logo ২১ এপ্রিল ২০২৫
অগ্নিকাণ্ডে তদন্ত কি কেবলই আইওয়াশ?
আশিক আহমেদ, ঢাকাটাইমস
২৩ মে, ২০১৬ ১১:২২:৫১
image




ঢাকা: রাজধানীর কারওয়ানবাজারের হাসিনা মার্কেটে আগুন কেন লাগলো, সে কারণ এখনও জানায়নি ফায়ার সার্ভিস। যদিও তদন্ত শেষ হয়েছে, প্রতিবেদনও জমা পড়েছে। কিন্তু সব কিছুতে রাখঢাক।



গত ২ মে শনিবার রাতে  রাজধানীর কারওয়ান বাজারের হাসিনা মার্কেটে আগুন লাগে। ওই ঘটনার তদন্তে উপপরিচালক জহুরুল আমিনকে প্রধান করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করে ফায়ার সার্ভিস। আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে আরেক উপ-পরিচালক মোজাম্মেল হক ঢাকাটাইমসকে বলেন, এখন ‘প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি।  কারন তদন্ত কমিটির প্রধান জহুরুল আমিন সাহেব বিদেশে গিয়েছিলেন একটি প্রশিক্ষণে। ওনি ফিরেছেন, দুই একদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে’।



এই আগুন লাগার পর থেকেই ব্যবসায়ীরা ঘটনাটিকে নাশকতা বলছিলেন। সরকারি ওই জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, উচ্ছেদ পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এই আগুন লাগানো হয়। তাৎক্ষণিকভাবে ফায়ার সার্ভিস বৈদ্যতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগার সম্ভাব্যতার কথা বললেও ব্যবসায়ীরা জানান, তখন মার্কেটে বিদ্যুৎ ছিল না। আর যে দোকান থেকে আগুনটি ছড়িয়ে পড়ে সেটি বন্ধ ছিল।



হাসিনা মার্কেটে বৈধ দোকানের সংখ্যা ছিল ১৮৬ জন। এর মধ্যে বেশির ভাগই পুড়ে গেছে আগুনে। বেশ কিছু দোকানি টাকাপয়সা ও অল্প কিছু মালপত্র সরিয়ে নিতে পারলেও বেশির ভাগ মালিকই তা করতে পারেননি।



সরোজমিনে ঘুরে দেখা যায়,  কারওয়ানবাজারের ওই মার্কেটের বাইরে ফুটপাতে এখন  কিছু দোকান বসেছে। তবে ভেতরে দোকানিদের এখনও কেউ ব্যবসায় নিয়ে বসেনি। এ ব্যাপারে কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য ইমাম হোসেন বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা গুছিয়ে উঠতে পারেনি ফলে সবাই এখন পর্যন্ত ব্যবসা শুরু করতে পারছে না।



কেবল এই একটি ঘটনা নয়, এর আগেও নানা সময় রাজধানীতে বস্তি বা এই ধরনের কিছু স্থাপনায় আগুনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। এসব আগুনে প্রধানত ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় নি¤œ আয়ের মানুষ। মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছ শত শত মানুষ। আগুন লাগার পর ঘটনাস্থল থেকে উচ্ছেদ হয়ে অন্যত্র আবাস গড়তে বাধ্য হয় তারা। এমনিতে নি¤œ আয়ের মানুষগুলো এসব ঘটনায় আরও বেশি নিঃস্ব হয়।



এ ধরনের আগুনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নাশকতার অভিযোগ উঠে। আর তদন্ত করে প্রকৃত কারণ বের করা এবং ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেয় প্রশাসন। কিন্তু সে প্রতিবেদন কখনও প্রকাশ হয় না। যোগাযোগ করা হলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিটি ঘটনাতেই তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয় বাহিনীটি। সেখানে আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি বেশ কিছু সুপারিশও থাকে। কিন্তু সেগুলো প্রকাশের দায়িত্ব তদন্ত কমিটির নয়।



জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) আনিস মাহমুদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করা হয় তার ফলোআপ করা সম্ভব হয় না’।



পোড়াবস্তির আগুনের ঘটনায় প্রতিবেদনও হিমঘরে



চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি রাজধানীর কল্যাণপুরের নতুনবাজারের পোড়া বস্তিতে আগুনের ঘটনায় নিঃস্ব হয়েছে শত শত মানুষ।



হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মালিকানায় থাকা প্রায় ৫০ একর ওই জমির মধ্যে ১৫ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে এই বস্তি। বেশ কয়েক বছর আগে একবার আগুন লাগায় এর নাম হয়ে যায় পোড়া বস্তি। সেখানে কয়েক হাজার ঘরে অন্তত ২০ হাজার মানুষ এতদিন বসবাস করে আসছিলেন বলে স্থানীয়দের তথ্য।



২০০৩ সালে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ওই জমি থেকে বস্তি উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলে আদালত স্থগিতাদেশ দেয়। এরপর আরও দুই দফা সেই উদ্যোগ নেওয়া হলেও আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ কয়েকটি বেসরকারি সংগঠনের চেষ্টায় তা আটকে যায়।



১৯ জানুয়ারি হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জমি উদ্ধারে এই বস্তির একটি অংশে উচ্ছেদ অভিযান চালায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। সে সময় বস্তিবাসীর সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এক-চতুর্থাংশ উচ্ছেদের পর হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞায় দুপুরে ওই অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই বস্তির অন্য মাথায় বেলতলী মাঠ এলাকার আট নম্বর বস্তিতে আগুন লাগে।



বস্তিবাসীদের অভিযোগ, এই বস্তিতে আগুন লাগানো হয়েছিল। ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ওই দিন সকাল ১০টার দিকে তারা পোড়া বস্তিতে আগুন লাগার খবর পান। এরপর দুটি ইউনিটকে সেখানে পাঠানো হয়।



স্থানীয়দের দাবি, এ ঘটনায় অন্তত একশ ঘর পুড়েছে। তাদের অভিযোগ, তাদের ঘরে ইচ্ছে করে আগুন লাগানো হয়েছে। পারভীন আক্তার নামে এক নারী বলেন, সকাল আটটার পরপর বস্তিতে আগুন লাগে। বেশ কয়েক দফা ফায়ার সার্ভিসে খবর দেওয়া হলেও তারা আসতে অনেক দেরি করেছে। ওই বস্তির আরেক বাসিন্দা কামাল হোসেন বলন, ‘সরকারদলীয় লোকজন মিরপুর বাংলা কলেজ ও হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সামনে এবং বস্তিতে ঢোকার মুখে ফায়ারের গাড়িকে বাধা দিয়েছে’।



এ ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকেও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু ওই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছি কিনা জানে না ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক প্রশাসন আনিস মাহমুদ বলেন, ‘এই বিষয়ে আমি আপনাকে পরে বলব’। এরপর একাধিকবার তার ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি তা ধরেননি।



তিন প্রতিবেদনের তিনটিই গায়েব



২০১৩ সালের ৮ মে গভীর রাতে মিরপুরের এক এর দারুস সালাম রোডের ৩০/২ তুংহাই গার্মেন্টে আগুন লাগে। এ ঘটনায় পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক মঞ্জুর মোর্শেদ, বিজিএমইএর পরিচালক ও তুংহাই গার্মেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর রহমান, কুমিল্লার যুবলীগের নেতা সোহেল, মোস্তফা স্বপন, এমাদুর রহমান বাদল, সৈয়দ নাসিম রেজা, মঞ্জুর মোর্শেদের দেহরক্ষী কনস্টেবল রিপন চাকমা, তুংহাইয়ের অফিস সহকারী সাহাবুদ্দিন ও রিপন নামে এক রঙ মিস্ত্রি মারা যান। আগুনে প্রাণহানির পাশাপাশি প্রায় কোটি টাকার মালামাল ভস্মীভূত হয়। ঘটনার পর মিরপুর জোনের সহকারী পুলিশ সুপার , গোয়েন্দা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে তিনটি আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।



দুই বছরেও ওই আগুনের রহস্য ও প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। শর্টসার্কিট থেকে না নাশকতা থেকে আগুন লেগেছিল। তবে তদন্তের স্বার্থে তুংহাই গার্মেন্টের মালিকের স্ত্রী ও একই গ্রুপের চেয়ারম্যানে মঞ্জুয়ারা বেগমকে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তদন্ত কর্মকর্তাদের সামনে হাজির হননি।



ওই ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির প্রধান বাহিনীটির ঢাকা অঞ্চলের উপ-পরিচালক জহুরুল আমিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ওই ঘটনায় আমিপ্রতিবেদন জমা দিয়েছিলাম। তবে আগুন লাগার কারণ বিষয়ে প্রতিবেদনে কি ছিল তা এখন আমার মনে নেই। এটা তো অনেকদিন আগের কথা’।



জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পশ্চিম বিভাগের উপ-কমিশনার সাজ্জাদুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমি ২০১৫ সালে যোগদান করেছি। ফলে ওই তদন্ত কমিটি বা প্রতিবেদন সম্পর্কে তেমন কিছু বলতে পারব না’।



ওই ঘটনার দিন রাতেই ঘটনাস্থলে আসেন বিজিএমইএর নেতারা। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে ও প্রকৃত ঘটনার রহস্যভেদ করতে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরা আলাদা করে তদন্ত শুরু করে। এরমধ্যে মিরপুর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার সাখাওয়াত হোসেনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।



এ ব্যাপারে মিরপুর অঞ্চলের পুলিশের উপ-কমিশনার মাসুদ আহমেদ বলেন, ‘যতদূর মনে পড়ে এ ঘটনায় নিয়মিত মামলা হয়েছে। তবে তদন্ত প্রতিবেদন না দেখে এ সম্পর্কে কিছু বলতে পারবনা।



উচ্চবিত্তের বাড়িতে আগুনের প্রতিবেদন প্রকাশ



গত ১৯ মার্চ রাজধানীর বনানীর ‘বি’ ব্লকের ২৩ নম্বর রোডের ৯ নম্বর বাসায় আগুন লাগার ঘটনা তদন্তে পেট্রোবাংলার পরিচালককে (প্রশাসন) আহ্বায়ক করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে গঠিত এই কমিটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদনও জমা দেয়। এতে এ ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনা পরিহারের লক্ষ্যে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও করা হয়। ওই প্রতিবেদনে তারা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের রাস্তা খোঁড়াখুড়িকেই দায়ী করেছেন। তবে তিতাশ গ্যাসের কোন দায় এই দুর্ঘটনায় নেই বলে তাদের অভিমত।



তবে এই ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস কোনও তদন্ত কমিটি গঠন করেনি।



ঢাকাটাইমস/২৩মে/এএ/ডব্লিুউবি