ঢাকা: পাকিস্তানের লাহোরের রাস্তায় একটি বিশেষ অটোরিকশা ছুটে চলে প্রতিদিন। তার গায়ে শোভিত চালকের বিশেষ মুহূর্তের কিছু ছবি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের সঙ্গে করমর্দন করছেন তিনি। চালকের গায়ে কখনো কখনো শোভা পায় অলিম্পিক ব্লেজার। নিজের গৌরবময় স্মৃতি দিয়ে ঘেরা অটোরিকশায় যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দিন তিনি।
শখের বশে নয়, জীবনের তাগিদে এখন অটোরিকশাচালক সাবেক অলিম্পিয়ান সাইক্লিস্ট মোহাম্মদ আশিক।
আর এক দিন পর শুক্রবার ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পর্দা উঠবে অলিম্পিকের ৩১তম আসরের। পুরো বিশ্বের ক্রীড়াপ্রেমীদের এখন অপেক্ষা সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। আর এই বিশাল উৎসবের আগমূহূর্তে পাকিস্তানের গণমাধ্যম ডন নিউজ প্রকাশ করেছে ১৯৬০ এবং ১৯৬৪ অলিম্পিকে সাইক্লিংয়ে অংশ নেয়া পাকিস্তানের অলিম্পিয়ানের করুণ কাহিনি।
অলিম্পিকে কোনো পদক না পেলেও এশিয়ান গেমসসহ নানা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় মোহাম্মদ আশিকের রয়েছে অনেক অর্জন। সাবেক এই অলিম্পিয়ান প্রতিদিনই তার ট্রফিগুলোর দিকে চোখ ভোলান। তখন তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে কয়েক দশক আগে তার ঝলমলে সাইক্লিং ক্যারিয়ার। ক্রীড়াবিদ হিসেবে তখন সংবর্ধিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী-প্রেসিডেন্টদের কাছে। কিন্তু সেসব এখন শুধু তারই স্মৃতি। আর কেউ মনে রাখেনি তাকে।
অশ্রুসিক্ত চোখে মোহাম্মদ আশিক বলেন, “সম্ভবত অনেকে মনে করেন, আমি মারা গেছি। আমি শুধু স্মরণ করতে চাই, তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট, প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলাম। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, কীভাবে সবাই আমাকে ভুলে গেল।”
মোহাম্মদ আশিকের খেলাধুলা ক্যারিয়ার শুরু হয় মুষ্টিযোদ্ধা হিসেবে। তার শরীরের আঘাত নিয়ে স্ত্রীর আপত্তির কারণে ১৯৫০ সালের দিকে সাইক্লিং শুরু করেন তিনি।
১৯৬০ সালে ইতালির রোমে ও ১৯৬৪ সালে জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে সাইক্লিং প্রতিযোগিতায় অংশ নেন মোহাম্মদ আশিক। প্রতিযোগিতায় তিনি পদক না পেলেও পাকিস্তানের ‘জাতীয় হিরো’র মর্যাদা লাভ করেন তখন।
আশিক বলেন, “আমি তখন খুব খুশি ছিলাম। নিজেকে তখন ভাগ্যবান মনে হতো। কারণ আমি পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিলাম।”
কিন্তু সাইক্লিং ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার পরই তার দুর্ভাগ্য শুরু হলো।
খেলাধুলা ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার পর তিনি জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি নেন। কিন্তু স্বাস্থ্যগত কারণে ১৯৭৭ সালে চাকরিটা ছেড়ে দিতে হয়। এরপর তিনি কিছুদিন ট্যাক্সি এবং ভ্যান চালান। তারপর ছোটখাটো কিছু ব্যবসা করেন। তবে গত ছয় বছর ধরে তিনি লাহোরের রাস্তায় অটোরিকশা চালাচ্ছেন।
৪৫০ বর্গফুটের একটি ছোট্ট বাড়িতে থাকেন আশিক। এই বাড়ির জন্য ঋণ নেয়া ১০ লাখ রুপি এখন শোধ করছেন অটোরিকশা চালিয়ে। প্রতিদিন সর্বসাকল্যে ৪০০ রুপি আয় করেন তিনি।
স্ত্রী মারা গেছেন বছর দুই আগে। চার ছেলেমেয়ের সবাই আলাদা থাকেন। একাই চলছে তার জীবনযাপন। আশিক বলেন, ‘আমি কারো ওপর নির্ভরশীল হতে চাই না।’
মোহাম্মদ আশিক সাধারণত তার পদকগুলো অটোরিকশাতে ঝুলিয়ে রাখতেন। তবে এখন আর রাখেন না। তার পরিবর্তে অটোরিকশার পর্দার বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কোলিজের বিখ্যাত একটি উক্তি লিখে রেখেছেন- ‘যে জাতি তাদের বীর সন্তানদের ভুলে যায়, সেই জাতি কখনো উন্নতি করতে পারে না।’
যখন যাত্রীরা তাকে এই উক্তির তাৎপর্য জিজ্ঞাসা করে, আশিক তার কষ্টের কাহিনি তুলে ধরেন। আর দরিদ্রদের অনুরোধ করেন, কখনো খেলাধুলায় অংশ না নিতে।
তার স্ত্রী যখন বেঁচে ছিলেন, তখন তাকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে নিষেধ করতেন। তার ছেলেমেয়েরাও চাইতেন না তিনি অতীত নিয়ে ভাবেন।
আশিক বলেন, “একদিন আমার স্ত্রী কাঁদতে শুরু করলেন। আমি তাকে কাঁদার কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলে, ‘আপনার স্বাস্থ্য দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এ জন্য আমার দুশ্চিন্তা হয়।’ আমার স্ত্রী আমাকে সব সময় হাসিখুশি থাকার জন্য বলে। যারা আমাকে ভুলে গেছে, তাদেরও ভুলে যেতে বলে। আমি তখন তাকে বললাম, ঠিক আছে। তখন সে খুশি হয়েছিল। এর কিছুদিন পর আমার স্ত্রী মারা যায়।”
দুই বছর হলো গত হয়েছেন স্ত্রী। এখন মৃত্যুর প্রহর গুনছেন আশিক। বলেন, “আমার এখন আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া। তিনি যেন দ্রুত আমাকে জান্নাতবাসী স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ করে দেন। কঠিন এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে মৃত্যুই একমাত্র উপায়।”
(ঢাকাটাইমস/৩আগস্ট/এসআই/মোআ)