logo ০৫ জুলাই ২০২৫
তাড়া খেয়ে খেয়ে নদীতে ভাসছে হাতিটি
পরিমল মজুমদার, কুড়িগ্রাম থেকে
০১ আগস্ট, ২০১৬ ১৬:০০:২০
image



৩৫ দিন আগে কুড়িগ্রামের রৌমারীর সাহেবের আলগা সীমান্ত দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের বানের পানিতে ভেসে বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে পড়ে এক বুনো হাতি। আটকা পড়ে চরবাগুয়ার কাঁশবনে।






বাংলাদেশে ভেসে আসার পর হাতিটি বিভিন্ন চরে ওঠার চেষ্টা করলেও মানুষের তাড়া খেয়ে আবার নদীতে ভাসে। এভাবে প্রায় সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার নদীপথ পাড়ি দেয় হাতটি। প্রথমে রৌমারী, রাজীবপুর, গাইবান্ধার ফুলছরি, সাঘাটা, বগুড়ার সারিয়াকান্দি, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ হয়ে ওই জেলার মাদারগঞ্জের ডাকাতিয়ার চরে ওঠে। কিন্তু গ্রামবাসী তাড়া করে হাতিটিকে পানিতে নামিয়ে দেয়। এখন হাতিটি পানিতে আটকা আছে। তীরে ওঠার চেষ্টা করলেই মানুষ থালা-বাটি ও টিন বাজিয়ে নদীতে নামিয়ে দিচ্ছে। দীর্ঘ সময়ে সঙ্গীহীন, ক্ষুধা ও বানের জলের সাথে বাঁচার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।






যেমন করে কাটছে তার দিন






২৮ জুন মঙ্গলবার সকাল ৭টার দিকে নদে ভারত থেকে কিছু একটা ভেসে আসছে দেখে গ্রামবাসী। মোষ ভেসে আসছে মুহূর্তে রটে যায়। তাকে ধরতে পারলেই অনেক টাকা। উৎসাহ নিয়ে একটা নৌকায় ধরতে যায় সাহেবের আলগা চরের আনোয়ার হোসেন, বিনত মোল্লা, সিরাজুল ইসলাম, সোনাউল্লাহ। কিছুদুর যাওয়ার পর তারা দেখতে পায় ভেসে আসা প্রাণিটি মোষ নয়- হাতি। হাতিটি মরে যেতে পারে এই ভেবে তারা তাড়িয়ে চরবাগুয়ার জনমানব শূন্য চরে ভেড়ায়।






সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাতিটি চরবাগুয়ার চরেই অবস্থান করে। কিন্তু চরে খাবার না থাকায় চর ছাড়ার চেষ্টা করে নদের তীব্র স্রোতের কবলে পড়ে। সেখান থেকে ভাসতে ভাসতে প্রায় ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে একই উপজেলার খেড়–য়ার চর নামক চরে আটকা পড়ে।






আবার ভেসে যায়






২৯ জুন খেড়–য়ার চরে খাবার না পেয়ে ওই দিন রাতে স্রোতে গা ভাসায় খাবারের সন্ধানে। গন্তব্যবিহীন যাত্রায় আবার কাদায় আটকা পড়ে ১৫ কিলোমিটার দূরে রাজীবপুরের নয়াচর বাজারের পশ্চিমে মধ্যপাড়া নামক চরে কাদায় আটকা পড়ে।






৩০ জুন সারাদিন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল হাতিটি। রাতে প্রায় এক কিলোমিটার উজানে চড়াইহাটি নামক চরে ঢোকে।






কীর্তনতারি চরাঞ্চলের ইউপি মেম্বার নুরুল হক জানান, ওই সময় হাতিটিকে খুবই দুর্বল ও ক্ষুধার্ত মনে হয়েছিল। এ কারণে তিনি তার বাড়ি থেকে কলাগাছ কেটে নৌকায় করে হাতির কাছে ফেলে দেন।






১ জুলাই থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত চড়াইহাটিতে অবস্থান করে হাতিটি। এর কারণ হিসেবে স্থানীয়রা জানান, চরে প্রচুর কাঁশবন থাকায় খাবার হিসেবে তা বেচে নেয় হাতিটি। খাবার থাকায় এখানে একটানা আট দিন অবস্থান করে। রাতে আবার ছুটে যায় নয়াচর মধ্যপাড়া চরে।






নয়ার চরে হাতিটি ৮ থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত অবস্থান করে। খাবার না পেয়ে রাতে দক্ষিণ বড়বেড় চরের জনবসতি হামলা করে একটি পরিবারের ঘর ভেঙে ফেলে। কয়েকটি গাছও উপড়ে ফেলে। এসময় মানুষের তাড়া খেয়ে আবার স্রোতে ভেসে যায়।






ওই রাতেই গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার এরেন্ডাবাড়ি নামক চরে অবস্থান নেয়। এখানে খাবার না থাকায় খাবারের খোঁজে জনবসতিতে ঢোকে। কিন্তু হাতি দেখে চরের মানুষ ভয়ে হাতিটিকে তাড়ানোর চেষ্টা করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হাতিটি মানুষের বাড়িঘরে আক্রমণ করে। এতে ১২টি পরিবারের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক পর্যায়ে রাতের অন্ধকার আগুন ও ঢোলের শব্দ করে হাতিটিকে তাড়িয়ে দেয় চরের মানুষ। এখানে ১০ থেকে ১১ জুলাই দুদিন অবস্থান করে হাতিটি।






১২ থেকে ১৩ জুলাই এরেন্ডাবাড়ি চরের মানুষের তাড়া খেয়ে চরহাগড়া নামক চরে গিয়ে ওঠে। এ চরে জনবসতি ছিল না। কাঁশবন থাকায় এ চরে দুই দিন অবস্থান করে হাতিটি। চরটি জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চুকাবাড়ি ইউনিয়নের অধীনে।






১৪ জুলাই গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের পাতিল তলা চরে আটকে পড়ে। এখানে কোনো খাবার ছিল না। ফলে সারা দিন অবস্থানের পর রাতে ছুটে চলে অন্য চরের দিকে।






১৫ থেকে ১৭ জুলাই বগুড়ার সারিয়াকান্দির হরিরামপুর কাশিয়া বাড়ি  চরে গিয়ে ওঠে হাতিটি। রাতের বেলায় জেলেরা হাতিটি প্রথমে দেখে ভয় পেয়েছিল। সকালে হাতি দেখার জন্য অসংখ্য নৌকায় উৎসুক জনতা ভিড় করে। চরের বাবুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি কলাগাছ কেটে হাতিকে খাবার দিত বলে জানা গেছে।






এরপর আবার পানির তোড়ে ভেসে যায় সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার ছিন্নার চরে। সেখান থেকে জামালপুর উপজেলার মাদারগঞ্জের ডাকাতিয়া চরে। সেখানে এখন পর্যন্ত অবস্থান করছিল বানে ভেসে আসা বন্য হাতিটি।






ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা গোবিন্দ রায় বলেন, “ব্রহ্মপুত্র নদে যে হাতিটি রয়েছে সেটা বুনো হাতি। ভারতের পাহাড়ি এলাকার বন্য হাতিটি দলছুট হয়ে নদের পানিতে ভেসে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। হাতি উদ্ধারে আমরা অনেক চেষ্টাই করেছি। মাহুত দিয়ে হাতির ভাষায় শব্দ করে চেষ্টাও করা হয়েছে,  কিন্তু তাতে সাড়া দেয়নি। পানির মধ্যে থাকার কারণে অচেতন করাও যাচ্ছে না।”






এদিকে, প্রায় এক মাস আগে হাতি উদ্ধারে বন বিভাগের কমিটি গঠন করা হলেও হাতি উদ্ধারে কার্যকর দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না। শুধু পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছেন বন বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশ প্রশাসন।






ভারত থেকে তিন সদস্যের একটি হস্তি বিশারদ দল আসার কথা রয়েছে। তারা এলে কী করবে এর ওপর নির্ভর করবে পথ ভুলে বাংলাদেশে ভেসে এই বুনো হাতিটির ভাগ্য।