উত্তরের সীমান্ত জেলা দিনাজপুরে ধস নেমেছে কোরবানি পশুর চামড়া ব্যবসায়। ট্যানারি মালিকদের নির্ধারণ করা দামে চামড়া বিক্রি করতে গিয়ে লোকসানে পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় পাশের দেশ ভারতে চামড়া পাচারের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
দিনাজপুরের রামনগর চামড়াপট্টি এলাকার ব্যবসায়ী ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে মিলেছে এসব তথ্য।
মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী রমজান আলী, পারভেজ, রাশেদুলসহ বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ট্যানারি মালিকরা বর্গফুট হিসেবে চামড়ার যে দাম নির্ধারণ করেছে, তার চেয়ে বেশি দামে তাদের কিনতে হয়েছে কোরানির পশুর চামড়া। একদিকে দাম কম, অন্যদিকে ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেট, এ কারণে তারা চামড়ার দাম নিয়ে পড়েছেন বিপাকে।
এদিকে গত বছরের চেয়ে এবার ঈদে চামড়ার আমদানি অনেক কম হয়েছে বলে জানান চামড়া ব্যবসায়ী তোসাদ্দেক হোসেন। তিনি জানান, চামড়া সংরক্ষণের প্রধান উপাদান লবণের দাম বেশি, আবার চামড়ার দাম কম। বিক্রেতা আছে কিন্তু ক্রেতা নেই। ভালো দাম পাওয়ার আশায় চামড়া কিনে বাজারে এসে অনেকেই লোকসানের মুখে পড়েছেন।
তোসাদ্দেক হোসেন বলেন, গত বছর ঈদের দিন আড়াই হাজারের বেশি চামড়া কিনেছিলেন তারা। এবার তার অর্ধেকও কিনতে পারেননি। তবে ট্যানারি মালিকদের বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে বেশি দামে অনেকে চামড়া কিনতে বাধ্য হচ্ছেন বলেও জানান এই ব্যবসায়ী।
এদিকে সৌখিন মোকাররম, মিন্টু সৈয়দ, ইব্রাহিমসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে বলা বলে জানা গেছে, গতবার লাভ হয়েছিল বলে এবারও তারা চামড়া কেনেন। কিন্তু বিক্রি করতে গিয়ে এমন লোকসান হয়েছে যা ভাবতেই পারেননি তারা। হঠাৎ করেই এমন দরপতনের কারণে এবার চামড়া কিনতে তেমন বেশি ক্রেতাও ছিলেন না বলে জানান এক দিনের এই ব্যবসায়ীরা।
রামনগর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, গত বছরের চেয়ে এবার চামড়ার গুদামের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। চামড়া কেনার জন্য ট্যানারি মালিকদের কোনো প্রতিনিধিও নেই। আর স্থানীয় যে ব্যবসায়ী চামড়া কিনেছেন, তারা লবণ দিয়ে প্রক্রিয়া করে রেখেছেন।
বৃহত্তর দিনাজপুরের তিন জেলায় (ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড়-দিনাজপুর) এবার দুই লাখের বেশি পশু কোরবানি হলেও চামড়ার আমদানি হয়েছে অর্ধেকের মতো। আর দিনাজপুর জেলা শহরে চামড়া কেনাবেচা হয়েছে অন্তত ১০ হাজার। এখানকার ব্যবসায়ীদের দাবি, গেল চার-পাঁচ বছর ধরে ঈদ এলেই চামড়ার আমদানি কমে আসে।
দিনাজপুর চামড়া ব্যবসায়ী মালিক গ্রুপের সাবেক সভাপতি তৈয়ব উদ্দিন চৌধুরী জানান, লোকসানের বোঝা দিন দিন ভারী হওয়ার কারণে পুরনো ব্যবসায়ীরা এ ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। অনেকে অন্য ব্যবসা করছেন। কেউ কেউ এখনো ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে আগের পাওনা টাকা পাননি। এসবের প্রভাব পড়ে ঈদ এলেই।
তৈয়ব উদ্দিন বলেন, এবার ঈদে চামড়ার আমদানি কম হওয়ার অন্যতম কারণ ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেট। তারা এমন দাম বেঁধে দিয়েছে, যাতে ব্যবসায়ীরা চামড়াবিমুখ হন। এ অবস্থা চলতে থাকলে চামড়া পাচারের পথ প্রসারিত হবে। আর তাতে আরো বড় সংকটে পড়বে চামড়া শিল্প।
এদিকে চামড়া কিনে মৌসুমি ক্রেতারা এখন নিদারুণ বিপাকে। ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন বেঁধে দেয়া দামে চামড়া কিনতে পারেননি বেশির ভাগ মৌসুমি ক্রেতা।
এবার ট্যানারি মালিকদের সংগঠন ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন ঢাকায় লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে প্রতি বর্গফুট ৫০ টাকা। ঢাকার বাইরে এই দাম ৪০ টাকা। অর্থাৎ লবণছাড়া দাম হওয়ার কথা আরও কম। কিন্তু এই হিসাব ধরে চামড়া কিনতে পারেননি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, কেনা দামের চেয়ে এবার আড়তে দাম কম বলা হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। এই অবস্থায় শত শত কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কায় পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
ট্যানারি মালিকরা বর্গফুট হিসেবে চামড়ার দর ঠিক করে দিলেও খুচরা ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনেছেন চোখের আন্দাজে। আড়তে নিয়ে বর্গফুট হিসেবে বেচতে গিয়ে দেখেন ঠকে গেছেন প্রায় সবাই। একেকটি চামড়া তারা এক হাজার থেকে ১৬০০ টাকা দরে কিনেছেন। কিন্তু আড়তে ৮০০ টাকার বেশি দাম উঠছে না।
সারা দেশেই দর পড়ে যাওয়ায় প্রতিবেশী দেশে চামড়া পাচারের আশঙ্কা করছে খোদ প্রশাসনও। এ জন্য দিনাজপুরের সীমান্ত জুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
(ঢাকাটাইমস/১৬সেপ্টেম্বর/মোআ)