বড় বাগান আর গাছপালা ঘেরা দুই কক্ষের বাড়িটাকে ঘিরে দীর্ঘ দিন ধরেই পাড়ার মানুষের কৌতূহল ছিল। কারণ বাড়ির প্রবীণ সদস্য বৃদ্ধাকে বেশ কয়েক মাস ধরেই বাড়ির বাইরে যেতে দেখা যাচ্ছিল না।
রবিবার বিষয়টি সামনে আসার পর ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে ভারতের নদীয়া জেলার হরিণঘাটায়।
জানা গেছে, সিমহাত গ্রামের বাসিন্দা ননীবালা সাহা (৯০) গত জানুয়ারি মাসের ১৬ তারিখে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান। অভিযোগ, মৃত্যুর পরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া না করেই ননিবালার দেহ বাড়িতে রেখে দেন তার দুই ছেলে অজিত সাহা ও অরুণ সাহা।
তারা এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে ইদানিং কম মিশতেন। দুই ছেলের ক্রমাগত অদ্ভুত ব্যবহার ও ননিবালা দেবীর কোনো সন্ধান না মেলায় এলাকাবাসীর মনে সন্দেহ হয়। রবিবার সকালে এলাকাবাসী অজিত সাহা ও অরুণ সাহার বাড়িতে জোর করে ঢুকলে দেখতে পান ঘরে চৌকির উপরে পরে আছে কঙ্কাল। পরে হরিণঘাটা থানায় খবর দেয়া হলে পুলিশ এসে কঙ্কালটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়েছে। পাশাপাশি অজিত ও অরুন সাহাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে পুলিশ। ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে।
ননীবালার স্বামী কুঞ্জমোহন সাহা বেঙ্গল কেমিক্যালে চাকরি করতেন। বছর কুড়ি আগে মৃত্যু হয় তার। বাড়ির উঠোনে তিনি আর একটি পাকা বাড়ির ভিত করে গিয়েছিলেন। সেই বাড়ি অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। অরুণ সাহা বিএসসি পাস করে চাকরি পাননি। এলাকায় টিউশন পড়াতেন। পাড়ায় তার অসংখ্য ছাত্র। তার ছোট ভাই অজিত কিছুই করতেন না।
অরুণ সাহার প্রাক্তন ছাত্র সুজিত চক্রবর্তী জানান, বছর দশেক আগে টিউশন ছেড়ে দেন ৬৫ বছরের অরুণ। তার পর থেকেই এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। ধীরে ধীরে এলাকায় সবার সঙ্গেই সম্পর্কচ্ছেদ করেন তারা।
এলাকার বাসিন্দা সবিতাব্রত শীল জানান, বছর খানেক ধরে ননীবালাকে আর দেখা যেত না। অরুণবাবুকে বাড়ির বাইরে বিশেষ দেখা যেত না। অজিতকে মাঝেমধ্যেই মুড়ির প্যাকেট হাতে রাস্তায় দেখা যেত। মায়ের কথা জানতে চাইলে তিনি বলতেন, ভালই আছে মা।
সবিতাব্রবাবু বলেন, ‘ঐ দিন দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ আমরা কয়েক জন ওদের বাড়িতে যাই। নাম ধরে ডাকতেই বেরিয়ে আসে দুই ভাই। কিন্তু ওরা কিছুতেই বাড়ির ভিতরে যেতে দিচ্ছিল না।’
পাড়ারই বাসিন্দা তরুণ ঘোয জানান, ভোটার কার্ড সংশোধনের জন্য ননীবালার হাতের ছাপ দরকার। এতে সরাসরি ‘না’ বলে দেন দুই ভাই। কিন্তু এক রকম জোর করেই বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়েন তারা।
সবিতাব্রত বলেন, ‘ঘরের ভিতর ঢুকে দেখি অন্ধকার। ওরা বলে মা ঘুমোচ্ছে। জেগে গেলে আমাদের গালাগালি করবে। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে দেখি, তক্তপোষের উপরে কম্বল চাপা দেয়া কিছু একটা রয়েছে। কম্বল তুলে দেখি নরকঙ্কাল। খানিক ক্ষণ মুখে কোনো কথা বের হয়নি।’
তার পরেই ভিড় জমে যায় বাড়িতে। আসে পুলিশ। কিছুতেই পুলিশের সঙ্গে যেতে চাননি দুই ভাই। পাড়ার লোকেরা চ্যাংদোলা করে তাদের পুলিশের গাড়িতে তুলে দেন।
পুলিশ দুই ভাইকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে। অরুণবাবু পুলিশকে জানান, এ বছর ১৬ জানুয়ারি তার মায়ের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু, পাড়ার কাউকে সে কথা জানালেন না কেন?
অরুণবাবু বললেন, ‘আমার দাঁতে ব্যথা, ভাইয়ের পায়ে ব্যথা। আমরা কী করে মায়ের কাজ করব? আর দুই দিন পরে দেখলাম ‘মরদেহে’ পোকা ধরেছে, তাই আর কাউকে জানাইনি।’
থানায় এনে দুজনকে ভাত খাওয়ায় পুলিশ। ভাত-ডাল-তরকারি-মাছের তরকারি খেয়ে অজিত বলেন, ‘এক বছর পর ভাত খেলাম। আর দুট ভাত হবে স্যার?’ তা হলে খেতেন কী? অরুণবাবুর জবাব, ‘কেন, মুড়ি তো দিব্য খাবার।’ সূত্র: আনন্দবাজার ও এবেলা।