ঢাকা: দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪২ বছর হতে চললো। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দীর্ঘ এই সময়ে হয়েছে অনেক গবেষণা, এখনও হচ্ছে। পাতার পর পাতা ইতিহাসও লেখা হয়েছে। কিন্তু এখনও যদি জানতে চাওয়া হয় দেশে কতগুলো বধ্যভূমি রয়েছে? আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এর সঠিক হিসাব পাওয়া কঠিন।
এখনও অনেক জায়গায় মাটি খুঁড়লে মেলে মানুষের মাথার খুলি। শিশুর ছেড়া জামা ও নারীর শাড়ির ছেড়া অংশ। বাঙালি সেনার রঙচটা ইউনিফর্মও মাটি খুঁড়ে পাওয়া যায়। শহীদদের পরিবারের চোখের জল এখনও শুকায়নি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্ন নিয়ে বধ্যভূমি পড়ে আছে অবহেলায়, অনাদরে। সারা বাংলার মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অরক্ষিত এমন অনেক বধ্যভূমি। যেখানে গড়ে উঠেছে বসতবাড়ি, দোকানপাট। বধ্যভূমির পাশের দেয়ালে উঠেছে কাঁটালতা। জমেছে সবুজ শেওলা।
২০০৮ সালে বধ্যভূমি উদ্ধারের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি উদ্যোগ নেয়া হয়। এ প্রকল্পের নির্ধারিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭১ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ২০১৩ সালের মধ্যে। কিন্তু এখনও শেষ হয়নি কাজ। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে মিলেছে এসব তথ্য।
সরকারি হিসাবে ২০৯ টি বধ্যভূমি ও গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ শনাক্ত করেছে ১৯৩টি। বেসরকারি সংস্থা ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং এর মতে সারা দেশে পাঁচ হাজার বধ্যভূমি রয়েছে। এর মধ্যে ৯২০টি বধ্যভূমি শনাক্ত করা গেছে। প্রণয়ন করা হয়েছে একটি মানচিত্র।
জানা গেছে, সরকারি উদ্যোগে প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় প্রথমে দেশের ১৭৬টি বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে পরে ১২৯টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ এবং সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এর ব্যয় ধরা হয় ৫১ কোটি টাকা। প্রাথমিকভাবে মাত্র ৩৩টি বধ্যভূমিতে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়। ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির মাঠ পর্যায়ের গবেষণা ও জরিপ থেকে জানা যায় দেখভাল ও নজরদারির অভাবে ইতিমধ্যে ২৮টি বধ্যভূমি ও গণকবর দখল হয়ে গেছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন ২৯টি বধ্যভূমির খোঁজ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৪৭টির জন্য জমি টাকা দিয়ে কিনতে হবে। গড়ে প্রতিটি জমির জন্য ১০ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি বধ্যভূমির গায়ে লেখা থাকবে ‘মুক্তিযুদ্ধের গৌরব গাথা’।
এদিকে বধ্যভূমির জেলাওয়ারি হিসেবে সরকার বলছে, ঢাকা জেলায় আটটি। রাজবাড়ী জেলায় তিনটি, ফরিদপুরে চারটি, নরসিংদিতে চারটি, মুন্সিগঞ্জে পাঁচটি, টাঙ্গাইলে দুটি, শেরপুরে দুটি, কিশোরগঞ্জে ১১টি, ময়মনসিংহে নয়টি এবং মানিকগঞ্জ, শরীয়তপুর ও গাজীপুরে একটি করে বধ্যভূমি রয়েছে। এছাড়া জয়পুরহাটে পাঁচটি, নওগাঁয় সাতটি, রাজশাহীতে তিনটি, নাটোরে ছয়টি, পাবনায় একটি, বগুড়ায় চারটি, রংপুরে দুটি, লালমনির হাটে একটি, গাইবান্ধায় নয়টি, পঞ্চগড়ে চারটি, ঠাকুরগাঁয়ে চারটি, নীলফামারীতে ছয়টি, দিনাজপুরে একটি, চট্টগ্রামে ১১টি, সুনামগঞ্জে একটি করে বধ্যভূমি রয়েছে।
এদিকে এলাকার প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, ঢাকার কল্যাণপুর বাস ডিপোতে একটি বধ্যভূমি ছিল তার কোনও চিহ্ন এখন আর নেই। চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর আমবাগানে ও ফয়েস লেকের ভেতর ছিল বধ্যভূমি। খুলনার চুকা নগর ও সিলেট কলেজ সংলগ্ন বধ্যভূমি অন্যের দখলে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. শামসুজ্জোহা হলের পেছনে, রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমি সংলগ্ন এলাকায়ও বধ্যভূমি ছিল।
বেসরকারি জরিপে ঢাকা বিভাগে ২৭০টি, ঢাকা জেলায় ৭০টি, রাজশাহী বিভাগে ২১২টি, চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগে ১১৬টি, সিলেট বিভাগে ৭৪টি ও বরিশালে ৪১টি বধ্যভূমি রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক আফসান চৌধুরী বলেন, ‘সারা বাংলাদেশই তো বধ্যভূমি। এমন কোনো লোকালয় নেই যেখানে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যাকা- চালায়নি।’
চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর আমবাগান বধ্যভূমির আংশিক দখল হলেও হাইকোর্টের রায়ে সেখানকার নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে। এখানে দুই একর জায়গাজুড়ে একটি বধ্যভূমি ছিল। এখানে গড়ে উঠেছে ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) জিয়া বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন ইনস্টিটিউট ভবন নির্মাণ করছে। আর যেখানে সরকার স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করতে চায় সেখানে ছিল ঝর্ণা। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) একেএম শফিউল্লাহের নেতৃত্বে ৭ সদস্যের ওই কমিটি একটি প্রতিবেদন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বধ্যভূমির জন্য ২০ শতাংশ জমি দিয়েছি। কিন্তু কমিটি বলেছে এখানে ঝর্ণা ছিল। জমি দিতে হবে।
এ বধ্যভূমি রক্ষার জন্য শিক্ষাবিদ জাফর ইকবাল ও অন্যরা রিট করেন। আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করে। এতে রয়েছেন জেনারেল শফিউল্লাহ, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসির মামুন, মাহফুজুর রহমান, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি, ইউএসটিসির রেজিস্ট্রার ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সৈয়দ মুজবুল হক।
পরিত্যক্ত এসব বধ্যভূমি সম্পর্কে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বলেন, বধ্যভূমি জাতীয় সম্পদ। দেশপ্রেমিক মাত্র একে রক্ষা করা মহান দায়িত্ব। বাংলাদেশের বধ্যভূমিগুলো যে অবস্থায় যেখানে রয়েছে, তা অবিকল রেখে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমরা উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেছি। আদালত আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছে। তবু বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষিত হচ্ছে না। এর জন্য বাঙালির ইতিহাস বিমুখতাও দায়ী।’
(ঢাকাটাইমস/ ১৪ ডিসেম্বর/ এইচএফ/ ১৬.৩৩ঘ.)