ঢাকা: একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক ঘটনার উদ্ভব হলেও কাদের মোল্লার ঘটনাটি স্বাধীনতার পর সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি আলোচিত ঘটনা। একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে গোটা দেশ আলোড়িত হয়ে ওঠে। জামায়াতের এই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পরও সহিংসতা বা প্রতিশোধের আগুনে পুড়ছে দেশ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই যুদ্ধাপরাধীকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়ার পর থেকেই মূলত সহিংসতা শুরু। রায়ের দিনই জন্ম নেয় গণজাগরণ মঞ্চ। রাজধানীর শাহবাগে জন্ম নেয়া এই গণজাগরণ মঞ্চ পরে ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল সরসরি একে সমর্থন দিলেও বেকায়দায় পড়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দল। এই কাদের মোল্লার বিচারকে ঘিরেই নজিরবিহীনভাবে জাতীয় সংসদে সংশোধিত হয় ট্রাইব্যুনাল আইন, দানবীয় রূপে আবির্ভাব ঘটে হেফাজতে ইসলামের, দেশ অচল করে দেয়ার হুমকি, দেশ-বিদেশে উদ্বেগ, লাশের মিছিল, আগুন এ সবই ঘটেছে কাদের মোল্লাকে ঘিরে।
শুরুটা ৫ ফেব্রুয়ারি। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম কোনো জামায়াত নেতারা বিচারের রায় ঘোষিত হয়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজধানীর মিরপুর অঞ্চলে হত্যা, ধর্ষণ লুটপাটের অভিযোগে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ‘মিরপুরের কসাই’ হিসাবে পরিচিত কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল থেকে বের হয়ে গাড়িতে চড়ার সময় গণমাধ্যমে ‘ভি’ (বিজয়) চিহ্ন দেখান কাদের মোল্লা। যুদ্ধাপরাধীর এমন বিজয় উল্লাস আঘাত হানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির হৃদয়ে।
গুরু অপরাধে লঘু দণ্ডেরর অভিযোগ এনে রায় বাতিল করে মৃত্যুদ-ের দাবি তোলা হয়। ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্টদের ব্যানারে শাহবাগের চত্বরে শুরু হয় আন্দোলন। ধীরে ধীরে এই আন্দোলনে নামে জনতার ঢল। ছাত্র, শিক্ষক, বিশিষ্টজন, সাংস্কৃতিক কর্মী, পেশাজীবী, রাজনীতিক সবাই এসে সংহতি জানান গণজাগরণের আন্দোলনে। আন্দোলনের জোয়ার গিয়ে আচড়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। দেশ পেরিয়ে বিভূঁইয়েও গণজাগরণ দোলা দেয় প্রবাসী বাঙালি হৃদয়ে। তখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে কোনো রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আবেদনের কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু তুমূল আন্দোলনের মুখে ১৭ ফেব্রুয়ারি সেই আইন জাতীয় সংসদ সংশোধন করে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ রাখা হয়।
গণজাগরণের আন্দোলন থেকে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধেরও দাবি তোলা হয়। ঠিক ওই পরিস্থিতিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে কট্টর ইসলামী দল হেফাজতে ইসলাম। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের নাস্তিক দাবি করে সরকারের কাছে তাদের বিচার দাবি করতে থাকে সংগঠনটি। গণজাগরণ মঞ্চে ইসলাম বিরোধী কর্মকা- হচ্ছে- এই অভিযোগ এনে তা বন্ধে তাদের দাবি জানায় এবং দাবি মানা না হলে দেশজুড়ে গণআন্দোলনের মুখে সরকার পতনেরও হুমকি দেয় কট্টপন্থি এই ইসলামী গোষ্ঠীটি। এরকিছু দিন পরই খুন হন গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার রাজিব। এ ঘটনায় ক্ষোভ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে গোটা দেশ। রাজিবের পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে তার বাড়িতে ছুটে যানে প্রধানমন্ত্রী নিজে।
এদিকে দাবি আদায়ে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনও ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে শুরু করে। গত এপ্রিল ও মে মাসে হফোজতে ইসলামের দুটি সমাবেশ থেকে অভিযোগ তোলা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ শাহবাগের ‘নাস্তিক’দের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। এ নিয়ে হরতালর দিয়ে বসে হেফাজত। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৫ মে ঢাকা ঘরোও কর্মসূচি ঘোষণা করে এবং শেষ মুহূর্তে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ ডাকে হেফাজত। পরে শর্তসাপেক্ষে শাপলায় সমাবেশের অনুমতিও পায় হেফাজতে ইসলাম। ঐ সমাবেশে বিপুল সংখ্যক লোকের সমাগম ঘটে, গোটা মতিঝিল লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। সন্ধ্যার আগে সমাবেশস্থল ত্যাগ করার কথা থাকলেও পরে তারা বঁেকে বসে এবং সমাবেশ থেকে নাস্তিকদের শাস্তি ও ইসলাম বিরোধী কর্মকা- বন্ধের পাশাপাশি শেখ হাসিনার পদত্যাগও দাবি করে বসেন হেফাজত নেতারা। ওই সময় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটও সরকার পতনের আন্দোলন করছিল। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নিজে দলের নেতাকর্মীদের শাপলা চত্বরে হেফাজতকে সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন। বিকাল থেকেই গোটা গুলিস্তান রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বাড়াতে মৃত্যুর মিছিল। গোটা গুলিস্তান, পল্টন, মতিঝিল, নয়াপল্টনসহ বায়তুল মোকাররম এলাকায় আগুন জ্বলতে থাকে। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে সরকার। উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। মধ্যরাতের পুলিশি অভিযানে শাপলা চত্বর থেকে পিছু হটে হেফাজত। পরে বিএনপি ও হেফাজতের নেতারা দাবি করেন ওই রাতে অভিযানের নামে পুলিশের গুলিতে আড়াই থেকে তিন হাজার মানুষ মারা গেছেন। বিরোধী দলের এ অভিযোগ নিয়ে সরকারও বিপাকে পড়ে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বিষয়টা নানাভাবে আসতে থাকে।
সরকারবিরোধী আন্দোলন নতুন বাঁক নেয়। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার এ নিয়ে একটি প্রতিবেদনও বের করে। যেখানে শাপলা চত্বরে পুলিশের অভিযানে বিপুল হতাহত হয়েছে বলে দাবি করা হয়। অথচ সরকার ও পুলিশের তরফে দাবি করা হয় ওই রাতে পুলিশি অভিযানে একজন লোকও মারা যায়নি। অসত্য তথ্য প্রচার করায় গ্রেপ্তার করা হয় অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমানকে। এ নিয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে।
এছাড়া হেফাজতে ইসলামের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকেও গ্রেপ্তার করে পুলিশি হেফাজতে নেয়া হয়। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। পুলিশের শাপলা অভিযান নিয়ে নানা অপপ্রচারের রেশ টানতে হয় সরকারকে। এর প্রভাব গিয়ে পড়ে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে একচেটিয়া জয় পান বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা। নির্বাচনের এই ফল কিছুটা চিন্তায় ফেলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের।
অবশেষে সরকারের আপিলের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় মৃত্যুদ- দেয়। তারপর শুরু হয় ক্ষণ গণনা। ১০ ডিসেম্বর হঠাৎ করেই ঘোষণা আসে রাত ১২টা এক মিনিটে কার্যকর হচ্ছে কাদের মোল্লার ফাঁসি। স্বরাষ্ট্র ও আইন প্রতিমন্ত্রী দু’জনে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দেন। এজন্য সব ধরনের প্রস্তুতিও শেষ করে আনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। কাদের মোল্লার পরিবারের সঙ্গে শেষ দেখারও ব্যবস্থা করে দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে নতুন নাটকীয়তার জন্ম হয়। কাদের মোল্লার আইনজীবীরা ছুটে যান চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হাসানের বাসায়। সেখান থেকে রায় কার্যকরের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে কারাগারে পৌঁছান আইনজীবীরা। তখন রাত ১২টা বাজতে বাকি ছিল এক ঘণ্টা।
পরে সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ আদালতে কাদের মোল্লার রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হয়। দু’দিন শুনানি শেষে আপিল বিভাগ কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদনটি খারিজ করে দেয়। এর মধ্যে ফাঁসি কার্যকরের সব বাধা দূর হয়ে যায়। এবার পূর্ব থেকে কোনো ঘোষণা না দিয়ে ১২ ডিসেম্বর রাত ১০টা এক মিনিটে কার্যকর করা হয় কাদের মোল্লার মৃত্যুদ-। ফাঁসি কার্যকরের ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মরদেহ নিয়ে রওনা দেয়া হয় ফরিদপুর সদরপুরের আমিরাবাদ গ্রামের উদ্দেশে। ওইদিন ভোর রাতে কাদের মোল্লার পরিবারের কাছে তুলে দেয়া হয় মরদেহ। দাফনও সম্পন্ন হয় দিনের আলো ফুটে ওঠার আগেই।
কিন্তু সেখানে থেমে থাকেনি সবকিছু। জামায়াত-শিবির আগেই ঘোষণা দিয়েছে কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়া হলে ৫৫ হাজার বর্গমাইল জ্বালিয়ে দেয়া হবে। ঘোষণা অনুযায়ী ১২ ডিসেম্বর রাত থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় সহিংসতা শুরু করে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্র্মীরা। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর এ পর্যন্ত জামায়াত-শিবিরের সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন সাতজন। শত শত বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। এখনো চলছে সহিংসতা। এদিকে ফাঁসির প্রতিবাদে রবিবার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালও ডেকেছে সংগঠনটি।
(ঢাকাটাইমস/ ১৪ ডিসেম্বর/এইচএফ/এআর/ ১২.০৮ঘ.)