একুশে বইমেলা শেষ প্রান্তে চলে এসে এসেছে। দিন দিন মেলাও জমে উঠেছে। যতই দিন যাচ্ছে বিক্রিও বাড়ছে। প্রকাশকরাও এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। মেলার নানা দিক নিয়ে সাপ্তাহিক ‘এই সময়’ এর সঙ্গে কথা হয় অন্যপ্রকাশকের প্রকাশক মাজহারুল ইসলামের। আলাপচারিতার চুম্বক অংশ ঢাকাটাইমস পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো-
অন্যপ্রকাশের যাত্রা শুরু কবে থেকে?
১৯৯৭ সাল থেকে। পড়াশোনা শেষ করে আমরা একটি ভালো মানের পারিবারিক ম্যাগাজিন বের করার চিন্তা করি। ১৯৯৬ সালের ১৬ জানুয়ারিতে আমরা পাক্ষিক অন্যদিন পত্রিকা বের করি। সৃজনশীল প্রকাশনার কাজ করার অনেক সুযোগ আছে, সেই চিন্তা থেকেই ১৯৯৭ সালে আমরা অন্যপ্রকাশের যাত্রা শুরু করি।
তখন প্রকাশনার অবস্থা কেমন ছিল?
তখনও বাংলাদেশে প্রকাশনার সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। কেউ কেউ ভালো কাজ করলেও সার্বিকভাবে আমাদের দেশ থেকে প্রকাশিত বইগুলোর কাজ খুব ভালো হতো না। প্রকাশকরা ভারত থেকে বই এনে বিক্রি করত। তাই প্রকাশনীর বা বইয়ের বাজার অনেকটা ভারতীয় লেখকদের দখলে ছিল। তাদের বইয়ের সঙ্গে আমাদের এখানকার প্রকাশিত বইয়ের বেশ পার্থক্য লক্ষ্য করা যেত। তবে এখন এই পার্থক্যটা অনেক কমেছে।
আপনাদের বইগুলোর মান কীভাবে ঠিক রেখেছেন?
আগে চার রঙে বই ছাপা হতো না। বইয়ের জেলেও চার রং ব্যবহার করা হতো না। জেল হলো কাভারের নিচে বোর্ডের ওপর যে কাগজটি থাকে সেটি। জেল পেপারটা এক রঙের কাগজে করা হতো। তখন বইয়ের কাভারটা ছিঁড়ে গেলে বইটিকে খুব বাজে লাগত। মনে হতো এটির পোশাক খুলে ফেলেছে। আমরা জেলটিকেও প্রচ্ছদের কালারে চার রঙে প্রিন্ট করালাম, সঙ্গে কাভারও। তাতে করে বইয়ের কাভার ছিঁড়ে গেলেও আরেকটি প্রচ্ছদ থেকে যায়। আমরা সব বিষয়েই একটা গুণগত পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছি।
শুরুতে কি ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিলেন?
প্রতিবন্ধকতার কিছু না। কারণ আমরা তো টেকনোলজিক্যালি অনেক পিছিয়ে। এখনো আমাদের উন্নত মুদ্রণশৈলী বাঁধাই থেকে শুরু করে আমরা যে কাগজ ব্যবহার করি এগুলোতে বেশ অসংগতি আছে। আমি অনেক দেশে গিয়েছি, তাদের প্রকাশনাও দেখার সুযোগ হয়েছে। আমরা যে কাগজে বই ছাপি সেটি ছাপার কাগজ নয়। ওয়েইটলেস পেপারে বই ছাপা হয় পৃথিবীর সর্বত্র। ৭০০-৮০০ পৃষ্ঠার একটি বই হাতে নিলে মনে হবে কিছুই না। কিন্তু এসব কাগজ আমরা পাই না। বিশেষ করে আধুনিক প্রযুক্তির অপর্যাপ্ততাগুলো বেশ ভুগিয়েছে।
অন্যপ্রকাশের বড় সফলতা কী?
বড় সফলতা যদি বলি তাহলে অবশ্যই একটি নাম বলতে হবে, সেটি জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের কথা। ১৯৯৯ সালে হুমায়ূন আহমেদ অন্যপ্রকাশের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি যুক্ত হওয়ার ফলে অন্যপ্রকাশে একটি আলাদা অবস্থান তৈরি হয়। আমাদের এখান থেকে তার ‘রুপার পালঙ্ক’ প্রথম প্রকাশিত হয়। সে বছর বইমেলায় আমরা এর পঞ্চাশ বা ষাট হাজার কপি বই বিক্রি করতে পেরেছি। আমাদের বিপণন ব্যবস্থায় তিনি যথেষ্ট সন্তুষ্ট হন। তারপর থেকে একের পর এক বই আমাদের প্রকাশনাকে দিতে থাকেন তিনি। একটা সময় এই জিনিসটা প্রতিষ্ঠিত হয় অন্যপ্রকাশ মানেই হুমায়ূন আহমেদ আর হুমায়ূন আহমেদ মানেই অন্যপ্রকাশ। বইমেলায় পাঠকের উপচেপড়া ভিড় মানেই অন্যপ্রকাশ। এটি আমাদের সবচেয়ে বড় সফলতা।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের প্রকাশনা নিয়ে কিছু বলুন।
আমাদের দেশে প্রকাশনা একটি ভালো জায়গায় এসে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতি আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা আইপিএলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এর ফলে উন্নত বিশ্বের কাছে এদেশীয় প্রকাশকদের পরিচয় ঘটছে। আন্তর্জাতিক যেকোনো প্রকাশনা উৎসব বা বইমেলায় আমাদের প্রকাশকরা যুক্ত হতে পারবে। এটি আমাদের জন্য এখন সবচেয়ে বড় সুখবর।
প্রযুক্তির উৎকর্ষ ঘটছে। সেক্ষেত্রে প্রকাশনা শিল্পের ভবিষ্যৎ?
প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তরুণ সমাজের অনেকেই এখন প্রকাশনা শিল্পে যুক্ত হচ্ছে। জ্ঞান ও মেধা নিয়ে যে তরুণরা প্রকাশনা শিল্পে আসছে, এতে প্রকাশনা শিল্প আরও ভালো একটি জায়গায় পৌঁছবে বলে আমি মনে করি।
পাঠক কমেছে না বেড়েছে?
পাঠক কমেছে বলে আমি মনে করি না। আপনি বইমেলার দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন আমাদের পাঠক কমেছে কি বেড়েছে। মেলার পরিসর বড় হয়েছে, প্রকাশক বেড়েছে এবং প্রচুর বই বিক্রি হচ্ছে। আমি মনে করি না পাঠক কমছে।
একটি সমাজের জন্য বই কতটা জরুরি?
জ্ঞান মানুষকে আলোকিত করে। মানুষ জ্ঞানের জন্যই বই পড়ে। অর্থাৎ বই মানুষকে আলোকিত করে। একটি সমাজ বই ছাড়া কল্পনা করা যায় না। যে জাতি যত উন্নত, তাদের কাছে বইয়ের কদর তত বেশি।
প্রকাশনা সমৃদ্ধ করতে সরকার কি পদক্ষেপ নিতে পারে?
সরকারের অনেক করণীয় আছে। বর্তমান সরকার প্রকাশকদের ইতিমধ্যে স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করেছে। আমি এ বছর মেলার উদ্বোধনের সময় কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি সৃজনশীল প্রকাশকদের জন্য ভালো কাগজ আমদানি করার কথা এবং সেগুলো রেয়াতি মূল্যে প্রকাশকদের দেওয়ার আবেদন করি। কাগজের দাম কমালে পাঠকদের কাছে কম মূল্যে বই পৌঁছে দেওয়া যাবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?
আমরা যে বইগুলো প্রকাশ করি সেগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে যাওয়া। সেজন্য আমরা আমাদের প্রকাশিত বইগুলো অনুবাদ করার কাজ করছি। হুমায়ূন আহমেদের কিছু বইয়ের অনুবাদ আমরা করেছি, ইচ্ছে আছে আরও ভালো বই অনুবাদ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছে দেওয়া।