ঢাকা: “টিম ইঞ্জিন” নামের একটি প্রতিষ্ঠান প্রথমবারের মত সফলভাবে বাংলা ওসিআর তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে । এই ওসিআরের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর অ্যাকুরেসি রেট শতকরা ৯৪ ভাগ যা অন্যান্য ভাষার ওসিআরের থেকেও অনেক এগিয়ে। একইসাথে এর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বিজয় কীবোর্ডে লেখা একটি ইমেজকে ওসিআর করলে ইমেজের কনটেন্ট সরাসরি ইউনিকোড ফরম্যাটে চলে আসবে যা বেশিরভাগ অপারেটিং সিস্টেমে কোনো ধরণের বিচ্যুতি ছাড়াই উপস্থাপিত হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, আইটি সচিব নজরুল ইসলাম খান এই দুটো সফটওয়্যার দুটি উদ্ভাবনে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ লক্ষ্যেই সফটওয়্যার দুটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী এবং ড. জাফর ইকবালের উপস্থিতিতেই শিগগিরই সফটওয়্যার দুটির উদ্বোধন করা হবে।
কথাসাহিত্যিক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এই ওসিআরের স্বপ্নদ্রষ্টা। ওসিআর তৈরি করেছেন এসএম আল-আমিন (সম্রাট) ও তার টিম। টিম ইঞ্জিনের স্বপ্নদ্রষ্টা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামিরা জুবেরি হিমিকা এই বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফের ডটকমের সাথে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কিরণ সেখ।
ঢাকাটাইমস: বাংলা এই ওসিআরে আমরা কি ধরণের সুবিধা পাবো?
সামিরা: ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে শুরু করে অন্য লাইব্রেরিকে অনলাইনে নিয়ে আসার একটি বড় মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে ওসিআর। এছাড়া, সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান যেমন সংবাদপত্র শুধু ডকুমেন্টের ইমেজ ফরম্যাটটি ওয়েবে আপ করে দেয়। গবেষণা বা অন্য প্রয়োজনে কোনো তথ্য সার্চ দিলে ওই ইমেজ ফরম্যাট থেকে তা খুঁজে পাওয়া যায় না। ওসিআর অপটিক্যালি ক্যারেক্টারকে রিড করে পাঠককে এই তথ্যের সন্ধান দেবে।
ঢাকাটাইমস: আপনি পাঠকের কথা বললেন, ব্যাংকের ক্ষেত্রে ওসিআর কি ভূমিকা রাখবে?
সামিরা: এনবিআর, আদালত, ব্যাংক, জমির নিবন্ধন অফিস এ রকম অনেক সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের প্রাত্যহিক অফিসিয়াল কার্যক্রম সম্পাদন করতে অনেক পুরনো ডকুমেন্ট সার্চ করতে হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কোনো বিষয়ে ডকুমেন্ট সার্চ করতে কোড নাম্বার দিয়ে সার্চ করতে হয়। নাম দিয়ে সার্চ করা যায় না। ওসিআর ব্যবহার করে এই সুবিধাটি পাওয়া যায়। ওসিআরের মাধ্যমে ডকুমেন্টের ইমেজকে ওয়ার্ডে কনভার্ট করে অথবা সরাসরি ইমেজ থেকে রিড করে আউটপুট বের করা যাবে।
ঢাকাটাইমস: ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে ওসিআর কতটা সহায়ক হবে?
সামিরা: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি প্রথমেই আন্তঃমন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমকে ডিজিটাইজড করতে চেয়েছিলেন। ডিজিটাইজড করার অনেকে ধাপ রয়েছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো-ডকুমেন্টশন প্রক্রিয়াকে ডিজিটাইজড করা এবং পুরোনো ডকুমেন্টগুলোকে খোঁজায় সহজলভ্য করা। ডিজিটাইজেশনের যে প্রজেক্টটি প্রধানমন্ত্রী করেছেন তার ধীরগতির একটি বড় কারণ ছিল ওসিআর না থাকা ।
ঢাকাটাইমস: উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে ওসিআর নিয়ে আপনাদের সফলতা কি?
সামিরা: বাংলাদেশ সরকার ওসিআর তৈরির জন্য নেপালকে দীর্ঘ আট বছর ধরে অর্থায়ন করে যাচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত নেপাল আশানুরূপ ভূমিকা রাখতে পারেনি। একইসাথে ভারত সরকারকেও সাত বছর ধরে বাংলাদেশ অর্থায়ন করলেও তারা কেবল তাদের হিন্দি ভাষাকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এখন সেই নেপাল, ভারত ও পাকিস্তানই আমাদের তৈরি ওসিআরের জন্য আমাদের প্রতিষ্ঠানের কাছে সহযোগিতা চেয়ে ধর্না দিচ্ছে। সুতরাং এটা আমাদের একটি বিরাট সফলতা।
ঢাকাটাইমস: এ বিষয়ে আপনাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সরকারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়েছে?
সামিরা: আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মহিতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি এবং এই বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। তারা অনেক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে আমাদের কথা শুনেছেন। ভবিষ্যতে সহযোগিতা করারও আশ্বাস দিয়েছেন এবং খুব শিগগিরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওসিআরের শুভ উদ্বোধন করবেন।
ঢাকাটাইমস: সরকারের কাছ থেকে আপনারা কি ধরণের সহযোগিতা আশা করছেন?
সামিরা: সরকারের কাছ থেকে আমরা কোনো আর্থিক সহায়তা চাইনা। তবে আমরা চাই সরকার যে ডিজিটাইজেশনের কথা বলছে, এর সুফল জনসাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে চাচ্ছে, তারই অংশ হিসেবে আমাদের এই ওসিআর বিনামূল্যে প্রতিটি থানা ও উপজেলার স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি থানা সহায়তা কেন্দ্রে পৌঁছে দিক। এছাড়াও যদি কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি ব্যক্তিগতভাবে ব্যাবহার করতে চান, তাহলে তিনি বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারবেন।
ঢাকাটাইমস: ওসিআর বাংলাদেশকে আর কি কি দিতে পারবে?
সামিরা: বাংলা ওসিআর বাজারে আসলে বাংলাদেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী যারা আছেন তাদের একটি বড় ধরণের উপকার হবে। তারা পাঠ্য বই হাতে পান অনেক দেরিতে। বাংলা ভাষায় ব্রেইল বই রয়েছে ৮-৯টি টাইটেলের। অডিও বুক আরও কম। ওসিআর ব্যবহার করে পুরনো বা নতুন বইকে ব্রেইল বইয়ে রূপান্তর খুব সহজেই করা সম্ভব। অডিও বুক করাও সহজতর হবে। বইটি স্ক্যান করেও করা যায় তবে টেক্সট এডিট করতে গেলে ওসিআর তাকে সাহায্য করবে।
ঢাকাটাইমস: ওসিআর ছাড়া আপনাদের আর কি প্রোগ্রাম রয়েছে?
সামিরা: ইংরেজি ভাষায় টেক্সট টু স্পিচ রয়েছে। অন্যান্য ভাষায়ও রয়েছে। বাংলা ভাষায় প্রথম টেক্সট টু স্পিচ নিয়ে আসছে টিম ইঞ্জিন । ইংরেজি টেক্সট টু স্পিচ সফটওয়্যার দিয়েও এই কাজ করা যায় তবে সেক্ষেত্রে বাংলা লেখাকে ইংরেজি অক্ষরে লিখতে হয় যা অনেক জটিল প্রক্রিয়া । কিন্ত বাংলা টেক্সট টু স্পিচ সফটওয়্যার দিয়ে বাংলা লেখা থেকেই বাংলা পড়ে শোনাবে। টিম ইঞ্জিনের তৈরি করা টেক্সট টু স্পিচ সফটওয়্যারটির প্রথম পর্যায়টি শেষ হয়েছে। এটি এখন বাংলা টেক্সটকে ডিটেক্ট করতে পারে এবং পড়তে পারে। । কোথায় থামতে হবে সেটাও বুঝতে পারে। এখন সেখানে ইমোশন নিয়ে আসা হচ্ছে। বাংলা ভাষার টেক্সট টু স্পিচে মেশিন ভাষা নয়, হিউম্যান ভয়েস নিয়ে আসা হয়েছে।
ঢাকাটাইমস: দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিদের কথা বললেন, তাদের জন্য টেক্সট টু স্পিচ কেমন সহায়ক হবে?
সামিরা: অসংখ্য বই অনলাইনে নিয়ে এসে সেগুলোকে ইউনিকোডে সার্চেবল করলেও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের তেমন কোনো উপকারে আসছে না। এই কনটেন্টকে তাদের শোনার উপযোগী করে তুলতে হবে। এখানেই আসে টেক্সট টু স্পিচের গুরুত্ব। দৃষ্টি প্রতিবন্ধিরা এটা থেকে পড়াশুনা এবং গবেষণার জন্য প্রচুর বই এবং তথ্যে সহজেই সাহায্য পাবে। এছাড়া সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে ভ্রমণের সময় বই পড়াটা কঠিন। তখন টেক্সট টু স্পিচ সফটওয়্যারের মাধ্যমে শুনে শুনে খুব সহজেই বইটি সম্পর্কে জানতে পারবেন। এ সফটওয়্যারটি উদ্ভাবন করেন মাসুদ, ফয়সাল, মোনা এবং সাজ্জাদ। সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন অয়ন মিজান। প্রোজেক্ট অ্যাডভাইজার হিসেবে কাজ করেন আশিকুর রহমান অমিত।
ঢাকাটাইমস: ওসিআরের মাধ্যমে আপনারা কি অর্জন করতে চান বা আপনাদের মূল লক্ষ্য কি?
সামিরা: আমরা টিম ইঞ্জিন একটি পরিবারের মতো। বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই আমাদের এই পরিবারের লক্ষ্য। দেশের অগণিত তরুণ ও তরুণিকে ডিজিটাইজড করার মাধ্যমে আমরা দেশকে সমৃদ্ধ করতে চাই। অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন আমাদের কাম্য নয়। তবে সরকার, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সেক্টর এবং জনগণের মাঝে যে দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসন করাই আমাদের মূল লক্ষ্য।
ঢাকাটাইমস: আপনাকে ধন্যবাদ
সামিরা: আপনাকেও ধন্যবাদ
সাক্ষাৎকার: সামিরা জুবেরি হিমিকা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, টিম ইঞ্জিন