খ্যাতিমান অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদকসহ বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিচারকের আসনেও ছিলেন গুণী মানুষটি। তিনি আমাদের সবার পরিচিত- হাসান ইমাম। বাংলাদেশের নাট্যশিল্পীদের জন্য এত দরদ দিয়ে সংগঠন তৈরি, সংগঠন নিয়ে ভাবনা-চিন্তা এবং বিপদাপদে শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানো, এসব কাজে তিনি নিষ্ঠাবান। বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই নাটকে নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন হাসান ইমাম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় শিল্পীদের প্রতিবাদী সংগঠন ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’, যারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বর্জন করেন। জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের প্রধান মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’র আহ্বায়কের দায়িত্ব পান। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন নাট্যশিল্পী, নাট্যকার সংসদ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীসহ বহু সংগঠনের সভাপতি-আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। তার বর্ণাঢ্য জীবনের নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে এই সাক্ষাৎকারে। কথা বলেছেন সৈয়দ ঋয়াদ
শৈশবের কথা বলুন।
আমার পৈতৃক বাড়ি বাগেরহাটের খানজাহান আলীর মাজার যেখানে সেটাই আমাদের গ্রাম। গত পাঁচ পুরুষ ধরে আমরা সেখানেরই স্থায়ী বাসিন্দা। এর আগে আমরা আরেকটি গ্রামে ছিলাম। বাগেরহাট শহরে আমাদের যে বাড়িটা সেটি এক শ বছরের পুরনো। আমার দাদু খানবাহাদুর সৈয়দ সুলতান আলী। তিনি কৃষক প্রজা পার্টি করতেন আর পেশায় আইনজীবী ছিলেন। বাগেরহাট বারের সভাপতিও ছিলেন। তিনি ফজলুল হক (শেরেবাংলাা এ কে ফজলুল হক) সাহেবেরও খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আমার আব্বা যখন মারা যান আমার বয়স তখন দুই বছর আর আমার বড় ভাই চার বছরের। আব্বা মারা যাওয়ার সময় আমাদের তিনজনের জন্য তিনটি চিঠি লিখে যান। চিঠিতে লেখা ছিল আমাদের নানার বাড়ি বর্ধমানে। ওখানকার পড়াশোনার পরিবেশ বাগেরহাটের চেয়ে ভালো। আমার মামারা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত স্টুডেন্ট ছিলেন। আব্বা ছিলেন ইনকাম ট্যাক্স অফিসার। আব্বার মৃত্যুও হয়েছে বর্ধমানে। সেখানে তার কবরও আছে।
আপনার নানার বাড়ির তো রাজনৈতিক ঐতিহ্য আছে।
হ্যাঁ, যে বাড়িটিতে আমার জন্ম হযেছে সেটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ম্যালেরিয়া হাসপাতাল ছিল। তারও আগে সেটি ছিল ইংরেজদের নীলকুটি। আমরা যে বাড়িতে থাকতাম সেটি সিপিএমকে দিয়ে দিয়েছে। এটি বিশাল বড় একটি বাড়ি। আমার নানা বাড়ির পাঁচ পুরুষের রাজনৈতিক ঐতিহ্য। নওয়াব আব্দুল জব্বার যিনি বঙ্কিমচন্দ্রের সহপাঠী ছিলেন। তিনি আমাদের পূর্বপুরুষ। আমার মামা সৈয়দ মনসুর হাবিব, সৈয়দ শহিদুল্লাহ রাজনীতি করতেন। তার নামে পার্টি একটি শিক্ষালয় করেছে। এটি কমিউনিজম ও সোশ্যালিজম শিক্ষার স্কুল। আমার মেজো মামা মনসুর হাবিবুল্লাহ এমপি ছিলেন, পরে স্পিকার হয়েছেন। দেশ ভাগের পর তাকে পূর্ববঙ্গে পাঠানো হয়। তাদের নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলন হয়েছে। তিনি কৃষকদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন করতে এসে এখানে ধরা পড়েন ও গুলিবিদ্ধ হন। আমাকে ছোটবেলার এগুলো বেশ প্রভাবিত করেছে। ১৯৪৮ সালে আমার বয়স তখন তেরো বছর। তখন কংগ্রেস গভর্নমেন্ট কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করল। তেলেঙ্গানায় একটি সশস্ত্র বিপ্লব করতে গিয়েই কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়। মামা-মামি আমার বড় ভাই আন্ডারগ্রাউন্ডে লুকিয়ে ছিল। আমি তখন একমাত্র পুরুষ বাইরে ছিলাম। তখন গভীর রাতে ডাক্তারের কাছে যেতাম, ডাক্তারকে টোকা দিয়ে বের করে তাকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে নিয়ে আসতাম। যেখানে বড় মামা আত্মগোপন করে আছে। আবার ডাক্তারকে বাড়ি পৌঁছে দিতাম। পরের দিন আবার গভীর রাতে ওষুধ কিনে মামাকে দিয়ে আসতাম। আমার মা খুব সাহসী ছিলেন। কখনো বারণ করেননি। মেজো মামা যখন রাজশাহী জেলে অসুখ হলো, তখন তেরো বছরের কিশোর বর্ধমান থেকে কলকাতা হয়ে রাজশাহী এসে জেলারকে দরখাস্ত করে মামার ওষুধ পৌঁছে দিতাম। তখন পাসপোর্ট ভিসা হয়নি। সেটা হলো ৫২ সালে- এইভাবে বিশাল একটি রাজনৈতিক প্রভাব আমার মধ্যে পড়েছিল।
রাজনীতি করেছেন কি?
পরবর্তী জীবনে ছাত্ররাজনীতি করেছি। আমার শিষ্য যারা ছিলেন পরবর্তীতে তারা মন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু আমি কখনো রাজনৈতিক দল করিনি। তবে মানুষের পক্ষে সব আন্দোলনেই যুক্ত ছিলাম। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করি। আমি যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি তখন প্রথম আন্দোলনে যুক্ত হই। স্পোর্টসে আমি সব সময়ই ভালো ছিলাম। ধীরেন দা নামে স্কুলে আমাদের এক বড় ভাই ছিল। সেবার তিনি স্পোর্টসে পুরস্কার পাবেন। তিনি তখন আমাদের বললেন, আমাকে যখন পুরস্কারের জন্য ডাকবে আমি বলব ইংরেজ প্রশাসকের হাত থেকে পুরস্কার নেব না। তখন তো ইংরেজ শাসন চলছিল। সব জেলা প্রশাসকই ইংরেজ ছিলেন। সেবার সবাই ধীরেন দার সাথে একসাথে বলেছিলাম, ইংরেজ প্রশাসকের হাত থেকে পুরস্কার নেব না। পরে এটা নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছে। বয়সে ছোট ছিলাম তাই আমি সেবার রক্ষা পেয়েছি। এরপর ১৯৪৫-৪৬ রেড ফোর্টে সুভাষ বসুর আইএনএ। কর্নেল রশিদ আলী, কর্নেল জিশন, কর্নেল শাহনেওয়াজ এদের বিচার হচ্ছে। রশিদ আলীর বিচারের দিন রশিদ আলী ডে বলে সারা ভারত উত্তাল। কারণ বিচার বন্ধ করতে হবে। তখন আমরাও আন্দোলনে যোগ দিই। তখন ফাইভ সিক্সে পড়ি। আমার সেই সময়ের এই রাজনৈতিক ঘটনাগুলো আমাকে পরবর্তী সময়ে ভীষণভাবে ইনফ্লুয়েন্স করেছে। তারপর কলেজে ভর্তি হয়ে রাজনীতিতে যুক্ত হলাম। তখন ছাত্র ফেডারেশন বলে কমিউনিস্ট পার্টির একটি দল ছিল। আমি সেখানে যুক্ত হলাম। তখন তো কংগ্রেস শাসন। আমরা বামপন্থি কিছু সংগঠন মিলে কংগ্রেসকে কলেজের ইলেকশনে হারিয়ে দিলাম। তুষার খান নামে একজন ছিলেন, তাকে জেনারেল সেক্রেটারি করা হলো। পরবর্তী সময়ে তিনি পদ্মশ্রী পেয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে আমি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউটের সেক্রেটারি হয়ে গেলাম।
শুনেছি আপনি খেলাধুলায় অনেক ভালো ছিলেন?
আমি খেলাধুলায় আসলেই অনেক ভালো ছিলাম। স্পোর্টসে কিছু কিছু বিষয় ছিল যেগুলোতে আমি পুরস্কার পেতাম। আমার প্রধান খেলা ছিল ক্রিকেট ও ফুটবল। পরবর্তী জীবনে জুনিয়র বেঙ্গল ক্যাম্পে আমার ডাক পড়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জন খেলোয়াড়কে তারা ডেকেছিল তাদের মধ্যে আমি একজন। তখন ইডেন গার্ডেনে ট্রেনিং নিয়েছিলাম। তখন কলেজগুলো ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। বোর্ড হয়নি। আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় টিমের ওপেনিং ব্যাটসম্যান ও উইকেটকিপার হিসেবে খেলেছি। ফুটবলও খেলতাম। আমার সঙ্গে চুনী গোস্বামী বলে একজন প্লেয়ার আমাদের সঙ্গে ফুটবল খেলত। সে একটা ইনসাইটে খেলত। আমি একটা ইনসাইটে খেলতাম। চুনী গোস্বামী পরে ভারতের ক্যাপ্টেন হয়েছে। আমার অপজিটে দলে খেলত পিকে ব্যানার্জি নামে একজন। সেও পরবর্তীতে ভারতীয় দলের ক্যাপ্টেন ও পরে কোচ হয়েছিল। কাটিয়া পুলিশের সঙ্গে একটি খেলায় আমার লিগামেন্ট ছিড়ে যায়। আমাকে ফুটবল খেলা ছেড়ে দিতে হয়। ঢাকায় এসে দুই তিন বছর লিগে খেলেছিলাম। পরে আর খেলা হয়নি।
আপনি তো গানও করতেন?
আমি রবীন্দ্রসংগীত করতাম। আমি ক্লাসিক্যাল ট্রেনিং নিয়েছি এক বছর। গলায় ফ্যানেঞ্জাইটিস হওয়ার ফলে গানের চর্চাটা কন্টিনিউ করতে পারিনি। তবে গান করতাম। কলকাতায় ইয়ুথ ফ্যাস্টিভাল হয়েছিল। ৪৮/৪৯ সালের দিকে। সেই যুব উৎসবে আমি রবীন্দ্রসংগীতে প্রথম হয়েছিলাম। সবচেয়ে বড় কথা বিখ্যাত চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় ওই অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বিশাল সংগীতশিল্পী হলেন। আমি আর গানে থাকতে পারিনি। এবাবে আমার বিভিন্ন বিষয়ে সম্ভাবনা ছিল, বিভিন্ন বিষয়ে ভালো করতাম। ফলে একটা বিষয় ধরে চূড়ান্ত পর্যায়ে আমি যেতে পারিনি। রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন, ‘আমার এতো দিকে প্রতিভা সেটাকে যদি আমি বান দিয়ে সমুদ্রের দিকে না নিয়ে যেতাম তাহলে পানিগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেত। আমারও প্রতিভাগুলো শুকিয়ে গেছে (হেসে)। তার জন্য আমার কোনো আফসোস নেই। কারণ আমি জীবনে কিছু হতে চাইনি। সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চেয়েছি। আনন্দে জীবনটা কাটিয়ে দিতে চেয়েছি এবং সেটা পেরেছি।
অভিনয়ের শুরুটা কিভাবে?
আমি কলেজে উঠে অভিনয় করি। আমি আসলে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। বর্ধমান স্কুল থেকে পাস করে ভর্তি হলাম রাজ কলেজে। ইন্টারমিডিয়েট রেজাল্ট বেরোবে এমন সময় বর্ধমানে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার কলেজের গেইম টিচার এসে প্রতিদিন বসে থাকতেন সেখানে আমাকে ভর্তি করাতে। আমি বলেছি, জেনারেল লাইনে পড়ব না। স্যার বললেন, আমি ভর্তি হলে ভালো একটা ক্রিকেট টিম করবেন। এক মাস গ্যানর গ্যানর করার পর একপ্রকার বিরক্ত হয়েই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছি। আমি জীবনে কখনো কাউকে ধরে বা দরখাস্ত করে কোনো জায়গায় ভর্তি হইনি, কোনো জায়গায় চাকরিও নিইনি। কেমন করে লোকজন আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গেছে। কলেজের বার্ষিক কালচারাল অনুষ্ঠানে আমাকে ধরল নাটক করতে। তুই দেখতে শুনতে ভালো আছিস তুই নাটকে অভিনয় কর। আমি বললাম, আমি তো কখনো অভিনয় করিনি। গান, আবৃত্তি করেছি। বলল, তুই পারবি। এই আমাকে নাটকে ঢুকিয়ে দিল। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা নিয়ম ছিল ছেলেদের নাটকে মেয়ের অভিনয় করতে পারবে না, আর মেয়েদের নাটকে ছেলেরা অভিনয় করতে পরবে না। ছেলেদের নাটকে ছেলেই মেয়ে সাজত। মেয়েদের নাটকেও তাই হতো। এটা ১৯৫২-৫৩ সালের দিকে। তারপর আমাকে মিশর কুমারী এক ঐতিহাসিক নাটকে মিশর কুমারী নামে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে অভিনয় করতে দিল। প্রথমত নারী চরিত্র, দ্বিতীয়ত ঐতিহাসিক নাটক সব মিলিয়ে আমার ভালো লাগছিল না। আমাকে ধরে কতগুলো ছেলে একটা চক্রান্ত করল যারা ওই নাটকে সুযোগ পায়নি। তারা গোপনে ‘তাই তো’ নামে একটা সামাজিক নাটক শুরু করল। সেখানে তারা আমাকে একটি ছেলে চরিত্র দিল। আর বলল তুই একটা প্যাঁচ কসবি শেষ রিহার্সেলের দিন বলবি- আমার এই চরিত্র ভাল্লাগে না আমি করব না। তখন আস্তে আস্তে প্রকাশ করব তারা আরেকটা নাটক করতে চায়। সেটা করতে দিলে এটা করবে। শেষ পর্যন্ত তাই হলো। আমি একটা রেকর্ড করলাম। জীবনে প্রথম মঞ্চে উঠলাম একই সন্ধ্যায় দুটি নাটক করলাম। প্রথমে ‘তাই তো’ পরে মিশর কুমারী’ একটা ঐতিহাসিক আরেকটা সামাজিক। একটাতে নায়িকা চরিত্রে আরেকটাতে নায়ক। এমনটি পৃথিবীতে কেউ করেছে বলে আমার জানা নেই। তখনো কি জানি এটাই আমার পেশা হবে। আস্তে আস্তে আমি খুব পপুলার হলাম। বর্ধমানে জেলার বিভিন্ন জায়গায় আমাকে নাটকের জন্য নিয়ে যেত।
আপনি অনেকবার মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচেছেন, সেটা বলবেন?
আমি কিন্তু মৃত্যুর হাত থেকে অনেকবার বেঁচেছি। নানার বাড়ি কাশেমনগরে গিয়েছিলাম (শেরেবাংলা ফজলুল হক সাহেবের যেটা বাড়ি) এক বিয়েতে। আমার বড় ভাই আমার মামা তখন পানিতে গোসল করছে। ওরা আমার চেয়ে দুই তিন বছরের বড় হবে। হোমিওপ্যাথিকের একটা শিশি দিয়ে পানি তুলতে গেছি। তখন পিছলে পানিতে পড়ে গেছি। আমি ডুবে যাচ্ছি ওরা কিন্তু গল্প করছে। আমি কেন যেন চিৎকার করতে পারছি না। আমাদের স্টেটের ম্যানেজার মুন্সিজি নামে একজন ছিলেন। তিনি পুকুরের ওপারে থেকে শুনে আমাকে এসে উদ্ধার করল। আরেকবার গাজী কালু সিনেমার সময় আমি গাজী আনোয়ার হোসেন কালু চরিত্রে অভিনয় করছি। একটা দৃশ্য ছিল গাজীকে শিকল দিয়ে বেঁধে ডুবিয়ে দেবে, গাজী সেখান থেকে শিকল খুলে বেঁচে যাবে। কিন্তু শিকলের ভারে আমি ডুবে যাচ্ছি আর কোনো মতেই শিকলে খুলতে পারছি না। শেষে কোনোভাবে রক্ষা হয়েছে। এই গাজী কালুর সিনেমায় আরেকবার গাজীকে পুড়িয়ে মারবে এমন একটি দৃশ্যে গাজীকে পেছন মোড়া করে বেঁধে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আর আমাকে রেখেছে আগুন থেকে দূরে বাতাসের দিকে। আগুন বাতাস ঠেলে আমার গায়ে নিয়ে এলো। গ্রামের মানুষ সেবার বাঁচাল। গাজী কালুতে আরও একবার হাতির পায়ের নিচে আমাকে শুতে হলো। হাতি আমার ওপর পা রাখার একটি দৃশ্য ধারণ করবে। হাতিটার নাম ছিল মতিলাল। তখন মতিলালের বয়স ১৭৫ থেকে ২০০ বছরের মতো। এখনও বেঁচে আছে কি না জানি না। মাহুত বলল স্যার আমার হাতি মানুষের ওপর পা দেবে না আপনি শুতে পারেন। সত্যি আমার ওপর থেকে পা সরিয়ে নিল। পাকিস্তানে ‘কসম ইস ওয়াক্ত’ নামে এয়ার ফোর্সের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা কাহিনিচিত্র। এটা ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ওপর। আমি পাইলটের চরিত্র করেছিলাম। তারিক আজিজ নামে আরেকজন ছিল সেটাতে। শুটিংয়ে ব্যবহার করা হলো একটা হুড খোলা লাল স্পোর্টস কার। ডিরেক্টর আর ক্যামেরাম্যান হেলিকপ্টার নিয়ে ওপরে উঠল। একটা রাস্তা পাহাড়ে ঘেষে ওপরে উঠছে। বাঁ পাশের রাস্তাটা নিচে খাদে চলে গেছে খাদে। আমি গান গাইতে গাইতে গাড়ি চালাচ্ছি। চল্লিশ কিমি. গতিতে যাচ্ছি আর এটাই নির্দেশনা ছিল। ওরা আমাকে বলছে স্পিড আপ স্পিড আপ। এভাবে বারবার শট নেওয়া হচ্ছে। তখন একটা কুকুর এসে ঘেউ ঘেউ করছে। গাড়ির হুড নেই আমি ভীত, গাড়ি চালাচ্ছে ৬৫-৭০ গতিতে। শট শেষ কিন্তু ওরা কাট বলছে না। হঠাৎ দেখি রাস্তার সামনে একটা খাদ আমি তো হার্ড ব্রেক কষলাম। এমন বহুবার আমি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। বর্ধমানে সাপের হাত থেকে বেঁচে গেছিলাম। সাপের কামড় থেকে, পুকুরের পানি থেকে, হাতির পা থেকে এমনকি জামায়াতিদের হাত থেকেও বহুবার বেঁচেছি। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি মিটিংয়ে ছিলাম তখন একবার আমার বাড়িতে নারিকেলগাছের ওপর দিয়ে আমাকে মারতে আসে। তখন বাড়িটা দুতলা ছিল। কিভাবে যেন ওরা বুঝতে পারল আমি বাড়িতে নেই। আরেকবার ফ্রিডম পার্টির ওরা মারতে এসেছিল। যখন পাকিস্তান বুঝতে পেরেছিল তাদের নিশ্চিত পরাজয় তখন পাকিস্তানিরা এই কাজটা করেছে। তাদের দেশে ঢুকিয়ে দিল। সেদিনও আমি জাহানারা আপার বাড়ি ছিলাম। তখন মায়ের মাথায় বন্দুক ধরে মাকে শাসিয়ে গিয়েছিল ছেলের লাশ পাঠিয়ে দেব। আমার মা খুব সাহসী ছিলেন। এসব ব্যাপারে ভয়ও পেতেন না। আমাদের বাধাও দিতেন না।
আপনি খুব সহজেই সব কিছু রপ্ত করতে পারেন, এটা শুনেছি।
আমার শেখার অ্যাডাপটিবিলিটি খুব ভালো। আমি একদিনে গাড়ি চালাতে শিখেছি। একদিনে সাঁতার কাটতে শিখেছি। একদিনে সাইকেলও চালাতে শিখেছি। কোনো কিছু একবার দেখিয়ে দিলেই সেটা পেরেছি। সব কিছু সহজে পেরেছি বলে কোনো কিছুর মূল্য আমি বুঝিনি। এখনো বুঝি না।
বর্ধমান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে কখন এসেছেন?
আমি ১৯৫৭ সালে বর্ধমান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসি। আমার বাপের দিকের আত্মীয়স্বজন সব এখানে ছিল। বড় ভাই খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিল। বড় ভাই সব সময় ফার্স্ট হতো, দেবো দা নামে একজন ছিল তিনি সেকেন্ড হতেন আর বদরউদ্দিন উমর থার্ড। বড় ভাই রাজনীতি করা শরু করলেন। তারপর দু বছর জেল খাটল। ওখানে যারা ছিল তার অনেকেই জানত আমি নাটক করি। বেবি জামানসহ আরও বেশ কয়েকজন। এই আমি ঢাকায় এসে নাটকে যুক্ত হলাম ‘বন্ধু’ নামে একটা নাটকে। খাইরুল পরিচালক। এই নাটকে ঝর্ণা বসাক নামে এক মেয়েকে নিয়ে এসেছে। আমরা তখন আলোচনা করতাম মেয়েটা কী সুন্দর নায়িকা হতে পারত। পরে সে বিখ্যাত নায়িকা হয়েছে। তার পৈতৃক নাম ঝর্ণা বসাক এ দেশের মানুষ যাকে ‘শবনম’ নামে চেনে। যাই হোক এরপর আমি চলে গেলাম দর্শনায়। দর্শনা সুগার মিলে চাকরি নিলাম। সেখানে গিয়ে আমি কন্টিনিউ করিনি। আমি সেখানে তাদের ক্রিকেট টিমটা করে দিয়েছি। তাদের ক্রিকেট টিম ছিল না ফুটবল টিম ছিল। ক্রিকেট টিমটা আমি তৈরি করে দিয়ে আসছি।
ব্যাংক জব আর অভিনয়, এই গল্পটা শুনতে চাই।
আমার নানা আবুল হাশেম সাহেবের শিষ্য ছিল। নুরউদ্দিন সাহেব, মোয়াজ্জেম সাহেবরা। তারা বঙ্গবন্ধুরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। বঙ্গবন্ধুসহ তারা সবাই নানার ওখানে যেতেন। আমি কত যে তাদের কোলে কাঁধে চড়েছি। তারা সবাই আমাকে চিনত। আর সবাই মুসলিম স্টুডেন্ট লিগ করত। টাঙ্গাইলের শামসুন হক যিনি আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক। নুরুদ্দীন ভাই তখন এমপি, বলাকা সিনেমা হলটা ওনার ছিল, সোনালি ব্যাংকের বিশাল বিল্ডিংটা ওনার ছিল। আইয়ুব খান এসে ওনার সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করল। এই হলো নুরুদ্দিন ভাইয়ের ইতিহাস। ওনার মেয়ের জন্মদিনে আমাকেও ধরে নিয়ে গেছে। খান আতা তখন ইংল্যান্ড থেকে ফিরেছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেখানে। আমি গান গাইলাম, তখন নুরউদ্দিন ভাই জিজ্ঞেস করল তুই কী করছিস রে? আমি দর্শনা সুগার মিলে আছি। উনি বললেন, না তুই গান শিখবি। আমি বললাম তা কী করে হয়? নুর উদ্দিন ভাই তখন রশিদ সাহেবকে আমাকে চাকরি দিতে বললেন। রশিদ সাহেব তখন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের জেনারেল ম্যানেজার। পরে তিনি গভর্নর হয়েছিলেন। আমি পরের দিন সকালবেলা সদরঘাট গেলাম আমাকে চাকরি দিল খুলনায়। আমি নুরউদ্দিন ভাইয়ের কাছে গেলাম। বললাম, আমাকে তো খুলনা চাকরি দিয়েছে। বলল তুই আবার যা, আমি ফোন করে দেব। আমি গেলাম সে খুলনা কেটে রমনা করে দিল। আমার ব্যাপারটাই এমন আমাকে সবাই ধরে ধরে নিয়ে গেছে। আমি কোনো কিছুর জন্য দরখাস্ত করিনি। ব্যাংকে কাজটাজ করি না। হঠাৎ আমাকে একটা প্রমোশন দিয়ে দিল। আমি তো অবাক। তখন বললাম ভাই এটা তো ঠিক না। আমার এই প্রমোশনটা অন্য একটা লোক পেত। তারপর অনেক রিকুয়েস্টের পর আমার রিজাইনটা একসেপ্ট করল। এই সহানুভূতিগুলো সারা জীবন মানুষের কাছ থেকে পেয়ে এসেছি। ভালোবাসার সহানুভূতি। এগুলোর প্রতিদান দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তবে সারা জীবন তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। চাকরি ছেড়ে আমি তখন ডকুমেন্টারি ছাড় করতাম। অভিনয় করতাম।
ব্যাংক জব থেকে অভিনয়, এটা কিভাবে?
আলী কাউসার বলে একটা ছেলে ছিল; তার বড় ভাই আলী মনসুর। তিনি একটা ফিল্ম বানাবেন। কাউছার আমাকে বলল, দোস্ত, আমার বড় ভাই একটা সিনেমা বানাবে তোকে নায়ক বানাব। ওর অনুরোধে আলী মনসুর সাহেবের সাথে দেখা করতে গেলাম। ছবিটবি দেখেটেখে বললেন তুমি নায়ক। তো সাড়ে সাত শ টাকার একটা কন্ট্রাক্টে সই করলাম। আমার তো ভাগ্য ভালো। রহমান, মোস্তফারা ‘রাজধানীর বুকে’ ছবিতে এক টাকায় কন্ট্রাক্ট করেছিল। যাই হোক তা ওই ছবিটা হতে দেরি হচ্ছিল। আনিস সাহেব নামে এক ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি মহিউদ্দিন সাহেবের অ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টর। তিনি ‘রাজা এলো শহরে’ জন্য নিয়ে গেলেন। ওটাতে তিনজন নায়ক ছিল। তার মধ্যে আমি একজন। আরো দুজন ফতেহ লোহানী ও সাদেক খান। সাদেক খান আমাদের মেননের (রাশেদ খান মেনন এমপি) বড় ভাই। তাদের মধ্যে ফতেহ লোহানী ফিল্মে কন্টিনিউ করেছে। কিন্তু সাদেক খান করেনি। উনি ডিরেক্টর হিসেবে একটা ছবি বানিয়েছিলেন ‘নদী ও নারী’। তারপর আর ছবিতে কন্টিনিউ করেননি। এখন মাঝেমধ্যে কাগজে কলাম লেখেন। বয়স হয়ে গেছে। আমাদেরও বড়। ‘রাজা এলো শহরে’তে আমার গায়ে আগুন লেগে যাচ্ছিল। গল্পটাতে আমি পৌরাণিক রাজা। নর্তকীর নাচ দেখছি প্রদীপ জ্বলছে। আমি আনমনাভাবে উত্তরীয়টা ফেলছি তাতে আগুন লেগে পুরো রাজধানী শহর পুড়ে যাচ্ছে। এটা ছিল দৃশ্য। আমি যতবার উত্তরীয় ফেলি প্রদীপ ধুপ করে নিভে যায়। আনিস সাহেব করেছি কি পুরো কাপড়টাতে কেরোসিন দিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে। যেই আমি ফেলেছি সেই দাউ দাউ করে আগুন ধরে গেল। আনিস সাহেব পেছন থেকে এটা টেনে নামিয়ে দিল। উত্তরীয়টা পেঁচিয়ে আমার শরীর দিয়ে বেরিয় গেল। তাতেও হাতের সব লোম পুড়ে গেছে। তখন সেটের এক ভদ্রলোক বললেন সৈয়দের ছেলে সিনেমা করতে গেছে হবে না।
নায়ক হয়েও রাজপথের আন্দোলনে ছিলেন?
আমি যখন নায়ক তখন ছাত্র ইউনিয়নের অনুষ্ঠানে যেতাম। তখন প্রফেশনালরা কেউ ভয়ে আসত না। আমি একমাত্র এসবে আসতাম। আমার প্রযোজকরা বলত আপনি রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করে বেড়ালে আর পাবলিক মিটিংয়ে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ালে তো আপনার গ্ল্যামার থাকবে না। আমি তখন বললাম দূর গ্ল্যামার দিয়ে আমি কী করব? আমি তো নায়ক হতে জন্মায়নি। আমি মানুষ হিসেবেই আছি। গ্ল্যামার থাকলে থাকবে না থাকলে নাই কী করা যাবে।
তখন ব্যাংকের চাকরিটা কি ছেড়ে দিলেন?
এটা না বললে অকৃতজ্ঞতা হয়ে যাবে। আমি চাকরিটা তিন বছর করেছি। আমি যতবার রিজাইন দিয়েছি ততবার এটা ছিঁড়ে ফেলতেন। তখন স্টেট ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বললেন তোমাকে আমরা চাকরি করতে বলিনি। মাস এসে বেতনটা নিয়ে যেতে পারবে না? তো আমি বললাম দেখেন এটা খুব অন্যায়। তখন তারা বললেন, সিনেমা খুব রিস্কি জায়গা তুমি স্টেবল হয়ে নাও তারপর চাকরিটা ছেড়ো। তো তিন বছর আমি চাকরি না করে বেতন পেয়েছি। মাস শেষে বেতন নেওয়ার জন্য ফোন করতেন।
তখন বেতন কত পেতেন?
জয়েনিংয়ে দিত দু শ টাকা। দু শ টাকা তখন অনেক টাকা। আমি তখন বাড়ি ভাড়া দিতাম ৬৫ টাকা। আমাদের কাজের ছেলের বেতন ছিল ১৫ টাকা। ডেলি বাজারে দিতাম ১ টাকা। মাছ, গোশত, তরিতরকারি এক টাকাতেই হয়ে যেত। তিরিশ টাকা লাগত মাসে খেতে। আর তখন নাটক করে অনেক টাকা রোজগার করতাম।
সেটা কেমন?
প্রতি সপ্তাহে আমরা ছয় দিন নাটক করতাম। অফিসের নাটকগুলোতে আমাদের নিয়ে যেত। আমি আনোয়ার হোসেন, সিরাজুল ইসলাম, আক্তার হোসেন, শওকত আকবর এরা। তখন নাটক করে মাসে আট শ-নয় শ টাকা রোজগার করতাম। তখন যারা সিএসপি এখনকার বিসিএস তাদের তখন ওপেনিং সেলারি ছিল ৩৫০ টাকা। আর আমরা নাটক করে আট শ আর বেতন দু শ এই এক মাসে হাজার টাকা। ওই টাকা দিয়ে আমি তখন যেই জমি কিনেছিলাম এগুলোর দাম এখন কোটি কোটি টাকা। তখন জমির বিঘা পাঁচ হাজার। বছরে এক দুই বিঘা জমি কিনতে পারতাম।
‘সেলিমাবাদ’-এর ধারের খাতা সম্পর্কে বলবেন?
জিরো পয়েন্টে সেলিমাবাদ নামে একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। পীর ইয়ামেনী মার্কেট নাকি একটা হয়েছে। মালিকের নাম আকবর। মধ্যবিত্ত লোকে ভর্তি সেটা। এক-দেড় শ লোক একসঙ্গে খেতে পারত। সেলিমাবাদে আমার একটা ধারের খাতা ছিল। আমার বন্ধু-বান্ধবরা সবাই খেয়ে আমার ওই খাতায় লিখে আসত। তারপরও টাকা ফুরাতো না। কিভাবে ফুরোবে একজন খেতে এক আনা দুই আনা লাগত। আমার তখন মাসিক আয় হাজার টাকা। সেই সময় যে প্রপার্টি করেছিলাম সেগুলো দিয়ে এখন মাথা উঁচু করে বেঁচে আছি। যাই হোক, মানুষের সহানুভূতিতে খুব সচ্ছলভাবে আমার জীবনটা কেটে গেছে।
তখন আপনার সমসাময়িক কারা অভিনয় করে জীবন নির্বাহ করত?
রহমান, মুস্তফা, সুভাষ দত্ত, আনোয়ার হোসেন, আমি, শওকত, নারায়ণ চক্রবর্তী সুস্মিতা, সুচন্দা, শবনম, সুজাতা, নাসিমা।
প্রোডাকশন ডিস্ট্রিবিউশনেও তো ছিলেন, পরিচালনাও করেছেন?
প্রোডাকশনে এসে বিশাল বিশাল সিনেমা করেছি। মিঠুন চক্রবর্তী নিয়ে ‘অবিচার করেছি। আমার পরিচালনায় প্রথম সিনেমা ‘লালন ফকির’। লালন ফকির বলে একটা নাটক হয়েছিল টেলিভিশনে। আমি ঠিক করলাম লালনকে নিয়ে একটা সিনেমা করব। আমি মহিউদ্দিন সাহেবের কাছে গেলাম। তিনি বললেন, আপনি আশকার ইবনে শাইখের কাছে যান। লালনের যে মতাদর্শ ছিল তা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তা-ই আমাকে মুগ্ধ করেছে। গানের মধ্য দিয়ে যে প্রগতিশীল চিন্তা, সব দিক থেকে প্রগতিশীল আমি বলব না। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছিল। তখন মহিউদ্দিন সাহেব আমাকে আশকার ইবনে শাইখের কাছে নিয়ে গেলেন। কিন্তু ওই স্ক্রিপ্টে অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস ছিল। লালন মরা মানুষের শরীর লাঠি লাগালে মানুষ জীবিত হয়ে যায়। আমার কাছে এটা ভালো লাগল না। আমি ওটা করিনি। স্ক্রিপটা তখন আশকার ইবনে শাইখের কাছে রেখে আসি। একদিন আশকার ইবনে শাইখ আমাকে ফোন করে বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে এটাকে নাটক করতে চাই। আমি বললাম, করেন। আরেক দিন ফোন করে বললেন এটাকে আমি টিভি নাটক বানাব। আমি বললাম, করেন। আবার আরেক দিন ফোন করে বললেন এটাকে আমি সিনেমা বানাব। আমি বললাম টাকা দেবে কে? উনি বললেন ছাত্ররা টাকা দেবে। আমি বললাম, এসব আজগুবি কথা বাদ দেন। এভাবে হয় না। আপনি শেষকালে ডুববেন। আমার কথা শুনলেন না। তার ব্যাংকে ছিল ত্রিশ হাজার টাকা। সেটা বের করে গান টান রেকর্ড করে টাকা শেষ। একদিন আমাকে ফোন করে বললেন, হাসান সাহেব আপনি আমাকে উদ্ধার করেন। আমি মাস্টার মানুষ আমার টাকাটা চলে গেছে। তখন আমি বলেছিলাম এভাবে ইমোশনাল হয়ে সিনেমা হয় না। টিভিতে নাটকটা করার সময়।
আমার এক মামানি বললেন হাসান আমি পিন্ডি থেকে পারমিশন করিয়ে আনব। মোয়াজ্জেম ভাই পিন্ডি টিন্ডি ঘুরে এসে জানালেন এটা অনেক খরচ, এটা হবে না। এটা আমরা একটা প্রোপডাকশন করি তুমি পার্টনার হও। তখন আমি আর মোয়াজ্জেম ভাইয়ের মামানি আমরা পার্টনার হলাম। ‘যাত্রিক’ বলে একটা প্রোডাকশন করে আমি ছবির কাজ শুরু করলাম। পরে ওনারা কেউ ছবিতে ছিলেন না। পুরোটাই আমাকে দিয়ে দিলেন। বললেন, তুমি এটার মালিক। তারপর আমি অনেক বড় বড় ছবি করেছি। ‘মিন্টু আমার নাম’, ‘প্রতিজ্ঞা’ সুপারহিট ছবি। উৎপল দত্ত, মিঠুন চক্রবর্তীকে নিয়ে করলাম ‘অবিচার’। মোস্ট সুপারহিট ছবি। আমার ধরতেও সময় লাগেনি, ছাড়তেও সময় লাগেনি।
প্রোডাকশন ছেড়েছেন কি?
হ্যাঁ, যখন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি করলাম। তখন একদিনে সব ডিস্ট্রিবিউশন ছেড়ে দিলাম। তখন আমার সবচেয়ে বড় প্রোডাকশন ডিস্ট্রিবিউশন হাউস।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি হলো কিভাবে?
জিয়াউর রহমানের আমলে গোলাম আযম পাকিস্তান থেকে ভিসা নিয়ে দেশে চলে এলেন। তিনি এখানে এসে থেকে গেলেন। ভিসাও এক্সপায়ার হয়ে গেল। তিনিও গেলেন না। জিয়াউর রহমান সাহেবও তাকে শাস্তি দিলেন না। যখন খালেদা জিয়া নির্বাচন করলেন তখন বিএনপি নির্বাচনে জয়লাভ করল গোলাম আযম নিজেকে জামায়াতে ইসলামীর আমির ঘোষণা করে বসলেন। এত দিন তিনি পেছন থেকে জামায়াতে ইসলামী চালাতেন। আমির ছিলেন আব্বাস আলী খান। গোলাম আযম পেছনে থাকতেন। আমাদের সংবিধানে আছে কোনো বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারবে না। তো আমরা তখন বললাম গোলাম আযম সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। তার সাথে যুদ্ধাপরাধ বিচার এই দুটি দাবি তুললাম। তখন দুটো কমিটি হলো। কর্নেল নুরুজ্জামান সাহেব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। তার বাড়িতে মিটিংয়ে আমি, মেনন, শাহরিয়ার কবিরসহ অনেকে ছিলাম সেখানে আওয়ামী লীগ অন্য সব রাজনৈতিক দল ছিল। ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ নামটা আমি ঠিক করলাম এবং মিটিংয়ে এটা প্রস্তাব করলাম।
আহাদ চৌধুরী নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মিলে তারা করল ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি’। আমরা দুই প্লাটফর্ম থেকে এই আন্দোলনটি করলাম। ছাত্ররা এসে আমাদের ধরল, তারা বলল দুই জায়গা থেকে আন্দোলন করলে তো হবে না। দুটোকে মিলিয়ে দেন। জাসদ অফিসে মিটিংয়ে বসলাম। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন জাহানারা ইমাম। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি’ আহ্বায়ক আহাদ চৌধুরী। জাসদ অফিসে দুটাকে মিলিয়ে জাহানারা আপা (জাহানারা ইমাম) আমি, শাহরিয়ার কবির আমরা তিনজন। আহাদ চৌধুরী ও মান্নান চৌধুরী এরা ‘চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি’ তখন নামটা হলো ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’। আহ্বায়ক জাহানারা আপা, আমি হলাম ট্রেজারার, মান্নান চৌধুরী সদস্যসচিব। তো কমিটি করা হলো। কমিউনিস্ট পার্টি থেকে এলো নুরুল ইসলাম নাহিদ (শিক্ষামন্ত্রী)। কাজী আরিফ জাসদ থেকে, আব্দুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগ থেকে। মোট সাতজনের একটা স্টিয়ারিং কমিটি হলো। ওই কমিটি করার পর রেসকোর্স ময়দানে গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের আন্দোলন শুরু করি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। তখন আমি এককথায় একদিনে ডিস্ট্রিবিউশন অফিসস উঠিয়ে দিলাম। প্রেসক্লাবের উল্টো দিকের বিএমএ ভবনে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কাজ শুরু হলো। অভিনয়ও ছেড়ে দিলাম। আন্দোলন করতে করতে ৯৬-তে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করল। তখন বিএনপি ভাবল আমাদের আন্দোলনের ফলেই তাদের পরাজয় হয়েছে। একদিন আমি প্রেসক্লাবের উল্টো দিক থেকে আসছিলাম। তখন আমার গাড়িটা ভেঙে ফেলল। মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে মিছিলটি এলো। তখন একটা বাড়িতে ঢুকে গেলাম। আমাকে না পেয়ে গাড়িটা ভাঙল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তখন আর যুদ্ধাপরাধীর যখন বিচারটা করল না। তখন মানুষ আর আন্দোলনে এলো না। তারপর জাহানারা আপা মারা গেলেন। আমাকে আবার আহ্বায়ক করা হলো।
যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবি নিয়ে সমগ্র দেশে ঘুরেছেন, এই ব্যাপারে জানতে চাই।
আমরা এই আন্দোলন নিয়ে ১২০০ জায়গায় গিয়েছি। আমি প্রতিটি জায়গায় বক্তৃতা দিয়েছি। আমার বক্তৃতার তখন বেশ সুনাম হয়েছিল। সেদিন আমার জন্মদিনে সৈয়দ আশরাফও বলেছিল। সেদিন আমার বাড়ি পৌঁছাতে দেরি হয়েছে। বলেছিলেন সেদিন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আপনার সে বক্তৃতা শুনছিলাম। তখন আমি বক্তৃতা দিচ্ছিলাম। রাত ১২টা থেকে ১টা ৩০ পর্যন্ত টানা দেড় ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়েছি। একবার ঈশ্বরদীতে বক্তৃতা দিয়ে বসে যাচ্ছিলাম। পাবলিক তখন বলছে আরো শুনব আরও শুনব। জনকণ্ঠে তখন লিখেছিল বক্তৃতায় প্রথম শোনা গেল ওয়ানমোর। তো আমি লংগেস্ট বক্তৃতা দিয়েছিলাম টাঙ্গাইলে। কাদের সিদ্দিকী আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে তিন ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়েছিলাম। প্রথম পাঁচ হাজার লোক ছিল পরে সেখানে ১৫ হাজার লোক হয়েছে। চিলমারীতে আমি ঘণ্টাখানেক আরেকটা বক্তৃতা দিয়েছিলাম। মাস খানেক পরে এক ভদ্রলোক আমার কাছে এসে বললেন, হাসান সাহেব সাতচল্লিশ সালে আমাদের নেতারা যদি এই বক্তৃতাগুলো দিতেন আমাদের দেশটা ভাগ হতো না। একজন ভুক্তভোগী যিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ আমার কাছে এটা শুনে আমার ভেশ ভালো লেগেছিল। এটা আমার কাছে স্লাগার বিষয়। তাদের মুখ থেকে এই প্রকার সবটা পেয়েছি। এভাবেই উল্টোপাল্টা করে জীবনটা কাটিয়েছি।
প্রথম টিভি নাটকে কখন?
প্রথম যখন টিভি হলো প্রোগ্রামের দায়িত্বে ছিল কলিম মামা (কলিম শরাফী) তখনো পাইলট প্রজেক্ট সরকারি না। তখন দুই তিন দিন রিহার্সেল করেছি। তখন কাজী খালেক সাহেবের কাছে খবর গেছে। তিনি আমাকে ফোন করেছেন। হাসান তুমি বলে টেলিভিশনে গেছ? আমি বললাম গেছি। বললেন, ‘না টেলিভিশনে যাইও না। কারণ ওরা এখনো ঠিক করে নাই আমাদেরকে কি সম্মানী দেবে, না দেবে তা ঠিক করে নাই তুমি পট করে চলে গেলে কোনো আলোচনা না করে।’ আমি বললাম, যাব না? বললেন, না যেও না। আমি বললাম ঠিক আছে যাব না। আমি কলিম মামাকে ফোন করে বললাম আপনারা শিল্পীর সম্মানীটম্মানি ঠিক করেননি আমি কাজ করব না। এটা ১৯৬৫ সালের কথা। আমি প্রথম নাটকটি করলাম না। তারপর দ্বিতীয় নাটক থেকে কাজ শুরু করলাম। তারপর অসংখ্য নাটক করেছি। প্রথম মুনীর ভাইয়ের ‘একতলা দুতলা’ আর দ্বিতীয় নাটকটা নুরুল মোমেন সাহেব না নীলিমা ইব্রাহিমের মনে নেই। তখন দুই মাস রিহার্সেল করে আমার নাটক করলাম। তখন তো রেকর্ডিং ছিল না। পুরটো নাটকটি মুখস্থ করতে হতো। একবার ভুল হলে কারেকশনের সুযোগ নেই। সেজন্য অনেক দিন রিহার্সেল করতে হতো। পরে দু-তিন দিন রিহার্সেল করলেই হয়ে যেত।
মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে কিছু বলুন?
আমরা যখন টেলিভিশনে কাজ করি দেশ তখন উত্তাল। ঊনসত্তর থেকে গণ-আন্দোলন শুরু হলো। ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ফেডারেশনে যে নাটকগুলো করতাম। তখন গোর্কির ‘মা’ করলাম, ‘রক্তকরবী’ করলাম। ‘রক্তকরবী’ ও গোর্কির ‘মা’ বেশ সাড়া ফেলেছিল। লেখক সমরেশ মজুমদারের একটি নাটক খুব জনপ্রিয় হলো। গল্পটা ছিল এমন, একটা ছেলে জমি হারিয়ে শহরে চাকরির জন্য যায় আর শহরের একটা ছেলে চাকরি হারিয়ে গ্রামে চলে আসে। আসাদ যখন মারা গেল তদখন আমি ‘রক্তকরবী’ নাটকের রিহার্সেল করছি। আমাদের সাথে আমি তরু ও তামান্না নামে দুজন ছিল কো-আর্টিস্ট। ওরা তখন এক ঘণ্টা পরে আসছে। আমি খুব বকাবকি করছি। যারা রাস্তায় আন্দোলন করবে তারা রাস্তায় আন্দোলন করুক, আর যারা সাংস্কৃতিক আন্দোলন করবে তারা একটাই করবে। দুটো মেলালে ঝামেলা। তরু তখন দেখাল তার আঁচলে আসাদের রক্ত লেগে আছে। আসাদের লাশ সে হাসপাতালে রেখে এসেছে। তখন এমনই ছিল। আঁচলে রক্ত নিয়ে রিহার্সেল করতে আসত। এই যে চেতনাটা শিল্পীদের মধ্যে ছিল। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এসে এটা অতটা থাকা না। কিন্তু এখন নতুন প্রজন্মের কাছে আবার এই চেতনাটা আছে। তো যাই হোক। অসহযোগ আন্দোলনের সময় আমি বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ নামে একটা সংগঠন করেছিলাম। এটাতে আমি আহ্বায়ক।
তখন তো আপনারা বেতার আর টেলিভিশনের দায়িত্ব পেয়েছেন?
১৯৭১-এর মার্চে টেলিভিশনটা একদমই বন্ধ হয়ে গেল। বেতার কোনো রকম রেকর্ডটিং দিয়ে চলল। টেলিভিশন তো রেকডিং সিস্টেম ছিল না। ফলে চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ল। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বললেন বেতার চলবে, টেলিভিশন চলবে। তখন তো ওনার নির্দেশেই দেশ চলছে। কী চলবে আর কী চলবে না তা বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা করতেন। আমরা ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম, আমি, আতিক আর গোলাম মুস্তফা। বঙ্গবন্ধুকে বললাম, আপনি বললেন বেতার-টেলিভিশন চলবে কিন্তু অসহযোগ বাদ দিয়ে? বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোদের কথামতো যদি চলে তবে চলবে। না হলে এটাও অসহযোগের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। বঙ্গবন্ধু তখন জহুরুল হক সাহেবকে ফোন করে বললেন, ‘জহুরুল সাহেব আমার ছেলেরা যাচ্ছে ওদের সাথে কথা বলে যদি টেলিভিশন চালান তাহলে চলবে না হলে এগুলোও অসহযোগ আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত থাকবে।’ তিনি তখন তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন আমরা তখন তার বাড়িতে গেলাম তিনি পিন্ডিতে কি কথাটথা বলে বেরিয়ে এসে আমাদের দুটো শর্ত দিলেন। পাকিস্তান গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে কিছু, অখ-তার বিরুদ্ধে কিছু, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারবেন না। আবার ওনার ফোন থেকে বঙ্গবন্ধুকে ফোন করলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোরা তার কথা মেনে যা, মেনে গিয়ে বেতার টেলিভিশন দখল কর।’ এটি বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের একটি বড় কাজ। ৮ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বেতার টেলিভিশন দখলে রাখি। ওরাও কৌশলগতভাবে সুযোগ নিল আমরাও বাঙালিরা তাদের কাছ থেকে এই সুযোগটা নিলাম। আমরা অসাধারণ সব প্রোগ্রাম করে বাঙালি জাতীয়তাবাদে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করলাম। ২৫শে মার্চ ক্র্যাকডাউনে আমরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেলাম। তারপর আমরা গিয়ে মুজিবনগর সবাই একত্র হলাম। আমাদের এই কথা জাতি স্মরণ রেখেছে। তারপর অনেকগুলো সংগঠন করেছি।
জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ তো আপনার মাধ্যমেই হয়েছে?
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলী পরিষদ নামে যে সংগঠন করলাম সেখান থেকেই ‘স্টপ জেনোসাইড’ ছবিটা করেছিলাম। সারা পৃথিবীতে মানুষের বিবেককে আলোড়িত করেছিল এটি। এটার পরিচালক ছিল জহির রায়হান। এটার টাকাও আমি তাকে জোগাড় করে দিয়েছিলাম। আর এই সমিতির বত্রিশজন শিল্পীকে নয় মাস আমি ভরণ-পোষণ দিয়েছিলাম। যারা ব্যাচেলর তাদেরকে ১০০ টাকা করে, যারা বিবাহিত তাদেরকে দু শ টাকা করে দিয়েছিলাম। আরেকটি সংগঠন করেছিলাম, ‘মুক্তির গান’ ছবিটির সানজিদা খাতুন, ওয়াহেদ ভাই, আমি আর মোস্তফা মনোয়ার- এই চারজন আর জুনিয়র কিছু আর্টিস্ট মিলে এই ইউনিটটি আমরা গড়েছিলাম। আমরা রিলিফ ক্যাম্প, রিক্রুটিং ক্যাম্প, ট্রেনিং ক্যাম্পগুলোতে রেগুলার অনুষ্ঠন করে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতাম। এই নয় মাস ভীষণ পবিত্র দিন গেছে আমাদের। এই ইউনিট নিয়ে দিল্লি গেলাম।
আমাদের দেশের শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার ভাবনাটা তো আপনারই?
যুদ্ধ থেকে ফিরে আমি আলমগীর কবির, জহির মিলে ন্যাশনালাইজেশন ফর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। রণেশ দাস গুপ্ত আমাদের বললেন, ‘এখন ন্যাশনালাইজেশনে যাইয়েন না। কারণ যেভাবে স্বাধীনতার পর কাজ করার কথা সেভাবে হচ্ছে না। ব্যুরোক্রেসি আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছি। এখন যদি ন্যাশনালাইজেশন করেন আপনারাই ছবি করতে পারবেন না। আজে বাজে ছবি ঠিকই হবে।’ আমরা এটা আর করলাম না। আমি কিন্তু এটা ছাড়লাম না। আমি এটা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর পিছু লেগেই থাকলাম। আমাকে একটা কিছু করে দিন, যেটার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারি। বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, ‘তুই ইউসুফ আলীর কাছে যা।’ তিনি তখন সংস্কৃতি ও শিক্ষামন্ত্রী। ইউসুফ আলী বললেন, ‘আপনার তো বয়স কম একটা কমিটি টমিটি করেন।’ তখন একটা কমিটি করলাম। আলী আহসান ভাইকে আহ্বায়ক, কবির ভাই, সানজিদা খাতুন, কামরুল হাসান সাহেবসহ। কামাল সিদ্দিকীও ছিলেন সেটাতে। তিনি তখন সিএসপি। পরবর্তীতে তিনি ওই দলে চলে গেলেন। জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে ওর ভালো ভূমিকা ছিল। সে ছিল তখন কালচারের ডেপুটি সেক্রেটারি। এই কামাল সিদ্দিকীর বাড়িতে রাতের পর রাত বসে আমরা শিল্পকলা একাডেমির কাগজ তৈরি করলাম। কাগজ রেডি করে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পাস করিয়ে শিল্পকলা একাডেমি বানালাম। তারপর ইউসুফ আলীকে বললাম আমাদের ছেলেমেয়েদের ট্রেনিং না দেওয়া হলে প্রথাগত শিক্ষাটা দেবে কে? আমাদের কিছু স্কলারশিপ দরকার। তখন তার কাছ থেকে একটা চিঠি নিলাম। নুরুল ইসলাম বলে ইন্দিরা গান্ধী কালচার অ্যান্ড অ্যাডুকেশন মিনিস্টার ছিলেন। পরে পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর হয়েছেন। খুব শিক্ষিত লোক ছিলেন। আমি ইউসুফ আলীর কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে নুরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে দেখা করে বললাম আমাদের তো সংস্কৃতিতে স্কলারশিপ লাগবে। তিনি আমাকে ৭২টা স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দিলেন। অ্যাডুকেশনে ছিল বেশি। সংস্কৃতিতে ১৭টা। পরে কমিটি করে ছেলেদের পাঠাতে শুরু করলাম। ওরা প্রশিক্ষিত হয়ে এসে দেশে শিক্ষা দেবে। এটা একটা আমার সেটিসফেকশন। আজকে ইউনিভার্সিটিতে নাচের গানের ডিপার্টমেন্ট হচ্ছে।
শুনেছি বঙ্গবন্ধু আপনাকে অনেক ¯েœহ করতেন?
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছোটবেলা থেকে। বর্ধমান থেকে দেশে এলাম ’৫৭ সালে। ’৫৮ সালে মার্শাল ল’ হলো। ’৫৮ সালে আমরা একটা সংগঠন করলাম বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি তখন মন্ত্রী। নাম দিয়েছিলাম ‘মুক্তধারা’। আমি তখন সদস্য। বঙ্গবন্ধুর আরেক বন্ধু নুরুল আলম তিনি হাই কমিশনে ছিলেন বঙ্গবন্ধুই তাকে নিয়ে এলেন। এ কে এম আহসান সভাপতি ও নুরুল আলম সাধারণ সম্পাদক। ‘মুক্তধারা’র উদ্দেশ্য ছিল সারা দেশে সাংস্কৃতিক বিপ্লব করা। সারা দেশে ব্রাঞ্চ হবে। ’৫৮ সালে বঙ্গবন্ধু জেলে গেলেন, ফলে সব কিছু ভেস্তে গেল। তিনি খুব ¯েœহ করতেন আমাকে। আমি যখন লালন ফকির শ্যুটিং করছি তখন হোটেল পূর্বাণীতে একটা পার্টি ছিল সেটা ইত্তেফাক করেছে। আমি অনুষ্ঠান শেষে সেখানে হাজির হলাম। তিনি তখন আমাকে ঘাড়ে হাত দিয়ে বললেন চল কেক কাটব। কেকের কাছে গিয়ে বললেন নৌকার কেক বানিয়েছিস এটা আমার সিম্বল, আমি এই কেক কাটব না। এই কেক বাড়ি পাঠিয়ে দে। বঙ্গবন্ধু কেক কাটলেন না। দেশে ফিরে শুনলাম ওনি শপথ নিচ্ছেন। আমি তখন একটা ট্যাক্সিতে করে স্ত্রীকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে বললাম তুমি বাড়ি যাও আমি বঙ্গভবনে যাচ্ছি। আমি বঙ্গভবনে ঢুকছি হঠাৎ রাজাকার রাজাকার বলে একটা ছেলেকে তাড়া করছে কতগুলো ছেলে। আমি দেখলাম শপথ নেওয়া শেষ। আমি তখন বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে বললাম আপনার একটু সাবধান হওয়া উচিত। ওনি আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে বললেন, ‘কেন তোরা আমাকে মারবি।’ তো এ রকম ছিলেন। এত সাধারণ আর এত অসাধারণ নেতা পৃথিবীতে জন্মেছে কি না আমি জানি না। সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করেছেন। মনের দিক থেকেও সাধারণ ছিলেন। তাঁর স্মরণ শক্তি ছিল অসাধারণ। প্রথম ঈদে আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। বকরি ঈদে গেছি, বুক মিলাচ্ছি। তখন তিনি বললেন, ‘কিরে তুই ঈদে আসলি না।’ আমি অবাক। হাজার হাজার মানুষ তাঁর সঙ্গে রোজ দেখা করে অথচ আমি গেলাম না এটাও মনে রেখেছে। আমি তখন টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করি না। তখন যারা টেলিভিশন প্রোগ্রাম করেছে তাদের সবাইকে ব্যান্ড করে দিয়েছে। যারা মুজিবনগরে ছিল তারাই প্রোগ্রাম করছে। আমাকে বললেন তোর সঙ্গে কথা আছে। ঘণ্টাখানেক হয়ে গেছে আমি বসে আছি। তারপর চলে আসছিলাম। ওনি আমাকে জানালা দিয়ে দেখে লোক পাঠালেন। দু-তিনজন এসে আমাকে বললো বঙ্গবন্ধু আপনাকে ডাকছে। আসার পর ওনি বললেন, ‘তোকে বসতে বললাম না। তুই চলে যাচ্ছিলি কেন।’ আবার গিয়ে বসলাম। সবাই যখন চলে গেলেন তখন এম আর আখতার মুকুল আর তোয়াব খানকে ডাকলেন। ওদের জিজ্ঞেস করলেন হাসান টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করছে না কেন? চিন্তা করো কোথায় বঙ্গবন্ধু দুনিয়ার চিন্তা আর তার মাথায় ঢুকে আছে আমি টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করছি কি না। তো এম আর আখতার মুকুল বলে ওকে জিজ্ঞেস করেন? আমি তখন মাথা চুলকাচ্ছি। কি বলব তার সামনে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তুমি কি মাদবরি করছ সেটা আমি জানি, সেটা তোমার কাজ নয়। তুমি অভিনেতা, মন দিয়ে অভিনয় করো তা হলেই দেশ সেবা হবে।’ এটা আমার পরিবারের কেউ কোনোদিন বলেনি। আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, সবাই তো আর রাজাকার নয়। সব শিল্পীকে নিষিদ্ধ করেছে সেটার সঙ্গে আমি একমত ছিলাম না। তখন বঙ্গবন্ধুকে বললাম সব শিল্পীকে নিষিদ্ধ করলে কীভাবে হয়। তিনি তখন বললেন, ‘তুই কি বলিস?’ আমি বললাম তাহলে একটা কমিটি করেন। যারা দালালি করেছে তাদের নিষিদ্ধ করেন। সবাই তো দালালি করেনি, সবাই চাকরি করেছে। কেউ কেউ দালালি করেছে। তখন নীলিমা ইব্রাহিমকে প্রধান করে কমিটি করা হলো। আমাকে বললেন তুই কর? আমি বললাম আমি তো তখন দেশে ছিলাম না। কমিটি করে যারা রিয়েলি দালালি করেছে তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে।
বিবিসি থেকে একবার ডেভিড ফ্রস্ট নামে এক সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার নেন। তিন সিটের এক সোফা এক পাশে বঙ্গবন্ধু অন্য পাশে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বসে আছেন। তাজউদ্দিন ভাই ও আরও অনেকে অন্যদিকে বসে আছে। শেখ মনিরা তখন পেছনে দাড়িয়ে আছে। আমি গেছি, তখন বঙ্গবন্ধ আমাকে ডেকে প্রেসিডেন্ট আর ভাইস প্রেসিডেন্টের মাঝখানে বসালেন। বললেন, ‘দেখ আমি কেমন ইন্টারভিউ দিছি’। সেটা টেলিভিশনে দেখাচ্ছে। তিনি তো কোন পড়–য়া করতো না। যদি ইংরেজিতে ভুলও হয়ে যেত তিনি তাও পড়–য়া করতো না। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন তিনি বাঙালি। তার মধ্যে এ বিষয়ে কোন হীনমন্যতা ছিল না। ডেভিড ফ্রস্টের মতো একজন বড় মাপের ব্রডকাস্টার জার্নালিস্ট, যিনি বহু যুদ্ধ কাভার করেছেন সেই লোকটা কেঁদে দিয়েছেন তার সাক্ষাতকারের এক পর্যায়ে। আমরা তা দেখে কাদছি। ঐটা কেন যে এখন দেখায় না আল্লাহ জানে। বঙ্গবন্ধুকে হারানোই আমাদের অনেক বড় ক্ষতি।
বেতারে আপনার নাম সালে আহমেদ ছিল?
সাংবাদিকরা চলে যাওয়ায় প্রথমে আমি সংবাদ এবং নাটকের প্রধান ছিলাম। পরে কামাল লোহানীকে সংবাদে আমাকে প্রোগ্রামের দায়িত্ব দেয়া হয়। সেখানে সবারই একটা ছদ্ম নাম ছিল। তাজউদ্দিন ভাইয়েরও একটা ছদ্ম নাম ছিল, মান্নান ভাই টাঙ্গাইলের এমপি তারও একটা ছদ্ম নাম ছিল। আলমাস কবিরের ছিল। আমার ছদ্ম নাম ছিল সালে আহমেদ। সরকার থেকেই আমাদের এই ছদ্মনাম দেয়া হয়। তখন কারণও ছিল। আমরা মানুষকে বিশ্বাস করাতে চাইছিলাম আমরা মুজিবনগর থেকে এটা চালাচ্ছি। চালাতাম তো কলকাতা থেকে। বুঝতে পারলে পাকিস্তানীরা বলবে এটা ইন্ডিয়ানরা চালাচ্ছে। সে জন্য আমরা ছদ্মনাম ব্যবহার করতাম। প্রথমে আমি সংবাদ পাঠ করি সালে আহমেদ নামে।
আপনারতো একটা আফসোস আছে শুনেছি?
হ্যা এটা আমার এখনও আছে। শেষ দিন ১৬ ডিসেম্বরের সংবাদটা আমাকে লোহানী পড়তে দেয়নি। আমি এখনও তাকে বলি আপনি একটা অন্যায় করেছেন।- সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।