বিরোধী জোটের বর্জন, নির্বাচন প্রতিহতের ডাক আর দেশের বিভিন্ন এলাকায় নজিরবিহীন সহিংসতার মধ্য দিয়েই হলো দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ২৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকে বলতে গেলে টানা অবরোধ আর হরতালের মধ্যে ৫ জানুয়ারির ভোটের পর গঠিত হয়েছে নতুন সরকারও। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির পর এই প্রথম নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি। এই নির্বাচন নিয়ে কথা হচ্ছে দেশে-বিদেশে। নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব যাদের সেই নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচনকে কীভাবে দেখছে সে বিষয়ে ঢাকাটাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেনÑ বিলকিছ ইরানী।
ঢাকাটাইমস: প্রধান বিরোধী দল এবং তাদের জোট দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসেনি। আর তাই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি। বিএনপি এবং তাদের শরিকদের নির্বাচনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কিছু কি করার ছিল?
মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ: কোনো ব্যক্তি বা দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের বিশেষ কোনো দায়িত্ব নেই। বরং নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। আমরা সে কাজ করার চেষ্টা করেছি আন্তরিকভাবে। সব দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য বারবার বলেছি। সবাই নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবেÑ এমন পরিবেশ নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি আমরা।
ঢাকাটাইমস: নির্বাচন কেমন হলো? গোটা পরিবেশ নিয়ে আপনি কি সন্তুষ্ট?
মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ: বিষয়টা সন্তুষ্টি অসন্তুষ্টির বিষয় না, বিষয়টা হচ্ছে আমাদের দায়িত্ব পালন করা। সরকার পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচনে আমাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব ছিল। নির্বাচনের দিন কিছু কিছু সহিংসতা হয়েছে। তারপরেও বাস্তবতার নিরিখে বলতে হবে মোটামুটি সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন হয়েছে।
ঢাকাটাইমস:ভোটের আগে এবং ভোটের দিন সহিংসতায় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এর দায় কাকে দেবেন?
মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ: জনগণই দেখবে এর দায় কার। যারা সহিংসতা করে তারাই দায়ী হয়। অন্য কারো দায়তো কাউকে দেয়া যায় না। যারা সহিংসতা করে তারাই হত্যাকা-ের জন্য দায়ী হয়। দেশের মানুষই বিবেচনা করবে কাদের জন্য সহিংসতা হয়েছে। তবে আমরা সর্বান্তকরণে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ কামনা করেছিলাম।
ঢাকাটাইমস: কোনো কোনো ক্ষেত্রে জালভোটের অভিযোগ এসেছে গণমাধ্যেমে। কমিশনে কেউ কি আনুষ্ঠানিক কোনো অভিযোগ করেছেন? আপনারা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?
মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ: জালভোটের এমন কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। অভিযোগ এলে আমরা এবং তা সুনির্দিষ্ট হলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নিতাম। এখনও কেউ অভিযোগ করলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।
ঢাকাটাইমস:ভোটের দিন অনিয়মের অভিযোগে ২১টি আসনে নির্বাচন বর্জন করেছেন প্রার্থীরা। এসব অভিযোগ তদন্তে কমিশন কোনো উদ্যোগ নেবে কি না।
মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ: অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে আমাদের কাছে কোনো প্রার্থী আসেননি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমরা তাদের অভিযোগ দেখেছি। কিন্তু আমাদের কাছে তারা নিজেরা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ না করলে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আপাতত দেখছি না।
ঢাকাটাইমস: দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়ার হার গত কয়েকটি নির্বাচনের তুলনায় এবার বেশ কম। কেন এমন হলো?
মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ: বিষয়টা একেবারেই অস্বাভাবিক না। এবার একটা বড় দল এবং তাদের শরিকরা ভোটে অংশ নেয়নি। আর তারা না আসায় ভোটে আসেনি আরও বেশ ক’টি দল। নির্বাচন কেবল বর্জন না, ভোট যাতে না হয় সেজন্য তারা সবাইকে বলেছে এবং প্রতিহতের চেষ্টাও করেছে। এই অবস্থায় সব দলের অংশগ্রহণের নির্বাচনের তুলনায় দশম সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে।
ঢাকাটাইমস: ভোটের দিন বেশকিছু অঞ্চলে সহিংসতা হয়েছে। এসব এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা কি পর্যাপ্ত ছিল?
মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ: অবশ্যই ছিল। ভোটের নিরাপত্তায় অন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সামরিক বাহিনী সব জায়গায় ছিল। তবে তারপরও কিছু কিছু এলাকায় সহিংসতা হয়েছে। তবে আমরা যে ধরনের সহিংসতার আশঙ্কা করেছিলাম, সেই পরিমাণ ঘটনা ঘটেনি। ১৪৭টি আসনের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে ১০ থেকে ১২টিতে। নির্বাচন বর্জন এবং প্রতিহতে একটি বড় দল এবং জোটের ঘোষণার পর এই সহিংসতাকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না।
ঢাকাটাইমস: বেশকিছু অঞ্চলে ভোটকেন্দ্রে না আসতে হুমকি দেয়া হয়েছে। ভোটের দিনও ভোটারদের ওপর হামলার ছবি প্রকাশ হয়েছে ভোটকেন্দ্রে। অথচ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কার্যকর ব্যবস্থ নিতে পেরেছে কম ক্ষেত্রেই। এসব ঘটনায় এখন কোনো ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে কি?
মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ: যেখানে এ ধরনের ঘটনা হয়েছে সেখোনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিমাণ কম ছিল। আমাদের দেশে যেহেতু একদিনে ভোট করতে হয়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সে তুলনায় খুবই কম। যে পরিমাণ থাকা দরকার ছিল সে পরিমাণ রাখতে পারিনি। তারপরও আমরা চেষ্টা করেছি, যে কারণে খুব সামান্যই সহিংসতা হয়েছ। যেখানে একটা দলের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগও রয়েছে। সে ক্ষেত্রে যতটুকু পেরেছি আমরা সহিংসতা বন্ধ করার চেষ্টা করেছি। ওই মুহূর্তে বোধহয় আর কিছু করার ছিল না।
ঢাকাটাইমস: ভোটের দু’দিন আগে নিরাপত্তাবাহিনী পৌঁছার আগেই ভোটকেন্দ্র হিসেবে নির্ধারিত পাঁচ শতাধিক স্কুল পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর নিরাপত্তায় আগেভাগে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ ছিল কি?
মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ: ভোট নিতে আমাদেরকে একটি ভবন লাগে। সাধারণত স্কুলগুলোকে নির্বাচন করি আমরা। একদিন হয়ত সেখানে ভোট হয়, বছরের বাকি সময় ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে এখানে। নির্বাচন নিয়ে বিরোধিতায় ভোট ঠেকাতে কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেবেÑ এমনটা আমাদের ভাবনারও অতীত ছিল। তারপরেও স্থানীয় প্রশাসন অবশ্যই খেয়াল রেখেছিল। তারপরও যেহেতু প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক স্কুল রয়েছে সেখানে হয়ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন ছিল। কিছু কিছু কেন্দ্র দুর্বৃত্তরা পুড়িয়ে দিয়েছে। আলাদাভাবে কোনোরকম পূর্বপ্রস্তুতি বা সম্ভাবনা চিন্তাই করা হয়নি। তবে কয়েকটি এলাকায় এমন ঘটনার খবর আসার পর স্থানীয় প্রশাসন নিশ্চয় অন্যত্র যথেষ্ট ব্যবস্থা নিয়েছিল, যে কারণে অন্যগুলো পুড়িয়ে দিতে পারেনি। আবার স্কুল পুড়িয়ে দেয়াটা মানুষ পছন্দ করেনি। ফলে ভবিষ্যতে হয়ত কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মীরা এমন কাজ আর করবে না। আমাদেরও প্রস্তুতি থাকবে। ১৬ জানুয়ারি স্থগিত আট আসনে নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তারা নিশ্চয় আরও সতর্ক থাকবে।
ঢাকাটাইমস: ঢাকায় বেশ কিছু কেন্দ্রে ভোটাররা আসলেও ভোট দিতে পারেননি। কারণ তারা ভোটার নম্বর জানেন না। এটা এবার কেন হলো?
মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ: আমরা ভোটার নম্বরসহ সিডি সরবরাহ করেছি। সেখান থেকে প্রিন্ট করে প্রার্থীদেরই ভোটার নম্বর ভোটারদের কাছে পৌঁছে দেয়ার কথা। সব নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মীরাই এ কাজ করে। কিন্তু এবার তারা সে কাজ করেনি। ভোটের আগে আমাদের কাছেও কেউ এসে ভোটার নম্বর জানতে চাইলে আমরা অবশ্যই জানাতাম। কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক ভোটারকে আলাদাভাবে জানানোর অবকাঠামো আমাদের নেই। এই দায়িত্বটা ভোটে অংশগ্রহণকারী দলেরই করা উচিত।
ঢাকাটাইমস: স্থগিত আটটি আসনে ১৬ জানুয়ারি ভোট হবে। এগুলোর নিরাপত্তায় এবার বাড়তি কী ব্যবস্থা নিচ্ছে কমিশন?
মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ: আমরা বাড়তি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়োগ করেছি, সকলকে আরো যতœবান হওয়ার জন্য বলেছি। আমাদের েেয সামরিক বাহিনী আছে, তারাও দায়িত্ব পালন করবে। তাদেরকে যেন উপজেলাভিত্তিক মোতায়েন করা হয় সেজন্য বলেছি। তাছাড়া প্রতি ভোটকেন্দ্রেই নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য আগের চেয়ে বেশি থাকবে।
ঢাকাটাইমস: নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে বিতর্ক এখনও থেকে গেল। এই বিতর্ক কমাতে কী করা যেতে পারে বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ: এই বিতর্ক কমানো রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব। কীভাবে তারা তা করবে, সেটা চিন্তা করবে রাজনীতিবিদরা। আশা করি গণতন্ত্রের স্বার্থে নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক এড়াতে কাজ করবে তারা। আমাদের যা করার আমরাও করব। বিভিন্ন সংস্থা এবং লোকজনের মতামত নিয়ে আমরাও বসে সিদ্ধান্ত নেব কী করা যায়।
ঢাকাটাইমস: সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করার কথা উঠেছে। কমিশনের কোন কোন ক্ষমতা থাকা দরকার বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ: এগুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনার বিষয় আছে। চট করে বলা যাবে না। যে সব দল নির্বাচন করবে তারাসহ সবাই কমিশনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে এবং কমিশনের কার্যক্রমে সহযোগিতা করলেই কমিশন শক্তিশালী হবে। রাজনীতিবিদরা যদি মনে করেন আরো কিছু বিষয় যোগ করতে হবে সেটাও করতে পারেন।
ঢাকাটাইমস: সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দল এবং প্রশাসনে কী ধরনের পরিবর্তন দরকার বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ: এটা রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসন চিন্তা করবে। আমাদের জন্য যেটা দরকার সেটা হলোÑ সুন্দরভাবে মানুষ আসবে-যাবে, সে জন্য যে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে তার জন্য সবাইকে সহযোগিতা করা।
ঢাকাটাইমস: নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা তাদের যে হলফনামা জমা দিয়েছেন তাতে কোনো অসঙ্গতি আছে কি-না, তা কমিশন কি যাচাই করবে? করলে কবে থেকে তা শুরু করবে?
মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ: নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা যে হলফনামা দেন, তা জনগণকে জানানোর বিষয়ে বলছেন আদালত। তা আমরা করেছি। কোনো প্রার্থীর সম্পদ তাদের আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ কিনা, তা দেখার জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা আছে। তারা নিশ্চয় এই দায়িত্ব তাদের মতো করে পালন করবেন।
(ঢাকাটাইমস/ ১৪ জানুয়ারি/ এআর/ ঘ.)