logo ২০ এপ্রিল ২০২৫
রাজনীতি আমার জন্য কঠিন: পাপন
০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ১১:৩৩:৩৭
image


সোফার ওপর একটা আদরের বিড়াল গড়াগড়ি করছিল। অনেক লোকের পায়ের শব্দে দৌড়ে পালাল। এই অনেক লোক এসেছেন দেখা পেতে, নাজমুল হাসান পাপনের দেখা পেতে। তবে সবাই একই পাপনের খোঁজে আসেনি! ভৈরব থেকে অনেক মানুষ এসেছেন তাদের জনপ্রতিনিধি ‘পাপন ভাই’-এর কাছে। অনেকে অপেক্ষায় আছেন কর্মকর্তা নাজমুল হাসান পাপনের জন্য। আবার ক্রিকেটাঙ্গনের অনেকে এসেছেন ক্রীড়া সংগঠক ও বিসিবি সভাপতি পাপনের কাছে।

এই বহুমাত্রিক কর্মব্যস্ত মানুষটির ব্যক্তিজীবন, ক্রিকেট জীবন ও পেশাগত জীবন নিয়ে জানতে ঢাকাটাইমসের মুখোমুখি হয়েছিল সাংসদ নাজমুল হাসান পাপনের। মূল লক্ষ্য ছিল আইসিসি সংস্কার ও বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে বিসিবির সর্বশেষ অবস্থা জানা। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধ রাজনৈতিক পরিবারের এই সন্তানের কাছ থেকে সোনালি যুগের রাজনীতিরও অনেক গল্প শোনা গেল। সব বিষয়ে খোলামেলা ও আন্তরিকভাবে কথা বলেছেন তিনি এই একান্ত সাক্ষাৎকারে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেবব্রত মুখোপাধ্যায়

ঢাকাটাইমস: এখন কি সব কিছু একটু শান্ত হয়ে এসেছে?

পাপন: হ্যাঁ, ইতিবাচক একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আইসিসির ব্যাপারটা এখনো চূড়ান্ত হওয়া বাকি, বিশ্বকাপ-এশিয়া কাপ মাঠে গড়ানো বাকি। তবে মূল সংশয়ের পর্বগুলো পার করে এসেছি বলেই মনে হয়।

ঢাকাটাইমস: আইসিসির সংস্কার নিয়ে শুরু করি। বাংলাদেশের টেস্ট খেলার সুযোগ রাখার ব্যাপারটা আরেকবার একটু বলুন।

পাপন: নাজমুল হাসান পাপন: আসলে বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস থাকবে না, এমন কোনো আলোচনা কখনোই হয়নি। ড্রাফট প্রোপোজালে পরিষ্কার বলা হয়েছে, সব দল সব আইন সত্ত্বেও যথাযথ টেস্ট মর্যাদা ভোগ করবে। যেটা করা হয়েছিল, ৯ ও ১০ নম্বর দেশ ইন্টারকন্টিনেন্টালে খেলবে; কিন্তু তাদের টেস্ট স্ট্যাটাস থাকবে। আমরা এই রেলিগেশনটার বিরোধিতা করেছি। আমি আইসিসি সভায় বলেছি, টেস্ট মর্যাদা থাকলে আমরা ইন্টারকন্টিনেন্টালে জাতীয় দল পাঠিয়ে চার দিনের ম্যাচে খেলব, এটা তো অবনমন। এটা মেনে নেওয়া যায় না। প্রতিযোগিতায় আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তো নিজেদের অপমান ও বঞ্চনা মেনে নেওয়া যাবে না।

ঢাকাটাইমস: কিন্তু এই রেলিগেশনের ব্যাপারটা ভাবার দরকার কি ছিল?

পাপন: এটা করার চেষ্টা হচ্ছে। আফগানিস্তান, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড প্রতিনিধিরা বলছে, আমরা টেস্ট খেলার মতো যোগ্যতা অর্জন করে ফেলেছি। কিভাবে তাহলে সুযোগ দেওয়া যাবে। আইসিসি তো যোগ্য কাউকে বাধা দিতে পারে না। এখন আমরা রেলিগেশনটা যেহেতু বাতিল করাতে পেরেছি, ফলে নতুন একটা আইডিয়া ভাবা হচ্ছে। একই সঙ্গে একটু প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি করতে পারলে সব দেশ টেস্ট নিয়ে আরো সিরিয়াস হবে।

ঢাকাটাইমস: এখন কি চার বছর মেয়াদে করে কন্টিনেন্টাল কাপ চ্যাম্পিয়নকে টেস্ট স্ট্যাটাস দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে?

পাপন: হ্যাঁ, সে রকম কিছু একটা ভাবা হচ্ছে। এটা সিঙ্গাপুর সভার আগে আলোচনা করাটা আমার ঠিক হবে না। তবে আপনি যেমন বলছেন, খুব কাছাকাছি কিছু আলোচনা চলছে।

ঢাকাটাইমস: বিগ থ্রি এখানে কী ভূমিকা রাখছে? বলা তো হচ্ছে, তারাই সব কিছু দখল নিতে চাচ্ছে?

পাপন: দেখুন, এই সংষ্কার প্রস্তাব তো বিগ থ্রির আবিষ্কার নয়; এটা এফঅ্যান্ডসিএ সুপারিশ করেছে। এ কমিটিতে কিন্তু অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ভারত ছাড়াও জিম্বাবুয়ে ও ওয়েস্ট ইন্ডিজও আছে।  একেকটা কমিটিতে ভিন্ন ভিন্ন সদস্যরা থাকেন। আমি যেমন আইনি বিষয় দেখার গভকম কমিটিতে আছি। এই এফঅ্যান্ডসিএতে আছে এরা পাঁচ দেশের প্রতিনিধি। ফলে এটাকে ‘বিগ থ্রি’র প্রস্তাব যেটা বলা হচ্ছে, সেটা ঠিক না আসলে। আর আপনারা তো আইসিসি সভাপতির প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেও দেখেছেন যে, তিনিই আসলে এফঅ্যান্ডসিএকে এ রকম কিছু সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করতে অনুরোধ করেছেন। ফলে এটা হঠাৎ করে তিনটি দেশ এসে চাপিয়ে দিচ্ছে, ব্যাপারটা তা নয়।

ঢাকাটাইমস: আমরা দেখেছি, এক্সকো গঠন করে আসলে এই কয়েকটি দেশ খেলাটার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে চাচ্ছে।

পাপন: এ ধারণাটায়ও কিছু ভ্রান্তি আছে। এক্সকো কি হবে? তারা আইসিসির একটা উপকমিটি হবে মাত্র; সুপারিশ করার ক্ষমতা থাকবে তাদের। সিদ্ধান্ত আইসিসি বোর্ডই নেবে, এখনকার মতোই। এখানে একটু পরিষ্কার করে বলি। ক্রিকেটের আসলে দুটো বৈশ্বিক সংগঠন আছেÑএকটা আইসিসি, আরেকটা আইডিআই। আইসিসিই ক্রিকেটের প্রধান সংস্থা। কিন্তু সমস্যা হলো, আইসিসি তো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। তাই তাকে ব্যবসা, বিভিন্ন দরপত্র, লাভালাভের ব্যাপার দেখার জন্য আরেকটা কোম্পানি করতে হয়েছেÑআইসিসি ডেভেলপমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল। আইসিসির সভাপতিই এটার সভাপতি, আইসিসির পরিচালকরাই এটার পরিচালক। এই আইডিআইয়ের একটা উপকমিটি হলো এফঅ্যান্ডসিএ। এরাই এত দিন মিডিয়া ডিল, সূচি এসব ঠিক করত। কিন্তু আইসিসিতে সম্প্রতি আলাপ হলো যে, আইসিসির সদস্যরা কে কার সঙ্গে খেলবে, সেটা এফঅ্যান্ডসিএ কেন ঠিক করবে? আমাদেরই এ রকম একটি কমিটি থাকা দরকার। সেই চিন্তা থেকেই এই এক্সকো গঠনের জন্য এবং কিছু কাঠামোগত সংস্কারের জন্য এফঅ্যান্ডসিএকে বলল।

ঢাকাটাইমস: আইসিসির মাধ্যমে যে এফটিপি করা হতো, সেটা বাতিল করে দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছে। কেন?

পাপন: এফটিপির সংস্কারটা দরকার ছিল। আগে তো এটার আইনি কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। ফলে অনেকেই এফটিপিতে বিনা নোটিশে পরিবর্তন আনত। এতে খুব বিপদে পড়ে যেত আয়োজক দেশটা। তারা যেসব স্বত্ব বিক্রি করত, সে টাকা পাওয়া যেত না। এটা অনেক বড় লোকসান হয় কখনো কখনো।

ঢাকাটাইমস: আইসিসির বর্তমান কাঠামো ও অর্থনৈতিকব্যবস্থা সংস্কার করা কি আসলেই দরকার ছিল?

পাপন: সংস্কার আসলে অবধারিত হয়ে গিয়েছিল। আইসিসির খরচ যেভাবে বেড়ে যাচ্ছিল, তাতে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণে আইসিসি ইভেন্টে লাভ হওয়াতেও সদস্য দেশগুলো বাড়তি অর্থ পাচ্ছিল না। এটা সব দেশের ওপরই প্রভাব ফেলছিল। ফলে কস্ট কাস্টিং দরকার ছিল।

ঢাকাটাইমস: কিন্তু এটা করতে গিয়ে ভারত সিংহভাগ আয় দাবি করছে। এটা কি অন্যায় না?

পাপন: দেখুন ভারতের জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও এটা করত। ভারত কিন্তু বর্তমান লাভ থেকে কোনো বাড়তি অংশ চাচ্ছে না। তারা বলছে, এখন এই কস্ট কাস্টিং ও তাদের লিডারশিপে যে বাড়তি আয় হবে, তার একটা বড় অংশ কন্ট্রিবিউশন অনুযায়ী তাদের দেওয়া হোক। তারা আমি শতাংশ আয়ে কন্ট্রিবিউট করে। ফলে নতুন যে আয়ের দুয়ারগুলো তারাই খুলতে যাচ্ছে, সেখান থেকে তারা যা দেবে সেই অনুপাতে বাড়তি চাইতে পারে তারা।

ঢাকাটাইমস: তাহলে আপনি এই সংস্কারে কোনো সমস্যা দেখছেন না?

পাপন: অবশ্যই অনেক সমস্যা আছে। তবে সেদিক না দেখে, লোকেরা অন্য দিকে দেখছে। সমস্যাটা ছিল শুরুতে বলা হয়েছিল, এই এক্সকোর চেয়ারম্যান এবং কার্যত আইসিসির চেয়ারম্যান সব সময় ওই তিন দেশ থেকে আসবে। এটা তো একটা ডিসক্রিমিনেশন। আরেকটা বলা হয়েছিল, এই তিন দেশই যেহেতু ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করার মূল কাজটা করছে, ফলে ওরা কখনো রেলিগেটেড হবে না। এটাও সমালোচনার ব্যাপার হলো। কারণ, গ্লোবাল স্পোর্টসে এ ধরনের ছাড় কেউ পেতে পারে না। আর ওরা যদি কখনো রেলিগেটেড না হয়, তাহলে ওরা ছয়-সাত-আটে নেমে এলে আমাদের তো রেলিগেশন এড়াতে পাঁচে উঠতে হবে! এগুলোর বিরোধিতা করেছি আমরা। আমরা কোনো বৈষম্য মানব না।

ঢাকাটাইমস: তাহলে আপনার মতে, আপনাদের বলা সংশোধনীগুলোসহ এই সংস্কার প্রস্তাব পাস হলে বাংলাদেশ লাভবান হবে?

পাপন: বাংলাদেশ সবচেয়ে লাভবান হবে। আমরা যখন লাস্ট সার্কেলে আইসিসির কাছ থেকে ৩৪ মিলিয়ন পেয়েছি। পরের সার্কেলে এটা ৮০ থেকে ৯০ মিলিয়নে চলে যাবে। টেস্ট খেলা অনেক বেড়ে যাবে; অনেক।

ঢাকাটাইমস: দুবাই সভায় যাওয়ার আগে বিসিবির একটা ভোটাভুটি নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছে। আমরা জানি যে, আপনারা শুরুতে সরাসরি সংস্কারের পক্ষে থাকতে চেয়েছিলেন। এটা সত্যি?

পাপন: দেখুন আমরা বোর্ডে পরিষ্কার সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমরা অর্থনৈতিক ব্যাপার নিয়ে খুব ভাবনায় নেই। হ্যাঁ, ওটা নিয়েও আমার অনেক আপত্তির জায়গা ছিল, যেটা পর্যায়ক্রমে বলেছি। কিন্তু বাকি যে ব্যাপারগুলো, সেগুলোর আমরা ঘোর বিরোধিতা করব বলেই বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা; সবাই একমত হলেন। তবে আমরা এসব নিয়ে বাইরে শুরুতে বেশি কথা বলতে চাইনি। মুখে বিরোধিতা না করে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করে করে কারা বিরোধী এটা বুঝে প্রতিবাদ করব। একা একা প্রতিবাদ করলে তো সব কূল যাবে; প্রস্তাবও পাস হবে, সম্পর্কও নষ্ট হবে। এসব সিদ্ধান্তের আমি বললাম, ভোট ৭-২ হলে আমরা কী করব? তখন তো প্রস্তাব পাস হয়ে গেছে। তখনো কি আমরা বিরোধিতা করে যাব। এ নিয়ে আমি বিসিবি পরিচালকদের কাছে জানতে চাইলাম। তিনজন বললেন, এমন অবস্থায়ও বিরোধিতা করবেন। বাকি ২০ জন বললেন, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবেন। এটাই বাইরে এলো যে, ২০ জন নাকি সংস্কার প্রস্তাবের পক্ষে, টেস্ট বাঁচানোর বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন! কী বিস্ময়কর কথা!

ঢাকাটাইমস: শুরুতেই এই বিরোধিতার অবস্থানটা পরিষ্কার করে দেওয়া যেত না?

পাপন: এ রকম কৌশল প্রকাশ্যে নেওয়াটা খুব জরুরি ছিল। কারণ, যা ভেবেছিলাম, এর ভেতরে অনেক খেলা চলছে। বাইরে বিপ্লবী, খুব সোচ্চার একটা বোর্ড; নাম বলব না; তারা খুব প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। অথচ আইসিসি সভায় তারা সবার আগে হেসে বলল, ফাইন প্রোপোজাল।

ঢাকাটাইমস: আইসিসি সভায় তাহলে আসলেই কেউ এই সংস্কারের বিরোধিতা করেনি?

পাপন: সবাই, সবাই চুপ করে মেনে নিয়েছে। এখন অনেকে অনেক কিছু বলছে। আমরাই শুধু আপত্তি করলাম। বললাম, রেলিগেশন ব্যাপারটা বাদ দিতে হবে। সেটা হয়েছে। এটাই আমাদের বড় অর্জন।

ঢাকাটাইমস: এ অর্জনটা করতে তো দুই পক্ষকেই পাশে পেতে হয়েছে।

পাপন: দেখুন মজাটা এখানেই। ওই দিন এই রেলিগেশন শব্দটা বাদ দিতে আমার ভারত-অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের সমর্থন দরকার ছিল। আবার পুরো ব্যাপারটা যাতে পাস না হয়ে যায়, যাতে আরো দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সুযোগ পাই, সেই জন্য বাকিদের সমর্থন দরকার ছিল। আমি আগেই ঘোষণা দিযে অবস্থান নিলে এটা করা কি সহজ থাকে আর?

ঢাকাটাইমস: কিছু দ্বিপক্ষীয় সফর নিয়ে চুক্তি করার কাছাকাছি চলে গেছেন বলে জানা যাচ্ছে?

পাপন: হ্যাঁ, আমি তো ওদের বলেছি যে, আমরা র‌্যাংকিংয়ে ভালো করব কী করে তোমাদের বিপক্ষে না খেললে? এটা আমি প্রতি মিটিংয়ে বলি। আমি বড় দলগুলোর সঙ্গে খেলে তাদের দু-একট ম্যাচ হারাতে পারলে না আমাদের র‌্যাংকিং পয়েন্ট বাড়বে। ফলে আমাদের তোমাদের সঙ্গেই খেলতে হবে। ওরা রাজি। তবে ২০২০-এর আগে সুযোগ হচ্ছিল না। আমি ওদের তিন দলকেই বলেছি, আমাদের দ্রুতই সফর লাগবে।

সম্ভবত হয়ে যাবে। তবে ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ডেট মেলানোটা খুব সমস্যা হচ্ছে।

ঢাকাটাইমস: টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আর এশিয়া কাপের আয়োজনের কী অবস্থা? নিরাপত্তা ইস্যু তো আর চিন্তায় নেই?

পাপন: হ্যাঁ, এখন আমরা চূড়ান্ত প্রস্তুতির অবস্থায় আছি। এই আইসিসি সভায় আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে প্রশংসাও করা হয়েছে। এখান থেকেই বিশ্বকাপের ক্লিয়ারেন্সটা পেয়েছি। নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের এখানে যে বৈঠকটা হলো, সেখানে আমরা সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছি। দলগুলোকে, বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা যাতে তদের সফর দিয়ে সূচনাটা করে ফেলে, সে জন্য তাদের রাজি করাতে পেছনে কী কী কাজ করতে হয়েছে, তা আপনারা জানেন। এই সেদিন পর্যন্তও অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড বেঁকেছিল, পাকিস্তান আসবে না বলছিল; এখন সবই ঠিক হয়ে গেছে।

ঢাকাটাইমস: কাকতালীয়ভাবে আপনি সভাপতি হওয়ার পর থেকে বিসিবি একটার পর একটা ঝড়ের ভেতর দিয়েই যাচ্ছে...

পাপন: সে আর বলতে! যখন প্রথম এলাম, তখনই আইসিসি থেকে নির্বাচনের ডেটলাইন জানিয়ে দিল। এর মধ্যে বিপিএল শুরু হলো। প্রথম আইসিসি সভাতে গিয়েই প্রশ্ন শুনতে হলো, প্রথম বিপিএলের ফিক্সিং গুঞ্জনের কী হলো? এরপর বিপিএল ফিক্সিং, গঠনতন্ত্র নিয়ে মামলা, নির্বাচন, প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে সমস্যা, বিশ্বকাপের ভেন্যু জটিলতা, ফিক্সিংয়ের ট্রাইব্যুনাল, নিরাপত্তা সমস্যা এবং সর্বশেষ এই আইসিসি।

ঢাকাটাইমস: মাঝেমধ্যে মনে হয়, এনাফ ইস এনাফÑছেড়ে চলে যাই?

পাপন: না। আমি হাল ছাড়ার লোক নই। হ্যাঁ, আগে এমন জানলে হয়তো আসতাম না। তবে একবার দায়িত্ব নিলে সেটা আমি শেষ না করে ছাড়ি না।

ঢাকাটাইমস: আপনি তো এই জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন না। এখানে নিজেকে শান্ত রাখেন কী করে?

পাপন: প্রথমত, আমি কখনো নার্ভাস হই না। আমি মানুষটাই বোধ হয় এমন। আর পরিস্থিতিতে মাথা ঠা-া রাখি। কে কী বলল, তা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাই না। একেবারে অসত্য ঘটনা নিয়ে সমালোচনা হলে কষ্ট পাই, মাথা ঘামাই না। হতে পারে, এটা পরিবার থেকে এসেছে। আমার বাবা-মা, আপনারা জানেন এই নির্লিপ্ত, নির্বিকার, নির্ভীক জীবনযাপন করে গেছেন। জীবনে কখনো ভয় পেতে দেখিনি।

ঢাকাটাইমস: এত শত চাপ। অসহ্য লাগে না?

পাপন: দেখুন, আমি কর্মজীবনে ঢোকার পর থেকে এই চাপ নিয়ে অভ্যস্ত। আমি কিন্তু ¯্রফে চাকরিজীবী মানুষ। লোকে ভাবে ব্যবসা আছে, শেয়ার আছে; কিচ্ছু না। সকালে যাই, রাতে আসি; এই চাকরি জীবনে আমাকে অনেক চাপ সামলাতে হয়েছে।

ঢাকাটাইমস: সমালোচনা গ্রহণ করতে পারেন?

পাপন: ক্রিকেটকে আসলে সবাই ভালোবাসেন। যারা সমালোচনা করেন, ভালোবেসেই করেন। হয়তো একেকজন একেভাবে বোর্ড চালাতে চান। কিন্তু খারাপ কেউ চান না। আমি যেমন চাই, পুরো বোর্ড চলুক পেশাদার পদ্ধতিতে।

ঢাকাটাইমস: সেটা কি এখন একটুও হচ্ছে?

পাপন: কিছুটা। কিছুটা হচ্ছে। এই যে ধরুন বোর্ডের কেউ বোর্ডের ব্যবসা করতে পারবেন না; এটা চালু হয়েছে। হ্যাঁ, হয়তো গোপনে কেউ করে এখনো। অন্তত প্রকাশ্যে করায় তো একটা প্রথম বাধ দেওয়া গেছে। এই যে সুজন, আমার অতি কাছের মানুষ। ওকেও কিন্তু বোর্ডের চাকরি ছেড়ে কোচিং করাতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমার আপন-পর বলে কিছু নেই।

ঢাকাটাইমস: এই পুরো পেশাদার বিসিবিটা কত দিনে পাওয়া সম্ভব?

পাপন: ছয় মাস থেকে এক বছরে সম্ভব। কিন্তু এত সব ঝামেলায় পারছি না।

ঢাকাটাইমস: প্রশাসক, রাজনীতিবিদ, ক্রীড়া সংগঠকÑমোটা দাগে তিনটি পরিচয়। কোনটা উপভোগ করেন?

পাপন: আমি তো রাজনীতিতে আসলে সেভাবে ছিলামই না। আব্বা রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর নির্বাচন করলাম। তার আগে আমি রাজনীতি থেকে দূরে থাকতাম আমি পেশাগত ও একাডেমিক জীবন নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। আমার পেশাগত জীবনের পরিচিতরা অনেকেই আমার আম্মা মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত জানতেন না যে, আমি ওনাদের ছেলে। আমার নাম নাজমুল হাসান, বাবার নাম জিল্লুর রহমান; মিলও লোকেরা খুঁজে পেত না। রাজনীতি অনেকটা হঠাৎ করেই এলাম। এই তিন জীবনের কথা যদি বলেন, তাহলে পলিটিক্স করাটা আমার জন্য খুব কঠিন। হ্যাঁ, উপভোগ করি ক্রিকেট; খুব উপভোগ করি।

ঢাকাটাইমস: উপভোগ করার কারণটা কী?

পাপন: এই যে টানা একটার পর একটা চ্যালেঞ্জ। একটার পর একটা ঝামেলা আসছে। যেন যেকোনো সময় আউট হতে পারি, কিন্তু রান করে যাচ্ছি। বাউন্সি উইকেটে ব্যাট করার মতো। তবে রাজনীতির মতো কঠিন নয়।

ঢাকাটাইমস: রাজনীতি ঠিক কোন জায়গাটায় সবচেয়ে বেশি কঠিন মনে হয়?

পাপন: এই যে দেখলেন লোকেরা এসেছেন। এদের সবার কথা শুনতে হবে। একটা আম আছে, ১৫০ জন হয়তো দাবিদার। ওই ১৪৯ জনকে সন্তুষ্ট রেখে একজনকে আমটা দিতে হবে। এটা বাবা পারতেন। আমি পারি না। আসলে রাজনীতিবিদদের কিছু ব্যাপার থাকে। ওনারা ‘না’ ব্যাপারটা বলারও কৌশল জানেন, আমি এখনো সেটা পারি না। আমি পরিষ্কার বলে ফেলি। যারা আসেন, তারা বলেন, আপনার বাবা কখনো ‘না’ বলতেন না; এটা সত্যি। কিন্তু বাবার ব্যাপারটা আলাদা ছিল। ফলে আমার জন্য এটা খুব কঠিন।

ঢাকাটাইমস: এ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন? নাকি এড়িয়ে থাকতে চান?

পাপন: হ্যাঁ, আমি নিজেকে পরিবর্তন করছি, চেষ্টা করছি। তাদেরও একটু বদলানোর মনে হয় সময় এসেছে। এসে দাবি করে, ব্যাংকার হবে। যোগ্যতা কী? জেল খেটেছেন। জেল খাটা তো ব্যাংকার হওয়ার জন্য কোনো যোগ্যতা হতে পারে না। তবে এগুলো কথা না। আমাকে আরো সময় দিতে হবে। বিশ্বকাপের পর থেকেই ঠিক করেছি, এলাকার রাজনীতিতে গিয়ে অনেক সময় দেব।

ঢাকাটাইমস: আপনার আব্বা-আম্মার কথায় আসি। দুজনই বাংলাদেশের কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ ছিলেন। আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন তাদের?

পাপন: আম্মার ছিল অনেক সাহস। আপনি বলবেন, ওখানে গোলাগুলি হচ্ছে, কিছু মানুষ ঝামেলায় পড়েছে। বাবা মানুষকে ঝামেলা থেকে বের করে আনার জন্য কিছু কৌশল করবেন; কাজও করে ফেলবেন। আর মা নিজে ওই গোলাগুলির মধ্যে চলে যাবেন। দুজনেরই একটা দারুণ মিল ছিল, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের প্রতি দারুণ বিশ্বস্ততা।

ঢাকাটাইমস: আপনার বাবার একটা মস্ত গুণ বলা হয়, চরম বিরোধী মানুষকেও আস্থায় নিতে পারতেন?

পাপন: হ্যাঁ, বিরোধীদের আস্থায় আনাটা বাবার বড় একটা ব্যাপার ছিল। তার প্রথম কথা ছিল, বিরোধী মতের মানেই সে খারাপ নয়; তারও অবদান আছে কিছু। সেটাকে বড় করে দেখার গুণ ছিল। আরেকটা ব্যাপার, বিরোধী মতের লোকেদের কাছে রাখলে, তাদের সম্পর্কে জানাটা সহজ হয় বলে বাবা মনে করতেন।

ঢাকাটাইমস: বাবা-মা দুজন দেশের জন্য আক্ষরিক অর্থেই জীবন দিয়ে গেছেন। কিন্তু পরিবারে সন্তান হিসেবে আপনি কি তাদের সময় পেতেন?

পাপন: হ্যাঁ, আমি বিয়ে করার পরও বাবা-মায়ের সঙ্গেই থেকেছি। বাবা ১৯৯৬ সালে মন্ত্রী হওয়ার পর আমি আলাদা বাসায় উঠেছিলাম কিছুদিনের জন্য। আবার ২১ আগস্ট বোমা হামলার পর এই বাসায় চলে এসেছি, আর ধানম-ি বাসায় জামাকাপড় আনতেও যাইনি। ফলে ওই কয়েকটা বছর বাদ দিয়ে বাকি জীবন বাবা-মায়ের কাছেই কাটিয়েছে। তাদের পেয়েছিও।

ঢাকাটাইমস: না, রাজনীতিতে সময় দিয়ে পরিবারে ওনারা কতটা সময় দিতে পারতেন?

পাপন: আমাদের পরিবারের কতগুলো নিয়ম ছিল; আজকাল সেটা আর করা কঠিন। আপনারা অবাক হবেন, আমি এত বড় হয়েছি, কিন্তু এক বাসায় যত দিন ছিলাম, রাত ১০টায় ডিনার টেবিলে সবাইকে থাকতেই হবে। আমি বিয়ের আগ পর্যন্ত বাসার বাইরে কখনো রাত কাটাইনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের জন্য এটা খুব কঠিন না? শুক্রবার দুপুরে অবশ্যই একসঙ্গে খেতে হবে।

ঢাকাটাইমস: বাবা, নাকি মা? কাকে অনুসরণ করতে চান?

পাপন: এটা তো বলা খুব কঠিন। আমার জীবনের দুই পর্বে দুজন সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আমার মায়ের সঙ্গেই আমার বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল। বাবা বোনটাকে বেশি ভালোবাসতেন বলে আমাদের মধ্যে খুব মজাও হতো এ নিয়ে। আর আমার বড় হয়ে ওঠার সময়টা আব্বা জেলে ছিলেন। ফলে মা-ই ওই সময় বেশি কাছে ছিলেন। কিন্তু ২১ আগস্টের পর সব উল্টে গেল। আব্বা আমাকে ছাড়া একটা মুহূর্ত যেন থাকতে পারতেন না। আমি অফিসের কাজে বাইরে গেলেও অস্থির হয়ে যেতেন। আমি এসে ‘হ্যাঁ, খাও’ না বললে বড় বড় ডাক্তারের ওষুধও খেত না। তার মানে অবশ্য এই না যে, আব্বা দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন। রাজনৈতিক ব্যাপারে খুব শক্ত ছিলেন। এই যে সেবার এক-এগারোর সময়ের কথা বলি। বাবা একদিন আমাকে ডেকে দিয়ে একটা ব্রিফকেস দেখালেন। সেটার ভেতর একটা জামা, লুঙ্গি, গেঞ্জি, ব্রাশ আর দুটো বই। দেখিয়ে বলে, এই যে জেলে যেতে রেডি আছি!

ঢাকাটাইমস: আপনার বাবা-মা দেশের রাজনীতির সোনালি সময়ে রাজনীতি শুরু করেছেন; আদর্শের সময়ে। এখন সেই সময়টা নেই। যে রাজনীতির অবস্থা, তাতে আপনি কি আপনার সন্তানদের রাজনীতিতে স্বাগত জানাবেন?

পাপন: দেখুন, আমি নিজেই যেভাবে রাজনীতিতে এসেছি, এটা ঠিক না। আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলব, আরো সময় নিয়ে, প্রস্তুতি নিয়ে রাজনীতিতে আসা উচিত। এটা একটা আদর্শের লড়াইয়ের জায়গা। তবে হ্যাঁ, আব্বা যে রাজনীতি করেছেন, সেটা আজকের দিনে আর কেউ করছে না। একটা উদাহরণ দিই। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগের দিন পর্যন্ত বাবা বাসে করে ভৈরব যেতেন। গাড়ি ছিল; তার পরও মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতে যাবেন, এটাই লক্ষ্য। নবাবপুর থেকে রিকশায় করে কোর্টে যেতেন। এটাই তাদের স্টাইল ছিল।

ঢাকাটাইমস: এই বদলে যাওয়া সময় নিয়ে আব্বার সঙ্গে কথা হতো?

পাপন: অনেক। আব্বা আমাকে বলেছেন, ঢাকা থেকে কিভাবে পালিয়ে গিয়ে পাটক্ষেতে একটা একটা করে লোককে স্বাধীনতার পক্ষে বোঝাতেন। টের পেলে তারই ভাইয়েরা তাকে মেরে ফেলবে; সব তো তখন মুসলিম লীগ করে। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগেই বলছিলেন, ‘আব্বা, কী যে দিন এলো, কিছুই তো বুঝি না।’ আমি বললাম, কেন? বলেন, একটা লোককে একটা চিঠি দিয়ে কোথায় পাঠাতে চেয়েছিলেন। সেই লোক ভালো বেতন পায়। চিঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা বুঝতে পেরে ৫০০ টাকা দেওয়ার পর চিঠি দিতে গেছে। তখন গল্প করলেন, একদিন ঝড়ের রাত। দারুণ বৃষ্টিতে ঢাকা ভেসে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু একটা চিঠি দিয়ে বললেন, ‘সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে দিয়ে আয়।’ আব্বার পকেটে একটা টাকা নেই, রিকশায়-বাসে যাওয়ার উপায় নেই। ভিজতে ভিজতে দৌড়ে চিঠি নিয়ে গেছেন। এটাই ছিল তাদের কমিটমেন্ট। ওটা এখন পাওয়া কঠিন।

ঢাকাটাইমস: কেন? এই কমিটমেন্টটা পাওয়া কঠিন কেন?

পাপন: কঠিন না? আমাদের ভৈরবে প্রচুর নামকরা মাসলম্যান ছিলেন। তারা আব্বার সঙ্গে থাকতে চাইত। আমি বলি, নাও না কেন দলে? এরা থাকলে তো কাজ সহজ হয়। আব্বা অবাক হয়ে বলে, সে জন্য এসব খারাপ লোককে দলে নেব? আজ কি আমরা তাদের এড়িয়ে থাকতে পারছি?

ঢাকাটাইমস: এই পরিস্থিতি বদলানোর স্বপ্ন দেখেন না?

পাপন: অবশ্যই দেখি। দেখি বলেই রাজনীতির সঙ্গে আছি। আশা করি, দিন বদলাবে।