বই লিখে আর অধ্যাপনা করে ব্যস্ত সময় পার করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রধানের পদ ছাড়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনায় ফেরেন তিনি। এরপর শুরু করেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও কর্মের ওপর গবেষণাধর্মী বই লেখার কাজ।
অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচয়ের পাশাপাশি রবীন্দ্র গবেষক হিসেবেও সুনাম ছিল আতিউরের। রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক নীতি নিধারণের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ততা শেষে তার শখের সেই ভূবনে আবার ফিরে এসেছেন তিনি। তবে একটি কাজে কখনও থেমে থাকা শেখেননি আতিউর। তাই এই বইটির কাজ প্রায় শেষ হয়ে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি শুরু করেছেন আরও দুটি বই রচনার কাজ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদ ছাড়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যায়ন বিভাগেই তার বেশির ভাগ সময় কাটে আতেউরের। থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক কোয়ার্টারে। গবেষণা আর নিজের বই লেখা আর শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা- এই তিনে ভীষণ ব্যস্ত সময় যাচ্ছে তার।
ঢাকাটাইমসের সঙ্গে আলাপচারিতা
রবিবার বিকালে ঢাকাটাইমসের সঙ্গে কথা হয় আতিউর রহমানের। ব্যস্ত জীবনে একেবারেই কম সময় দিয়েছেন তিনি। বলেন, ‘অক্টোবরে বিস্তারিত কথা হবে।’
ড. আতিউর বলেন, ‘সময় যাচ্ছে ভীষণ ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে।’
অন্য দুটি বই ব্যাংকিং এবং উন্নয়ন বিষয়ে। জানান, এছাড়া গবেষণার কাজে তিনি আগামী সপ্তাহে বিদেশে যাচ্ছেন, দেশে ফিরবেন মধ্য অক্টোবরে।
তার সঙ্গে আলাপচারিতা ছিল এ রকম:
-বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়ার পর সময় কেমন কাটছে?
-‘খুবই ভাল সময় কাটছে। আমি আমার আপন ভুবনে কাজ করছি। অনেক সময় পাচ্ছি। এরচেয়ে আর সুখের কী হতে পারে।’
আগের জীবন আর এখনকার জীবনের মধ্যে কোনটা উপভোগ করছেন?
-‘আমি তো অধ্যাপনার মানুষ। গবেষণা আর অধ্যাপনাই আমার মূল কাজ। আমার কর্মজীবন শুরুই হয়েছে এসব দিয়ে। মাঝখানে বিরতি দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সেই বিরতি শেষে আমি আমার নিজ ভুবনে ফিরে এসেছি। কাজের মধ্যে ডুবে থাকতেই আমি স্বাছন্দ অনুভব করি।’
-রবী ঠাকুরকে নিয়ে বইটি কী ধরনের আর কখন প্রকাশ হবে?
এই বইটি গবেষণাধর্মী। লেখা শেষ করে ফেলেছি, এখন চলছে সম্পাদনার কাজ। এরপরই প্রকাশের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবো।
অন্য দুটি বই?
এর একটি ব্যাংকিং এবং একটি উন্নয়ন বিষয়ে।
বিদেশ যাচ্ছেন কেন?
সেটাও গবেষণার কাজে। আগামী সপ্তাহে যাবো, ফিরবো মধ্য অক্টোবরে। তখন বিস্তারিত জানাবো সব বিষয়ে।
২০০৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী আতিউর। তিন বছর পর ডেপুটেশনে গিয়ে গভর্নরের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। ‘হ্যাকিংয়ের’ মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ কোটি ডলার চুরির ঘটনাটি চেপে রেখে সমালোচনায় পড়া আতিউর পদত্যাগ করেন।
রিজার্ভ চুরির এই বিষয়টি নিয়ে এখন কোনো কথা বলতে চান না ড. আতিউর। বলেন, ‘আমি ১৫ মার্চের পর বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ে কোনো মন্তব্য কাউকে দেইনি। এ বিষয়ে আমি কথা বলতে চাই না।’
‘মাটি থেকে উঠে আসা’ আতিউরের কর্মজীবন
অধ্যাপক হিসেবে উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে যোগ দেওয়ার আগে নিজের গড়া প্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন সমুন্নয়’ চালাচ্ছিলেন আতিউর। তার আগে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে (বিআইডিএস) রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেন তিনি।
মাস্টার্স পড়ার সময়ই ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনে প্ল্যানিং অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন আতিউর রহমান। ১৯৮৩ সালে যোগ দেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে (বিআইডিএস)।
ষাটোর্ধ্ব আতিউরের জন্ম ১৯৪৯ সালের ২৮ নভেম্বর, জামালপুরে। মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে উচ্চ-মাধ্যমিক পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি নেন তিনি। পিএইচডি ডিগ্রি পান ১৯৮৩ সালে৷ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ক্ষুদ্রঋণ বিপ্লব নিয়ে অনেক গবেষণামূলক লেখা রয়েছে তার।
আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর ২০০৯ সালে আতিউরকে চার বছরের জন্য গভর্নর পদে নিয়োগ দেয়। এরপর ২০১৬ সালের ২ অগাস্ট পর্যন্ত তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল।
তার মধ্যেই রিজার্ভ চুরির ঘটনায় পদত্যাগ করতে হল আতিউরকে। বাংলাদেশে এই পর্যন্ত ১০ জন গভর্নরের মধ্যে তাকেই প্রথম এভাবে বিদায় নিতে হল।
ড. আতিউরের সমালোচকরা বলে আসছেন, রিজার্ভ চুরির বিষয়টি তিনি গোপন রেখে ভুল করেছেন। তবে অর্থ চুরির খবর চেপে রাখার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে আতিউর বলেছেন,লোপাট অর্থ ফেরত আনা এবং নতুন করে সাইবার আক্রমণ ঠেকাতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য ‘দেশের স্বার্থে’ সময় নিয়েছিলেন তিনি।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা আতিউর নিজেকে বলতেন ‘ভূমিপুত্র’, ‘রাখাল’। পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার আগেও তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মাটি থেকে উঠে এই পর্যায়ে এসেছি।’
গভর্নরের দায়িত্ব পালনের মধ্যে রিজার্ভে উল্লম্ফন, ব্যাংক সেবা প্রান্তিক মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য ‘গরিবের অর্থনীতিবিদ’ অভিধাও পান আতিউর। গত বছর লন্ডনভিত্তিক প্রভাবশালী পত্রিকা দি ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস তাকে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে ‘সেন্ট্রাল ব্যাংকার অব দ্য ইয়ার’ও ঘোষণা করেছিল। ‘গরিবের অর্থনীতিবিদ’ অভিহিত করে ২০১৩ সালে ফিলিপিন্সের গুসি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল আতিউরকে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ক্ষুদ্রঋণ বিপ্লব নিয়ে অনেক গবেষণামূলক লেখা রয়েছে তার। প্রবন্ধের জন্য এ বছর বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
গভর্নর হিসেবে নিজেকে মূল্যায়নে আতিউর বলেছেন, ‘আমি পুরোপুরি সফল হয়েছি বলব না। তবে নতুন ধারার কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমি চালু করার চেষ্টা করেছি। সারা পৃথিবী এখন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকটাকে মডেল হিসাবে নিচ্ছে।’
(ঢাকাটাইমস/৫সেপ্টেম্বর/এমএম/ডব্লিউবি)