logo ২০ এপ্রিল ২০২৫
সংসদে মারামারি, গালাগালির সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে চাই: মশিউর রহমান
০২ মে, ২০১৪ ২১:০১:২২
image


ঢাকা: মশিউর রহমান রাঙ্গা। সরকারের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য। সম্প্রতি সচিবালয়ে তাঁর কার্যালয়ে ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সাক্ষাৎকারটি দেন তিনি। কথা বলেছেন পল্লী অঞ্চলের উন্নয়ন, রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারি দল ও বিরোধী দলের ভূমিকা, স্থানীয় সরকারসহ নানা বিষয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বকৃত নোমান

ঢাকাটাইমস: আপনি এই মন্ত্রণালয়ে আসার পর সার্বিক পরিস্থিতি কেমন দেখতে পেয়েছিলেন?

মশিউর রহমান:
এখন যে অবস্থায় আছে, আমি যোগ দেওয়ার সময়ও একই অবস্থায় ছিল। চেষ্টা করছি আরো উন্নত করার জন্য। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়ের জন্য আমি বাংলাদেশের অনেক জায়গায় ঘুরেছি, অনেক জায়গা দেখে এসেছি। আমি মনে করি, দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য এটি একটি ভালো সংগঠন, ভালো প্রতিষ্ঠান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প সংযোজন করেছেন। এই প্রকল্পটি যদি আমরা সাফল্যের সঙ্গে শেষ করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশে দরিদ্র বলতে আর কেউ থাকবে না।

ঢাকাটাইমস: ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের জন্য যে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় তা যথাযোগ্য ব্যক্তির কাছে পৌঁছায় না বলে অভিযোগ শোনা যায়। প্রকৃত দরিদ্র না পেয়ে সরকারি দল সমর্থিত লোকজন পায়। এমন কোনো অভিযোগ আপনার কাছে এসেছে কি না?

মশিউর রহমান:
দেখুন, নিয়ম-অনিয়ম সব প্রশাসনেই আছে, সব জায়গাতেই আছে। কিছু দুর্নীতি, কিছু অনিয়ম সব জায়গাতেই থাকবে। আমাদের এই প্রকল্পটা তো শুধু একজন মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষ এর সঙ্গে জড়িত। সুতরাং কিছু দুর্নীতি তো হতেই পারে। কোনোরূপ দুর্নীতি যাতে না হয় সেজন্য আমি  ভালোভাবে তা পর্যবেক্ষণ করছি। এই প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য আমরা সচেষ্ট। যারাই এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আমরা প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছি। তারা যে রকম দুর্নীতি করছে আমরা তাদের বিরুদ্ধে সে রকম শাস্তির চিন্তা করছি। সার্বিকভাবে এই মন্ত্রণালয়ে আগে যে পর্যায়ে দুর্নীতি ছিল এখন সেই পর্যায়ে নেই। অনেকটা নেই বললেই চলে।

ঢাকাটাইমস: উন্নয়নের জন্য তো বিদ্যুৎ অপরিহার্য। কিন্তু পল্লীবাসীর অভিযোগ, পল্লী অঞ্চলে বিদ্যুৎ থাকেই না বলতে গেলে। বিদ্যুৎ ছাড়া পল্লী উন্নয়ন হবে কীভাবে?

মশিউর রহমান:
বিদ্যুৎ থাকে না বলেই তো সেটা পল্লী। সব পল্লী অঞ্চলে তো দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকার দরকার পড়ে না। বিদ্যুৎ দরকার শহরাঞ্চলে, যেখানে মিল-কারখানা বেশি থাকে। এরপরও আমরা চেষ্টা করছি গ্রামের সব জায়গায় বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। গ্রামে বেশিরভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকে নাÑ এ কথা আমি অস্বীকার করছি না। বিদ্যুতে আমাদের ঘাটতি তো আছেই। যে গরম পড়ছে তাতে বিদ্যুতের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা যখন বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণ করতে পারব, তখন গ্রাম-গঞ্জে আর বিদ্যুতের ঘাটতি থাকবে না। আগের চেয়ে তো এখন বিদ্যুতের ঘাটতি অনেক কমে  গেছে। আগামী দিনে এই ঘাটতি আর থাকবে না।

ঢাকাটাইমস: সরকারি দলের পক্ষ থেকে আপনি কোনো ধরনের অসহযোগিতা পাচ্ছেন কি না? আপনারা তো সংসদে বিরোধী দল...।

মশিউর রহমান:
আমি বিরোধী দলে কোথায়? আমি তো সরকারেরই অংশ। বিরোধী দলে আছে আমার দল জাতীয় পার্টি। আমি সরকারে থাকার কারণে জাতীয় পার্টিতে থাকলেও আমি সরকারের একটি অংশ। আর বিরোধী দল মানেই যে সংসদে মারামারি করতে হবে, প্রধানমন্ত্রীকে গালাগালি করতে হবে- এই সংস্কৃতিটা আমরা পরিবর্তন করতে চাই। দেশকে উন্নয়ন করতে হলে সরকারি দল ও বিরোধী দল উভয়ে মিলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমরা এই সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী। আমরা সেটাই করতে চাই। সরকারি দল যদি কোনো অন্যায় করে, দেশের এবং জনগণের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ করে, আমরা সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিবাদ করব। প্রতিবাদ করে জানিয়ে দেব যে এটা ঠিক হচ্ছে না।

ঢাকাটাইমস: সংসদে বিরোধী দল কি তার যথাযথ ভূমিকা পালন করছে?

মশিউর রহমান:
হ্যাঁ, যথাযথভাবে, সুন্দরভাবে বিরোধী দল নিজেদের ভূমিকা পালন করছে। বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি লিখিতভাবে সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে যে, সরকারের এই এই জায়গাগুলোতে ঘাটতি আছে। এসব জায়গায় সরকারকে আরো মনোযোগী হওয়ার জন্য আমার দল থেকে সবসময় পরামর্শ দিচ্ছি। বিরোধী দলীয় নেত্রী নিজেও চিঠি দিয়েছেন। সুতরাং কেউ যদি বিরোধী দল সম্পর্কে খারাপ কোনো কথা বলে সেটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিরোধী দল তার যা যা ভূমিকা সবই পালন করছে। আমি মনে করি না দেশে বড় কোনো সমস্যা আছে।

ঢাকাটাইমস: আপনি সরকারের অংশ। এই সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে। কাদের মোল্লার ফাঁসিও হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে বিচার প্রক্রিয়ার গতি যেন কমে গেছে? কেন?

মশিউর রহমান:
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে সরকার সরাসরি জড়িত নয়। এই বিচার প্রক্রিয়ার জন্য আলাদা করে ট্রাইব্যুনাল করে দেওয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনালই দেখছে সবকিছু। কাকে ফাঁসি দিতে হবে, কাকে যাবজ্জীবন  দিতে হবে, কাকে ছেড়ে দিতে হবে সব কিছুই ট্রাইব্যুনাল দেখছে। তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন। ট্রাইব্যুনালের কোনো কিছুতে সরকার হস্তক্ষেপ আগেও করেনি, এখনও করছে না, ভবিষ্যতেও করবে না।

ঢাকাটাইমস: কিছুদিন আগে আপনি দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটার অনিয়ম-দুর্নীতি সম্পর্কে বক্তব্য দিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠানটির এখন কী অবস্থা?

মশিউর রহমান:
মিল্কভিটায় দুর্নীতি ছিল। দুধ কেনাবেচা, দুধ সংরক্ষণ, নষ্ট হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে কিছু দুর্নীতি ছিল। এখন দুর্নীতি অনেক কমে গেছে। আগামী দিনে আরো কমে যাবে। আমরা চেষ্টা করছি মিল্কভিটাকে একটা সুন্দর প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশবাসীকে উপহার দিতে। শুধু মিল্কভিটা নয়, সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীন যত প্রতিষ্ঠান আছে সবকটিকেই আমি দুর্নীতিমুক্ত করব ইনশাল্লাহ।

ঢাকাটাইমস: স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়। বাস্তবে কি স্থানীয় সরকার শক্তিশালী? যেমন ধরুন উপজেলা বা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের যতটুকু ক্ষমতা থাকার কথা ততটুকু নেইÑ তারা বিভিন্ন সময় অভিযোগ করে থাকেন। তাদের ক্ষমতা বাড়ানো বা সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য আপনার মন্ত্রণালয় থেকে কোনো পদক্ষেপ বা পরিকল্পনা আছে কি না?

মশিউর রহমান:
উপজেলার জন্য আমাদের মন্ত্রণালয়ে আলাদা একটা বিভাগ আছে। সেখান থেকে তাদের কিছু ক্ষমতা দেওয়া আছে। তারা ওই ক্ষমতাটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে কাজ করতে হবে। মন্ত্রীদেরও ক্ষমতার একটা সীমাবদ্ধতা আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আছে। কেউই সব ক্ষমতায় ক্ষমতাবান নয়। সীমাবদ্ধতার মধ্যেই কাজ করে যেতে হবে। সেখানে সংসদ সদস্য আছেন, একজন চেয়ারম্যান, একজন ভাইস চেয়ারম্যান, একজন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আছেন। সবাই সম্মিলিতভাবে সেখানে কাজ করবেন। এটাই হলো উপজেলা পরিষদের কনসেপ্ট। এভাবেই তাদেরকে কাজ করতে হবে। আপনি দেখে আসলে বুঝতে পারবেন, আগের গ্রাম আর এখানকার গ্রামের মধ্যে অনেক পার্থক্য। স্থানীয় সরকার গ্রাম উন্নয়নের জন্য খুব কাজ করছে। নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করছে তারা। আগামী দিনে গ্রাম আরো পরিবর্তন হবে বলে আমি আশা করি। দারিদ্র্যমুক্ত গ্রাম গড়ে তোলাই আমার স্বপ্ন।

ঢাকাটাইমস: আপনি কেমন বাংলাদেশ চান?

মশিউর রহমান:
আমি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা দেখতে চাই এবং আমরা সেটাই করব ইনশাল্লাহ। বঙ্গবন্ধুর কনসেপ্টগুলোকে আমরা নতুন আঙ্গিকে, নতুন করে বাস্তবায়ন করব।

ঢাকাটাইমস: বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন তো ছিল একটা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, ধর্মীয় সৌহার্দ্য-সম্প্রীতিপূর্ণ বাংলাদেশ। তিনি তো ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেননি...।

মশিউর রহমান:
বাংলাদেশ তো অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রই আছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আমাদের আছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম একটা সময় যেকোনো কারণে করা হয়েছিল। তার মানে এই নয় যে, অন্য ধর্ম কেউ পালন করতে পারবে না। যার যার ধর্ম সে স্বাধীনভাবে পালন করছে, করবে। এই যে কদিন আগে পয়লা বৈশাখ গেল, বাংলাদেশের মানুষ ঈদের চেয়েও বেশি আনন্দ উপভোগ করেছে, আমি দেখেছি। ধর্ম আলাদা ব্যাপার আর বাঙালি হিসেবে আমাদের সংস্কৃতি আলাদা ব্যাপার। আমাদের সংস্কৃতিকে এবারের পয়লা বৈশাখে আমরা গ্রাম-গঞ্জে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছি। এই সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল। তিনি আমাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন এ বিষয়ে। আমরা সুন্দরভাবে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানগুলো বাস্তবায়ন করেছি এবং আগামীতেও করব। আমাদের সংস্কৃতিকে আমরা লালন করব।

আর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম মানে দেশে হিন্দু-বৌদ্ধ বা অন্য ধর্মাবলম্বীরা তাদের ধর্ম পালন করতে পারবে না, তা নয়। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এরশাদ সাহেব করেছেন বিশেষ কোনো কারণে। যখন দেশ স্বাধীন হয়েছিল তখন একটা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল। এরশাদ সাহেব মনে করেছেন তখন ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করতে হবে, তাই করেছেন। এটা তো পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত। এরশাদ সাহেবের একার সিদ্ধান্ত ছিল না। তিনি একা তো কিছু করতে পারেন না। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম লেখা আছে। কিন্তু ‘তবে’ কথাটিও লেখা আছে। ‘তবে’ অন্য ধর্মাবলম্বীরাও তাদের ধর্ম যথাযথভাবে পালন করতে পারবে, কেউ বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না’Ñ এ কথা কিন্তু লেখা আছে। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকার কারণে অন্য ধর্ম নষ্ট হচ্ছে বা সংবিধানের কোনো ক্ষতি হচ্ছেÑ এমন কোনো ব্যাপার আমি দেখতে পাচ্ছি না।

ঢাকাটাইমস: বিএনপি বলছে মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা। শিগগির তারা সরকার পতনের আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন কি?

মশিউর রহমান:
মধ্যবর্তী নির্বাচন একটা সরকারের সিদ্ধান্ত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে কথা বলবেন, সিদ্ধান্ত নেবেন। আমি চাইলেই যে মধ্যবর্তী নির্বাচন হবে এমন নয়। মন্ত্রী পরিষদ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি মনে করেন, দেশের মানুষ যদি মনে করে, তাহলে তিনি মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে পারেন। দেশের মানুষ না চাইলে নির্বাচন হবে কেন? আর আমি তো মনে করি না মধ্যবর্তী নির্বাচনের মতো কোনো পরিস্থিতি বাংলাদেশে বিরাজ করছে।

(ঢাকাটাইমস/ ২ মে/ এসএন/ এইচএফ/ ২০.৫৭ঘ.)