অবসরে গিয়ে কী করবেন?
‘অবসরে তো যাচ্ছি না। দুদক কমিশনারের দায়িত্বে ছিলাম। পাঁচ বছর পার করলাম। মেয়াদ শেষ, এবার বিদায় নেয়ার পালা। তবে কাজের মধ্যেই থাকবো।’ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় মুখের কোণে হাসি গুঁজে বলছিলেন দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। ‘সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে আজীবন লাইসেন্স তো আছে। হতে পারে আবারও আইন পেশায় ফিরে যাবো। কিংবা আইনী বিষয়ে পরামর্শক হয়ে কাজ করার সুযোগও তো থাকবে।’
বৃহস্পতিবার দুপুরে দুদক কার্যালয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। শেষ সময়ে কর্মব্যস্ততা তো আছেই। সঙ্গে জুটেছে দুদক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শ্রদ্ধা, ভালবাসামাখা আবদার। ২০১১ সালের ১৪ মার্চ দুদক কমিশনারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন শেষে রবিবার বিদায় নেবেন সাবেক এই জেলা জজ। দীর্ঘ কর্মজীবনের স্মৃতিকে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখতে সহকর্মীদের আবদার, ‘স্যার, আর তো এভাবে দেখা হবে না। আপনার সঙ্গে তোলা ছবিটা না হয় থাকবে স্মৃতি হয়ে।’ না, বলতে পারলেন না তিনি। বরং সহকর্মীদের এমন আবদার আগ্রহভরেই মেনে নিলেন।
টুকিটাকি ব্যস্ততার মাঝেই সময় দিলেন ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে। বললেন, ‘বলার তো আর বাকি নেই কিছু। অনেক বলেছি। শেষ দিনে ফরমাল কোনো ইন্টারভিউ দিতে মন চাইছে না।’ কিন্তু শেষতক কথার পিঠে কথাতে উঠে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ নানা প্রসঙ্গ।
দুদকে আপনার গোটা সময়টাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
‘মূল্যায়ন তো করবে তোমরা, মিডিয়া। আমি তো কাজ করে গ্যাছি।’
সফলতা কিংবা ব্যর্থতা?
‘বিগত পাঁচ বছরে দুদকের ব্যর্থতা বলতে তো কিছু দেখছি না। তবে হ্যাঁ, শতভাগ অর্জন হয়েছে তা হয়তো বলা যাবে না। এটা সম্ভবও না।’
এমন কিছু কী আছে করতে চেয়েছিলেন, পারেননি?
‘নাহ্। তেমন কিছু তো মনে পড়ছে না। কিন্তু বিগত পাঁচ বছরে অনেক ভাল কাজ করেছে দুদক। দুর্নীতিকে ঘৃণা করার সাহস আমরা সাধারণ মানুষের মধ্যে গড়ে দিতে পেরেছি। অতীতে যা হয়নি তাই করেছি।’
যেমন?
‘সারাদেশের ৬৪ জেলায় দুর্নীতি দমন কমিটি করে দিয়েছি। এই কমিটির মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ভেতর দুর্নীতি বিরোধী মনোভাব তৈরি করে দিতে পেরেছি। গণশুনানির ব্যবস্থা আছে দুদকে। এখানেও জনগণের সম্পৃক্ততা সন্তোষজনক।’
কোনো কাজ কি বাকি রেখে যাচ্ছেন?
‘তা তো থাকছেই। দুদককের কার্যক্রমকে অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসার যে উদ্যোগ আমরা নিয়েছিলাম তা কার্যকর হতে হয়তো আরও কিছুদিন সময় লাগবে। কিন্তু সেটা হবে। তবে একটা কথা বলতেই হবে যে, দেশের প্রতিটি জেলায় দুদকের কার্যালয় থাকা দরকার ছিল। আমরা শতভাগ নিশ্চিত করতে পারিনি।’
পারেননি কেন?
‘অবশ্য পারিনি বললে ভুল হবে। চেষ্টা তো করেছি। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। তবে ৬৪ জেলায় দুদকের কার্যালয় থাকা বাঞ্চনীয়।’
দেশের অগ্রগতিতে দুদক কি আসলেই কোনো অবদান রাখতে পারছে। আপনি কী মনে করেন?
‘আমি তো মনে করি দেশের বর্তমান উন্নয়নের পেছনে দুদকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই যে এখন আমরা বিশ্বে নি¤œমধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় উঠে এসেছি। এর পেছনে দুদকের গুরুত্বপূর্ণ আছে। দুর্নীতিকে ঠেকাতে পেরেছি বলেই এই অর্জন হয়েছে। দুর্নীতি কমিয়ে আনা গেছে বলেই দেশের অগ্রগতি দৃশ্যমান হচ্ছে।’
দায়িত্ব নেয়ার শুরুতে লক্ষ্য কী ছিল?
‘২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকার শীর্ষে। লক্ষ্য ছিল দুর্নীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা। চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশ অতীতের দুর্নাম ঘুচিয়েছে।’
একসময়ের দুর্নীতি দমন ব্যুরো এখন কমিশন। ব্যুরো আর কমিশনের কাজে কী ধরনের তফাত লক্ষ্য করেছেন?
‘অনেক ব্যবধান। দুর্নীতি দমন ব্যুরোর চেয়ে ঢের শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন। আমরা সাহসিকতার সঙ্গে যেসব কাজ করেছি, ব্যুরোর ইতিহাসে এমনটা বেনজির।’
পদ্মাসেতু, হলমার্ক, ডেসটিনিসহ অনেক আলোচিত ঘটনার সাক্ষী দুদক। বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী, বর্তমান সংসদ সদস্যদেরও দুদকের ডাকে আসতে হয়েছে। এসব নিয়ে কোনো রাজনৈতিক চাপ কি ছিল না?
‘না, কোনো রাজনৈতিক কিংবা সরকারের প্রভাব ছিল না। প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করেছি। কখনও কোনো চাপের মুখে পড়িনি। এটা সম্ভব হয়েছে সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার কারণে।’
অনেকে অপেক্ষা করছেন। বুঝতে পারছি আমার উঠতে হবে। শেষপ্রশ্ন, দুদকে দায়িত্বপালনের পুরো সময়টা পার করে এসে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
‘আমি সন্তুষ্ট। সন্তুষ্টি নিয়েই যাচ্ছি।’
কথা শেষ করতে না করতেই দুদকের একজন নারী কর্মকর্তা অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। কুশল বিনিময় শেষে বললেন, ‘স্যার, খুব ইচ্ছে ছিল আপনার পা ছুঁয়ে দোয়া নেবো। কিন্তু সাহস হয়নি এতদিন।’ অশ্রুসজল চোখ আড়াল করলেন ঠিকই কিন্তু গলা ধরে এল ওই কর্মকর্তার। তবে ইচ্ছে তার অপূরণ রইলো না।
(ঢাকাটাইমস/ ১০ মার্চ/ এইচএফ)