আমাদের অনেকে শহীদ হন। পাকিস্তানিদেরও অনেক নিহত হয়।
ঢাকাটাইমস: আখাউড়া পাকিস্তানিদের বড় ঘাঁটি ছিল জানতাম। সেটি দখল হলো। এরপর ওরা কোন দিকে গেল?
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম: আখাউড়ার পর আর পাকিস্তানিদের প্রত্যক্ষ মোকাবেলা করতে হয়নি আমাদের। কারণ আমরা যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া রওনা হই, ওরা তখন পালাতে থাকে। পিছু ধাওয়া করে আমরা যখন আশুগঞ্জে মেঘনা নদীর তীরে পৌঁছাই, তখন ওরা নদী পার হয়ে যায়। আমরা নদী পার হয়ে ভৈরবে গেলে ওরা চলে যায় নরসিংদীর রাস্তায়। আমরা সেখানে গেলে পাকিস্তানিরা ঢাকায় চলে আসে।
১২ ডিসেম্বর সকাল বেলা শীতলক্ষ্যা নদী পার হই আমরা। পরে সন্ধ্যার দিকে বালু নদীর পাড়ে এসে পৌঁছাই। নদীর এক পারে ঢাকা মহানগর, অপর দিকে রূপগঞ্জ উপজেলা। সেখানে তিন দিন অবস্থান ছিল আমাদের।
ঢাকাটাইমস: সাধারণ মানুষের সহযোগিতা কেমন পেয়েছেন?
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম: আমাদের এই দীর্ঘ পথে প্রতিটি স্থানে নারী-পুরুষনির্বিশেষে সাধারণ মানুষ নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। আমাদের ভারী ভারী অস্ত্র বহন করেছে তারা। এভাবে পথে পথে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত নানা সহযোগিতায় ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় আসি।
সত্যি কথা বলতে কি, অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি, তবে তাদের সাহস, দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখেছি। তেলিয়াপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফ আলী দেওয়ানের কথা না বললেই নয়। ওই সময় আমাদের রেজিমেন্টের দুই হাজারের মতো মুক্তিযোদ্ধার খাওয়া-দাওয়ার বিশাল দায়িত্ব তিনি পালন করেন। নিজের গোয়ালের ১২টি গরু আমাদের খাওয়ার জন্য দিয়েছেন। এসব শেষ হয়ে গেলে পরে অন্যদের কাছ থেকে চেয়ে এনে আমাদের খাওয়ান। নিজের গোলার চাল শেষ হওয়ার পর অন্যদের কাছ থেকে এনে আমাদের খাইয়েছেন এই নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা। নয়টি মাস তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। যতবার তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে-দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কী চান, তার উত্তর ছিল-“আমি স্বাধীনতা চেয়েছি, দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন আর আমার কিছু চাওয়ার নাই।” তিনি অসুস্থ অবস্থায় মারা গেছেন। তার স্ত্রী মারা গেছেন। কিছুই করতে পারিনি আমরা।
আর একজন সাধারণ নাগরিক দুলামিয়া, যিনি হবিগঞ্জের কলকরিয়ায় যুদ্ধ করেছেন। শত্রুদের গোলার আঘাতে তার নাড়িভুড়ি পেট থেকে বের হয়ে যায়। তিনি মাথার গামছা দিয়ে পেট বেঁধে রেখে অস্ত্র চালিয়ে গেছেন। তার বক্তব্য ছিল- “যদি আমি এমনটা না করি তাহলে অন্য যোদ্ধারা মনোবল হারিয়ে ফেলবে।”
ঢাকাটাইমস: যুদ্ধের চূড়ান্ত মুহূর্তে কোথায় কীভাবে ছিলেন?
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম: ১৬ ডিসেম্বর আমাদের অবস্থান ছিল বালু নদীর তীরে। যুদ্ধ চলছিল। পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করতে ভাষার প্রয়োগ করতাম। এরই মধ্যে খবর এল, যেকোনো সময় পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করবে। পরে বিকালে বেতারের মাধ্যমে খবর পাই পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করেছে। এরপর আমরা যুদ্ধ বন্ধ করে দিই। দলের সবাইকে একত্র করে নদী পার হয়ে সড়কপথে ঢাকায় ঢুকি। বিজয় দিবসের দিনেই অনেক মুক্তিযোদ্ধা ঢাকায় ঢুকেছেন।
আমি বীর প্রতীক খেতাব পেলেও আমাকে এটা সব মুক্তিযোদ্ধার জন্য উৎসর্গ করতেই হবে। কারণ সাহসিকতা বিষয়টি একক কোনো জিনিস নয়।
ঢাকাটাইমস: যুদ্ধের সময় কেমন দেশের প্রত্যাশা ছিল, এখন কেমন দেখছেন?
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম: বয়স কম ছিল বলে তখন খুব বেশি আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল না।
তবে স্বাধীন বাংলাদেশে অনেক সেক্টরে উন্নতি হলেও গণতন্ত্রের উন্নতি হয়নি। এটাই ছিল বাংলাদেশের মানুষের মূল চাওয়া। ৪৪ বছর ধরে আমরা গণতন্ত্রের উন্নয়নের জন্য কাজ করছি। অথচ এত বছর পরও দেশে মত প্রকাশের অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে।
ঢাকাটাইমস: আপনাকে ধন্যবাদ।
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম: ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকেও ধন্যবাদ।
(ঢাকাটাইমস/১৬ডিসেম্বর/মোআ)