মহাজোট সরকারের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। ছিলেন নির্বাচনকালীন সরকারে প্রধানমন্ত্রীর আইন উপদেষ্টাও। পাঁচ বছর রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন শেষে ফিরেছেন আইন পেশায়। পাঁচ বছরে দায়িত্ব পালনকালে সরকারের নানা ইস্যু এবং সমসাময়িক বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন ঢাকাটাইমসের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
ঢাকাটাইমস: জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মঞ্জুর হত্যা মামলার আসামি। এমন একজন ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত করার ক্ষেত্রে কোনো আইনি বাধা আছে কি?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ: তার বিরুদ্ধে মামলা এখনো শেষ হয়নি। রায়ে দোষী প্রমাণ হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে অপরাধী বলা যাবে না। তাই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান দোষী প্রমাণ হওয়ার আগে তার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে কোনো বাধা নেই।
ঢাকাটাইমস: নৈতিকতার দিক থেকে বিষয়টা কতটা গ্রহণযোগ্য হয়েছে?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ: নৈতিকতার দিক থেকে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে দিলে তিনি রাজনীতিতে অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারেন। এমনকি পদে থাকার ক্ষেত্রেও অযোগ্য হবেন। কিন্তু এটা তো ঠিক হবে না।
ঢাকাটাইমস: জাতীয় পার্টি একদিকে সরকারে অন্যদিকে বিরোধী দলেও আছে। এক্ষেত্রে সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে জাতীয় পার্টি কতটা সক্ষম হবে?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ: সেই রাজনীতি আমার জানা নেই। এগুলো থেকে সব সময় দূরে থেকেছি। আমি সরকারের টেকনোক্রেট মন্ত্রী ছিলাম। রাজনৈতিক মন্ত্রী ছিলাম না। এই প্রশ্নের উত্তর রাজনীতিবিদরাই ভালো দিতে পারবেন।
ঢাকাটাইমস: বাংলাদেশে বিচারে দীর্ঘসূত্রতা আছে। মন্ত্রী থাকতে আপনিও এ নিয়ে কথা বলেছেন। এরশাদের বিরুদ্ধে মঞ্জুর হত্যা মামলার বিচারেও ১৮ বছর লেগে গেল। এটাকে কীভাবে দেখছেন?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ: বিচারে দীর্ঘসূত্রতা সুবিচারের জন্য সমস্যা। তবে মঞ্জুর হত্যা মামলায় কেন এত সময় লাগলো এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। অনেক সময় সাক্ষী-প্রমাণ যথাসময়ে না পেলেও বিচারকাজে দেরি হতে পারে। তবে এই সমস্যা দূর করতে আমরা দেওয়ানি কার্যবিধি পরিবর্তন করেছি। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি চালুর চেষ্টা করেছি। এটা হলে অনেক মামলা মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে কম সময়ে নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। আরেকটি হচ্ছে ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড। সেটিও সংশোধনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এটি করলেও আমরা অনেক ছোট ছোট মামলা কম সময়ে নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।
ঢাকাটাইমস: মন্ত্রী হিসেবে নিজেকে কতটুকু সফল হিসেবে মনে করেন?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ: মন্ত্রী হিসেবে যতটুকু সরকারি সুযোগ-সুবিধা না নিলেই নয় তা-ই নিয়েছি। আমি সব সময় দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছ থাকার চেষ্টা করেছি। মন্ত্রিত্বকে আমি ক্ষমতার উৎস মনে করিনি, রাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে দেখেছি। এবারও মন্ত্রিসভায় আমাকে থাকা নিয়ে আলোচনা ছিল। কিন্তু আমি নিজেই অনাগ্রহ দেখিয়েছি। তাছাড়া মন্ত্রী থাকাকালে মোবাইলে ফোন এলে যতটুকু সম্ভব আমি নিজেই কথা বলেছি। কারণ, তথ্য জানার অধিকার নিয়ে যে আইন আমরা করেছি সে অনুযায়ী জনগণকে প্রয়োজনীয় তথ্য দেয়া মন্ত্রী হিসেবে নিজের দায়িত্ব মনে করেছি।
ঢাকাটাইমস: বিগত সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। এখন সরকারের কোথাও নেই। এ অবস্থায় সরকারকে কীভাবে সহযোগিতা করবেন?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ: যে কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গেই আমি আছি। সামরিক আইন জারি করে কোনো সরকার এলে আমি তাদের পক্ষে যাব না। এমনকি যারা সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে তাদের সঙ্গেও আমি নেই।
ঢাকাটাইমস: দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা বিতর্ক রয়েছে। এই নির্বাচনের কোনো বিকল্প কি ছিল?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ: সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা হয়। নির্বাচন না হলে পাঁচ বছর সরকারকে চালাবে। তাই সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন হওয়া জরুরি ছিল। সংসদীয় গণতন্ত্রে যেভাবে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল সেভাবেই হয়েছে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গেলে সংবিধান এবং আইন অনুযায়ী যা যা করণীয় তা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী পদক্ষেপ নিয়েছেন। সেভাবেই নির্বাচন হয়েছে। কেউ যদি নির্বাচনে না আসা সেজন্য নির্বাচনকে বিতর্কিত করার সুযোগ নেই।
ঢাকাটাইমস: বিএনপি বলছে তারাও গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছে। মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করছে।
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ: বিএনপি নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য যেভাবে হরতাল-অবরোধ দিয়ে, বাসে, অটোরিকশায় পেট্রলবোমা দিয়ে যেভাবে মানুষ মারা অপকৌশল বেছে নিয়েছিল তা অতীতে কখনো হয়নি। এটি ন্যক্কারজনক এবং গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। এতে রাষ্ট্রের অনেক ক্ষতি করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও হত্যা করেছে তারা। সবাইকে এটি প্রতিহত করা উচিত।
ঢাকাটাইমস: কিন্তু সহিংসতায় যারা প্রাণ হারান তাদের পরিবার তো বিচার পায় না ...
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ: বিচার হচ্ছে না এটা বলা যাবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাদী হয়ে প্রতিটি ঘটনায় মামলা করেছে। যাদের কাছে ঘটনা প্রমাণের উপযুক্ত প্রমাণ রয়েছে তাদের উচিত তদন্ত সংস্থাকে সেগুলো দিয়ে সহায়তা করা। ঘটনা নিজে দেখে থাকলে সাক্ষী দেয়া। এতে প্রকৃত অপরাধীর বিচার হবে।
ঢাকাটাইমস: নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে যে বিতর্ক সেটার শেষ কোথায়?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ: নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকার কথা নেই। এটা খুব সহজ কথা, জনগণ ভোট দেবে আইন অনুযায়ী এখানে বিতর্ক কোথায়। বিতর্কটা হচ্ছে বিএনপি চাচ্ছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু সংবিধান এটাকে সমর্থন করে না। তাছাড়া অনির্বাচিত সরকার এক বছর-দুই বছরের জন্য ক্ষমতায় আসবে এটা সাংবিধানিক না হওয়ায় ১৩তম সংশোধনী সংবিধান থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এটিকে আবার কীভাবে সংবিধানে ফিরিয়ে আনবেন?
ঢাকাটাইমস: নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে অনেকে বলছেন। কী হলে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হয়?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ: অনেকে না, এটা সবাই বলে। আমরাও বলি। তবে আমি মনে করি নির্বাচন কমিশন এখন শক্তিশালী। তারা তাদের ক্ষমতার মধ্যে যতটুকু কঠোর হওয়া সম্ভব তা হচ্ছে। কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে বদলি করে দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কথা শুনছে। তাছাড়া পৃথিবীর সব দেশেই নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন হয়। তাই নির্বাচন কমিশনকেই ক্ষমতাধর ও শক্তিশালী হতে হবে।
ঢাকাটাইমস: নবম জাতীয় সংসদের ৭ জন সংসদ সদস্যের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে মামলার নিষ্পত্তি হয়নি পাঁচ বছরেও। কেবল এবার নয়, আগের সংসদগুলোতেও একই ঘটনা ঘটেছে। এমনটা হলে নির্বাচনে অনিয়মের প্রতিকার করা কি আদৌ সম্ভব?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ: সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে মামলা হয় তাহলে নির্বাচন ট্রাইব্যুনাল আছে। সেখানেই মামলার বিচারকাজ পরিচালনা হবে। আর যে বিরোধ উত্থাপন করে তারই দায়িত্ব বিচার পরিচালনা করা।
ঢাকাটাইমস: বিগত সরকারের ৭ জন মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যের সম্পদের অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। সরকারের আর কোনো সংস্থার কি এ বিষয়ে তদন্তের সুযোগ আছে?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ: রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে বলে ‘ট্রাস্ট’ (বিশ্বাস)। এই ট্রাস্ট ভঙ্গ করে রাষ্ট্রের জন্য কাজ না করে যদি কেউ ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য সম্পদ আহরণ করে সেটিই হচ্ছে দুর্নীতি। যারা এ ধরনের সম্পদ আহরণ করবে আইন অনুযায়ী তাদের এসব সম্পদ লভ্যাংশসহ সরকারকে ফিরিয়ে দিতে হবে। কারণ, এটি রাষ্ট্রের সম্পদ। তার ওপর জেল-জরিমানাও থাকতে পারে। দুদক ছাড়া রাষ্ট্রের আর কোনো সংস্থার এ বিষয়ে অনুসন্ধানের সুযোগ নেই।
ঢাকাটাইমস: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সম্প্রতি তাদের একটি প্রতিবেদনে দেশের মানবাধিকারের সমালোচনা করেছে।
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ: আমি এটিকে কিছুই মনে করি না। যখন বিএনপি-জামায়াত দেশে সহিংসতা চালিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারে তখন তারা কোথায় থাকে? যখন শত শত স্কুল পুড়িয়ে দেয়া হয়, হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি হামলা হয়; তখন কেন তারা এসব নিয়ে কথা বলেন না? তাছাড়া সরকার মানবাধিকার রক্ষার ব্যাপারে সচেষ্ট আছে বলে আমি মনে করি।
ঢাকাটাইমস: বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক নষ্টের জন্য যেসব প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে সেগুলোকে কীভাবে দেখছেন?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ: বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হবে এমন কোনো মতামত দেয়া সাংবিধানিকভাবে অপরাধ। সংবিধানে মৌলিক অধিকারের বিষয়ে ৩৯ নম্বর ধারায় বলা আছে এ ধরনের কিছু করা যাবে না। যারা এসব করছে তারা সংবিধান অমান্য করছেন।
ঢাকাটাইমস: বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। কিন্তু তারপরও এটি বন্ধ হচ্ছে না।
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ: কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া আমি এটি মানতে রাজি নই। যদি কেউ বলে বিচারবহির্ভূত হত্যা হচ্ছে তারা কেন সাক্ষী-প্রমাণ নিয়ে আদালতে যাচ্ছে না? মুখোরোচক কথা বললে তো হবে না।
ঢাকাটাইমস: আপনি সরকারে থাকতে জামায়াতকে নিষিদ্ধের ব্যাপারে অনেক দাবি উঠেছে। কিন্তু তারপরও এটিকে নিষিদ্ধ করা যায়নি কেন?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ: জামায়াতে ইসলামীর বৈধতা নিয়ে হাইকোর্ট একটা রায় দিয়েছে। এটার বিপক্ষে একটি আপিল আছে। তাই বিচারাধীন কোনো বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।