ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক হত্যাকাণ্ডের পর নানা কারণে আলোচনায় উঠে এসেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ (ফেনী-২) জয়নাল হাজারী।আলোচিত একরাম হত্যাকাণ্ড, রক্তাক্ত জনপথ, ফেনীর রাজনীতি নানা বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন ঢাকাটাইমসের সঙ্গে। ফেনীর এক সময়ের গডফাদার হিসাবে খ্যাত জয়নাল হাজারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাবিবুল্লাহ ফাহাদ ও তানিম আহমেদ।
ঢাকাটাইমস: নিজাম হাজারীর হঠাৎ উত্থান এবং তিনি এক সময় আপনার ঘনিষ্ট ছিল বলে এলাকাবাসী মনে করতো। আপনার সাথে বিরোধিতা শুরু কখন?
হাজারী: ২০০১ সালে আমি যখন আত্মগোপনে ছিলাম, তখন ফেনীর রাজনীতিতে একটা মহল আমার বিকল্প খুঁজতে শুরু করে। তখন তারা নিজাম হাজারীকে মদদ দিতে থাকে। তারপর তাকে দলের পদ দেয়া হল। মেয়র পদে নমিনেশন দিল। এরপর ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বানালো। ওই পদে আমি ছিলাম। দেশে ফেরার পর পদ-পদবি আর ফিরে ফেলাম না। নিজামের আধিপত্য বেড়ে গেল। আধিপত্য এবং প্রভাব ধরে রাখার জন্য আমার অনুসারীদের মামলা-হামলা করে হয়রানি করতে লাগল। কাউকে বিদেশে পাঠিয়ে দিল, অনেকে এখন জেলখানায় আবার অনেকেই একেবারে চুপ হয়ে গেছে।
ঢাকাটাইমস: নিজাম হাজারীর শক্তির মূল উৎস কি?
হাজারী: তার শক্তির মূল উৎস বিপুল পরিমাণ অস্ত্র্। আর যেহেতু প্রশাসন তার পক্ষে। ঢাকা থেকে প্রশাসনকে বলে দেয়া হচ্ছে, ও যেভাবে যা বলবে তাই করতে হবে। এটাই হল তার ক্ষমতার মূল উৎস।
ঢাকাটাইমস: নিজাম হাজারী একরাম হত্যাকান্ডে আপনাকেই দায়ী করেছেন। এ ব্যাপারে আপনি কি বলবেন।
হাজারী: মানুষের দৃষ্টি অন্য জায়গায় নিতে আর নিজেকে বাঁচানোর জন্যই সে (নিজাম হাজারী) এ মিথ্যা অভিযোগ করেছে। সত্য কথা হলো ফেনীর আকাশ বাতাস জানে নিজাম ছাড়া কেউ একরামকে খুন করার ক্ষমতা রাখে না। একরামকে কারা খুন করেছে সে তথ্য আস্তে আস্তে বের হতে শুরু হয়েছে। মানুষ মুখ খুলতে শুরু করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ ঘটনায় আজ (শুক্রবার) তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের মধ্যে আদিব নামে যাকে র্যাব ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে সে নিজামের মামাতো ভাই। মূলত সেই-ই একরামকে সর্বপ্রথম গুলি করে।
ঢাকাটাইমস: এমপি নিজাম হাজারী কেন একরামকে খুন করবে?
হাজারী: কারণ নিজামের অনেক কু-কর্মই একরাম জানত। বিশেষ করে গত ৯ ও ১০ মে প্রথম আলো পত্রিকায় সাজার মেয়াদ দুই বছরের আগেই নিজাম হাজারী জেল থেকে বের হয়ে এসেছে- এ খবরের তখন একরামই সরবরাহ করেছে এমন সন্দেহ ছিল নিজামের। মূলত এ তথ্য ফাঁসের ঘটনার সন্দেহ থেকেই একরামকে খুন করেছে নিজাম। এ ছাড়া টেন্ডার ও দলীয় কিছু ব্যাপার তো আছেই।
ঢাকাটাইমস: একরাম হত্যাকাণ্ডের জন্য বিএনপি নেতাদের নামে মামলা হয়েছে। এ ব্যাপারে আপনি কি বলবেন।
হাজারী: তাদের সে শক্তি নেই। নিজাম ছাড়া এ ধরনের ঘটনা ঘটানো দূরের কথা, আওয়ামী লীগের কোনো কর্মীকে একটা থাপ্পড় দিবে এ শক্তি বা সাহস বিএনপি-জামায়াতের নেই। যেখানে একরামকে হত্যা করা হয়েছে সেটি একশ ভাগ আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রিত এলাকা। এখানে বিএনপি-জামায়াত ঘটনা ঘটাবে তা সম্ভব না।
ঢাকাটাইমস: একরাম হত্যাকাণ্ডে তার ভাই বিএনপি নেতাদের নামে মামলা করেছে কেন?
হাজারী: একরামের ভাই নিজেই বলেছে আওয়ামী লীগের জেলা আইন সম্পাদক একটা কাগজ দিয়ে আমাকে বলেছিল এখানে স্বাক্ষর করার জন্য। আমি বাধ্য হয়ে স্বাক্ষর করেছি। আমি কাউকে আসামি করিনি। একারণেই মাহতাব উদ্দিনকে আসামি করা হয়েছিল।এ মামলায় তার ভাইকে জোর করে বাদী করা হয়েছিল।
ঢাকাটাইমস: প্রধানমন্ত্রীও তো এ হত্যাকাণ্ডের জন্য বিএনপিকে দায়ী করেছেন।
হাজারী: নেত্রীকে ভুল বুঝানো হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি প্রকৃত ঘটনা কিভাবে জানবেন-সময়েরও তো ব্যাপার আছে।
ঢাকাটাইমস: নিজাম হাজারী তো এক সময় আপনারই অনুসারী ছিল।
ঢাকাটাইমস: নিজাম হাজারীর উত্থান সম্পর্কে কিছু বলুল। সে তো আপনার অনুসারী ছিলো।
হাজারী: আমার অনুসারী কি, সে তো আমার ড্রাইভার ছিল। চিটাগাংয়ে ক্রিমিন্যালি করত। সেখান থেকে আমি তাকে ড্রাইভার করি, পরে বডিগার্ড। সে খুবই ধূর্ত। সে যে এরকম হবে তা জানা ছিল না।
ঢাকাটাইমস: এরআগে আপনি বলেছেন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই ফেনী থেকে আপনি দুরে আছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ এমন ছিল কেন? বলা হয়, দলের জন্য আপনার অনেক অবদান রয়েছে। তারপরও আপনার এ অবস্থা কেন?
হাজারী: দূরে রাখার কারণ আছে। বিশেষ একজন ব্যক্তিকে (আলাউদ্দিন নাসিম) খুশি করার জন্য। সে চায় আমার যাতে আবার উত্থান না হয়। এর অন্যতম একটা কারণ হচ্ছে মিড়িয়া। যেহেতু ২০০১ সালের দিকে প্রথম আলোসহ বেশকিছু মিড়িয়া আমার নামে সত্য-মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে হেয়প্রতিপন্ন (ডিস কালারাড) করেছে।
প্রধানমন্ত্রী প্রথমে আমাকে চুপচাপ থাকতে বলেছিলেন। পরে দলীয় দায়িত্ব দেয়ার কথা থাকলেও তা আর হয়নি। আমি দলীয় কর্মকাণ্ডে আর ফিরতে পারলাম না একজন বিশেষ ব্যক্তির কারণে। কিন্তু তাতেও আমার কোনো দুঃখ নাই। কারণ দলকে ভালোবাসি। কিন্তু এখন ফেনীতে আওয়ামী লীগ বলতে কিছুই নাই। এখন যা আছে তা হল নিজাম হাজারীর গ্যাং। ওই গ্যাং দিয়ে সে আওয়ামী লীগও চালায়। দলীয় ইচ্ছা এখন তার ইচ্ছাই পরিণত হয়েছে। যেমন- এবারের মেয়র পদটা আর আওয়ামী লীগকে সে দিল না। সে দিল জাতীয় পার্টির আলাউদ্দিনকে্।
ঢাকাটাইমস: আপনিতো এখনও ফেনীতে জনপ্রিয় । তারপরও এলাকায় যেতে পারেন না কেন?
হাজারী: এখন অস্ত্রের কাছে সাধারণ মানুষ জিম্মি। এলাকার মানুষ হলেও যদি ২/৩ জন লোক সেখানে বোমা মারা শুরু করে এবং অস্ত্র দিয়ে তাড়া করে তাহলে সেথানে তো থাকা যায় না। বঙ্গবন্ধু যখন নিহত হলেন তখন জনপ্রিয়তায় তুঙ্গে ছিলেন। তখন আমরা জনগণ কি করতে পেরেছি। অন্য সময় বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা থাক বা না থাক যখন তিনি মারা যান তখন তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ছিল। এমনকি জিয়াউর রহমান যখন মারা যায় তখনও তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ছিল। সুতারাং জনপ্রিয়তা এবং নিরাপত্তা এক না। আগে ছিল প্রভাব, এখন আছে জনপ্রিয়তা।
ঢাকাটাইমস: তাহলে কি আপনি নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছেন?
হাজারী: আমি চরম নিরাপত্তাহীনতায় তা প্রশাসনও জানে। আমাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। তাতে যদি তারা সফল হতো তাহলে হয়তো একরামকে হত্যার দরকার হতো না।
ঢাকাটাইমস: তারা আপনাকে মেরে ফেলতে চায় কেন?
হাজারী: তাদের মনের ভিতরে সবসময় ভয় আছে- যে কোনো সময় জয়নাল হাজারীকে নেত্রী ডাক দিতে পারেন। শুধু নেত্রীর সিগনালের অপেক্ষায় আছি কোনো অস্ত্রের দরকার নাই ।শুধু নেত্রী যদি বলে আপনি ফেনীতে যান কাজ করেন- এটাই আমার অস্ত্র। অন্য কোনো অস্ত্রের দরকার হবে না।
ঢাকাটাইমস: প্রধানমন্ত্রী বললেই কি আপনি আগের অবস্থান তৈরি করতে পারবেন?
হাজারী: প্রধানমন্ত্রী বললে ফেনীতে আমার অবস্থান আগের চেয়ে শক্ত করতে পারব। আগে আমার প্রভাব ছিল কিন্তু জনপ্রিয়তা ছিলনা। এখন জনপ্রিয়তা আছে, কিন্তু সেই প্রভাববলয় নাই।
ঢাকাটাইমস: আপনার সময় ফেনীর ব্যবসায়ীরা খুব শান্তিতে ছিল। সেটা কেন?
হাজারী: অবিশ্বাস্য কিছু ঘটনা আছে। কেউ বিশ্বাস করবে না। যেমন আমার হাজার হাজার কর্মী ছিল। তাদের প্রতি পরিষ্কার নির্দেশ ছিল কেউ ছিনতাই, লুটপাট করতে পারবে না। কোনো দোকানে বাকী করতে পারবেনা। বাকী করলে বিনা নোটিশে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। তাই আমার কোনো লো্কই তা করতো না। টাইগার বাহিনী ফেণীর ব্যবসায়ীদেরকে শেষ করে দিয়েছিল। সেই টাইগার বাহিনীর সাথে লড়াই করে আমি ব্যবসায়ীদেরকে উদ্ধার করেছি। তারা বলত জয়নাল হাজারীর ব্যপারে কোনো দল নাই। একারণে আমি যতবার নির্বাচন করেছি ততবারই জয়লাভ করেছি। কারণ আমার মূলশক্তি ছিল এই ব্যবসায়ীরা।
ঢাকাটাইমস: শোনা যায়, আপনি জামায়াত-শিবিরের প্রশংসা করেন। কিন্তু কেন?
হাজারী: আমার সময়ে জামায়াত-শিবিরের বিরোধীতা করতে হয়নি। ওরা কোনো কোনো আন্দোলন করতো না। তাই ওদের বিরোধীতা করার কোনো দরকার হয়নি। ১৯৯৬ সালের পর জামায়াত নেতা সাঈদীর ওয়াজ মাহফিল নিয়ে যখন সারাদেশে মারামারি হচ্ছিল তখনও ফেনীতে তিনি প্রোগ্রাম করেছেন। ওই সময় কিছু মুক্তিযোদ্ধা নেতা আমার কাছে এসে বললো, সাঈদীর প্রোগ্রাম করতে দেব না। তখন আমি তাদের বাধা দিতে দেয়নি। আমি এক সংবাদ সম্মেলন করে বললাম, সাঈদী আসতে পারবেন কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারবেন না। সাঈদী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দোয়া করেছিলেন। সেখানো কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়নি।
আমি জামায়াত-শিবিরের প্রশংসা করি কারণ তারা কোনো নেশা করেনা । তারা কেউ ছিনতাই করে না। চুরি ডাকাতি করে না। এজন্য কিছু কিছু নেতা আমার উপর নাখোশ হন। আমি এখনও মনে করি, জামায়াত-শিবিরের লোক অপরাধ জগতে নাই বললেই চলে।
ঢাকাটাইমস: আপনার বিরুদ্ধে খুন-খারাবি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং চাঁদাবাজির অভিযোগ ছিল। সেগুলো পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। আপনি কি বলবেন?
হাজারী: আমি একটি বই লিখেছি। ওই বইতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নির্দেশে আমাদের যে কয়জনকে খুন করা হয়েছিল তাদের সবার ছবি ও জীবনী আছে। লড়াইতো হাতে হয় না। এখন কিন্তু ফেনীতে লড়াই হচ্ছে না। একরামকে হত্যা করতে কোনো লড়াই হয়নি তার উপর সরাসরি আক্রমণ হয়েছে। আমি বিএনপির সাথে লড়াই করেছি । সে লড়াই এ আমাদেরও মারা গেছে, তাদেরও মারা গেছে। আমি কাউকে মেরে ফেলার নির্দেশ দেয়নি। এজন্য হয়তো আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তখন লড়াই করে ফেনীতে আওয়ামী লীগের পতাকা টিকিয়ে রাখতে হয়েছিল। আর এখনতো ফেনীতে নিজাম হাজারীর কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নেই।
ঢাকাটাইমস: বলা হয়, নিজাম হাজারীর উত্থান আপনার হাত দিয়েই। এটা কতটুকু সত্য?
হাজারী: তখন সে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতো চট্রগ্রাম কমার্স কলেজে। সে যখন চট্রগ্রামে বিপদে পড়লো, তখন সে আমার কাছে এসে বললো- ভাই আমি আর চট্রগ্রামে থাকবো না। চট্রগ্রামের মানুষ আঞ্চলিকতায় বিশ্বাস করে, আমি যত কষ্টই করি না কেন তারা আমার কষ্টের মূল্যায়ন করবে না। তাই আমি ফেনীতে চলে এসেছি এখানে রাজনীতি করবো। আমাকে আপনি যে দায়িত্ব দিবেন তা আমি মেনে চলবো। আমি তাকে বলেছিলাম থাক, তবে তাকে কোনো দায়িত্ব দেইনি ।
(ঢাকাটাইমস/ ২৪ মে /টিএ/এএসএ/এআর/ ঘ.)