একুশে গ্রন্থমেলা শেষ প্রান্তে। আর মাত্র বাকি তিন দিন। মেলার এই প্রান্তে এসে বিক্রিও কিছুটা বেড়েছে। প্রকাশকরাও এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন।মেলার নানা দিক নিয়ে সাপ্তাহিক ‘এই সময়’ এর সঙ্গে কথা বলেন অনুপম প্রকাশনীর প্রকাশক মিলন কান্তি নাথ।
আলাপচারিতার চুম্বক অংশ ঢাকাটাইমস পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো-
অনুপমের যাত্রা কবে শুরু হয়েছিল?
১৯৭৮ সালে অনুপম প্রকাশনী যাত্রা শুরু করে। এ বছর তিন যুগ পেরিয়ে অনুপম ৩৭ বছরে পা দিয়েছে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ থেকে সবেমাত্র ফিরে, পড়ালেখা শেষ করে তখন কিছু একটা করতে হবে এই ভেবে প্রকাশনা জগতে পা রাখি। আমার এই তিন যুগ বা ৩৭ বছরের অর্জন মূলত আমি খেলাঘর ও ছাত্র ইউনিয়ন থেকে পেয়েছি। যার ফলে পরবর্তী সময়ে আমি শিল্প-সাহিত্যে জগতে জায়গা করে নিতে পেরেছি।
তখন প্রকাশনা জগতের অবস্থা কেমন ছিল?
তখন প্রকাশনা জগতের কথা বলতে গেলে এখন অনেকটা রূপকথার মতো মনে হবে। সর্বপ্রথম প্রকাশনা জগতের যাত্রা শুরু করেন চিত্ত বাবু। কলকাতা থেকে হাতেগোনা কয়েকটি বই নিয়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এক টুকরো চট বিছিয়ে সর্বপ্রথম বইমেলার গোড়াপত্তন করেন তিনি। তখন মাত্র কয়েকজন প্রকাশক ছিলেন। তাদেরই ধারক হিসেবে আশির দশকে আমরা কিছু তরুণ প্রজন্ম প্রকাশনা জগতে পা রাখি।
শুরুতে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিলেন?
ভাষার জন্য লড়াই করে যেখানে একটি স্বাধীন দেশ হয়েছে সেখানে প্রকাশনা জগতে তো এমন হাজারো প্রতিবন্ধকতা থাকতেই পারে। তখন প্রতিবন্ধকতা থাকলেও সেটাকে জয় করার চেষ্টা করেছি। তখন সহজে কালি, কাগজ, ছাপানোর প্লেট পাওয়া যেত না। সে সময় প্রকাশনা শিল্প একমাত্র কর্ণফুলী কাগজের ওপর নির্ভর করত। আমাদের কাগজ পাকিস্তান থেকে সিল মারার পর এখানে আসত। আট আনার কাগজ বিক্রি হতো এক টাকায়।
আপনার প্রকাশনার সবচেয়ে বড় সফলতা কী?
আমার প্রকাশনার সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে পাঠক। পাঠক আমাকে গ্রহণ করেছে বলেই অনুপম প্রকাশনী ৩৭ বছর পাড়ি দিয়ে আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। আমি প্রতি বছরই বইমেলা থেকে, পাঠকদের কাছ থেকে কিছু না কিছু শেখার চেষ্টা করি। যে পরিকল্পনাকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তী বছরে বইমেলায় পাঠককে নতুন কিছু উপহার দেওয়ার চেষ্টা করি। আমাদের প্রকাশনার স্লোগান হচ্ছে ‘বিজ্ঞান চেতনার সঙ্গে থাকুন।’
বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প সম্পর্কে আপনার অভিমত?
প্রকাশনা এখনো শিল্প হিসেবে দাঁড়ায়নি। প্রকাশনা শিল্প অনেকটা স্বপ্ন। আমি মনে করি শিল্পে রূপ দিতে চাইলে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। প্রকাশনা শিল্প সম্পর্কে যারা পলিসি মেকার তাদের বোঝাতে হবে। যে দেশে একটা গ্রন্থনীতি বাস্তবায়ন হয় না, সেখানে প্রকাশনাকে একটা শিল্প ভাবা কল্পনার শামিল।
তথ্যপ্রযুক্তি দিন দিন উৎকর্ষ হচ্ছে, সেক্ষেত্রে প্রকাশনা শিল্পের ভবিষ্যৎ কী?
একজন বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি, তথ্যপ্রযুক্তি প্রকাশনা শিল্পের জন্য মোটেও শঙ্কার বিষয় নয়। বরং আশীর্বাদ স্বরূপ। মনে-প্রাণে এবং কাজে আমি যদি সৃজনশীল হতে না পারি তাহলে পাঠক সমাজ তৈরি করা যাবে না। দুই বছর আগে একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, আমাদের দেশে বিজ্ঞান শিক্ষা ২৩ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। কাজেই অনলাইন ভার্সন চালু হওয়ায় যে কাগজ-কালিতে লেখা বইয়ের পাঠক সংখ্যা কমে যাবে এমনটা ভাবা ভুল।
বইয়ের পাঠক কমছে, না বাড়ছে?
বলা হয় আমাদের দেশে পাঠক সংখ্যা কম। এই মেলায় সাধারণত তিন হাজারের মতো বিভিন্ন ধরনের বই ছাপা হয়েছে। সব ধরনের বই কম-বেশি বিক্রি হচ্ছে। তার পরও বলতে চাই যতগুলো বই ছাপা হয় তার ১ ভাগ বিক্রি হলেও সেটাই লেখক- প্রকাশকদের জন্য অনেক বড় অর্জন। এজন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও সঠিক উদ্যোগ দরকার।
একটি সমাজের জন্য বই কেন জরুরি?
সমাজকে বুঝতে, জানতে হলে আপনাকে প্রচুর পড়তে হবে। এই ধারাটি অব্যাহত রাখতে হলে একটি সমাজের জন্য বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। বেঁচে থাকার জন্য যেমন পর্যাপ্ত ও পরিমিত খাদ্য দরকার, তেমনি একটি সমাজ বিনির্মাণে বিদ্যা তথা জ্ঞান আহরণ করা দরকার।
প্রকাশনা শিল্প এগিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারের কোনো করণীয় আছে?
এক্ষেত্রে সরকারের কিছুই করার নেই। যেখানে সরকারের জাতীয় গ্রন্থাগার ডেড হয়ে আছে, যেটি পুনরুজ্জীবিত করতে কোনো উদ্যোগ নেই সেখানে সরকারের করণীয় কি থাকতে পারে। আমাদের দেশে পাবলিক লাইব্রেরি সরকারি উদ্যোগে মাত্র ৬০টি বই কিনে। যেখানে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গে লাইব্রেরির ওপর আলাদা করে লাইব্রেরি মন্ত্রী আছে।
আপনার প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
প্রতিবার মেলাতে বসে থাকি আগামী মেলার পরিকল্পনা করার জন্য। পাশাপাশি সরাসরি পাঠক ও লেখকদের কাছ থেকে যা কিছু শিখব সেটাকে পরবর্তী মেলাতে দেওয়ার চেষ্টা করব। আমাদের মোট বইয়ের ২৫ ভাগ হচ্ছে বিজ্ঞানভিত্তিক। তাই আমরা সবসময় বিজ্ঞান-মনস্ক বা বিজ্ঞানের চেতনার ওপর জোর দেওয়ার চেষ্টা করি।