logo ০২ মে ২০২৫
ম্যারেজ মিডিয়া: ঘটকালির নামে প্রতারণা

বিলকিছ ইরানী, ঢাকাটাইমস
১০ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:০৪:০২
image


ঢাকা: যশোরের বাসিন্দা আবদুল মালেক। যেতে চান বিদেশে। যোগাযোগ করলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। তারাই পরামর্শ দিল, সে দেশে থাকে এমন কাউকে বিয়ে করে চলে যেতে। পাত্রীও আছে তাদের কাছে। এ জন্য টাকা লাগবে পাঁচ লাখ।

এর মধ্যে মেয়েও দেখানো হয় মালেককে। পরে নানা কথা বলে ধাপে ধাপে আড়াই লাখ টাকা নেওয়া হয় তার কাছ থেকে। শেষে মালেক বুঝতে পারেন, প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন তিনি। দেন মামলা ঠুকে।

মালেকের অভিযোগ পেয়ে ২০১৩ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর এই কথিত ম্যারেজ মিডিয়াতে অভিযান চালায়। রাজধানীর শ্যামলী ও আফতাবনগরে তাদের দুটি শাখা আছে। দুটি কার্যালয়েই যায় পুলিশ। আটক হয় মোট আটজন। এদের মধ্যে চারজন নারী। এদেরকে কনে হিসেবে দেখিয়ে মালেকের মতো লোকদের কাছ থেকে নানা কৌশলে আদায় করা হয় টাকা।  

পুলিশের অভিযানে দুটি কার্যালয় থেকে একটি যুক্তরাষ্ট্রের, একটি যুক্তরাজ্যের এবং দুইটি কানাডার নকল ভিসা উদ্ধার করা হয়। আরও পাওয়া যায় নকল কাবিননামা ও নোটারি পাবলিকের স্ট্যাম্প। এই মামলা তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু আটক হওয়া আটজনের মধ্যে এরই মধ্যে জামিন পেয়ে উধাও হয়ে গেছেন ছয়জন।

মালেকের মতো এভাবে প্রতারিতের সংখ্যা কম নয়। প্রতিদিন দেশের সব কটি প্রধান দৈনিকেই পাত্র এবং পাত্রী চেয়ে দেওয়া হয় বিজ্ঞাপন। বিয়ের ঘটকালির জন্য এ রকম কথিত ‘ম্যারেজ মিডিয়া’ আছে শত শত। আর তাদের কাছে প্রতারিত হয়ে লজ্জায় কাউকে বলে না বেশিরভাগ মানুষ। মালেকের মতো কেউ কেউ মামলা করলেও তার সুরাহা হওয়ার উদাহরণ বিরল। আটক হলেও পরে মুক্তি পেয়ে আবার প্রতারণায় জড়ানোর উদাহরণ আছে ভুরি ভুরি।  

তবে প্রতারকদের ভিড়ে আছে ভালো ম্যারেজ মিডিয়াও। কিন্তু শত শত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনটা আসল আর কোনটা নকল, তা যাচাই বাছাই করা মানুষের পক্ষে খুব কঠিন হয়। এমনকি একই ব্যক্তির বিরুদ্ধে একাধিক নামে একাধিক এলাকায় প্রতিষ্ঠান খোলার অভিযোগও আছে।

বিয়ের ঘটকালি করার এই ব্যবসা আছে প্রায় দেশেই। পশ্চিমা বিশ্ব, এমনকি আশপাশের বিভিন্ন দেশেও বেশ জমজমাট এই ব্যবসা। কাজের চাপের কারণে যারা বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজতে সময় পান না, তাদের জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলো বরং সুবিধা করে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতারণার কারণে আসলরাও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠিত ঘটকদের একজন ‘পাখি ভাই’ মুঠোফোনে কথা বলতে চাননি। তবে তিনি ম্যারেজ মিডিয়ার প্রতারণার বিষয়টি অসত্য নয় বলেও স্বীকার করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাশেদা ইরশাদ নাসির বলেন, ‘ঘটকালি সব সময়ই ছিল। বিষয়টির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছে ম্যারেজ মিডিয়াগুলো। আধুনিক জীবনের নানা জটিলতার কারণে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ প্রয়োজনীয়ই হয়ে উঠেছে। এই প্রতারণা রোধ করতেই হবে। আমাদের নিজের ওপর পড়ছে না বলে হয়তো আমরা কিছু বলছি না। কিন্তু বিপদে পরিনি বলে চুপ করে থাকলে এক সময় হয়তো আমরাও বিপাকে পড়বো’।





প্রতারণার কৌশল: মূলত বিদেশি পাত্র-পাত্রীর কথা বলেই টাকা হাতিয়ে নেয় এসব কথিত ম্যারেজ মিডিয়া। কিন্তু টাকা দেয়ার পর শত চেষ্টা করেও আর যোগাযোগ করতে পারেন না প্রতারিতরা। প্রায়ই ফায়দা হাসিল করে ফোন নম্বর আর ঠিকানা পাল্টে ফেলে কথিত ম্যারেজ মিডিয়াগুলো।

বিজ্ঞাপন দেখে সাধারণ মানুষ মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তাদের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। এদের মধ্যে পাত্রের সংখ্যাই বেশি। সুদর্শন কিছু তরুণী জোগাড় করে রাখে এসব প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করা হলে তাদেরকে কথিত পাত্রীর জাল ভিসা ও পাসপোর্ট দেখানো হয়। রেস্টরেন্ট বা অন্য কোথাও মেয়ে দেখানোর ব্যবস্থাও করা হয়। কখনও কখনও ভূয়া বিয়ের আয়োজনও করে প্রতিষ্ঠানগুলো।

প্রতারণার শিকার একজন জানান, ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে একটি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেখে তিনি যোগাযোগ করেন। তারপর তারা পাত্রীকে দেখানোর কথা বলে একটি জীবন বৃত্তান্ত নেয়। তিন-চারদিন পর ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা তাকে আমেরিকা প্রবাসী এবং পোশাক কারখানার মালিক পরিচয় দিয়ে ঋদিতা জামান নামের এক পাত্রীর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেয়।

সেদিনের কথাবার্তার পর ওয়াজিউল ইসলামকে বিয়ে করতে রাজি হন ঋদিতা। সপ্তাহ দুই পর বিয়ের পরে ফেরত দেয়ার আশ্বাস দিয়ে পাত্রের কাছে ৩০ হাজার টাকা ধার চান কথিত পাত্রী। টাকা ধারও দেন ওয়াজিউল। একমাস পর ঋদিতা এবং ম্যারেজ মিডিয়ার লোকজন বিয়ের খরচ হিসাবে তার কাছে দেড় লাখ টাকা চায়। এরপর সন্দেহ জাগে ওয়াজিউলের মনে। ঘটনাটি গোয়েন্দা পুলিশকে জানান তিনি। এরপর প্রতারণার বিষয়টি বের হয়ে আসে। কিন্তু টাকা আর ফেরত পাননি প্রতারিত ওয়াজিউল।

এসব কথিত এক পাত্রী জানান, একবার দেখা করলেই এক হাজার টাকা পান তারা। আর পাত্রের কাছ থেকে বড় অংকের টাকা আদায় করতে পারলে সে থেকেও ভাগ পান তিনি।

একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপানো বিজ্ঞাপন দেখে অন্তরা মিডিয়া নামে একটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করা হলে ফোন ধরে নিজেকে সাইদুল ইসলাম নোমান বলে পরিচয় দেন। প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে ছিল খিলগাঁওয়ে। পরে আরও দুই জায়গায় কার্যালয় স্থানান্তর করা হয়। এখন গুলশান-১ এর নিকেতনের ডি ব্লকের ৬ নম্বর সড়কের ২১ নম্বর বাড়িতে করা হয়েছে কার্যালয়টি। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও ঘটক হচ্ছেন শাহনাজ পারভীন নামে একজন নারী।

কেন এতোবার প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা পাল্টানো হলো- জানতে চাইলে কোনো জবাবই দিতে পারেননি সাইদুল ইসলাম নোমান। তিনি জানান, কেউ বিয়ে করতে চাইলে আগে ১০ হাজার টাকা দিয়ে নিবন্ধন করতে হয়। আর বিয়ের পর দিতে হয় ৫০ হাজার টাকা। পাত্রপাত্রী কীভাবে যোগাড় করেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাত্রপাত্রীরাই নিবন্ধন করেন সেখানে।  

একই বাড়িতে আছেন আরও বেশ কয়েকটি ম্যারেজ মিডিয়া। মাহী নামে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান ঘটকের নাম সানি। ফোন ধরেন মাহী নামের একজন। তিনি জানান, তার প্রতিষ্ঠানে নিবন্ধন ফি দুই হাজার টাকা। আর বিয়ের পর দিতে হয় ৩০ হাজার টাকা।

ধানম-ি শংকর এলাকায় একটি প্রতিষ্ঠানের নাম কাবিন। এর উদ্যোক্তা আতাউল্লাহ বাবুল। তিনি বলেন, ‘আমরা লোক বুঝে টাকা নেই। এক হাজার টাকা থেকে শুরু করে যার যাছে যেমন নেয়া যায় তেমনই নেই’।

এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই কোথায় পাত্র-পাত্রীর খোঁজ পান, সে তথ্য জানাতে রাজি হননি।   

পাত্রের অভিভাবক হিসেবে ফোন করলে তিনটি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা কথা বললেও পরে সাংবাদিক হিসেবে যোগাযোগ করলে কথা বলতে রাজি হননি।

আবার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলেও শনিবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানকে। কারও কারও নম্বরও পাওয়া গেছে বন্ধ।

একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশকে মাসোহারা দিয়েই চলে তাদের কার্যক্রম। স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীদেরকেও ‘ম্যানেজ’ করতে হয় বলেও জানিয়েছেন তারা। এ কারণেই প্রতারণার দায়ে সাজা পাওয়ার বিষয়টি বিরল।  

এখন অনলাইনেও চালু হয়েছে ব্যবসা: তবে সবকটি ম্যারেজ মিডিয়ার বিরুদ্ধে যে প্রতারণার অভিযোগ করে এমন না, কিছু কিছু নামীদামী প্রতিষ্ঠানও আছে। ইদানিং অনলাইনেও নানা পেজ খোলা হয়েছে যেখানে পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে।

তবে আসলের ভিড়ে ভূয়ার সংখ্যাই যে বেশি তা এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরাও স্বীকার করেন। একটি প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি এসব প্রকাশ করলে চাকরি চলে যাবে। এসব প্রতিষ্ঠান পাত্র-পাত্রী দেখানোর নাম করে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে তারা তাদের ঠিকানা পরিবর্তন করার সাথে সাথে প্রতিষ্ঠানের নামও পাল্টে ফেলে। প্রতারিতরা এসে দেখে ঐ ঠিকানায় কেউ নেই। এরা বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পরলেও মুচলেকা দিয়ে আবার ব্যবসা শুরু করে’।

(ঢাকাটাইমস/১০এপ্রিল/বিআই/জেএস)