তিনি ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ এর কো-চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ। শিক্ষানীতির বিভিন্ন দিক, সমস্যা ও সম্ভাবনা বিষয়ে তিনি ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মহিউদ্দিন মাহী।
ঢাকাটাইমস: শিক্ষানীতি প্রণয়ন চার বছর অতিবাহিত হতে চলছে। এখনও অনেক কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। বিষয়টি নিয়ে বলুন।
ড. খলীকুজ্জামান: জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা চালু হয়েছে। প্রাথমিকে শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা চালু হয়েছে। ১১৩টি বই নতুন করে তৈরি হয়েছে। ১৭ বছরের পুরানো কারিকুলাম পরিবর্তন করা হয়েছে। শিক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। শিক্ষক নির্বাচন ও উন্নয়ন কমিশনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে।
তবে এসবের মধ্যে অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। আশা করছি খুব শিগগিরই তা বাস্তবায়ন হবে। তবে এক্ষেত্রে প্রসাশনিক কিছু বাধা এখনো রয়েছে। আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষা আইন পাস করানোর জন্য মন্ত্রাণালয় কাজ করে যাচ্ছে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অধিকার বাস্তবায়নের বিষয়টি ইতোমধ্যে শিক্ষা আইনের খসড়ায় প্রাধান্য পেয়েছে। আমরা চেষ্টা চলাচ্ছি যাতে শিক্ষানীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন হয়।
ঢাকাটাইমস: প্রশাসনিক বাধা দূর করতে করণীয় কী বলে আপনি মনে করেন?
ড. খলীকুজ্জামান: জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে প্রশাসনিক বাধা দূর করতে সরকারের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন করতে হবে। আমলারা তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়। আর যেসব বিষয় তাদের স্বার্থের বাইরে সেগুলোকে পাত্তা দেয় না। এসব কারণে বাস্তবায়নে ধীরগতি পরিলক্ষিত হয়। তবে বেশ কিছু বিষয় প্রায় সমাধানের পথে। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, খুব শিগগিরই শিক্ষা আইনের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। সে হিসেবে আমরা আশাবাদী। এটি হলে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের পথে অনেক দূর অগ্রগতি সাধিত হবে। আগামী চার-পাঁচ মাসের মধ্যে আইনটি সংসদে পাস হতে পারে।
ঢাকাটাইমস: গ্রামে বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষার্থী কমছে। বিষয়টি শিক্ষাখাতে অশনি সংকেত। এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
ড. খলীকুজ্জামান: গ্রামাঞ্চলে বিজ্ঞান ও অর্থনীতি বিষয়ে শিক্ষার্থী কমছে। এর পেছনে যৌক্তিক কারণ রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে বিজ্ঞানের ইকুয়েপমেন্ট নেই। ভালো শিক্ষক নেই। এসব কারণে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বিষয় পড়ছে না। এটি আমাদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। তবে এ থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে, গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে বিজ্ঞানের সরঞ্জামাদি দিতে হবে। ভালো প্রশিক্ষক দিতে হবে। তাহলেই শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী হবে। তবে শিক্ষা আইন বাস্তবায়িত হলে অনেকটা অগ্রসর হওয়া যাবে।
ঢাকাটাইমস: অভিন্ন সিলেবাস করার বিষয়ে একটা কথা উঠেছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
ড. খলীকুজ্জামান: এটা কোনোভাবেই সম্ভব না। আমরা সবাইকে কেন ডাক্তার বানাবো। সবাইকে কেন ইঞ্জিনিয়ার বানাবো। সবাইকে কেন উকিল বানাবো। একেক জন একেক লাইনে মাস্টার হবে। অভিন্ন সিলেবাস করার কোনো যুক্তিকতা নেই। দেশে সবধরনের মাধ্যম থাকবে। যেখানে যার ইচ্ছা সেখানে সে পড়বে।
ঢাকাটাইমস: কওমি মাদ্রাসা তো সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এ বিষয়ে কি করণীয়?
ড. খলীকুজ্জামান: কওমি মাদ্রাসা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসবে না। আমি কওমি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেশ কয়েকবার বৈঠক করেছি। তারা বাংলা, ইংরেজিসহ সরকার নির্ধারিত বই পড়াতে চায়। কিন্তু তারা বোর্ডের নিবন্ধন করবে না। সেক্ষেত্রে সরকার কতটা কঠোর হবে তার উপর নির্ভর করছে কওমি মাদ্রাসা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসবে কি না।
ঢাকাটাইমস: শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে আর কি বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
ড. খলীকুজ্জামান: শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আগামী ২০১৪-১৫ অর্থ বছরের বাজেটে ১৫ শতাংশের বেশি শিক্ষাখাতের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে। নির্বাচনের ইশতেহারে সবরকম কথা বলা হয়। কিন্তু শিক্ষা নিয়ে কোনো প্রকার আলোচনা হয় না। শিক্ষা একটি উৎপাদনশীল খাত। এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। তবে আমাদের আশা বেশি থাকলেও বাস্তবতার নিরীখে বেশি বরাদ্দ পাওয়া সম্ভব না। কারণ আমাদের ১৩ শতাংশ হচ্ছে রাজস্ব আয়। সেখান থেকে যদি ৩ শতাংশও শিক্ষায় দেয় তাহলে অন্য খাতের অবস্থা তো বারোটা বাজবে। তাই আমি মনে করি শিক্ষায় যে বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয় সেগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ। আরেকটা বিষয় হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতি শক্ত হাতে দমন করতে পারলে আর কোনো বাধা থাকবে না। আরেকটা বিষয় হচ্ছে শিক্ষা প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। যেটা আমাদের প্রস্তাবনার মধ্যে আছে।
ঢাকাটাইমস: শিক্ষানীতির আলোকে প্রাথমিক স্তরকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেটা নিয়ে তো জটিলতা তৈরি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বলুন?
ড. খলীকুজ্জামান: ২০১০ সালে শিক্ষানীতি চালুর পর প্রাথমিক স্তর অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করতে গত বছরের জানুয়ারি থেকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সারাদেশের ৪৯৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি চালু করেছে। টাকার অভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে একাদশ শ্রেণি চালু করতে পারেনি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এ নীতি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় দেশের ১৩ হাজার ১৪৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দ্বাদশ শ্রেণি চালু করা হলে প্রতিবছর শিক্ষকদের অতিরিক্ত বেতন-ভাতা বাবদ সরকারের ব্যয় হবে ১ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। এছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন ও শিক্ষক প্রশিক্ষণে ব্যয় হবে আরো ৩ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। দেশে মোট এমপিওভুক্ত সাধারণ স্কুল (মাধ্যমিক বিদ্যালয়) আছে ১৬ হাজার ৮৬টি এবং স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে ২ হাজার ৮৫৭টি। এর মধ্যে অবকাঠামো উন্নয়ন ছাড়া শিক্ষানীতির আলোকে কেবল ১৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাধ্যমিক স্তর নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি উন্নীত করা যাবে। এসব প্রতিষ্ঠানে ১ হাজার ৫৩১ জন অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। এতে এমপিও সুবিধা বাবদ প্রতিবছর অতিরিক্ত ব্যয় হবে ২২ কোটি টাকা। অবকাঠামো উন্নয়ন করে আরো ১২ হাজার ৯৮৭টি প্রতিষ্ঠানে দ্বাদশ শ্রেণি চালু করা যাবে। এসব প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে ৭৭ হাজার ২১২ জন। তাদের এমপিও সুবিধা বাবদ প্রতিবছর অতিরিক্ত ব্যয় হবে ১ হাজার ১১১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ১৩ হাজার ১৪৯টি প্রতিষ্ঠানে দ্বাদশ শ্রেণি চালু হলে বছরে শিক্ষকদের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় হবে ১ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে খুব শিগগিরই প্রাথমিক স্তরকে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করা সম্ভব নয়। এটি সময় সাপেক্ষ ও আর্থিক বিষয়।
ঢাকাটাইমস: শিক্ষানীতিতে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। তার অগ্রগতি কতটুকু?
ড. খলীকুজ্জামান: এটার জন্যও শিক্ষা আইন খুবই দরকার। কারণ বর্তমান সংবিধানে আছে প্রাথমিক শিক্ষা দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এটা কোনো শিশুর অধিকার নয়। কিন্তু আমরা শিক্ষা আইনে বলেছি, প্রাথমিক শিক্ষা প্রত্যেকটা শিশুর অধিকার। পাশাপাশি এটার দায়িত্ব সরকারের। তাহলে একজন শিশু যদি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় সে আদালতে যেতে পারবে। বর্তমান বিদ্যমান আইনে সেই সুযোগ নেই। তাই শিক্ষা আইন পাস হওয়া জরুরি। যদিও এটা ধীরগতিতে চলছে।
এছাড়া পুরো শিক্ষা প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর কাজও ধীর গতিতে চলছে। কেননা সরকারি কর্মকর্তারা শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের বিভিন্ন কমিটিতে আছেন। তারা আরো নানা কাজের সঙ্গে জড়িত থাকায় এই নীতির বাস্তবায়ন দ্রুত হচ্ছে না। দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী- যেমন পাহাড়ি ছেলেমেয়ে, চরাঞ্চলের ছেলেমেয়ে ও পথশিশুদের জন্য যদি আমরা বিশেষ কোনো ব্যবস্থা দিতে চাই তাহলে শিক্ষা আইনের দরকার আছে।
ঢাকাটাইমস: আর্থিক যে সংকটের কথা বলা হয়েছে। শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে কি পরিমাণ অর্থের দরকার বলে আপনি মনে করেন?
ড. খলীকুজ্জামান: বিগত মহাজোট সরকারের আমলে ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে দেশে বড় কোনো বিতর্ক ওঠেনি। তীব্র আর্থিক সংকটের কারণে পরবর্তী তিন বছরে ওই শিক্ষানীতির অনেকাংশ বাস্তবায়ন করা হয়নি। জাতীয় সংসদে গৃহীত এটিই দেশের একমাত্র শিক্ষানীতি। এর আগে দেশে ৯টি শিক্ষা কমিশন ও কমিটি গঠিত হলেও কোনোটি কার্যকর হয়নি। জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে গেলে শিক্ষা খাতে বর্তমান বাজেটের অতিরিক্ত ৬৮ হাজার কোটি টাকা লাগবে। এই প্রস্তাব আমরা আগেই দিয়েছি।
ঢাকাটাইমস: ২০১৮ সালের মধ্যে কি শিক্ষানীতি পুরোটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে?
ড. খলীকুজ্জামান: প্রস্তাব অনুযায়ী পুরো শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে ২০১৮ সালের মধ্যে মোট ৬৮ হাজার কোটি টাকা বাড়তি খরচ করতে হবে। শিক্ষাখাতের মোট বাজেট বরাদ্দের ৬৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে। তার ওপর অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হয়। এ দুটি বড় ব্যয় মিটিয়ে নীতি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ হাতে থাকে না। প্রায় ২ লাখ নতুন শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি চালু করতে শ্রেণি কক্ষের সংখ্যা বাড়ানো, কওমি মাদ্রাসার উন্নয়ন, শিক্ষকদের জন্য পৃথক ও সম্মানজনক বেতন স্কেলসহ আনুষঙ্গিক কাজ বাস্তবায়নে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন ও পাশাপাশি এগুলো সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই বাস্তবসম্মত কারণেই ২০১৮ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।
ঢাকাটাইমস: কাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনের পথে কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
ড. খলীজুজ্জামান: আমাদের অর্থনীতির চাকা খুবই শক্তিশালী। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথেও আমরা অনেক এগিয়ে। আমাদের রিজার্ভও বাড়ছে। প্রবৃদ্ধিও বাড়ছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন আমাদের যে অবস্থা বর্তমানে বিরাজমান আছে সেটাকে ধরে রাখা। এ অবস্থা থাকলেই আমরা শক্তিশালি অর্থনীতির পথে এগিয়ে যাবো। সন্ত্রাস আরও শক্ত হাতে দমন করতে হবে। এছাড়া বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিনিয়োগে অন্যদেরকে উৎসাহিত করতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে অর্থায়ন, তথ্য ও প্রযুক্তিগত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
এছাড়া অন্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে- আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত রাখা। হলমার্কের মতো প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও দুর্নীতিমুক্ত থাকতে পারবে। অর্থনীতির চাকা শক্তিশালী হবে।