ঢাকা: লেক সার্কাসের বাড়িতে জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয়কে খুন করে যখন ডলফিন গলি দিয়ে ছয় খুনি পালাচ্ছিল, তখন উল্টো দিক থেকে আসছিল পুলিশের টহল গাড়ি। একই রঙের টিশার্ট পরা খুনিরা পুলিশের গাড়িটি পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ সন্দেহবশত তাদের থামতে বলে। কিন্তু কেউ থামেনি। পেছন থেকে একজনকে ঝাপটে ধরে চাপাতির কোপ খান এক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই)। এ সময় দুই পক্ষে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। পুলিশের ভাষ্য, ওই সময় তাদের ধারণাই ছিল না, এই ‘পোলাপানে’র কাছে এত কিছু আছে!
গত সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর কলাবাগান থানার ডলফিন গলির ৩৫ নম্বর বাড়িতে খুন হন ইউএসএআইডির কর্মকর্তা ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাবেক প্রটোকল অফিসার জুলহাজ মান্নান (৩৫) এবং তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব তনয় (২৮)। নিহত জুলহাজ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির খালাতো ভাই। জুলহাজ বাংলাদেশে সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতেন। সমকামীদের মুখপত্র ‘রূপবান’নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন তিনি। তনয় আশা ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করতেন। লোকনাট্য নামের একটি থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি।
কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বলেন, ওই হামলার ঘটনাটি কলাবাগান থানার পুলিশ স্থানীয়দের মাধ্যমে জানতে পারে। পরে তিনি রাসেল স্কয়ারে টহলে থাকা উপপরিদর্শক (এসআই) শামীম আহমেদকে ফোনে দ্রুত ওই বাসায় যাওয়ার নির্দেশ দেন। টহল পুলিশের দলটিতে এসআই শামীম ছাড়াও সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মমতাজ উদ্দিন, কনস্টেবল আজগর আলী, কনস্টেবল নূর ইসলাম ও গাড়িচালক কনস্টেবল মজিবর ছিলেন।
এদিকে, ওই বাসা থেকে বের হয়ে হত্যাকারীরা তেঁতুলগলি হয়ে ডলফিন গলির দিকে যান। ডলফিন গলির মাঝামাঝি ৬০ নম্বর রাশেদ মোশাররফের বাড়ির সামনে হত্যাকারীদের সঙ্গে পুলিশের গোলাগুলি হয়।
কলাবাগান থানার এসআই শামীম আহমেদ বলেন, “ওসি স্যারের ফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ওখানে রওয়ানা হই। ডলফিন গলির মুখ দিয়ে ঢুকতেই একটি ছেলে আমাকে জানায় কিছু পোলাপান তেঁতুলতলায় ঝামেলা করছে। এরপর আমরা গাড়ি নিয়ে সামনের দিকে আগাই। আমি গাড়ির সামনে চালকের পাশের আসনে ছিলাম।
“আমাদের সামনের দিক থেকে পাঁচ-ছয়জন ‘পোলাপান’ একই টি-শার্ট পরে দৌড়ে যাচ্ছিল। আমাদের গাড়ি তখনো রানিংয়ে। এরপর আমি আমার সঙ্গে সোর্সদের বলি, ওদের থামতে বলতে। এএসআই মমতাজ গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে একজনকে ঝাপটে ধরেন। গাড়িটা অল্প একটু দূরে গিয়ে থামে। আমি নামি এবং অন্য পুলিশ সদস্যরাও নামেন। এ সময় ওই ছেলেটাকে উদ্ধার করতে অন্য একজন চাপাতি দিয়ে হামলা চালায়। চাপাতির আঘাত মমতাজের কপালে লাগে। তিনি মাটিতে পড়ে যান। এ সময় আমি পিস্তল দিয়ে এক রাউন্ড গুলি করি। অন্য এক পুলিশ সদস্যও গুলি করেন। তারাও (খুনি) পাল্টা গুলি চালায়। একজনকে পেছনে থেকে আবার ঝাপটে ধরি। তবে তাকেও রাখতে পারিনি। এ সময় ডলফিন গলির মাথায় থাকা মসজিদ দিয়ে মুসল্লিরা বের হচ্ছিলেন। তাই আমি দ্বিতীয় বার ফায়ার করিনি।”
এসআই শামীম আরো বলেন, ‘‘আমাদের ধারণাই ছিল না, এই ‘পোলাপানে’র কাছে এত কিছু আছে! পরে দেখেছি তাদের তিনজনের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। দুজনের কাছে ছিল চাপাতি।”
খুনিরা পালিয়ে যাওয়ার সময় কিংবা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় আশপাশের মাুনষের কোনো সহযোগিতা পাননি বলে দুঃখ করেন এসআই শামীম। তিনি বলেন, “ঘটনার সময় ডলফিন গলিতে কয়েক শ লোক ছিল। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। একজন মানুষও যদি এগিয়ে আসত, তাহলে আমরা অন্তত দুই-তিনজনকে ধরে রাখতে পারতাম। কিন্তু কেউ সহযোগিতা করলেন না। এটাই আমাদের দুঃখ।”
এসআই শামীম বলেন, “যখন আমার অফিসারের ওপর হামলা হয়েছে, তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন, তখন আমার অফিসারের জীবন রক্ষা করাও আমার দায়িত্ব। ওই সময় হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। আমি নিজেও গর্তে পড়েছি। কিন্তু লোকজন দাঁড়িয়ে দেখেছে। কেউ এগিয়ে আসেনি।”
এদিকে জুলহাজ ও তনয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশের করা মামলার তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। আজ বুধবার বিকেলে এই মামলা ডিবিতে আনা হয়েছে। তদন্ত করবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষিণ বিভাগ। তবে এখনো পর্যন্ত কোনো তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়নি।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার মো. মারুফ হোসেন সরদার বলেন, কলাবাগানের জোড়া খুনের মামলার তদন্তভার আজ বুধবার বিকেলে ডিবিতে এসেছে।
(ঢাকাটাইমস/২৭এপ্রিল/এএ/মোআ)