মহাজোট সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ছিলেন ঢাকা-১ আসনের (নবাবগঞ্জ-দোহার) আসনের সংসদ সদস্য। ক্ষমতায় থাকতে পাঁচ বছরে তার বিরুদ্ধে উঠেছে নানা অভিযোগ। আর এর প্রভাব পড়েছে তার জনপ্রিয়তায়। জিততে পারেননি বিএনপিবিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এর অংশ হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে দুদক। এসব নিয়ে ঢাকাটাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন আব্দুল মান্নান খান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাবিবুল্লাহ ফাহাদ।
ঢাকাটাইমস: রাজনীতিতে বেশ সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন আপনি। কিন্তু ক্ষমতায় থাকতে ওঠেছে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ। আপনার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। কীভাবে মোকাবিলা করবেন এতো অভিযোগ?
আবদুল মান্নান খান: বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করা একটি মরণব্যাধি। দুদক একটি স্বাধীন সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান। যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো ব্যক্তির সম্পদের অনুসন্ধান করতে পারে। এখানে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। আমি তাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছি।
ঢাকাটাইমস: দুদক কী জানতে চেয়েছে আপনার কাছে?
আবদুল মান্নান খান: দুদক তাদের অনুসন্ধান কাজের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো জানার জন্য সহযোগিতা চেয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে তারা আলোচনায় সন্তুষ্ট হয়েছেন। নির্বাচনের আগে যে হলফনামা দিয়েছি সেটা আমারই দেয়া। সেখানে যে সম্পদের হিসাব দেয়া হয়েছে তা সঠিক।
ঢাকাটাইমস: হলফনামায় দেখা গেছে আপনার সম্পদ শতগুণ বেড়েছে...
আবদুল মান্নান খান: ১৯৮৯ সালে বর্তমান মার্কিন দূতাবাসের সামনে গুলশান থানাধীন ভাটারা মৌজায় আমার নামে পাঁচ কাঠা এবং আমার স্ত্রীর নামে পাঁচ কাঠা জমি কিনি। তার কিছুদিন পরে আরও পাঁচ কাঠা জায়গা আমি কিনেছি। সবমিলিয়ে ১৫ কাঠা জায়গা কিনেছি পানির দামে। তখন ওইখানে যাওয়ার কোনো রাস্তা ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগের উন্নয়ন কর্মকা-ের ফলে সেখানে মাদানী সড়ক তৈরি হয়েছে। যেটা শত ফুট প্রশস্ত। মাদানী সড়কের উত্তরদিকে আমার এই ১৫ কাঠা জায়গা। একেবারেই রাস্তার পাশে। এটি এখন হীরার খনির মতো সম্পদে পরিণত হয়েছে। এটা কি আমার অপরাধ? আইন পেশায় আমার রক্তঘাম করা টাকায় কেনা জায়গা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে; কিন্তু বিচারের আগেই রায় দিয়ে মৃত্যুদ-, কারাদ- দেয়া এটা কি কোনো সভ্যতার মানদ- হতে পারে? এরকম পরিস্থিতি হলে এই দেশে কারো সম্মান ও মান-মর্যাদা নিয়ে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হবে না। ভয়ে কেউ কোনো দায়িত্ব নিতে চাইবেন না।
ঢাকাটাইমস: হলফনামায় বাইরেও আপনার সম্পদ আছে বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে...
আবদুল মান্নান খান: আমার অর্জিত সম্পত্তি স্থাবর-অস্থাবর সবকিছুই আমি হলফনামায় বর্ণনা করেছি এবং কর দিয়েছি। যখন নির্বাচন হয়েছে তখন গত অর্থবছরে আয় কর বিবরণী জমা দিয়েছি। কারণ, কর দিতে হয় এক জুন থেকে অরেক জুন পর্যন্ত। তখন পর্যন্ত আমার যে পরিমাণ সম্পদ ছিল আমি তার বিবরণী পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দিয়েছি। যারা এনিয়ে বিভ্রান্ত ছড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা জেনে, না জেনে কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটা করছেন।
ঢাকাটাইমস: ড্যাব নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?
আবদুল মান্নান খান: আমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর বুয়েটের বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ, পরিকল্পনাবিদ, রাজনীতিবিদসহ সব শ্রেণি পেশার প্রতিনিধিদের সঙ্গে ঢাকার আবাসন ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেছি। মাসের পর মাস সেমিনার, সেম্পোজিয়াম ও গণশুনানি করে তাদের মতামতের ভিত্তিতে ডিটেইল এরিয়া প্লান (ড্যাপ) করেছিলাম। ঢাকা ছিল অপরিকল্পিত একটি নগরী। আমরাই প্রথম এটিকে পরিকল্পিত নগরী করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো কিছুই সরকারের একার পক্ষে করা সম্ভব হয় না, যদি না দেশপ্রেমে উদ্বুব্ধ জনগণ এতে সহযোগিতা করে।
ঢাকাটাইমস: রাজউকের প্লট বরাদ্দে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়...
আবদুল মান্নান খান: একসময় প্লটের চেয়ে আবেদনের সংখ্যা ছিল কম। তখন যারাই আবেদন করতেন তারাই প্লট পেলেন। কিন্তু আমাদের সরকার যখন পরিকল্পিতভাবে প্লট বরাদ্দের ব্যবস্থা করলাম তখন কয়েকশ গুণ বেশি আবেদন পড়েছে। আমরা প্রকাশ্য লটারির মাধ্যমে আবেদনকারীদের মধ্যে প্লট বরাদ্দ দিয়েছি। এখানে কোনো ধরনের অনিয়ম কিংবা দুর্নীতি হয়নি। এমনকি ভূমি বণ্টন নিয়ে সরকারের প্রতিপক্ষও কথা তুলতে পারেনি। তারাও এই সুবিধা নিয়েছে। এখানে সীমাহীন দুর্নীতির সুযোগ নেই।
ঢাকাটাইমস: রাজউকের উত্তরা ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ আপনার সময়েই শুরু হয়েছিল কিন্তু যেভাবে এগোনোর কথা ছিল আগায়নি কেন?
আবদুল মান্নান খান: আমরা উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করার পর অনেক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছিল। তারা মনে করেছিল এখানে কাজ করলে খুব দ্রুত মুনাফা অর্জিত হবে। অথবা অন্য কোনো চিন্তাও থাকতে পারে। এটা তাই ভাল বলতে পারবেন। আমি চেষ্টা করেছি রাষ্ট্রের টাকা যেন কোনোভাবেই অপচয় না হয়। উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে কাজ দেয়া হয়েছে। এখানে কোনো পক্ষপাতিত্ব করা হয়নি। এখন যদি কেউ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে ব্যর্থ হন সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষের এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করা ঠিক হবে না।
ঢাকাটাইমস: মন্ত্রী থাকতে আপনার পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়স্বজনদের প্লট বরাদ্দ দিয়েছেন বলে পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে।
আবদুল মান্নান খান: লটারির মাধ্যমে যারা অংশগ্রহণকারীরা যদি নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছভাবে প্লট পায় সেটা নিশ্চয়ই অন্যায় হতে পারে না। তার পরও বলছি, প্লটের লটারির আগে আমার আত্মীয়স্বজনদের বলেছি তোমরা কেউ অংশ নিতে পারবে না। কিন্তু আমি চাইলে অবশ্যই তাদের প্লট দিতে পারতাম। আমার ছোট দুই ভাইয়ের নামে ঢাকা শহরে কোথাও সরকারি জমি বরাদ্দ আমার হাত দিয়ে বা তত্ত্বাবধায়নে হয়েছে কি-না এটা খতিয়ে দেখুন।
ঢাকাটাইমস: গুলশানে আপনার নামে প্লট আছে বলে শোনা যাচ্ছে। অথচ হলফনামার কোথাও এটা নেই।
আবদুল মান্নান খান: গুলশানে আমার নামে কোনো প্লট নেই। প্রশ্নই ওঠে না। যারা বলছেন, তাদের বলবো খুঁজে বের করে প্লটটি আমার দখলে এনে দেন।
ঢাকাটাইমস: অন্য কারো নামে প্লটটি আপনি কিনেছেন...
আবদুল মান্নান খান: বাংলাদেশে বা পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে এমনটা আছে কি-না আমার জানা নেই যে, যে সম্পদ আপনার নামে নেই সেটার দায়দায়িত্ব আপনার হতে পারে।
ঢাকাটাইমস: আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদকের পদে কি আপনি এখনও আছেন?
আবদুল মান্নান খান: নির্বাচনে আমি প্রার্থী ছিলাম। এমনকি সহকারী দপ্তর সম্পাদকও নির্বাচন করেছেন। আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের কার্যালয় দায়িত্বশীল লোক ছাড়া চলতে পারে না। তাই দলীয় প্রধান নিজেই বলেছিলেন নির্বাচনকালীন সময়ে আরেকজনকে অস্থায়ীভাবে দায়িত্ব দেয়ার জন্য। নির্বাচন শেষে আমি আওয়ামী লীগ সভাপতির নির্দেশ মেনে আমার দায়িত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করছি।
ঢাকাটাইমস: নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নে কী কাজ করেছেন?
আবদুল মান্নান খান: দোহার-নবাবগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা পদ্মা নদীর একপাড়ে। প্রায় বছর নদীর একতীর ভাঙে আরেক তীর গড়ে। গত পাঁচটি বছর ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ভাঙনকবলিত মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। জনগণ আমার কাজের মূল্যায়ন করেছে।
ঢাকাটাইমস: কিন্তু নির্বাচনে আপনার পরাজয় হয়েছে।
আবদুল মান্নান খান: বিগত নির্বাচনের ফলাফল দেখে মনে হয়, আমি পরাজিত হয়েছি। ভোটের পুরো চিত্রটিই ছিল বিস্ময়কর। দোহারের ২৩টি ইউনিয়নের দুইশরও বেশি ভোট কেন্দ্র। প্রায় ভোটকেন্দ্রগুলোতে আমি জয়ী হয়েছি। শুধু চোরাইন ইউনিয়নে যেখানে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির প্রার্থীর বাড়ি। সেই এলাকার পাঁচটি কেন্দ্রে নজিরবিহীনভাবে ১৭টি থেকে ২২টি ভোট করে পেয়েছে নৌকা। যা অবিশ্বাস্য। পক্ষান্তরে আমার প্রতিপক্ষ সেখানে প্রতিটি কেন্দ্রে দুই থেকে তিন হাজার ভোট পেয়েছে। এখানে কী ধরনের কারচুপি হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মূলত এ কারণেই নির্বাচনে আমার প্রত্যাশিত ফলাফলকে পাল্টে দিয়ে ঘোষিত ফলাফলকে সামনে নিয়ে এসেছে।
ঢাকাটাইমস: ঢাকার সুন্দর্যবর্ধনে হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে কী ধরনের বাধার মুখে পড়েছিলেন?
আবদুল মান্নান খান: একসময় সমালোচকরা কটাক্ষ করে বলতো রাতে মশা, দিনে মাছি এই নিয়ে ঢাকায় আছি। ঢাকা নোংরা, ময়লা শহর। কিন্তু গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে আমার মন্ত্রণালয় এবং ১১টি অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং দিনমজুরসহ ঢাকার দুর্নাম ঘুচিয়ে সুনাম অর্জনে কাজ শুরু করি। এ লক্ষ্যে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে হাতিরঝিল একটি। এই বিস্তীর্ণ এলাকার দুই পাশে সরকারি জমি দখল করে অনেকে বসতবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা করেছিলেন। এ অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করার জন্য আনুমানিক ৭৭টির মতো মামলা মোকাবিলা করতে হয়েছিল। সরকারি জমি উদ্ধারের পর সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আজকের নয়নাভিরাম হাতিরঝিল প্রকল্প গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। নগরবাসীর নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা ছিল না। কিন্তু হাতিরঝিল নগরবাসীকে সেই সুযোগ করে দিয়েছে।
ঢাকাটাইমস: রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হাতিরঝিলের নান্দনিক সুন্দর্য হারাতে যাচ্ছে বলে দর্শনার্থীরা অভিযোগ করেন।
আবদুল মান্নান খান: এটি রক্ষণাবেক্ষণে যারা আছেন আমি সবাইকে অনুরোধ করব ঢাকাবাসীর বহুদিনের স্বপ্নের হাতিরঝিল যেন কোনো কারণে অযতেœ-অবহেলায় নান্দনিকতা না হারায়। বরং সবাই মিলে আমরা যেন এটিকে সমৃদ্ধ করি এবং দৃষ্টি নন্দন করি।